তুমি রবে ৫

0
2319
তুমি রবে ৫ . . মাহি চকিত দৃষ্টিতে তাকাল আশফির দিকে। চোখে তার রাগের আভাস পেল সে। এমনিতেই সে এত সময় কুকড়ে বসে ছিল তার উপর আশফির ধমকানি। আশফি এবার বলল, – “আপনি তখন থেকে নিজের সাজগোজ, ড্রেস মেইনটেইন এসবের প্রতি ব্যস্ত। তাহলে কাজটা কি এখানে বসে আমি করব?” মাহি মাথা নিচু করে তার দুটি ভীত চোখের দৃষ্টিও নিচে রেখে যখন ‘স্যরি’ বলতে গেল তখন আবার আশফি বলল, – “কাজটার থেকে আপনি যদি নিজের বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়েই ব্যস্ত থাকবেন তাহলে কাজ করার তো কোনো প্রয়োজন নেই। এখানে আমি পাত্রপক্ষ নই যে আমার সামনে আপনাকে পারফেক্ট সুন্দরী হিসেবে নিজেকে প্রেজেন্ট করতে হবে।” – “ভুল হয়ে গেছে স্যার।” আশফি চেয়ারে হেলান দিলো এবার। বিরক্তি ভরা কণ্ঠে সে মাহিকে বলল, – “আপনি যান আর আপনার সিনিয়র ম্যামকে পাঠিয়ে দিন।” কথাটা বলে আশফি অন্যদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে থাকল। কেবিন ছেড়ে মাহি চলে গেল। তার কিছু সময় পরই খুশি হুড়মুড়িয়ে এসে কেবিনে ঢুকল। যেটা খুশি হরহামেশায় করে থাকে। আর আশফির কাছে সেটা সবসময়ই ব্যাপারটা অসহ্য লাগে। সে রেগে উঠে খুশিকে বলল, – “আপনাকে আমি আগেও বলেছি আপনি এভাবে আমার কেবিনে আসবেন না। আপনি যেভাবে আসেন তাতে মনে হয় আমার ডাকার এক মিনিটের মধ্যেই আপনাকে আসতে হবে। না হলে আপনাকে আমি পানিশমেন্ট দেবো।” – “স্যরি স্যার।” – “আর আপনি এগুলো কী করেছেন?” কাগজগুলো হাতে নিয়ে বলল আশফি। তখন খুশি নিরপরাধীর মতো করে বলল, – “আমি করিনি স্যার। আমার আন্ডারে কর্মরত ওই নতুন স্টাফ করেছে। আমি তাকে সবকিছুই ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম।” – “আপনি নিজের দোষ অন্যের ওপর জাহির করা বন্ধ করবেন প্লিজ? এই কাজটা আপনি প্রতিনিয়তই করেন। এখানে যে কাজগুলো করেছে সে তার থার্টি পার্সেন্ট কাজও তার করার কথা নয়। অথচ আপনি তাকে দিয়েই অল কমপ্লিট করিয়েছেন। কেন? তাকে তো কাজ শেখানোর জন্যই আপনার আন্ডারে রাখা। প্রথমদিনেই আপনি তাকে কাজের কারখানা চাপিয়ে দিলে সে কাজের বদলে আপসেট হবে প্রতিনিয়ত। আপনাকে আমি লাস্ট টাইম বলছি, যেটা নিজের কাজ সেটা নিজেই করবেন। আর তাকে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই তাকে বোঝাবেন, শেখাবেন আর করতে দেবেন। বেশিও নয় বা তার কমও নয়।” – “জি স্যার।” কাজগুলো কারেকশন করে খুশি অন্ধকার মুখ করে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। আশফি কলমটা আঙুলের মাঝে ঘোরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তখন। মূলত কলম ঘোরাতে ব্যস্ত নয়, এক রাশ অপ্রতিভ অবস্থা তাকে ঘিরে ধরেছে। যা থেকে সে এই মুহূর্তে কোনোভাবেই নিজেকে বের করতে পারছে না। খুব জরুরি ছিল তখন মাহির বেরিয়ে যাওয়াটা। কারণ সে তার থেকে নিজেই বেশি অস্বস্তিকর পরিবেশ উপলব্ধি করছিল। তাই বাধ্য হয়ে তাকে বকাগুলো শোনাতে হয়েছে তার। .
. – “মাহি তুমি কি কাঁদছো?” মাহি ডেস্ক থেকে দ্রুত মাথা তুলে তাকাল মিলির দিকে। মুখে ম্লান হাসি টেনে বলল, – “আরে না না, কাঁদব কেন?” – “প্রথমদিনেই খুশি ম্যাম তোমাকে ঝেরেছে তাই না? ওই মানুষটায় এমন। তার আন্ডার থেকে বের হওয়ার জন্য কয়েকজন চাকরিও ছেড়ে দিয়েছে।” ম্লান সুরেই উত্তর দিলো মাহি, – “খুশি ম্যাম কিছুই বলেনি মিলি।” – “তবে?” মাহি মিলির কাছে আশফির ব্যবহারের সবটায় বলল আর কারণটাও বলল। মিলি বিস্মিত হয়ে জবাব দিলো, – “স্যার এমন ব্যবহার করেছে? কিন্তু উনি তো এমন নয়। নতুন স্টাফদের প্রতি উনি যথেষ্ট সফ্ট। আর শুধু নতুন স্টাফ নয় পুরোনো সব স্টাফদের প্রতিও তিনি খুব বিনয়ী। হয়তো স্যার আজ খুব ডিস্ট্রাবড ছিল। তাছাড়া উনি খুব ভালো মানুষ। উনি আজও পর্যন্ত কারো সাথে এমন রুঢ় আচরণ করেনি।” মাহি হতাশ মুখ করে বসে রইল। সে ধরে নিলো আশফির সঙ্গে তার পূর্বের খারাপ আচরণের জন্যই সে এমনটা করেছে। কিন্তু তখন তো খুব বলল তার জীবনে তার কারো সঙ্গে পার্সোনাল প্রবলেম থাকলে তা এক স্থানে আর কারো সঙ্গে তার বিজনেস বা কাজ সংক্রান্ত ব্যাপার তা অন্য স্থানে। মনে মনে আশফিকে মাহি খুবই তিক্তপূর্ণ কথা শুনিয়ে থম মেরে বসে রইল। দিশান তখন করিডর হতে আসছিল। সরাসরি চোখ আটকে গেল তার লাল আর সাদা জামা পরিহিত মাহির দিকে। অফিসের সুন্দরী স্টাফদের সঙ্গে বরাবরই দিশানের খুব ভালো ভাব জমে যায়। দিশান কখনোই তার সামনে থাকা সুন্দরী মেয়েদের ইগনোর করতে পারে না। তার এ আচরণ সম্পর্কে অফিসের সবাই অবগত। কারণ সে সকলের সঙ্গেই খুব হেসে খুলে কথা বলে। আর যে তার প্রতি পজিটিভনেস অ্যাটিটিউড দেখায় শুধু তাকেই নিজের প্রিয়তমাদের লিস্টে নাম এঁটে চুটিয়ে প্রেম করে তার সঙ্গে। মাহির পাশে এসে দাঁড়িয়ে মুখে প্রাণবন্ত একটা হাসি টেনে দিশান বলল, – “কারো গম্ভীর মুখ দেখে সকালটা শুরু হলে আমার আবার পুরো দিনটায় খারাপ যায়।” মাহি ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকালে মিলি তখন হেসে মাহিকে বলল, – “আমাদের ম্যানেজার স্যার। আর আশফি স্যারের ভাই। একজন সুখি মানুষ তিনি, যার কোনো কষ্ট নেই।” মাহি উঠে দাঁড়িয়ে স্মিত হেসে সালাম জানাল। দিশান তখন বলল, – “আমাকে প্লিজ গুরুজনদের মতো সম্মান করো না। আমি খুব কষ্ট পাই।” এই বলে দিশান হেসে দিলো। সঙ্গে মাহিও হাসলো। দিশান ডেস্কের কাছে দাঁড়িয়ে খুব গল্প করতে থাকল মাহির সঙ্গে। এদিকে আশফি মাইন্ড রিফ্রেশ করার জন্য যখন কেবিন থেকে বের হলো তখন সরাসরি তার দৃষ্টি স্থাপন হলো মাহি আর দিশানের দিকে। বিশ মিনিট হলো মাহি তার কেবিন থেকে বেরিয়েছে। এর মাঝেই দিশানের সঙ্গে তার প্রথম দিনেই তাকে এত ক্লোজলি মিশতে দেখে ভেতরে ভেতরে তার কেমন একটা রাগ রাগ হলো। কিছুক্ষণ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল দুজনের দিকে। তারপর আবার কেবিনে চলে এলো। এক গ্লাস পানি খেল সে। এরপর মনে মনে ভাবল এখানে তার রাগ হওয়াটা একেবারেই অবাঞ্ছনীয়। তার ভাই দিশান বরাবরই এমন। সকলের সঙ্গে সে মিশতে খুব পছন্দ করে। আর তা যদি একজন মেয়ে এবং সেই সঙ্গে সে সুন্দরী হয় তো কথাই নেই। প্রচন্ড ইম্পর্ট্যান্ট দিয়ে ফেলছে সে ব্যাপারটাকে। এটা একেবারেই তার ভাবনার বহির্ভূত ব্যাপার। চিন্তাগুলোকে মাথা থেকে ঝেরে রিল্যাক্স মাইন্ডে সে এবার কাজে মনোযোগী হলো। . . দুপুর বেলা লাঞ্চ টাইমের সময় হয়ে গেছে। দিশান আজ আর ভাইয়ের সঙ্গে লাঞ্চ করতে যাবে না। একটু রেগে আছে সে তার প্রতি। কারণ তার ভাই তার প্রতিটা ব্যাপারে তাকে সাপোর্ট না করে তার দাদা দাদিকে সে সাপোর্ট করে থাকে। কালকের ব্যাপারটাতেও সে তার দাদিকেই সাপোর্ট করেছে। যেটা দিশানের কাছে খুব অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। সে সোজা মাহির ডেস্কের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। – “কী সুন্দরী ম্যাম খিদে পায়নি?” মাহি হাতের কাজগুলো সামলে নিতে নিতে বলল, – “হ্যাঁ তা তো একটু পেয়েছে।” – “দুপুর বেলা মানুষের অনেকটাই পায় একটু পায় না। চলো চলো।” – “কোথায়?” – “লাঞ্চে আবার কোথায়?” মাহির না বলার পূর্বেই দিশান তার হাত ধরে তাকে টেনে উঠিয়ে বলল, – “এত ভাবতেও হবে না আর বিব্রতও হতে হবে না। এটা আমি শুধু তোমার সঙ্গেই নয় প্রায় সবার সঙ্গেই করি। কারণ একা একা খেতে আমার ভালো লাগে না।” মাহি এক প্রকার বাধ্য হয়ে দিশানের সঙ্গে বাহিরে যায় কোনো একটা কাছের রেস্টুরেন্টে। আশফি কেবিন থেকে বেরিয়ে দিশানের কেবিনে গেল। কিন্তু দিশানের বদলে তার চেয়ারের ওপর একটি সাদা কাগজের চিরকুট পেল সে। চিরকুটটা হাতে নিয়ে পড়ল আশফি। সেখানে লেখা, – “আমি লাঞ্চ করতে যাচ্ছি। আপনি একাই করে নিয়েন। আর যদি পারেন তো ঐন্দ্রীকে সঙ্গে করে লাঞ্চটা করবেন। বেচারি সকালে খুব আপসেট ছিল আপনার ব্যবহারে।” চিরকুটটা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে আশফি ঐন্দ্রীর কেবিনে গেল। ঐন্দ্রী তখনই কেবিন থেকে বের হচ্ছিল। আশফির মুখোমুখি হয়ে সে মুখটা কালো করে দাঁড়িয়ে পড়ল। আশফি তাকে বলল, – “লাঞ্চ করেছো?” – “জি না স্যার।” বেশ অভিমানের সুর তার গলায়। আশফি তখন বলল, – “ঠিক আছে চলো, এক সাথে করা যাবে।” ঐন্দ্রী হ্যাঁ না কিছুই বলল না মুখে। কিন্তু মনে মনে খুব খুশি হলো। তারা দুজন কাছের একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকল। সেখানে ঢুকেই আশফি প্রথম দেখতে পেল মাহিকে। আর তারপর চোখ পড়ল নিজের ভাইয়ের দিকে। সেদিকে সরু দৃষ্টি রেখেই আশফি অন্য পাশের টেবিলে এসে বসল। সে লক্ষ্য করতে থাকে দুজনকে। খেতে বসেও তারা খুব হাসি তামাশাতে ব্যস্ত। মাহি দিশানের ঠোঁটের কোণে ইশারা করে বলল, – “ওখানে কিছু লেগে আছে তোমার।” দিশান টিস্যুটা মাহির হাতে দিয়ে মুখটা এগিয়ে দিয়ে বলল, – “ক্লিন করো।” মাহি চোখদুটো বড় বড় করে বিব্রত মুখ করে তাকাল তার দিকে। দিশান তখন ওকে বলল, – “প্লিজ টেক ইট ইজি সুন্দরী। আমি কোনো বয়ফ্রেন্ড সেজে বা বয়ফ্রেন্ডের মতো দাবি করে বলছি না।” মাহি টিস্যু দিয়ে সেখানটা মুছে দিলো। দিশান তখনো খেতে ব্যস্ত। তার মাঝেই তার ঠোঁটের বাঁ পাশে আবার লেগে গেল। মাহি সেদিকে কপাল কুচকে তাকালে দিশানও স্থির দৃষ্টিতে তাকাল মাহির দিকে। তারপর দুজনেই একত্রে হেসে উঠল। এরপর দিশান নিজেই তা মুছে নিলো। মাহি হাসতে হাসতে বলল, – “সত্যি আমি এভাবে কখনো কোনো ছেলেকে খেতে দেখিনি।” দিশান মুখের মধ্যে বার্গার পুরে বলল, – “দেখো খাওয়ার ব্যাপারে আমি কখনোই ভদ্র নই। প্রচন্ড শৌখিন আমি এ ব্যাপারে।” দুজনের মধ্যে আবার হাসির রোল পড়ে গেল। আশফি তখন মুখের মধ্যে বার্গার টেনে ছিঁড়তে ছিঁড়তে ওদেরকে দেখছিল। ঐন্দ্রী আশফির দৃষ্টি লক্ষ্য করে তাকিয়ে ওদের দুজনকে দেখে হেসে বলল, – “দিশান এখন মাহির সঙ্গে! ওহঃ ছেলেটা পারেও। বাট খুব ভালো মানিয়েছে ওদের দুজনকে।” আশফি মুখটা টিস্যু দিয়ে মুছে উঠে দাঁড়াল। তারপর ঐন্দ্রীকে বলল, – “আমার খাওয়া শেষ। তুমি শেষ করে এসো।” আশফি আর কোনো দিকে না তাকিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল রেস্টুরেন্ট থেকে। দিশান আর মাহি খাওয়া শেষ করে ফিরছিল। দিশান তখন মাহিকে বলল, – “তুমি বোধহয় একটু অসুস্থ ডিয়ার। কেমন যেন লাগছে তোমার চোখদুটো। মনে হচ্ছে ঝিমুনি ঝিমুনি ভাব।” মাহি বলল, – “কাল রাত থেকে অত্যাধিক জ্বর।” দিশান মাহির পথ আগলে দাঁড়িয়ে ওর কপালে হাত রাখল রাস্তার মধ্যেই। মাহি ব্যাপারটাতে একটু হতবুদ্ধি বনে গেল। – “সিরিয়াসলি! এত গরম তোমার শরীর? তাও তুমি অফিস করতে এসেছো কেন?” – “আজ ফার্স্ট ডে না?” – “তো? এটা একদম ঠিক করোনি। চলো তোমাকে ট্যাক্সি করে দিই। তুমি এখনি বাসায় ফিরবে।” – “না না কোনো প্রয়োজন নেই তার। আর তো মাত্র দু ঘন্টা। সমস্যা হবে না আর। এত সময় পেরেছি এটুকু সময়ও পারব।” – “শিওর?” – “একদম।” . . কথা ছিল অফিস ছুটি টাইমে দিশান আজ মাহিকে ওর বাসায় পৌঁছে দেবে। কিন্তু হঠাৎ করে তার গার্লফ্রেন্ডের ইমার্জেন্সি ফোন কলে মাহিকে সে স্যরি বলে অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। আর এদিকে ঐন্দ্রী আশফির কেবিনে বসে ওর সঙ্গে বের হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। আশফি তখন ওকে বলল, – “আমি অফিস থেকে ফিরে অন্য কোথাও যাওয়ার মুডে থাকি না ঐন্দ্রী। আমি দুঃখিত, তুমি অপেক্ষা না করে বাসায় চলে যেতে পারো। অফিস ডে ছাড়া আমাদের অন্য কোনোদিন বাহিরে কোথাও মিট হবে, ওকে?” ঐন্দ্রী খুব মন খারাপ করে কোনো কথা না বলে বেরিয়ে গেল। তার যাওয়ার সময় মাহি বেশ কয়েকবার তাকে পিছু থেকে ডাকল। কিন্তু সে এতটায় মন খারাপের কারণে উদাসীন ছিল যে মাহির ডাক সে না শুনতে পেয়েই চলে যায়। এদিকে মাহির জ্বর বেড়ে যাওয়ার কারণে খুবই বেহাল অবস্থা তার। মাথা তুলে সে দাঁড়িয়ে থাকতেও পারছে না। এই অবস্থায় সে সুস্থভাবে বাসায় ফিরতে পারবে কি না তা নিয়ে সে খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। লিফ্টের কাছে এসে তার মাথার মধ্যে হঠাৎ চক্কর দিয়ে উঠে। দ্রুত লিফ্টের গায়ে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল সেখানে। তারপর লিফ্ট খুললে ভেতরে ঢুকে যায়। লিফ্ট বন্ধ হওয়ার পূর্বেই আশফি এসে লিফ্টে ঢুকে। মাহি তখন চোখদুটো বন্ধ করে লিফ্টের গায়ের সঙ্গে লেপ্টে দাঁড়িয়ে ছিল। আশফি বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে তাকে জিজ্ঞেস করতে চাইল, – “আর ইউ ওকে?” কিন্তু তা সে করল না। পকেটে দু হাত পুরে সোজা দৃষ্টি রেখে লিফ্টের এক কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকল। লিফ্ট চলতে শুরু করলে মাহি আধখোলা চোখে আশফিকে দেখে দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়াল। আশফি একবার তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো। এমনিতেই জ্বরে মাহির গা, হাত, পা কাঁপতে আছে। আবার আশফির সঙ্গে একই লিফ্টে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য তার বুকের ভেতরেও কাঁপুনি হতে শুরু করেছে। আশফি না তাকিয়েও বুঝতে পারছে মাহির অবস্থা খুব সুবিধার নয়। দু মিনিট পার হওয়ার পূর্বেই মাহি ঝিমুনি চোখে তাকিয়ে আশফিকে কিছু একটা বলতে গেল। কিন্তু বলতে আর পারল না। তার পড়ে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে আশফি তার দিকে দ্রুত এগিয়ে এলে মাহি তখনই নিচে লুটিয়ে পড়ে। সেন্স পুরো হারিয়েছে সে। আশফি তাকে ধরে বুঝতে পারল জ্বরের তেজ বেশি থাকার ফলে এই অবস্থা হয়তো। লিফ্ট ওপেন হতেই আশফি লিফ্ট থেকে বেরিয়ে বাহিরে কয়েকজনের কাছে এসে পানি চাইল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে কারো কাছেই পানি পাওয়া গেল না। বাধ্য হয়ে আশফি মাহিকে পাঁজাকোলা করে তার গাড়ির কাছে নিয়ে এসে কেউ একজনকে বলল গাড়ির ডোরটা খুলে দিতে। গাড়ির ডোর খুলতেই তারপর ব্যাকসিটে মাহিকে শুইয়ে গাড়ি থেকে পানির বোতল নিয়ে মাহির মুখে ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফেরাতে সক্ষম হলো। কিন্তু মাহির শরীরের সামর্থ্যের অভাব। যার ফলে উঠে বসতেও তার ভীষণ কষ্ট বোধ হলো। দুই-চার মিনিট কিছুক্ষণ নড়নচড়নহীন হয়ে শুয়ে থাকল সে। আশফিও কিছু বলল না। গাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসে গাড়ি থেকে নামতে গেলে আশফি তাকে বলল, – “কিছু মনে না করলে আমি আপনাকে পৌঁছে দিতে পারি।” মাহি নীরব। সে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে আবার মাথার মধ্যে অন্ধকার লাগল তার। আশফি তাকে ধরতে গেলে মাহি দ্রুত তার গাড়িতে হাত ভর করে দাঁড়ায়। তারপর আশফিকে বলল, – “প্রয়োজন নেই, ধন্যবাদ।” এই বলে মাহি হাঁটতে শুরু করলে আশফি পিছু থেকে বলল, – “আপনি তো যেতে পারবেন না।” মাহি তার কথা কানে তুলল না। সে তার মতো সামনের দিকে আগাতে থাকল। আর আশফি তার যাত্রা পথে পলক ফেলে রাখল। কারণ সে নিশ্চিত মাহি আবারও রাস্তার মাঝেই মাথা ঘুরে পড়বে। ঠিক কয়েক সেকেন্ডের মাথায় তাই-ই ঘটল। পড়ে যাওয়ার সময় কোনো কিছুর সাপোর্ট না পেয়ে মাটিতেই পড়ে গেল মাহি। আশফি দৌড়ে গিয়ে মাহির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে মাহি ফের তাকে এড়িয়ে গেল। আশফি টের পেল মাহির চোখে মুখে তার প্রতি স্পষ্ট রাগ ফুটে উঠেছে। আর এও নিশ্চিত হলো, তখন কেবিনে ওই ব্যবহারকে ইস্যু করেই মাহি তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আশফির তাতেও মনে চাইল না মাহিকে ফেলে চলে যেতে। তাই তো সে হাতটা বাড়িয়েই রাখল। মাহি সেখানে বড্ড জিদ প্রদর্শন করল। নিজে নিজে উঠতে চেষ্টা করল। বহু কষ্টে সে দাঁড়ালও। কিন্তু হাঁটার সামর্থ্য নেই যে তার। রাস্তার কিনারাতে দাঁড়ানো দুজন। আশফি শুধু পাশে দাঁড়িয়ে কপাল কুচকে মাহির কার্যকলাপ ফলো করতে থাকল। মাহি ট্যাক্সি বা সিএনজির অপেক্ষাতে আছে। কিন্তু অপেক্ষা করতে করতে তত সময়ে এই মেঘলা আকাশ হতে আবার বর্ষণের ধারা ঝরতে শুরু করবে। আশফি নিজের ইগোকে সাইড রেখে মাহিকে আবার বলল, – “আমি দাঁড়িয়ে আছি আপনার জন্য। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। এখানে দাঁড়িয়ে না তো আপনি খুব সহজে কোনো গাড়ি পাবেন আর না উবারে কল করে তাদের আসা অবধি দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন।” মাহি এবার কাঁপা কণ্ঠে চেঁচিয়ে তাকে জবাব দিলো, – “তাতে আপনার কী? আপনি দেখতে পাচ্ছেন যেহেতু আমি দাঁড়িয়ে আছি তার মানে আমি যাব না আপনার সঙ্গে। তারপরও কেন দাঁড়িয়ে আছেন?” এই কথার পর আশফি আর সেখানে থাকল না। গাড়ির দিকে রওনা হলো সে। তার মাঝে ইগো ব্যাপারটা কম কাজ করলেও আত্মসম্মানবোধ প্রচুর। আর তার আত্মসম্মানে একবার আঘাত লাগলে সেখানে সে তান্ডবও বাধিয়ে ফেলতে পারে। আর ওই মুহূর্তে ওখানে আর একটা সেকেন্ডও দাঁড়িয়ে থাকলে দেখা গেল মাহির ত্যাড়ামির ফল তাকে রাস্তার মধ্যে থাপ্পড় খেতে হতো। কারণ মেয়েটা অত্যন্ত চেঁচিয়ে কথা বলে যা আশফির কোনোকালেও পছন্দ নয়। গাড়িতে উঠতেই ঝমঝমিয়ে বাদলের ধারা বইতে শুরু করল বাহিরে। আশফি গাড়িটা স্টার্ট দেওয়ার আগে একবার পিছে তাকাল। আগের স্থানেই মাহি কুকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ফোন, হয়তো উবার কল করছে। আশফি কিছুক্ষণ দোনোমনা করে গাড়ি স্টার্ট দিলো। বৃষ্টির তেজ ধীরে ধীরে বাড়ছেই। গাড়িটা টেনে নিয়ে সামনে গেলেও চার মিনিটের মাথায় সে আবার ব্যাক করল উল্টোদিকে। মাহি তখন গুটি গুটি পায়ে কেমন হেলে দুলে কাঁপতে কাঁপতে সামনের দিকে হাঁটছিল। কখন যেন পড়ে যায় যায় ভাব। আশফি তার কাছে এসে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে খানিকটা চেঁচিয়ে বলল, – “জায়গা মতো রাগটা দেখাবেন। অজায়গায় রাগ দেখিয়ে নিজের ক্ষতি করার প্রয়োজন নেই। গাড়িতে উঠে আসুন।” মাহি একবার মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে তার চলা পথে সে চলতে শুরু করল। আশফি গাড়িটা এগিয়ে নিয়ে আসতে আসতে বলল, – “লাস্ট টাইম বলছি, গাড়িতে উঠে আসুন।” মাহি তার কোনো কথা তোয়াক্কা করল না। তারপর আশফি গাড়ি দাঁড় করিয়ে গাড়ি থেকে নেমে সোজা মাহির হাতটা এসে চেপে ধরল। মাহির কোনো কথা শোনার অপেক্ষা সে করল না। মেজাজটাই তার নষ্ট হয়ে গেছে মাহির আচরণে। যুক্তিহীন ইগো আর রাগও আশফির সহ্য হয় না। সে যেচে পড়ে উপকার করতে চাইছে তাহলে সে কেন তার উপকার নেবে না? যত্তসব ফালতু ইগো, সেন্টিমেন্ট! আশফি তার হাতটা চেপে ধরে টেনে নিয়ে সোজা তাকে গাড়িতে ওঠাল। তাতে তাকে যে যা খুশি ভাবুক, তা পরে দেখা যাবে। ……………………………… (চলবে) – Israt Jahan Sobrin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে