নিউক্লিয়াস

0
586

এই তনিমা, এই তনিমা দাঁড়া।

– আরে দীপা যে, কতদিন পরে দেখা। কেমন আছিস?

আমি ভালো আছি। তুই অমন উসাইন বোল্টের মত দৌড়ে দৌড়ে কোথায় যাচ্ছিস? আরেকবার ডাকতে হলে বোধহয় আমার গলাটাই ভেঙে যেতো।

– আমার কি আর তোর মতো সুখের জীবন? এসোসিয়েট প্রফেসর হয়ে গেছিস। ছেলে বড় হয়ে গেছে। সংসারের চিন্তা নেই। আমি এখনো পড়াশোনার ইঁদুর দৌড়ে ঝুলে আছি। এখন দৌড়ে যাচ্ছি ছেলেকে আনতে। এই সময়ের বাসটা ধরলে ছেলের স্কুলে আধঘন্টা আগে পৌঁছানো যায়। যাইরে, পরে কথা হবে।

এককাপ চা খেয়ে যা ক্যান্টিনে। আজ না হয় আধঘন্টা পরেই পৌঁছাস স্কুলে। তুই চাইলে আমি অবশ্য নামিয়ে দিতে পারি।

– না রে আজ থাক আরেকদিন। ফোনে কথা হবে।

তপ্ত দুপুরে তনিমার দৌড়ে এগিয়ে যাওয়া ছায়ার দিকে তাকিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে এক লহমায় যেন নিজের অতীতে ডুবসাঁতার দিয়ে আসে দীপা।

কলেজের ডিঙি না পেরোতেই একদিন বাসায় এসে শোনে তার বিয়ে। কান্নাকাটি চিল্লাচিল্লি শুধু সারই হয় কিন্তু বিয়ে থামাতে পারেনা। বাসর রাতে খুব রেগে গিয়েছিল মামুনের সাথে দীপা।

– সারাদেশে কি মেয়ের অভাব পড়েছে? কেন আমাকেই আপনার বিয়ে করতে হবে?

আমার মায়ের যে কেন তোমাকে এতো পছন্দ হলো আর বাচ্চা মানুষের মতো জেদ করলেন এখানেই বিয়ে করাবেন আমাকে তা আমি কিভাবে না বলি, বলোতো? তুমি বরং আমায় বলো কেন তুমি বিয়ে করতে চাওনি?

– আমি অনেক পড়ালেখা করতে চাই। অনেক বড় ডাক্তার হতে চাই। সেটা কি আর হবে? কাল থেকে তো আপনাদের ঘরের রান্নাঘরে ঠেলে ঢুকিয়ে দেবেন। আমার বড় আপার জীবনটাও বাবা এভাবে শেষ করে দিয়েছে। আমার জীবনটাও।

আমি যদি তোমার পথের বাঁধা না হয়ে বন্ধু হই তাহলে কি এই বিয়েতে তোমার আপত্তি থাকবে?

সদ্য সতেরো পেরুনো এই আমার ছটফটানি এক নিমিষেই থেমে যায় মামুনের এমন কথায়।

– সত্যি বলছেন? আপনি আমাকে পড়ালেখা করাবেন?

কথা দিলাম তো। এবার তো একটু হাসো।

সেই রাতের কথা মনে করে গাড়ির হিম শীতল বাতাসে আনমনেই হেসে ওঠে দীপা।

মামুন তার কথা রেখেছে। সংসারের জোয়ালে দীপার মুখ ঠেলে না দিয়ে তাকে পড়াশোনার পথে এগিয়ে দিয়েছে। দীপা যেদিন মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পায়, মামুনের আনন্দ ছিল দেখার মতো। ছোট বাচ্চাদের মতো উচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিল তারা দুজনেই। শুধু একটাই সমস্যা সংসার দুভাগ হয়ে যাওয়া কারণ দীপা সুযোগ পেয়েছে ঢাকার বাইরের মেডিকেলে।

পরিবারের আরো অনেকে বাঁকা কথা বললেও মামুন সবার কথার বিরুদ্ধে গিয়ে দীপাকে হোস্টেলে তুলে দিয়ে আসে। হোস্টেল জীবনের শুরুটা খুব একটা স্বস্তির ছিলনা দীপার জন্য। ও কেন বিবাহিত, এই একটা কারণই যেন তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে দেয়। এমনকি কোন কোন মেয়ে তো মিশতেই চাইতোনা প্রথম দিকে কারণ তাদের মা নিষেধ করে দিয়েছে এমন কারো সাথে মিশতে। আগে ভাগে বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়ে তাদের মেয়েদের অকালপক্ক বানিয়ে দেবে এই ভয়ে। বাড়ি ছেড়ে থাকার কষ্ট, মেডিকেলের কঠিন পড়াশোনা তার ওপর সহপাঠীদের এমন বিরূপ আচরণে দীপার প্রায়ই ইচ্ছে করতো মেডিকেল ছেড়ে চলে যেতে। সেসব দিনগুলোতে প্রতি শুক্রবার সকালে মামুন রাতের বাসে ঢাকা থেকে চলে আসতো শুধু যেন দীপা লক্ষ্য হারিয়ে না ফেলে। বোঝাতো, স্বপ্নকে ছুঁতে হলে হাল ছেড়ে দেয়া যায়না কখনোই।

থার্ড ইয়ারে অপ্রত্যাশিতভাবে একমাত্র ছেলে ধ্রুবর আগমণবার্তা আবারও এলোমেলো করে দেয় দীপাকে। প্রেগন্যান্সী, পড়াশোনা দুটো সামলে কিভাবে যে দিন গেছে তা বুঝি শুধু দীপাই জানে। ভেঙে পড়তে গিয়েও উঠে দাঁড়িয়েছে কারণ মামুন শক্ত হাতে তাকে সামলে গেছে। দ্বিতীয় প্রফের আগে আগে ছেলে পুরোপুরি চলে যায় বাবার সাথে। একলা দীপা না পারে পড়ায় মন বসাতে না পারে হোস্টেলে থাকতে। দুদিন পরপর ঢাকা দৌড়াতে গিয়ে ক্লাস, পরীক্ষা সব লাটে উঠতে নেয়। মামুন সেসময় দুমাসের ছুটি নিয়ে চলে আসে দীপার শহরে। পরীক্ষা শেষে দীপা একটু সামলে নিলে আবার ফিরে যায় কাজে।

সময়ের পরিক্রমায় ফাইনাল প্রফ পাস, ইন্টার্নশীপ শেষ করে দীপা অবশেষে ফিরে আসে নিজের সংসারে। আহা কি সুখ! আর দৌড়াতে হবেনা, ছেলেকে কোলছাড়া করতে হবেনা। কিন্তু না দীপার সেই সুখের জীবনে থাকা হয়না মামুনের কারণেই। রোজ সকালে দীপাকে পিজির লাইব্রেরীতে নামিয়ে দিয়ে আসা, ছেলের যত্ন নেয়া, নিজের অফিস সব সামলে চলে আবার সংসারের কাজেও যতটা সম্ভব হাত লাগাতো মামুন। মামুনের প্রত্যক্ষ সাপোর্ট আর অনুপ্রেরনায় বিসিএস থেকে শুরু করে বাদবাকী একাডেমিক পরীক্ষাগুলো এক চান্সেই উতরে যায় দীপা। এমন না যে দীপা শুধু পড়েছে আর পরীক্ষা দিয়েছে। ওর ক্যারিয়ারের ব্যাপারে মামুনের এই অতিরিক্ত সচেতনতা দীপাকে সংসার আর ছেলের যত্নের পাশাপাশি অল্প সময়েই পড়ার জন্য আরো বেশী বেশী মনঃসংযোগ রাখতে সাহায্য করেছে।

দেশের বাইরে পড়াশোনার একটা অকস্মাৎ সুযোগ যখন চলেই আসে দীপা আর এবেলা সংসার ছেড়ে যেতে চায়নি। কিন্তু মামুন গাবের আঠার মতো পিছু লেগে থেকে দীপার বিদেশী ডিগ্রীটাও করিয়ে ছেড়েছে।
আজ যখন তনিমা বলে যায় তোর কি চিন্তা, সব গোছানো শেষ? তখন দীপার মনে হয় এই বন্ধুরাই একসময় ওর সাথে মিশতে চায়নি বিবাহিত বলে। কত জনে বলেছিল পর্যন্ত এ দেখবি ফার্স্ট প্রফই পেরুতে পারবেনা। সংসার করে পড়া হয় নাকি?

হঠাৎ করে ফোন বেজে ওঠায় ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসে দীপা। মামুনের ফোন।

– কোথায় তুমি দীপা?

গাড়িতে। বাসায় ফিরছি। তুমি?

– অফিসে। শোন ঘটনা তোমার ছেলেকে মাত্রই টিভিতে দেখালো।

তাই নাকি? কি জন্য?

– ঐ যে আন্তঃকলেজ বিতর্কতে সারাদেশের মধ্যে সেরা বক্তা হয়েছে সেটা নিয়ে একটা প্রোগ্রামে। ছেলের কাছে জানতে চেয়েছে তোমার রোল মডেল কে? তোমার ছেলে জবাব দিয়েছে, আমার বাবা। হা হা হা।

যা সত্যি তাইতো বলেছে। মামুন সাহেব, লোকে বলে ঘরের বৌ নাকি তার পরিবারের নিউক্লিয়াস। আর আমি ডা. দীপা বলি, আমার স্বামী আমাদের মা ছেলে তথা আমাদের পুরো পরিবারের নিউক্লিয়াস। আমার কখনো কেউ ইন্টারভিউ নিলে আমিও যে নির্দ্বিধায় বলবো, আমার জীবনের রোল মডেল আমার স্বামী।

#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে