তুমি রবে ৫৯

0
1942

তুমি রবে ৫৯
.
.
কিছু মুহূর্ত থাকে যা আজীবন ধরে রাখার বাসনা থাকে মানুষের। যেমন এই সকালের মুহূর্তটুকুই আশফির দীর্ঘস্থায়ীরূপে ধরে রাখার তীব্র বাসনা জেগেছে। একদিন হঠাৎ এই মেয়েটা এক ভুল রাতে ভুল মুহূর্তে প্রথমবার তার বুকের মাঝে এসেছিল। সেই রাতে চাইলেও আশফি পারেনি তাকে বুকের মাঝটাতে একদম জাপটে ধরে রাখতে। কিন্তু আজ আর কোনো বাঁধা নেই। এই মানুষটা যদি আজ নাও চায় তবুও আজ সে তাকে একদম বুকের মাঝেই জড়িয়ে রাখবে।

এটুকু ভাবতেই আশফি মাহিকে বুকের খুব কাছটাতে টেনে নিয়ে এলো। আর সেই সুযোগে ঘুমন্ত মাহি আরও জড়সড় হয়ে আশফির বুকের সঙ্গে মিশে গেল। তার বুকের মাঝটাতে সে মুখ ডুবিয়ে আছে। আশফির ঠোঁটে স্মিত হাসি। মাহির কোমল গালের মাঝে তার আঙুলের অপর পিঠ দ্বারা স্পর্শ করতে থাকল আলতোভাবে। কানের ওপরের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তার স্ত্রীকে দেখে ছোট্ট একটি চুমু খেলো তার গালে।

দীর্ঘ এক মাস দশদিন পর আজ বউটার এতটা কাছে সে। এই এক মাস দশদিনে তার বউয়ের মুখটা দেখার জন্য মনটা ছটফট করলেও সে যায়নি তার কাছে। কতবার ফোন করেছে বউটা তাকে। একটাবার রিসিভও করেনি সে। কী করার? তাকে বোঝানোটা যে জরুরি ছিল তার জীবনে এখন তার পরিবার ছাড়াও আরও একটি মানুষ তার জীবনের সব থেকে বেশি অংশ জুড়ে আছে। আর সেই মানুষটা তার স্বামী।
আশফি জানত, দিবা প্রহরটুকু পার করে রাত্রিভাগ এলেই তার বউটা দু জোড়া চোখের পাতা এক করতে পারেনি৷ কেঁদেছে সে প্রতি রাতে। আজ হয়তো মাহির পরিবারের সঙ্গে আশফির সম্পর্ক খারাপ। কিন্তু সে বিশ্বাস করে, একদিন তারা বুঝতে পারবে তাকে। সে যে শুধু রাগ আর জিদ থেকে নয়, মাহির সর্বোচ্চ ভালোর জন্য সে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে তা সবাই একদিন বুঝতে পারবে। তবে সবার মাঝে আশফি মাহতীমের আচরণে সব থেকে বেশি হতবাক। মাহিকে নিয়ে সে যতটা পজেজিভ, তাতে আশফির ধারণা ছিল হয়তোবা সে কখনোই মাহিকে তার পরিবার থেকে এত দূরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে মত দেবে না। এই একটা মানুষ, যে আশফিকে বুঝতে পেরেছে। আশফির পরিবারও তাঁদের নাতির এ সিদ্ধান্তে খুবই অসন্তুষ্ট তার প্রতি। আর খু্ব কষ্টও পেয়েছে তাঁরা। কিন্তু তার কাছে সকলের কষ্টের থেকে তার বউয়ের সঙ্গে তার একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপনের চিন্তার মূল্য বেশি। কোনোভাবেই যাতে আর মাহিকে কোনো বিপদে পড়তে না হয়, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা জরুরি বেশি তার কাছে।

শায়খ বসে আছে আশফির জন্য। প্রায় বিশটি দিন হতে চলল, এত ভালোবাসার ভাইটার সঙ্গে সে কথা বলে না। কিন্তু গতরাতে আশফি আর মাহির অ্যামেরিকা চলে যাওয়ার খবর শুনে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার। অনেক দুর্ব্যবহার করেছে তাদের দুজনের সঙ্গে সে। সেদিনের কথা মনে পড়ছে তার বারবার, যেদিন সে বলেছিল তাদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে,
– “এ বাড়ির ছাদের নিচে হয় আমার পরিবার থাকবে নয়তো তারা দুজন থাকবে।”
সেদিনই আশফি মাহিকে নিয়ে চলে আসে তার নিজের বাড়িতে। চলে আসে দিশানও। বোনটার মুখের দিকে তাকালেই সব রাগ গিয়ে পড়ে তার মাহির ওপর। কিন্তু আজ আর রাগ নয়, কষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে যে তারা দুজনও তার আপনজন ছিল। কী করে পেরেছে সে এতটা বাজে ব্যবহার করতে তাদের সঙ্গে!

.
আশফি তার বউয়ের সান্নিধ্য ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে এলো। লিভিংরুমে এসে সে কাউকেই পেলো না। কিচেনে কারো কাজ করার শব্দ শুনতে পেলো সে। সেখানে এসে দেখল শায়খ নিজে নিজে কফি তৈরি করছে। আশফি হেসে উঠল তা দেখে। তার হাসির শব্দ শুনে শায়খ কাজের মাঝে একবার তাকাল তার দিকে৷ কফি মগে ঢেলে নিতে নিতে বেশ গম্ভীরস্বরে তাকে বলল,
– “যেভাবে এক্সপ্রেশন দিচ্ছো মনে হচ্ছে সব কিছু স্বাভাবিক।”
আশফি তার কথার জবাবে মৃদু হেসে চলে এলো। কাউচে এসে বসতেই শায়খ একটা মগ আশফির হাতে তুলে দিয়ে তার পাশে এসে বসলো।
– “তুমি সব কিছু বুঝতে পারো কীভাবে?”
আশফি কফিতে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “সব কিছু বলতে?”
– “এই যে আমি যে আসব সেটা বুঝতে পারলে কীভাবে? আমি তো খুব খারাপ আচরণ দিয়েছিলাম, না?”
– “আমি তোর বড়, তুই আমার বড় না। আর বড় হয়ে যদি তোদের মতো ছোট ভাইদের দেওয়া কষ্ট পুষে রাখি ভেতরে তো বড় হওয়ার আর কী প্রয়োজন?”
– “এটাই যদি ভাবো তো এতদিনে একটাবার ফোন দাওনি কেন? শুধু শাওনের সাথে কথা বলেছো। কই আমার সঙ্গে তো কথা বলতে চাওনি?”
– “বড় বলে ছোটদের অন্যায় ক্ষমা করে দেওয়ার সামর্থ্য রাখি বলে কি বড় হয়ে ছোটদের কাছে আত্মসম্মানও খুইয়ে দেবো?”
শায়খ শুধু তাকিয়ে থাকল তার ভাইয়ের দিকে। আসলেই তাদের দাদীবুর বলা কথাটি সত্য। আরও কয়েকবার জন্ম নিলেও তার ভাই মানুষটার মতো চিন্তাভাবনা গড়তে পারবে না তারা। শায়খ মগটা টি টেবিলের ওপর রেখে বলল,
– “ব্যাপারটা এমন হচ্ছে না ভাইয়া যে চোরের ওপর রাগ করে কলার পাতাতে ভাত খাওয়া?”
– “এই চোরটা যদি শুধু আমার অর্থাৎ শুধুই আমার জিনিস চুরি করতো তবে এত বড় সিদ্ধান্ত আমি কখনোই নিতাম না। সে আমাকে রেখে আমার বউ, আমার বোন তাদের দিকে হাত বাড়িয়েছে। আর সে নিজের চারপাশে এমনভাবে বেড়াজাল দিয়ে রেখেছে যে আমি চাইলেও তাকে ছুঁতেও পারব না। অথচ সে ওই বেড়াজালের মধ্য থেকেই সে ধারাল অস্ত্র ছুঁড়ে দিচ্ছে আমার আপন মানুষগুলোর দিকে। তাকে যতটা তুচ্ছ ভেবেছিলাম সে ততটাই ভয়ংকর।
– “সোম এই মুহূর্তে দেশেই নেই। তুমি কি ভয় পাচ্ছো ভাইয়া?”
– “চিকিৎসা নিতে অস্ট্রেলিয়া গেছে। এটা বিশ্বাস করে বসে আছিস তুই? সব থেকে বড় চমক পাওয়ার পরও ওকে তুই ছোট ভাবছিস? শিশির আহমেদের মতো ব্যক্তির পার্টনার ও। আর সেই শিশির এই দেশ থেকে তার স্বার্থ চুষে নেওয়ার পরই সে অস্ট্রেলিয়াতে পারি জমিয়েছে। সোম যেভাবে ক্ষেপে আছে তাতে ও আমার বা মাহির কোনো ক্ষতি করতে না পারলেও আমার পরিবার আর মাহির পরিবারের যে কাউকে টার্গেট করবে আবারও, শুধু আমাদের হ্যারাজ করার জন্য। যেমন আমার ওপর, তোর ওপর, দিশানের ওপর ক্ষেপে ও টার্গেট করেছে প্রথমে শাওনকে। কারণ শাওন ছোট। ওর আবেগ বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক। আর সেই সুযোগ নিয়েই ও শাওনকে…! এখানে চাইলে ও দিয়া কিংবা মাহির বোন মিমির প্রতি ওর কোনো কৌশল কাজে লাগাতে পারবে না, যেটা ও শাওনের সঙ্গে পেরেছে। শাওনকে শেষ মুহূর্তেও ফিরিয়ে আনতে পারলেও আমি যদি মাহিকে নিয়ে দেশে থাকি তো কোনোদিনই ও মাহির পিছু ছাড়বে না। কারণ ওর অশ্লীল চাহিদা মাহির সেই স্কুল লাইফ থেকেই। মাহতীম থাকাকালীন ও নিজেকে সংযত রেখে চলতো। মাহতীম চলে গেলেও মাহির দাদা, বাবা, মাহির ভাই লিমন ওকে আগলে রেখেছে। আর যে সময়ে মাহিকে সে পুরো বাগে আনবে ঠিক তখনই আমার সঙ্গে মাহি জড়িয়ে গেছে। এসব কারণে সোম পুরোপুরি ধৈর্যহীন হয়ে পড়েছে। আর মাহি এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে ওকে চাইলেই সোম আর পাঁচটা মেয়ের মতো বিয়ে ছাড়াই ভোগ করতে পারবে না। তার জন্যই তো মাহিকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। না হলে যার রাত দিন কাটেই প্রস্টিটিউটের বিছানাতে, সে কখনো মাহিকে ভালোবাসার চোখে দেখে? মাহি ক্লাস নাইনে থাকতে যেটা হয়েছিল ওর সঙ্গে, সেই ঘটনা শুনে আমি তখনও সোমকে সন্দেহ করিনি। কিন্তু পরবর্তী আক্রমণ শুনে আমি একশোতে একশো ভাগ নিশ্চিত হয়েছিলাম যে শুধু মাহিকে বদনাম করে সেই বদনামের জন্য ওর পরিবারকে দূর্বল বানিয়ে তারপর মাহিকে বিয়ে করে নেওয়া। আর মাহিকে বিয়ে করতে পারলে তো নিজের নোংরা উদ্দেশ্যও সফল হতো আর যখন মাহির প্রতি ওর অরুচি ধরে যেত, আমি নিশ্চিত তখনই ও ব্যবসায়ের মাঝে মাহিকে ঢুকিয়ে দিতো। মাহিকে নিয়ে ওর এই সব পরিকল্পনা ভাবতেই আমার শরীরে কাটা দেয়। এসব মানুষ যে কতটা মনুষ্যত্ব আর বিবেকহীন হয় তা তুই জানিসই। আমি যত কিছুই করি, কিন্তু মাহির জন্য কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি না আমি। এখন সেটাকে তুই ভয় বলেও যদি বিচার করিস তাও কিছু করার নেই আমার। এত বাজে পরিস্থিতির মাঝে আমি মাহিকে নিয়ে বসবাস করতে চাই না। আমার চোখে এখনো ভাসছে সেই রাতটার কথা। কী অবস্থা করে ফেলেছিল ও শাওনের!”
– “ভাইয়া প্লিজ থামো। আমি মনে করতে চাইছি না ওই মুহূর্তগুলো।
শাওন এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। বাবা-মাও আর রেগে নেই ভাবিজানের ওপর। ফিরে আসতে বলছে তোমাদের। যাবে না?”
– “কেন যাব না? সেখানে কি আমার অধিকার নেই? এখানে সব গোছগাছ করে তারপর ফ্লাইটের আগের দিন রাত্রে যাব বাড়িতে।”
– “বড় আব্বু সব কিছু গুছিয়ে রেখেছে তোমাদের জন্য। আবার শুনছি ভাবিজানের ভাইও….”
– “বাবার কাছেই যাব। মাহতীমের কাছে গিয়ে থাকতে পারব না আমি। আচ্ছা ওঠ, নাস্তা করবি।”
– “ভাবিজান?”
– “কাল রাতে খুব কান্নাকাটি করেছে। ঘুমাচ্ছে এখন। তাই আর ডাকিনি।”
– “রেগে আছে এখনো তোমার ওপর?”
– “থাকাটাই তো স্বাভাবিক। তার রাগের মূল্য আমার কাছে ততদিন অবধি ছিল যতদিন সে না বুঝে ভুলগুলো করেছে। আর এখনকার ভুলগুলো ছিল তার অর্থহীন জিদ আর রাগের বশে করা। তাই এই রাগের কোনো মূল্যই আমার কাছে নেই।”
.
দিশানকে জাগিয়ে তুলে অনেক দিন পর তিন ভাই একত্রে সকালের নাস্তা করতে বসলো। আশফির যাওয়ার মাস দুই পরই দিশান আর দেরি করবেন না। দিয়াকে সে বিয়ে করে নেবে। তারপর যত দ্রুত সম্ভব সেও চলে যাবে ভাইয়ের কাছে। ভাইকে ছাড়া থাকা তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এসব আলোচনা করে নাস্তা শেষ করল তারা।

মাহি বিছানাতে শুয়ে ফোনটা তুলে সময় দেখে নিলো। বেলা সাড়ে দশটা বাজে। মাথা ভার লাগছে তার এখনো। নিজেকে বিছানাতে পেয়ে মনে পড়ল তার কাল রাতের ঘটনা। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় আশফি তার বাবার বাসার সামনে এসে ফোন করেছিল।
.
.
আশফি তার সেই গম্ভীর আওয়াজে বলেছিল,
– “আমি তোমার কোনো কথা শোনার জন্য ফোন করিনি তোমার কাছে। আমি ঠিক পাঁচ মিনিট কথা বলব। এরপর তোমাকে বলার সুযোগ দেবো ত্রিশ সেকেন্ড। আজ প্রায় এক মাসের বেশি তুমি কখনো তোমার বাবার বাড়ি, কখনো ভাইয়ের বাড়ি করে থাকছো। এই মাস শেষ হতে আর মাত্র তিন দিন বাকি। আগামী মাসের মধ্যে আমি অ্যামেরিকা ব্যাক করছি। সঙ্গে তোমার ভিসাও রেডি। যদি সত্যিই ফিরতে চাও তো আমার সঙ্গে তোমাকেও দেশ ছাড়তে হবে। এতে তোমার পরিবার বা আমার পরিবার কার মতামত থাকল বা না থাকল তা নিয়ে তুমি ভাবতে পারবে না। এই একটা মাসে যা হলো, এরপর এই অসুস্থ পরিবেশে এত যন্ত্রণা নিয়ে আমি তোমার সাথে এখানে সংসার করতে পারব না। আর আমার সাথে যদি তোমার সংসার করতেই হয় তো আমি যা বলব তোমাকে তাই মানতে হবে। এ ছাড়া আর কারো কথা তুমি শুনতে পারবে না। এতগুলো দিন ইচ্ছা করলেই আমাকে কল করতে পেরেছো, মেসেজ করতে পেরেছো। এরপর চাইলেও আমার খোঁজও পাবে না যদি না আমার কথা মানো। প্রশ্ন এটাই, আমার সঙ্গে কি তুমি থাকতে চাও না কি চাও না? এখানে দীর্ঘ সময় নিয়ে ভাবার কোনো সুযোগ নেই। দ্রুত উত্তর দাও আমায়। নয়তো আজকের পর এই নাম্বারে আর কলও করতে পারবে না।”
সে মুহূর্তে মাহির অবস্থা ছিল যেন সে শূন্যে ভাসছে। এতগুলো দিন পর এই মানুষটার মুখে সামান্য হ্যালো শব্দটুকু শোনার জন্য কতবার না ফোন করেছিল সে, কত মেসেজ করেছিল। অথচ মানুষটা তার কোনো রেসপন্সই করেনি। আর আজ সে নিজে থেকে ফোন করে এমন একটা সিদ্ধান্তের মাঝে ফেলল তাকে যেখানে তার ভাববারও সময় নেই। কী করে থাকবে সে অতদূরে তার বাবা-মা, দাদা সবাইকে ফেলে? চাইলেও যখন তখন সে আসতে পারবে না তাদের কাছে। আর তার পরিবার, তারাও কখনো সহ্য করতে পারবে না তার দূরে থাকা। তাদেরকে কষ্ট দিয়ে, তাদেরকে ফেলে সে কি থাকতে পারবে আশফির সাথে? কিন্তু আশফিকে ছাড়া থাকাটা যে কী পরিমাণ মরণ ব্যধির ন্যায় যন্ত্রণাদায়ক তার জন্য, তা সে এই ক’টা দিনে হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে। তাকে ছাড়া যে তার জীবন গতিহীন তা সে প্রচন্ডভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে।

ওপাশ থেকে টুপ করে ফোনটা কেটে যায়। মাহির ভাবনার মাঝে আশফি ঠিক ত্রিশ সেকেন্ড পরই ফোনটা কেটে দেয়। ফোনটা কাটতেই মাহি সম্বিৎ ফিরে পায়। চোখটা মুছে দ্রুত কল করে সে আশফির ফোনে। ফোনটা বন্ধ। মানুষটা কি তবে সত্যিই এক কঠিন হয়ে গেছে? কী করে পারছে সে তাকে এত যন্ত্রণা দিতে?

আশফি ফোনটা বন্ধ করে গাড়িতে উঠে পড়ল। তার ভাবনা একটাই, তার সঙ্গে থাকা নিয়ে কেন মাহি দ্বিধাতে ভুগবে? কেন ভাবতে হবে তাকে? এই যে সে যেমন পৃথিবীর সব ভাবনা একপাশে ফেলে রেখে শুধু মাহির ভাবনা ভেবে তাকে নিয়ে ভালো থাকার জন্য অন্য একটি দেশে সব রকম ব্যবস্থাও করে ফেলেছে। তাহলে মাহি কেন ভাববে এত কিছু? তবে কি তার ভালোবাসার সমতুল্য নয় মাহির ভালোবাসা? তবে সেই কি শুধু উজাড় করেছে? মাহি তবে তার ভালোবাসার কিঞ্চিৎ পরিমাণ দানও করেনি! এসব ভাবতেই আশফির সবটা এলোমেলো হয়ে আসছে।

ওদিকে মাহি যেমন অবস্থাতে ছিল তেমন অবস্থাতেই বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে গেল। যাওয়ার মুখে দেখা হলো দাদার সঙ্গে। মাহি দাদাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
– “দাদা ও আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ও চলে যাচ্ছে অ্যামেরিকা। আমি থাকতে পারব না ওকে ছাড়া। আমাকে ওর কাছে নিয়ে চলুন না দাদা! আমি পারব না ওকে ছাড়া থাকতে!”
এই প্রথম মাহি সব লাজ শরম ভুলে দাদার বুকে পড়ে নিজের ভালোবাসার বর্ণনা করল। যা দেখে আলজাহ সাহেব প্রচন্ড অবাক হন। নাতিকে শান্ত হতে বলে তার কাছে জিজ্ঞেস করেন মূল ঘটনা কী তা জানার জন্য। মাহি সব কিছু বলতেই আলহাজ যেন স্তব্ধ হয়ে যান। বুকের ধন ছিল এক নাতি। কিছুদিনের সে জন্য দেশে ফিরেও আসেনি তাদের সঙ্গে দেখা করতে। আবার চলে গেছে সে দূরে৷ যেখানে চাইলেও নাতিটার কাছে তিনি যেতে পারবেন না, একটাবার তাকে দেখতে পারবেন না। আজ তার আরও একটা ধনও সেই দূরেই চলে যাবে! সে থাকবে কী করে? তার বাবা-মা একজনকে হারিয়ে যে অন্যজনকে নিয়ে বেঁচে ছিল। তারাই বা সহ্য করবে কী করে? সব কিছু কেমন নিমিষে ঝাপসা হয়ে গেল আলহাজের চোখের সামনে। মাথা ঘুরে উঠতেই তিনি দ্রুত সোফায় বসে পড়লেন। মাহি চিল্লিয়ে উঠল মাকে ডেকে। রাত নয়টা অবধি মাহি দাদার পাশে বসে রইল। পরিবারের সবাই জেনেছে আশফির সিদ্ধান্ত সম্পর্কে। আলহাজ তাঁর বন্ধু আবরারের কাছে ফোন করে এই সম্পর্কে জানালে তাঁরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন আশফির প্রতি। এ সিদ্ধান্তে তাঁরাও ব্যথিত। কিন্তু আশফি যে কোনো কারণ ছাড়া এমন একটি সিদ্ধান্ত নেয়নি তা আর কেউ বিচার করল না। আর আশফিকে বোঝানোর মতো সাধ্যিও যে তার পরিবারের নেই, তা জেনে মাহির পরিবার খুবই ক্ষুব্ধ হলো আশফির প্রতি। কিন্তু দুজনের সম্পর্ক তো এভাবে নষ্ট হয়ে যেতে দিতে পারে না তারা। মাহি তার স্ত্রী। এখন সর্বোচ্চ অধিকার তার মাহির প্রতি। সে চাইলেই এমন বহু তাদের অপছন্দের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাদের ভালোবাসার জোর দেখাতে গিয়ে তো তারা এই দুজনের সম্পর্ক নষ্ট করতে পারে না।

আলহাজ লিমনকে আদেশ করে মাহিকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আশফির কাছে। বাড়ির বাইরে যখন পা ফেলে মাহি, পেছন থেকে হু হু করে কেঁদে উঠে তার মা। মাহি ছুটে আসে আবার তার মায়ের বুকে। মাকে ছেড়ে আশফির বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত বারোটা বেজে যায়। আশফি নিচে এসে লিমনের সঙ্গে কথা বলে তাকে ভেতরে আসাতে অনুরোধ জানায়। কিন্তু লিমন শুধু সৌজন্য বজায় রেখে মাহিকে রেখে চলে আসে। আশফি বুঝতে পারে তার এই সিদ্ধান্তে কেউই সন্তুষ্ট নয়।

মাহি আগেই রুমে এসে চলে যায় ট্যারেসে। মুখ চেপে কান্না করতে থাকে সে। আশফি রুমে এসে তাকে ট্যারেসে দেখেও শুয়ে পড়ে। ইচ্ছা করেই সে যায় না মাহির কাছে। রাত যখন দেড়টা, আশফি উঠে ট্যারেসে যায়। মাহি সেই আগের স্থানেই বসে আছে। তার কাছে এসে বলে,
– “রুমে এসো মাহি।”
মাহি নিশ্চুপ। গালদুটো চিকচিক করছে তার নোনাপানিতে। আশফির ডাকে সে ফিরেও তাকাল না তার দিকে। মাহি উঠে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আশফিকে বলে,
– “আমি আজ রাতটা এখানেই থাকতে চায়।”
– “ঘুমিয়ে থাকলে কিছু বলতাম না। ঘুমাচ্ছো না যেহেতু, তো শুধু শুধু ট্যারেসে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। চলো রুমে চলো।”
মাহির কান্নাটা বাড়তেই থাকল শুধু। একটুও নড়ল না সে আর কিছু বলল না। কিছুক্ষণ আশফি তার পেছনেই দাঁড়িয়েই রইল। তারপর তার কাছে এগিয়ে এসে পেছন থেকে তাকে জাপটে ধরে কপালের এক পাশটাতে চুমু খেয়ে মাহিকে বলল,
– “আমাকে একটু সময় দেওয়া প্রয়োজন তোমার।”
এটুকু বলে সে নীরব রইল। তারপর হঠাৎ মাহির ঘাড়ের মাঝ থেকে চুলগুলো সরিয়ে নিয়ে সেখানে তার ওষ্ঠের উষ্ণ স্পর্শ দিতে থাকল। মাহি তার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই আশফি তার গালদুটো মুছে দিয়ে বলল,
– “এতদিন পর কি এই গাল, এই ঠোঁটজোড়া থেকে শুধু নোনা স্বাদ নিতে হবে আমাকে?”
মাহি কান্নারত কম্পিত কণ্ঠে তাকে বলল,
– “আমি এখানেই থাকতে চাই কিছুক্ষণ।”

……………………………..
(চলবে)
– Israt Jahan Sobrin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে