নতুন সকাল পর্ব-০২

0
1070

নতুন সকাল
লেখকঃ আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
পর্ব-২

নিকষকালো আকাশে হাজার তারার মেলা। জানালা ভেদ করে মিহিকার দৃষ্টি চলে গেছে আকাশের বুকে।মুখে বিষন্নতার ছায়া। বর্ষামুখর চোখে ভাসছে এক সুদর্শন যুবকের প্রতিচ্ছবি। কথা বলতে বলতে আকস্মিক থেমে যাওয়ায় ভ্রু কুঁচকালেন গালিব সাহেব। গল্প পথে এগিয়ে যাওয়ার তাগাদা দিয়ে বললেন,
“তারপর? ”

টনক নাড়ল মিহিকার। আকাশ থেকে চোখ ফিরিয়ে গালিব সাহেবের দিকে তাকাল। গালিব সাহেবের আগ্রহী দৃষ্টিতে মিহিকার বিষন্ন চাহনি ধাক্কা খেল। ফিরতি দৃষ্টি সরিয়ে আকাশ পানে তাকাল। তারপর উদাস ভঙ্গিতে বলল,
“হুট করেই শ্রাবণের আচরণ পালটে গেলো। তার ভালোবাসাটা এবার অবহেলায় রূপ নিলো। ব্যস্ততার অযুহাত দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে লাগল আমাকে এড়িয়ে যেতে। প্রথম প্রথম ব্যাপারগুলোকে নিচকই ব্যস্ততা বলে এড়িয়ে গেলে ও পরবর্তীতে আর পারলাম না। ধীরে ধীরে কিছু জিনিস পরখ করতে লাগলাম। একমাত্র আমার সাথেই কথা বলার সময় ওর শত ব্যস্ততা এসে দাঁড়ায়। আর কারো সাথে না। আমার সাথে কথা বলতে গেলেই ওর কপালে বিরক্তির ভাজ পড়ে, বাকি সবার সাথে কথা বলার সময় তার ঠোঁটের কোণ থেকে হাসি সরে না। আমাকে নানা কাজের বাহানা দিতো। কিন্তু দিন শেষে ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর ঘুরাঘুরির ছবি আপলোড দিতে ভুলতো না। সেই ছবি গুলোতে তার পাশে একটা মেয়েকে দেখতে পেতাম। একসময় আমার মনে খটকা লাগে। কোথাও সে অন্য কারো সাথে জড়িয়ে নেই তো! ভাবতেই আমার আত্না কেঁপে উঠতো। আমি এসব আর সহ্য করতে না পেরে ঢাকা চলে যাই। ঢাকা গিয়ে লুকিয়ে ওকে ফলো করি। ওর সম্পর্কে খবর নিই। আর জানতে পারি, আমি রাজশাহী যাওয়ার পরপরই সে নিলীমা নামের একটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে। সব শুনে আমি ওর সাথে কথা বলার চিন্তা করলাম। ফোন করে ওকে হাতিরঝিল ডাকলাম। দেখা সাক্ষাতের পর আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে ও সাফ জানিয়ে দিলো, আমার সাথে তার যাচ্ছে না। সে এই সম্পর্কটা রাখতে চায় না।”

গলা কেঁপে উঠল মিহিকার। টুপ করে দু’ফোটা অশ্রু চোখ থেকে গালে গড়াল। ডুকরে কেঁদে উঠল মিহিকা। ভেজা গলায় বলল,
“বিশ্বাস করুন আংকেল, সেদিন শত মানুষের সামনে আমি ওর পা পর্যন্ত ধরেছি যাতে ও আমাকে ছেড়ে না যায়। কিন্তু ও আমাকে পা ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিয়েছে। কী বলেছে জানেন? বলেছে, আমাকে নাকি ও কখনো ভালোই বাসেনি। এসব নাকি শুধুই মোহ ছিলো, যা সময়ের সাথে কেটে গেছে। নাহলে আমি নাকি ওর নখের যোগ্য ও না। ও তার যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষকেই বেছে নিয়েছে, তাকে ভালোবাসে। বিয়েও তাকে করবে। আমার মতো মেয়েদের নাকি ভালোবাসা যায় না। শুধু ব্যবহার করে টিস্যুর মতো ফেলে দেয়া যায়। ওর কথায়,ওর বিচ্ছেদে আমি ভেঙে পড়েছিলাম। ওর বিচ্ছেদ, বিশ্বাসঘাতকতা আমি মানতে পারিনি। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে গেলাম। নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেললাম। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে শুধু কাঁদতাম
বাসার সবাই কারণ জিজ্ঞেস করতো। আমি কোনমতে এড়িয়ে যেতাম। সবার প্রশ্ন থেকে বাঁচতে রাজশাহী চলে আসি। আসার পর থেকে ঘুটে ঘুটে মরতে থাকি। শ্রাবণকে আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি। ওর সাথে কথা না বলে আমি থাকতে পারি না। ঘুমাতে পারি না। খেতে পারি না। আমি প্রতিদিন কম হলেও হাজারবার ওকে কল দিয়ে ফিরে আসার অনুরোধ করি। আর ও আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। আমি এসব আর নিতে পারছিলাম না। আমাকে কষ্ট দেয়া হয়তো আরো বাকি ছিলো তাইতো কাল সে তার গার্লফ্রেন্ডকে বিয়ে করে নিয়েছে ৷ দুজনের একসাথে ছবি তুলে আবার আমাকে পাঠিয়েছে। তারপর ফোন দিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
‘দ্যাখ,কে কোন জায়গায় আছে? তোর মতো মেয়েদের জায়গা আমার জীবনে নেই। আমার তো ভাবতেই ঘৃণা লাগে তোর মতো মেয়ের সাথে আমি এককালে ডেট করেছি। স্মার্ট আর যোগ্য দেখতে চাস? তবে আমার বউকে দেখ। সে সব দিক দিয়েই পারফেক্ট। তোর মতো জিরো না।’
আমি উত্তরে কেঁদে বলেছিলাম,’আমি মরে যাবো।’ শ্রাবণ হেসে বলেছিলো, মর। দেখি কেমন মরতে পারিস? আমাকে দায়ী করিস না আবার।’ এত প্রত্যাখ্যান এত অপমানের পর আমার বেঁচে থাকা সাঝে? যাকে আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি তাকে অন্যকারো সাথে দেখতে পারছিনা। যেই স্থানে আমি থাকার কথা সেই স্থানে অন্য কাউকে দেখে মরে যেতে ইচ্ছে হয়েছে। আমার তাই আমি মৃত্যুর পথকেই বেছে নিয়েছি।”

মিহিকা থামলো। মিহিকার কথা শুনে গালিব সাহেব হাসিতে ফেটে পড়লেন। যেন মিহিকা কোন মজার কৌতুক শুনিয়েছে তাকে । সেই কৌতুকে গালিব সাহেব মজা পাচ্ছেন। মিহিকা গালিব সাহেবের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সে কি হাসার মতো কিছু বলেছে! তবে এই লোক হাসছে কেনো! গালিব সাহেবের হাসি থামছেনা। তিনি নিঃশব্দে হেসে চলেছেন । মিহিকার এবার রাগ হলো। সে রাগত স্বরে বলল,
“আংকেল আপনি হাসছেন কেনো! আমার অনুভূতিগুলো আমার কাছে কৌতুক মনে হচ্ছে?”

গালিব সাহেব হাসতে হাসতেই বললেন,
“তুমি যদি তোমার বাবা মায়ের অনুভূতিকে কৌতুক বানাতে পারো তবে আমি কেনো তোমার অনুভূতিকে কৌতুক বানাতে পারবো না? তোমার অনুভূতির মূল্য আছে তোমার বাবা মায়ের অনুভূতির মূল্য নেই! আর কার জন্য মরতে যাচ্ছো যে কিনা তোমার মৃত্যু নিয়েও উপহাস করে!”
গালিব সাহেবের হেসে বলা এই কথা মিহিকার মনের মনের দরজায় টোকা দিলো যেন। মিহিকা করুণ চোখে তাকালো গালিব সাহেবের দিকে। গালিব সাহেব এবার হাসি থামিয়ে চোয়ালে গম্ভীরতা টানলেন ।
তারপর মিহিকার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আচ্ছা, তোমাকে যদি বলা হয় তোমার ভালোবাসার মানুষটার বিয়ের সাক্ষী হিসেবে তোমাকে থাকতে হবে তখন তুমি কী করবে? তোমায় চোখের সামনেই তোমার ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো নামে সাক্ষর করতে দেখতে পারবে?”

মিহিকা চকিতে তাকাল। তারপর গালিব সাহেবের কথা মোতাবেক শ্রাবণ আর নীলিমার বিয়েতে নিজেকে সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করাতে গেলো। চোখের সামনে শ্রাবণ অন্য কারো নামে সাক্ষর করতে কলম নিলো। কলম বসালো,নাহ সে আর ভাবতে পারছে না মিহিকা। ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো। মাথা ঝাকালো। এমন পরিস্থিতিতে ভাবনায় আনতেই বুক কেঁপে উঠছে। খুব কঠিন পরিস্থিতি। মিহিকা যেই পরিস্থিতি থেকে গেছে তার থেকেও ভয়ংকর পরিস্থিতি। সেই ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে সে কী করবে এমন ভাবনার সমাধান করতে না পেরে মিহিকা হতাশ কন্ঠে বলল,
” এমন ভয়ংকর পরিস্থিতির সমাধান নেই আমার কাছে। ঘটনাটা ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠছে। আমি পারবো না নিজের ভালোবাসার মানুষকে স্বচোক্ষে অন্যের হতে দেখতে। আমি তার আগেই কেঁদে মরে যাবো।”

গালিব সাহেব স্মিত হেসে বললেন,
” তুমি কত সহজেই মরা যাবার কথা ভেবে ফেললে। ভয়ংকর পরিস্থিতির কথা ভাবতেই তোমার গা শিউরে উঠছে। অথচ আমি সেই ভয়ংকর পরিস্থিতির নিরব দর্শক ছিলাম। না কাঁদতে পেরেছি, না পালাতে পেরেছি, আর না মরতে পেরেছি। আসলে মরে যাবো কথাটা বলা যতটা সহজ, মরে যাওয়া অতটা সহজ নয়। যদি সহজ হতো তবে এতদিনে আমার নামের পাশে ‘মৃত’ শব্দটা যুক্ত থাকতো। ”

গালিব সাহেবের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। মিহিকা বিস্মিত চোখে গালিব সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল। সে ভাবতে পারেনি গালিব সাহেব এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। সে ভেবেছিলো গালিব সাহেব হয়তো কথার কথা বলেছে। মিহিকা ভাবতে পারছে না। সে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
“আংকেল আপনি এমন…

গালিব সাহেব মিহিকাকে থামিয়ে বললেন,
” আমাকে দেখে তোমার কী মনে হয়, আমি খুব সুখী একজন মানুষ, তাই না? টাকা পয়সা স্ত্রী পরিবার নিয়ে খুব সুখে আছি, তাই তো!”

গালিব সাহেবের সাথে মিহিকা ইতঃপূর্বে দেখা হয়নি। খনিকের এই আলাপে গালিব সাহেবকে সুখী মনে হলো। মিহিকা ইতিবাচক সায় জানাল ।
গালিব সাহেব মুচকি হাসলেন।
তারপর বললেন,
“সবাই এমনই ভাবে। কারণ কেউ দেখে না, আমার ক্ষত বিক্ষত ভিতরটা। কেউ জানে না নিয়মিত ডিপ্রেশনের ওষুধ নিতে হয় আমার। কেউ জানে না। তুমি মাত্র অল্প কয়েকদিনে ভালোবাসার মানুষটার বিরহে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলে কত সহজে! অথচ আমি সেই বিরহকে নিজের মাঝে লালন করে আসছি দীর্ঘদিন দুই যুগ ধরে। ভেবে দেখো আমি কত কষ্টে আছি! এই যে সুখে আছি,হাসছি এটা কেবলই ঢং আর অভিনয়। এই অভিনয় করতে করতে মাঝে মাঝে আমি হাপিয়ে যাই। নির্জনে গিয়ে অতীতের ভাবনায় মত্ত হলে এখনো আমার চোখ ভিজে উঠে। ”

মিহিকা যেন অবাক হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সে তার চেহারায় দিগুন বিস্মিত ভাব মাখিয়ে তাকালো গালিব সাহেবের দিকে।
গালিব সাহেব বললেন,
“কী অবাক হচ্ছো তো? আমার মতো হাসি খুশি একজন মানুষের কিভাবে এত দুঃখ থাকে, তাই তো?”
মিহিকা মাথা নাড়ালো। সেই সাথে চোখ মুছে নড়েচড়ে বসলো। একটু আগের সব ভুলে সে গালিব সাহেবের কথায় মনোনিবেশ করলো। এ পর্যায়ে তাকে ভীষণ কৌতুহলী দেখাল। সে মনোযোগী শ্রোতার মতো প্রশ্ন করলো,
“আংকেল আপনার সেই ভয়ংকর পরিস্থিতির পিছনের ঘটনা কী ছিলো? আমাকে কি বলা যাবে?”

গালিব সাহেব এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলা শুরু করলেন,
” আমার গল্পের অর্ধেকটা খুবই সুন্দর ছিলো। পুরোটা জুড়েই ছিলাম আমি,আমার প্রেয়সী নিন্তিকা আর আমাদের এক মুঠো ভালোবাসা। সে আমার জীবনে এসেছিলো যখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। আমার সহপাঠি ছিল সে। প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গিয়েছিলো তাকে। শ্যামবর্ণের সে কী মায়াবী চেহারা ছিলো তার! ধীরে ধীরে তা ভালোবাসায় রূপ নেয়। সেই রূপই আমাদের প্রেমময় অধ্যায় শুরু করেছে । এখনকার মতো প্রযুক্তির যুগ ছিল না তখন। ফোনের বদলে চিঠিতেই আবেগ অনুভূতির আদান প্রদান হতো। ক্লাশের ফাঁকে চোখাচোখি, ক্লাস শেষে যাবার বেলা দুই একটা কথা আর চিঠি বিনিময়। এমনভাবেই কেটে গেলো চারটি বছর। এরমাঝে আমার বাবা গত হলো। পিতৃশোকে সবকিছু ভুলে গেলাম। পরিবারে অসুস্থ মা, অবিবাহিত বড় বোন আর এইট পড়ুয়া ছোট ভাই। বাবার অবর্তমানে সংসারের ভার এসে পড়লো আমার কাধে। আমি তখন সবে ইন্টারমেডিয়েটে পড়ি। কাধে আসা সেই ভার থেকেই আমি গ্রাম থেকে শহরে এসে টিউশনির খোঁজ শুরু করি। কলেজ কামাই করে দিনে সাতটা টিউশন করতাম। সারাদিন থাকতাম টিউশনে, রাতে থাকতাম পড়ায় ডুবে। ঘুমানোর অব্দি সময় পেতাম না। এত ব্যস্ততার মাঝেও প্রেয়সীকে কথা ভেবে পুরো সপ্তাহে সময় বের করে একটা চিঠি লিখে বন্ধুর মাধ্যমে পাঠাতাম। গ্রামে যাওয়া হতো না খুব একটা, নিন্তিকার সাথে দেখা ও হতোনা। ওকে দেখার জন্য আমার চোখ তৃষ্ণার্ত কাকের মতো চেয়ে থাকতো, ব্যস্ততা ঠেলে গ্রামের যাওয়ার সময় হয়ে উঠতো না আমার। আমার টিউশনিরর টাকায় সংসার চলতো। আমার টাকায় পড়াশোনা আর পরিবার সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছিলাম। তা ছাড়া বাবার চিকিৎসায় বন্ধককৃত ভিড়েও ছাড়ানোর তাড়া ছিলো আমার। এদিকে ইন্টারমিডিয়েটের চূড়ান্ত পরীক্ষা ও কাছাকাছি। তার প্রস্তুতি ও নিতে হচ্ছে। দিনে টাকার দায়ে ছুটোছুটি আর রাত পড়াশোনার চাপে আমার তখন বেহাল দশা। বাস্তবতা কত কাঠিন্যতা তখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। ”

গালিব সাহেব থামলেন। মিহিতার আগ্রহী দৃষ্টির দিকে চেয়ে আবার শুরু করলেন,
” বাস্তবতার কাটাযুক্ত পথে বেঁচে থাকার সংগ্রামে চিঠির মাধ্যমে নিন্তিকা আমাকে সাহস জোগাতো। আমার সব ক্লান্ত প্রহর তার চিঠি পড়েই পার হতো। হুট করেই তার চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেল। দু’মাস পরেই ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা ছিলো। আমি পড়াশুনার চাপ ভেবে এড়িয়ে গেলাম ব্যাপারটা। পরীক্ষার দিন পনেরো আগে বাড়ি গেলাম। বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলাম নিন্তিকার খবর। কিন্তু তারা জানালো মাসদুয়েক নিন্তিকা কলেজে যায়নি । কেনো তারা জানে না। নিন্তিকার বান্ধবীকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানালো নিন্তিকার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে দুদিন বাদেই বিয়ে। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলাম না। তারপর
খুব চেষ্টা করলাম নিন্তিকার সাথে কথা বলতে কিন্তু পারলাম না। নিন্তিকার পরিবার নাকি জেনে গিয়েছিলো নিন্তিকা কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে আছে তাই মেয়েকে ঘরবন্দী করে তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। অঘটনের সম্ভাবনায় কোন বান্ধবীর সাথেও দেখা করতে দিচ্ছে না। আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। বুঝতে পারলাম আমার গল্পের সৌন্দর্য এখানেই শেষ। ভাবলাম খুব ভাবলাম কিন্তু কোন পথ বেরিয়ে এলো না। সেদিন সন্ধ্যায় আমি নিন্তিকার বাড়িতে গিয়েছিলাম একটাবার দেখার আশায়। কিন্তু পাইনি তার দেখা। শুনেছিলাম শুধু তার কান্না। তার ঘরের পাশ কেটে যাবার সময় সে হয়তো বাঁশের তৈরি জানালার ফাঁকে সে আমাকে দেখেছিলো। দেখেই মৃদুস্বরে কেঁদে উঠেছিলো। পরক্ষণেই মুখ চেপে ধরেছিলো। তাও আমার কানে প্রিয়তমার চাপা কান্না ঠিকই এসেছিলো। চোখ বেয়ে দুই এক ফোঁটা জল আমার চোখ থেকেও গড়িয়ে পড়েছিলো। চোখের পানি মুছে কেউ দেখার আগে গা লুকাতে যাবো তখনই কোথা থেকে এক টুকরো কাগজ এসে পড়লো আমার গায়ে। কান্নাভুলে সেই কাগজ টুকরো কুড়িয়ে নিয়েছিলাম আমি। এলোমেলো করে মুড়ে বল বানানো কাগজটা নিজ ঘরে এসে হারিকেনের আলোয় খুলেছিলাম। তারপর আবিস্কার করলাম এটা আমার প্রিয়তমার চিঠি। হয়তোবা অন্তিম চিঠি।”

“কি লেখা ছিলো চিঠিতে?” কাঁপা গলায় বলল মিহিকা। গালিব সাহেবের গল্প শুনে কান্না আসছে তার। কিন্তু গালিব সাহেবের চোখ মুখ শক্ত। তিনি চোয়াল শক্ত রেখেই বললেন,
”সেই চিঠিতে এলোমেলো করে লেখা ছিলো, ভালো থেকো। বাবা মায়ের মুখের দিকে চেয়ে নিজেকেই বিসর্জন দিচ্ছি।ভালোবাসাটা তোমারই থাকলো।

সেটাই ছিলো নিন্তিকার পক্ষ থেকে শেষ চিঠি। চিঠি পড়ে আমি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম, ইচ্ছে করছিলো নিন্তিকাকে নিয়ে পালিয়ে যাই কিন্তু পরিবার নামক পিছুটানের জন্য পারিনি। মায়ের কাছে বলার অবধি সাহস হয়নি। যেখানে আমার বড় বোনটার বিয়ে নিয়ে এখনো ভাবার সাহস পাচ্ছি না সেখানে আমার মতো ছেলের এত অল্প বয়সে বিয়ে করার কথা ভাবাও পাপ। আমি পারিনি মায়ের কাছে বলতে কিংবা নিন্তিকার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। সারারাত আমি কেঁদে পার করেছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে হুট করেই সিদ্ধান্ত নিলাম আত্মহত্যা করব। পরদিন নিন্তিকা অন্যকারো হবে আমি তা দেখতে পারব না। সেই ভেবেই সিলিংয়ের সাথে বাধার জন্য দড়ি আনতে রুমের বাইরে যাবার জন্য পা বাড়ালাম। আমাদের দো’চালা ঘরের খাবার ঘরের ছিল দড়ি। দড়ি আনতে খাবার ঘরে যেতেই দেখি খাবার ঘরের প্লাস্টিকের টেবিলটায় দুটো প্লেট ভর্তি খাবার সাজানো। পাশেই একটা চেয়ারে মা ঘুমিয়ে আছেন। বুঝলাম মা আমার জন্য অপেক্ষা করতে করতেই ঘুমিয়ে গেছেন। আমি নিঃশব্দে আসায় টের পাননি। আমি দড়ি না নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। ভাবতে লাগলাম, যে মানুষটা আমাকে না খাইয়ে খায় না,যেই মানুষটা সবসময় আমাকে ভালোবেসে আড়কে রেখেছেন, আমার জন্য দশ মাস দশ দিন হাড় ভাঙা কষ্ট সহ্য করেছেন, জন্মের আগ থেকে যে আমাকে ভালোবেসে এসেছেন, আমি তার জন্য না ভেবে বছর পাঁচেকের ভালোবাসার জন্য আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি! আমি চলে গেলে তাদের কি হবে! বাবা মারা যাবার সময় তাদের মাথার উপর ছায়া হিসেবে আমাকে রেখে গেছেন। আমি চলে গেলে তো তাদের মাথার ছাদ উঠে যাবে। তাছাড়া আমি যার জন্য মরতে যাচ্ছি আমার মৃত্যুতে তার জীবনে কি বেশি পরিবর্তন আসবে? আসলেও কয়দিন? দুইদিন? দুইমাস? দুইবছর? এর পর তো তার জীবন স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার পরিবার? তারা কি আদৌ স্বাভাবিক হতে পারবে? হুট করেই মনে পড়লো বছর খানেক আগে একবার আমার জ্বর হয়েছিলো। প্রচন্ড জ্বরে আমি বেহুশ হয়ে গিয়েছিলাম। হুশ হওয়ার পর কারো কান্নার আওয়াজ কানে আসছিলো। খেয়াল করে দেখলাম কান্নাটা আমার মায়ের। মা আমার পাশে জায়নামাজে বসে দু’হাত তুলে অঝোরে কাঁদছেন। আর বারবার একটা কথাই বলছেন,’আমাকে ছেলেকে ভালো করে দাও আল্লাহ। ওকে কষ্ট দিও না। আমি সহ্য করতে পারছি না। ওর বদলে আমাকে কষ্ট দাও। তাও ওকে সুস্থ করে দাও। দরকার হলে আমাকে উঠিয়ে নাও তাও আমার ছেলেকে সুস্থ করে দাও।’
সেই কথাটা ভাবতেই নিজের উপর রাগ হলো। যেই মানুষটা আমার সামান্য কষ্ট দেখে সহ্য করতে না পেরে মরতে রাজি হয়ে গেলো আমি কিনা তার কথা ভাবছি না! আমার সামান্য জ্বরে যার এমন অবস্থা আমার মৃত্যুতে তার কী হবে! মা তো মনে হয় মরেই যাবে। আমি সন্তান হয়ে অন্য কারো জন্য নিজের মাকে মারতে যাচ্ছিলাম! কিভাবে পারলাম আমি! দুই দিনের ভালোবাসার জন্য আমি জন্মপূর্ব ভালোবাসাকে ভুলে গেলাম! এমন ভালোবাসার জন্য তো সব কিছু বিসর্জন দেয়া যায়। আমিও না হয় মায়ের জন্য নিজের আবেগ আর ভালোবাসাকেই বিসর্জন দিলাম! মায়ের ভালোবাসার কাছে এতটুকু তো খুব নগন্য।
এমন ভাবনা মনে আসতেই আত্মহত্যার ভাবনা বাদ দিলাম।”

গালিব সাহেব থামলেন আবার। মিহিকার কপালে চিন্তার ভাজ। এমন করে তো সে ভেবে দেখেনি! নিজের দৃষ্টিকোণ থেকেই ভেবেছে, একটাবারও বাবা মায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবে দেখেনি। নিজেকে ভীষণ নির্বোধ মনে হলো তার। সুক্ষ্ম অপরাধবোধ হানা দিল মনের কোণে। সেই সাথে গালিব সাহেবের জীবনকাহিনি শোনার আগ্রহটাও প্রবলভাবে অনুভব করল। সে প্রশ্ন করল,
“পরদিন কী হলো? নিন্তিকার বিয়ের সময়টা কিভাবে পার করলেন?”

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে