পিশাচ

0
680
— আমার হাতে যে দাগগুলো দেখে আপনি সিউরে উঠছেন সে দাগগুলো ব্লেড দিয়ে কাটার দাগ। ডানহাতে মোট আটত্রিশ আর বামহাতে একাত্তরটা দাগ আছে। তন্ময়ের মুখে এই কথাটা শুনে আমার যতটা চমকে যাওয়ার কথা ছিল তার অর্ধেকও চমকালাম না আমি। নির্লিপ্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
— কোন মেয়ের জন্য হাত কেটেছিলেন বুঝি? আমার প্রশ্নের উত্তরে তন্ময় কিছু না বলে শুধু মুচকি হাসলো। তারপর কফিতে চুমুক দিয়ে মুখটা মূহুর্তের মধ্যে বিকৃত করে একটা বিশ্রী গালি দিয়ে বললো, — ****দের বাচ্চারা চুলের কফি বানায়। চিনির দাম মনে হয় পেঁয়াজের চেয়ে বেশি। চিনি দিতে ওদের এত কিপ্টামি কেন? আমি অবাক হয়ে তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটা মেয়ের সামনে এভাবে এমন একটা বিশ্রী গালি সে কিভাবে দিতে পারলো? মানুষটাকে দেখে কেমন গোবেচারা টাইপের মনে হয়। কিন্তু আসলে তো পুরো মাকাল ফল টাইপের লোক। উপরে দেখতে সুন্দর কিন্তু ভেতরে যত গন্ডগোল।
— আপনি হয়তো ভাবছেন এত সুন্দরী একটা মেয়ের সামনে এমন বিশ্রী একটা গালি কিভাবে দিলাম। আসলে কলেজে উঠার পর থেকে বন্ধুদের কাছ থেকে গালি শিখেছি, পাড়ার বড়ভাইদের কাছ থেকে গালি শিখেছি। মাঝে মাঝে আমার বান্ধবীদের কাছ থেকেও গালি শিখেছি। তখন থেকেই অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। সরি। — আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি। আপনি হাত কেটেছিলেন কার জন্য? মেয়েটার নাম কি? — আমি কোন মেয়ের জন্য হাত কাটিনি। হাত কেটেছি একজন পুরুষের জন্য। — হোয়াট? — হ্যা শুধু এই হাত কাটা নয়, এই গালাগালি শিখেছিলাম তার জন্যই। — নাম কি তার? — তিনি আমার বাবা, বিশিষ্ট্য ব্যবসায়ী, সমাজসেবক আসিফ বিন জাহিদ। আপনি জানেন আমি আমার বাবার সাথে গত তের বছর ধরে একটা কথাও বলিনি, নট এ সিঙ্গেল ওয়ার্ড। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমি এভাবেই তার সাথে কথা না বলে থাকতে চাই।
আমি এবার ভালমত তন্ময়ের দিকে তাকালাম। মানুষের চোখের দিকে তাকালে তার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আমি তন্ময়ের চোখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম। তার চোখ দৃষ্টি দিশেহারা, উদভ্রান্ত। কোন কারণে তার মনে এখন উথাল পাথাল ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে। — মিঃ তন্ময় আমি কি জানতে পারি কেন আপনি আপনার বাবার সাথে এতদিন ধরে কথা না বলে থেকেছেন? যদি আপনার কোন আপত্তি না থাকে। আমার কথা মনে হয় তন্ময়ের কানে গেল না। সে আবারে কফির কাপে চুমুক দিয়ে আগের মতই মুখ বিকৃত করে মৃদুস্বরে কি যেন বললো। হয়তো আবারো কফিশপের লোকদের চিনি কম দেয়ার অপরাধে গালি দিচ্ছে। — আপনি অবশ্যই জানতে পারেন। আমাদের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আমার সম্পর্কে সবকিছু জানার অধিকার আপনার আছে। আমি বলছি, সবকিছু বলছি। তবে তার আগে একটা প্রশ্ন ছিল। — জ্বী বলুন। — আপনার বমি করার অভ্যাস আছে? মানে বাসে উঠলে বা কোন অস্বাভাবিক ঘটনা চোখের সামনে ঘটলে বা শুনলে বমি হয়? — এটা কেমন প্রশ্ন? — আমি আপনাকে এমন কিছু কথা বলবো যা শুনলে আপনি বমি কর দিতে পারেন। তাই আগাম সতর্কবার্তা দিয়ে দেয়াই ভাল। একথা বলেই তন্ময় চুপ হয়ে গেল। সে এখন বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে। হাতের আঙ্গুল মটকাচ্ছে। এতক্ষনে হয়তো তার মস্তিষ্কে নিউরণ ঝড় শুরু হয়ে গেছে। হয়তো সে অতীত হাতড়ে তাকে টেনে হেঁচড়ে বর্তমানে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছে। তন্ময় বলতে শুরু করলো, ” তখন আমি সবেমাত্র ক্লাস থ্রি এর ছাত্র। পানির বোতল গলায় ঝুলিয়ে স্কুল থেকে বাসায় ফিরলাম। ঘরের দরজা খুলতেই দেখলাম আমার মা ঘরের এক কোনায় গুটিশুটি মেরে বসে আছে। মায়ের চুল, শাড়ি সব এলোমেলো। আর আমার বাবা হাতে একটা মোটা রশি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার চোখদুটো লাল হয়ে ছিল আর মায়ের বামচোখে কালশিটে পড়ে গিয়েছিল। অল্প বয়সের হওয়ায় আমি ঘটনা বুঝতে না পেরে দৌড়ে গিয়ে মায়ের কাছে বসে পড়লাম। তারপর বললাম,
— মা, মা আজকে না নুডুলস রান্না করবে বলেছিলে। আমাকে নুডুলস দাও। অনেক ক্ষুদা লেগেছে। আমার বাবা তখন বিড়বিড় করে গালি দিতে দিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর মা আমার কপালে ছোট্ট চুমু একে দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল রান্নাঘরে। প্রায় প্রতিরাতেই বাবা মা ঝগড়া করতেন। প্রায় রাতেই বাবা মায়ের গায়ে হাত উঠাতেন। আমি ঘুম কাতুরে চোখে বাবা মায়ের ঝগড়া দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়তাম। ক্লাস ফোরে পড়তাম তখন। সেদিন শুক্রবার ছিল। বাবা আর মা তখন তুমুল ঝগড়া করছেন। বাবা গালাগালির তুবড়ি ছোটাচ্ছেন আর মা মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কথার উত্তর দিচ্ছেন। এক পর্যায়ে হঠাৎ বাবা মাকে খুব জোরে একটা ধাক্কা দিলেন। মা তখন দাঁড়িয়ে ছিল দরজার কাছে। মা ধাক্কা সামলাতে না পেরে পড়ে গেলেন। পড়ে গিয়ে মায়ের পা ভেঙ্গে গেল। আমার মা চিৎকার দিয়ে উঠলেন যন্ত্রনায়। বাবা রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। মায়ের চিৎকারে পাড়া প্রতিবেশীরা চলে এলেন। তারাই ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। মায়ের পা ডাক্তার ঠিক করে দিয়েছিল ঠিকই, তবে পুরোপুরি ঠিক করতে পারেনি। মা আজীবনের জন্য খোঁড়া হয়ে গেল। আমার এই মাকে বাবা সপ্তাহে কমপক্ষে দুইদিন মারতেন। পান থেকে চুন খসলেই মারতেন। একটু কথার এদিক সেদিক হলেই মারতেন। আর আমি সেই দৃশ্য দেখতাম আর কাঁদতাম। ক্লাস সেভেনে আমার সাথে ঘটে গেল সবচেয়ে বড় ঘটনা। আমি তখন ক্লাস এইটে। ক্লাস চলছিল। হঠাৎ মিজান নামের এলাকার এক বন্ধু আমার ক্লাসের সামনে এলো। চিৎকার দিয়ে আমাকে বললো, — তন্ময় তোর মা গলায় ফাঁসি দিয়েছে। তাড়াতাড়ি বাসায় চল। একথা শুনে আমার পৃথিবী মূহুর্তে ঝাঁপসা হয়ে এলো। জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াতে লাগলাম বাসার দিকে। আমার বাসায় ফেরার আগে আমার মা ফিরে গেলেন। তিনি ফিরে গেলেন যেখান থেকে এসেছিলেন সেখানে। যেখানে কেউ একবার ফিরে গেলে আর ফিরে আসে না। আমি স্কুলে যাওয়ার পরপরই নাকি গ্রাম থেকে আমার দুই খালা আর খালু এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। মা আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাদের সাথে গল্প করতে শুরু করলেন। তখন বর্ষাকাল ছিল। বাবা বাইরে থেকে এসে আম্মুকে বললেন পানি দিতে। বোনদের আগমনের খুশিতে আত্মহারা আমার মা বাবার ডাক হয়তো শুনতে পায়নি। বাবা পরের বার ডাকলেন। এবারো মা খেয়াল করলেন না। বাবা দৌড়ে ঘরে ঢুকে মায়ের গালে সজোরে এক চড় বসিয়ে দিলেন সবার সামনে। খালা খালু হতবাক, আমার মা নিজেও হতবাক। শুধু চড় দিয়ে ক্ষান্ত হলেন না আমার বাবা। বিশ্রী গালাগাল দিতে লাগলেন মাকে উদ্দেশ্য করে। মা এই অপমান সইতে পারলেন না। ঘরের দরজা আটকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে পা বাড়ালেন অজানার উদ্দেশ্যে।”
এতটুকু বলে থামলো তন্ময়। কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। তন্ময় সেই ঠান্ডা কফিতেই চুমুক দিল। তারপর আমার দিকে তাকালো। তার চোখদুটো টকটকে লাল। ” মাকে কবর দিয়ে আসার পর থেকে বাবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম আমি। বাবা মায়ের মৃত্যুতে অনেক কাঁদলেন। আমি জানি এটা মেকি কান্না। কারণ আমার বাবা মানুষ ছিলেন না, ছিলেন পিশাচ। যে পিশাচের হাতে আমার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল। বাবা যখনই আমার সাথে কথা বলতে চাইতেন তখনই আমার রাগ হতো। ইচ্ছে হতো বাবাকে দা দিয়ে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলি। অথবা জবাই করে ফেলি। দিনদিন বাবার প্রতি আমার আক্রোশ বাড়তে শুরু করলো। আমার যখন রাগ উঠতো নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারতাম না। ব্লেড দিয়ে নিজের শরীর নিজেই ক্ষতবিক্ষত করতাম। হাতের দাগগুলো এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে। মায়ের মৃত্যুর ছয়মাসের মাথায় পিশাচটা আবার বিয়ে করলো। এখন যাকে দেখছেন তিনি আমার আপন মা নন, আবার উনিই আমার আপন মা। পিশাচটা আমার এই মাকেও কয়েকদিন মেরেছিল। তখন আমি এসএসসি দিব। নতুন মাকে মারতে যাচ্ছিল পিশাচটা। তখন আমি হঠাৎ একটা কান্ড করে বসি। বাবা মা দুজনের সামনে বসেই আমি আমার বাম হাতের কব্জিতে ব্লেড চালিয়ে দেই। পিশাচটা আমাকে এমন করতে দেখে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় । আর মা দৌড়ে এসে তার শাড়ী দিয়ে আমার হাত চেপে ধরেন। এরপর থেকে পিশাচটা মাকে মারতে আসতো না। আমি বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে গালি শিখতাম। তারপর মনে মনে পিশাচটাকে গালি দিয়ে নিজের রাগ মিটাতাম। ইউনিতে উঠার পর সরাসরি গালাগাল করতাম। শুয়োরটাকে গালাগালি দিতে পারলে মনে একটা আলাদা তৃপ্তি আসে।” তন্ময় এবার পুরোপুরি থেমে গেল। ওর কাহিনি শুনে আমার গা গুলিয়ে উঠলো। বমি বমি ভাব হচ্ছিল। একজন পুরুষ কতটা পশু হলে তার সন্তান তাকে গালাগালি দিয়ে তৃপ্তি পায়? তের বছর কথা না বলে থাকতে পারে? সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। আমি উঠতে উঠতে তন্ময়কে জিজ্ঞেস করলাম, — আপনি বিয়ে করবেন আমায়? আমার কথায় তন্ময় মুচকি হাসলো। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, — প্রথম দেখায় আপনাকে ভালবেসে ফেলেছি। তবে আপনাকে বিয়ে করবো না আমি। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে ওই পিশাচটার কোন চাওয়া আমি পূর্ণ করিনি। পিশাচটা চায় আমি আপনাকে বিয়ে করি। পিশাচটার এই চাওয়াও আমি পূর্ণ হতে দেব না আমি। দুঃখিত। [] আরমান হোসেন

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে