প্রিয় আসক্তি পর্ব-০৮

0
1500

#প্রিয়_আসক্তি
#পর্বঃ০৮
#মাহমুদা_আক্তার_তাহিনা

নিষ্প্রভ দের বাসায়, সবাই একসাথে বসে আছে। মূলত কারণ টা হলো, আজ দীবা আসছে। একটু আগেই বাংলাদেশ এসে পৌঁছেছে। নিষ্প্রভ গিয়েছে একমাত্র বোন কে এগিয়ে আনতে।

তীব্রের চোখ বার বার দরজার দিকে যাচ্ছে। কবে সে তার প্রেয়সীকে দেখতে পাবে। আচ্ছা তাঁর প্রেয়সী কি তাকে ক্ষমা করে দিবে? নাকি দূরে ঠেলে দিবে। না তীব্র জানে তার প্রেয়সী থাকে কতো ভালোবাসে, সে কখনোই তীব্রের থেকে দূরে যাবে না। কখনো না।

তাহির ও একই অবস্থা, কতোবছর পরে, নিজের বেস্ট ফেন্ড কে দেখবে। যদিও মোবাইলে ভিডিও কলে দেখা হতো। কিন্তু সামনাসামনি দেখার আর মোবাইলে দেখা কি এক।

সবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ডোয়িংরুমের দরজা দিয়ে হাতে ব্যাগ নিয়ে ঢুকলো নিষ্প্রভ। ওর পিছনে এসে ঢুকলো আয়াত। তারপরই দীবা এসে পা রাখে নিজের বাড়িতে। প্রথমেই দীবা চারিদিকে চোখ ভুলিয়ে নেয়। তীব্রের দিকে তার চোখ আটকে যায়। কতো দিন পরে সে তার ইন্জিনিয়ার সাহেব কে দেখছে। আগের থেকে কিছুটা শুকিয়ে গেছে।

তীব্র ও একইভাবেই দীবার দিকে তাকিয়ে আছে। এতো বছরের না দেখার তৃষ্ণা মিটাচ্ছে।

দীবা তীব্রের থেকে চোখ সরিয়ে মা বাবার দিকে এগিয়ে যায়। এতোদিন পরে নিজের একমাত্র রাজকন্যা কে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরেন নাইম হাসান। – কেমন আছে আমার আম্মুটা?

– ভালো আছি বাবা, তোমাদের দেখে এখন আরো ভালো লাগছে।

দিয়া হাসান হাত বাড়িয়ে দিলেন, দীবা তৎক্ষণাৎ বাবাকে ছেড়ে মাকে জড়িয়ে ধরে।

তাহি’র দিকে এগিয়ে যায় দীবা। তাহি মুখ ফিরিয়ে নেয়। তাহির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে – কিরে আর কতো অভিমান করে থাকবি। আমি তো চলেই এসেছি। এবার দুজন মিলে সারা শহর ঘুরবো। স্যরি দুস্ত, ক্ষমা করে দে। আমার সত্যিই তোর কথা শুনা উচিৎ ছিলো। কিন্তু ততোক্ষণে আমি সুইজারল্যান্ডে পৌঁছে গিয়েছিলাম। তাই চেয়েও তো আর তোর সাথে পড়তে পাড়তাম না। আমিও তোকে ভার্সিটি লাইফে মিস করেছি। যেমন তুই মিস করেছিস। বলেই দীবা জড়িয়ে ধরলো তাহিকে। তাহি ও সব অভিমান ভুলে জড়িয়ে ধরলো।

– কি ব্যাপার, আমাকে কি কারো চোখে পড়ছে না? আমি কি চলে যাবো? আমাকে কারো চোখে পড়বে কেনো, আমি তো কারো কেউ লাগি না। থাকো তোমরা আমিই বরং চলে যায়। কেউ আমাকে ভালোবাসে না। বলেই মুখ গোমড়া করে আয়াত।

নিষ্প্রভ হেসে বলে- তোকে কেনো চোখে পড়বে না, তোকে তো প্রথমই এয়ারপোর্টে জড়িয়ে ধরেছি।

– আরে তোর কথা বলছি নাকি, আর কারো চোখে কি আমাকে দেখে না। নাকি দেখেও না দেখার ভান করে থাকে।

তীব্র হেসে এগিয়ে গিয়ে আয়াত কে জড়িয়ে ধরে। বলে- সরি দুস্ত, কেমন আছিস বল?

– আমি তো ভালোই আছি, এখন তোদের দেখে আরো ভালো লাগছে। তোকে বলেছিলাম না, তোর জন্য সারপ্রাইজ আছে?

-, হ্যা বলেছিলি তো, কোথায় আমার সারপ্রাইজ?

– তুই না সবসময় বলতি, তোর একটা কিউট মিষ্টি ভাবি চাই? তাই জন্য তোর ভাবিকে সাথে নিয়ে এলাম।

– হুয়াট! রিয়েলি, কোথায় ভাবি। কোথায় সে দেখা করাবিনা আমার সাথে?

– আরে দেখাবো কি, তুই তো তাকে চিনিস। খুব ভালো করে। আর তার সাথে তোর ইতিমধ্যেই দেখা হয়ে গেছে।

– কি বলছিস ইয়ার, কে সে। কোথায় আমি তো তাকে দেখতে পেলাম না। আই এম সো এক্সাইটেড ইয়ার। প্লিজ জলদি ভাবিকে সামনে আসতে বল।

– দীবা,,,

আয়াতের ডাকে দীবা তাকাতেই, ইশারা করে আয়াত বলে- এইটাই তোর ভাবি। যাকে দেখার জন্য তুই এতো উতলা হচ্ছিলি। দীবানি হাসান, মাই উডবি!

তীব্রের পৃথিবী থমকে গেলো। দুই পা পিছিয়ে গেলো সে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দীবানির দিকে।

দীবানি ও অবাক, কারণ সে এসবের কিছু জানেনা। তবে আয়াতের সাথে সুইজারল্যান্ডেই পরিচয় হয়েছিলো তার। আয়াতই পরিচয় শেষে বলেছিলো, সে নিষ্প্রভদের বেস্ট ফেন্ড। আর নিষ্প্রভ বলেছিলো, একা আসার দরকার নেই, তাই আয়াতের সাথেই বাংলাদেশ এসেছে। কিন্তু আয়াতের সাথে তার বিয়ে ঠিক হলো, কবে? কখন?

অবাক দৃষ্টি নিয়ে মা বাবা, ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে দীবা। দীবার চাহুনি দেখে দীবার বাবা বলেন- জানি তুমি অবাক হয়েছো আম্মু, তবে আয়াত খুব ভালো ছেলে। আমার আর তোমার মায়ের পছন্দ হয়েছে। তাই আয়াতকে বলেছি তোমার পছন্দ হলেই বিয়ে হবে, তার আগে নয়। তোমাকে আমরা জোর করবো না কোনো কিছুতে। তুমি ধীরে সুস্থে চিন্তাভাবনা করে আমাদের তোমার পছন্দ কি না জানিও। তোমার খুশিই আমাদের খুশি। যাও উপরে যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।

দীবা, তীব্রের দিকে একপলক তাকালো। তীব্রের চোখের ভাষা বুঝতে সময় লাগলো না দীবার। তাহির কাছ থেকে তীব্রের পাগলামি সম্পর্কে জেনেছে। সে পারবেনা তার ইন্জিনিয়ার সাহেব কে এতো বড় শাস্তি দিতে। সেও তীব্রকে খুব ভালোবাসে। তীব্রের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করে দীবা মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বুঝালো।

তীব্র ছলছল চোখে দীবার দিকে তাকিয়েই হাসলো। তার দীবানি তারই আছে। মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালো।

*****

রাত প্রায় ১টার কাছাকাছি, বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে দীবা। তাহি, আয়াত, তীব্র, সবাই খাওয়া দাওয়া করে চলে গেছে অনেক আগেই। হঠাৎ মনে হলো বেলকনিতে কিছুর শব্দ হচ্ছে। বেলকনির নিচে উঁকি দিয়ে তাকালো দীবা। তখনই তীব্র হাত বাড়িয়ে দিলো। অবাক হয়ে দীবা তাকিয়ে আছে তীব্রের দিকে, তীব্রের ফিসফিস শব্দে হুস ফিরে, তীব্রকে টেনে তুলে বেলকনিতে।

একটানা কয়েকবার শ্বাস ছাড়ে তীব্র। তারপর দীবার দিকে তাকায়, দীবা ও তার এদিকে তাকিয়ে আছে। দেরি না করেই দীবাকে জড়িয়ে ধরলো তীব্র। যেনো ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে, দীবা ও জড়িয়ে ধরলো। দুজনেরই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, সেদিকে কারো হুস নেই। তারা নিজেরা একে অপরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে, যেনো কেউ আলাদা না করতে পারে আর।

অনেকক্ষণ পরে দীবার মনে হলো, তার উচিৎ তীব্রের উপর অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। অভিমান করে থাকা, তা না করে সে তীব্রতে জড়িয়ে ধরেছে। তীব্রকে জোড় করে ছাড়িয়ে একটু দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ায় দীবা। তীব্রের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে- কি চাই আপনার, এতো রাতে আমার বেলকনি দিয়ে এলেন কেনো?

– তো কি করবো, এটা ছাড়া তো কোনো উপায় নেই। তোমাকে এতোদিন পরে দেখে নিজেকে ঠিক রাখা খুব কঠিন হয়ে পড়ছিলো। তাই চলে এসেছি,

– কেনো, আমি৷ কে হয় আপনার, যান না আপনার কাজিনের কাছে,,

ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলো তীব্র, দীবাকে টান দিয়ে নিজের দিকে টেনে আনলো। দু গাল ধরে বললো- আর কতো শাস্তি দিবে জান, আমার থেকে দূরে গিয়ে অনেক পুড়িয়েছো। সব হজম করেছি। এখন আর দূরত্ব মানবো না।

– আপনিই তো বলেছিলেন, আপনার থেকে দূরে থাকতে,

– সেটা বলেছিলাম ঠিকই, কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি আমি ও তোমাকে ভালো বেসে ফেলবো। তুমি যখন দুইবছর আমাকে ইগনোর করলে, তখনই নিজের অনুভুতি সম্পর্কে জানতে পারি আমি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তোমাকে প্রপোজ করবো। কিন্তু তার আগেই তুমি পাড়ি জমিয়েছিলে সুইজারল্যান্ডে। তুমি জানো, সেদিন আমি চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। প্রতিদিন নিয়ম করে তোমার ছবির দিকে তাকিয়ে কথা বলেছি, কতোশত অভিযোগ করেছি। উম্মাদের মতো তোমাকে চারিদিকে চোখ ভুলিয়ে খুজেছি, কিন্তু পাইনি। তুমি তো আমাকে শাস্তি দিতে চলে গিয়েছিলে,

– কেনো এতো দেরি করলেন, আমাকে ভালোবাসতে? তাহলে তো আর এতোদিন কষ্ট পেতে হতো না।

– স্যরি জান, আমি সবকিছুর জন্য স্যরি। তুমি প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেওনা। আমি শেষ হয়ে যাবো।

– আমি বাবা মাকে বলবো, আমি তাদের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি,,

– চুপপপ, একদম না। খুন করে ফেলবো। তুমি শুধু আমার, বলো না তুমি শুধু আমার, বলো দীবানি বলো,,

তীব্র কেঁদে দিয়েছে, তীব্রের কান্না দেখে দীবানি নিজেকে শক্ত রাখতে পারলো না, নিজেও কেঁদে দিলো- হ্যা ইন্জিনিয়ার সাহেব, আমি শুধুই আপনার, আর আপনিও শুধু আমার। আমার ইন্জিনিয়ার সাহবে।

চোখে জল নিয়ে ও হেসে উঠে তীব্র, পাশে থাকা চেয়ারে, বসে দীবানি কে কোলে নিয়ে নেয়। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। দীবানিও গলা জড়িয়ে ধরে। তীব্রের কাধে মাথা রাখে। দুজনেরই দৃষ্টি একে অপরের দিকে। এতো বছরের না দেখার তৃষ্ণা মিটাচ্ছে। আর দূর আকাশ থেকে চাঁদ ও বুঝি তাদের দেখছে।

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে