তুই হবি শুধু আমার ২ পর্ব-০৫

0
1317

#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)💙
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_০৫

আজ সকালে আরশান এসেছে অয়ন্তিদের বাড়িতে। বিয়ের কেনাকাটা করার জন্য ফারিয়া নিজের হবু পুত্রবধুকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চান। সারিম স্কুল থেকে ফিরে আরশানকে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে ব্যাগ জুতা খুলেই সোফার ওপর বসে পড়লো। আরশান মৃদু হেসে পাশে রাখা প্যাকেটটা সারিমকে দিলো। সারিম প্যাকেটটা নিয়ে দেখলো তাতে বিভিন্ন ধরনের খেলনা। প্লেন, কার, গান(বন্দুক)। সারিম বন্দুকটা আগে বের করে সেটা আরশানের দিকে তাক করে বলে,

-“জানো দাদাই।ওহ! ভাইয়া, আসলে আমি আর আমার আপিয়া সবসময় বলতাম, আমাদের ভাইয়া থাকলে তাকে দাদাই ডাকবো। তাই ভুল করে বলে ফেললাম। স্যরি। ”

-“তুমি দাদাই ডাকো সারিম। সমস্যা নেই। ”

-“আচ্ছা। জানো দাদাই আমার আপিয়ার কাছে এমন বন্দুক আছে। কিন্তু আসল বন্দুক। নকল না, সে বন্দুক থেকে গুলিও বের হয়। ”

-“তাই? আর কি কি আছে তোমার আপিয়ার? ”

-“আপিয়ার কাছে অনেক বড় বড় বই আছে, ছু’রি, রড, লাঠি,বড় বড় তলোয়ার আছে। রাজাদের যেমন থাকে না? ঠিক তেমন। ”

-“বাপরে! এতকিছু আছে? ”

-“হুম। আমি বড় হলে আপিয়া ওগুলো আমাকে দেবে।”

-“তুমি কি করবে ওগুলো দিয়ে? ”

-“আপিয়া যেখানে চাকুরি করে, আমিও সেখানে গিয়ে চাকুরি করবো। ওখানে বন্দুক, ছু’রি চাকু দিয়ে, ঢিসুম ঢিসুম করে কাজ হয়।”

-“না। তুমি ওই চাকুরি করবে না। ” ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল রোজ।

সারিম অভিমানি দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করতেই রোজ হেসে সবটা সামলানোর জন্য বলল,
-” তুমি ডাক্তার হবে। ছু’রি, কা’টাছেড়ার কাজ ওখানেও হয়। বুঝেছ? ”

-“ঠিক আছে। আমি এগুলো নিয়ে ঘরে যাই? ”

-“যাও। ”

সারিম চলে যেতেই রোজ আরশানের সামনে এসে বসে। আরশানকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সে মলিন হেসে বলে।
-“গুড চয়েজ।”

আরশান থতমত খেয়ে তাকালো। বাচ্চা রোজ অনেক বড় হয়েছে এখন। শেষ যেবার দেখেছিল রোজের বয়স তখন ছয়, কি সাত। চেহারার কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আগের থেকেও গায়ের রঙ উজ্জ্বল হয়েছে, গলার স্বর পরিবর্তন হয়েছে, তাকানোর স্টাইল বদলেছে। অল্পতে কেঁদে ফেলা বাচ্চাটার কঠিন রূপ বেশ আশ্চর্যজনক। এই মেয়েটা কি সেই মেয়ে? যে অয়ন্তির সঙ্গে প্রতিদিন ছাদে এক্কাদোক্কা খেলতো, পড়ে গেলে নাক টেনে কেঁদে উঠতো। অয়ন্তির থেকেও যে মেয়েটা বেশি লাজুক ছিল সে এখন অয়ন্তির পরামর্শদাতা। বাড়ির কোনো কাজ তাকে জিজ্ঞেস না করে করা হয় না। কতটা মানসিক পরিপক্বতা তাঁর মাঝে এসেছে। বাবা মায়ের মৃত্যুতেই কি এত পরিবর্তন এনেছে? আরশানের নিরবতা লক্ষ করে রোজ বলে ওঠে,

-“আমাকে বোধ হয় চেনেন নি। আমি সাইরাহ্ সীরাত রোজা। সাফোয়ান আনসারী ও মিফতাহুল মেহরিন রেণুর বড় মেয়ে। অয়ন্তির বোন। ”

-“তোমাকে চিনি আমি। ”

-“কিভাবে? আমি তো আপনাদের চিনি না। ”

-“তোমার মনে নেই হয়তো। তোমাকে ছোটবেলায় ললিপপ কিনে দিতাম আমি। ”

-“আজ আনেননি? ”

-“এখনও খাও নাকি? ”

-“না খেলেও, আনলে গুরুত্ব বোঝা যেত। যাই হোক, হীরামনকে নিয়ে যাবেন শুনলাম,সারিমও বায়না করছে যাবে বলে। ওকে কি নিয়ে যাওয়া যাবে? ও শান্ত বাচ্চা একদম দুষ্টুমি করে না। জ্বালাবেও না। শুধু ঘুরতে যাবে তাই আমিও না করতে পারছি না। আমি তো ওকে নিয়ে যেতে পারি না। হীরামনই নিয়ে যায়। আজ হঠাৎ বায়না করছে কেন বুঝতে পারছি না। ওকে না বলতে কষ্ট হয় আমার। বাবাই মামনির জন্য এমনিতেই কষ্ট পায়, যদি ওর ইচ্ছেপূরণ না করি ছেলেটা আরও কষ্ট পাবে। ”

আরশান চুপচাপ শুনছে।মেয়েটার কন্ঠস্বর দারুন স্পষ্ট। রেডিও জকি হিসেবে তাকে এ্যাপোয়েন্ট করলে মন্দ হয় না।রেডিও সেন্টারে একজন আরজে প্রয়োজন। সপ্তাহে একদিন দেড় ঘন্টার শো করবে, মাসে ত্রিশ হাজার বেতন। অফারটা কি করবে সে? অপমানিত হবে না তো রোজ? অনেক ভেবে আরশান ঠিক করলো এসব চিন্তা বাদ দেবে। হবু শালিকা মাইন্ড করলে বিপদ। তবে রোজ আরশানের চেহারা দেখে সবটা বুঝে ফেললো এবং তা সম্মুখে বলে দিল,

-“রেডিও সেন্টার আমার জন্য না। ”

আরশান হতচকিত দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো। ভয়ে গা কেঁপে উঠলো। রোজের আচমকা বলা কথাটা ওর পুরো ভাবনা নাড়িয়ে দিলো। মনে মনে কি ভাবছে এটা রোজ কিভাবে জানলো? রোজ আবারও হেসে বলে,

-“আমি মেন্টালিস্ট নই। কিন্তু মাঝে মাঝে চেহারার ভাব ভঙ্গি দেখে অনেকটা বুঝে যাই। আপনাদের একটা বড় রেডিও স্টেশন আছে। আপনিই ওটার দেখাশোনা করেন। আপনার ভাবনাচিন্তা সব ওটা ঘিরে। তাই স্বল্প অনুমানের বশে বলেছি কথাটা। ভয় পাবার দরকার নেই। আমি এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিচ্ছি। বসুন, কফি পান করুন। হীরামন চলে আসবে। ”

আরশান রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো। সত্যিই ভয়ে ঘেমে গেছে সে। রোজ এসির পাওয়ার বাড়িয়ে চলে গেলো। অয়ন্তি আর সারিম গুছিয়ে নিচে নামে। অয়ন্তিকে দেখে আরশান বাঁকা হাসে। অয়ন্তি লজ্জায় কুকড়ে গেলো। আরশানের দেওয়া শাড়িটাই আজ সে পড়েছে। লালরঙা শাড়িটির সঙ্গে মিলিয়ে চুড়ি পড়েছে। চোখে কাজল, চুল খোঁপা করা। সুলেমান সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ওরা।

🍁🍁🍁

বিছানায় বসে পুরোনো দিনগুলোর কথা ভাবছিল রোজ। গোয়েন্দা দেখলেও যখন ভয় লাগতো, যখন সে জানতো না তাঁর বাবা গোয়েন্দা। পুলিশ দেখামাত্র যখন সে দৌড়ে পালাতো তখন আনসারী সাহেব হাসতেন আর বলতেন, সব পুলিশ খারাপ হয় না। রোজ শুনতো না। বলতো, সব পুলিশ খারাপ, ঘুসখোর, অকারণে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করে। যেদিন আনসারী সাহেব জানতে পারলেন তাকে মা’রার পরিকল্পনা করা হচ্ছে সেদিন তিনি রোজকে ডেকে নিজের পেশার কথা, সব দায়িত্ব কর্তব্যের কথা জানিয়েছিলেন। রোজ বলেছিল সে তাঁর বাবার মত হতে চায়। এত দ্রুত ইচ্ছেটা বাস্তবে রূপ নেবে তা রোজ কল্পনাও করেনি।

রোজের বয়স এখন তেইশ! তেইশ বছর বয়সে সে সবে মাত্র অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে? না। রোজের ইন্টার এক্সাম হয় যখন ওর বয়স উনিশ। সে সিলেটের এক ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল। সেই বছরই রোজের বাবাকে হত্যা করার পরিকল্পনা সফল করেন তাঁর শত্রুরা। রোজ তখন দিশেহারা হয়ে যায়। সারিম ছিল ওর একমাত্র কাছের মানুষ।

রোজ বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল এবং সারিমের বায়োলজিক্যাল বাবা ছিলেন একজন খু’নি। মা ছিল না সারিমের। সারিমের বাবা যখন আনসারী সাহেবের হাতে নিহত হয় সারিম তখন দুধের শিশু। সারিমকে দেখে মায়া হয় আনসারী সাহেবের। তাই তিনি সারিমকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। নিজের পরিচয়ে বড় করেন।যেন সে একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন পায়।

রেণুর খোঁজ পাওয়া যায়নি। সবাই মনে করে আনসারী সাহেবকে মা’রার সময় রেণু চলে আসায় তাকেও হত্যা করা হয়েছে এবং লা’শটা গুম করে দেওয়া হয়েছে। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর সারিমের দায়িত্ব এসে পড়ে রোজের ওপর। তিন বছরের বাচ্চাকে নিয়ে সে ঢাকায় চলে আসে। বাবার পেশাকে নিজের করতে তিনবছর লেগে যায়। চারবছরের পরিশ্রম শেষে সে আবারও ডোনেশন দিয়ে নিজের গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করতে এসেছে। সেদিক থেকে হিসেব করলে রোজ মুগ্ধতারই বয়সী। কিন্তু রোজের বয়সের এই সূক্ষ্ম বিষয়টা অত্যন্ত গোপনীয় বলে সেটা শুধু প্রিনসিপ্যাল স্যারের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করা হয়েছে। নিজের নামের পাশ থেকে আনসারী শব্দটাও বাতিল করা হয়েছে পরিবারের জন্য। তবে সারিমের নাম সারিম আনসারী রিজভী রেখেছিলেন আনসারী সাহেব নিজে। তাই ওর নাম বদলানো হয়নি। ইউনিটের সবথেকে অল্পবয়সী অফিসার রোজ। সবার মতভেদ আছে এই বিষয়টি নিয়ে। অনেকে বলে এত অল্প বয়সে, সবেমাত্র ভার্সিটিতে উঠে কি করে এমন একটা চাকুরি জুটিয়েছে সে? নানারকম তর্কবিতর্কও শুনেছে সে। সমালোচনা শুনেছে অন্যান্য অফিসারের কাছ থেকে। বিষয়টা হচ্ছে বাবার চাকুরি ছেলে পেতে পারতো যদি যোগ্যতা থাকে, সেদিক থেকে রোজ সকল ধরনের বাঁধাবিপত্তি পার করে নিজের যোগ্যতায় বাবার পেশাকে নিজের পেশা করেছে। পাছে লোকে কি বলল তাতে কি এসে যায়?

তবে এখানে শুধু রোজের যোগ্যতা না, আনসারী সাহেবের ক্ষমতাও লেগেছিলো। আনসারী সাহেব আগে থেকেই আইজি সাহেবকে রোজের কথা বলে রেখেছিলেন। তাই আইজি সাহেব নিজে রোজকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, রোজের দেখভাল করেছেন। আর আজ রোজ সফল। বাস্তবে এমন চিত্র বিরল হলেও রোজ সেটা বাস্তবে করতে পেরেছে এটাই তো অনেক।

সংক্ষেপে বলা যায়, রোজ তাঁর বাবার পরিবর্তে এই পেশায় নিয়োজিত। নিজেকে সে কঠিন করেছে, বদল করেছে নিজ প্রচেষ্টায়।

তবে রোজের উদ্দেশ্য ভিন্ন। শুধু বাবা-মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে সে ইউনিটে জয়েন করেনি। প্রতিশোধ তো যখন তখন নেওয়া যায়,কারন হত্যাকারীদের রোজ চেনে। কিন্তু রোজ চায় তাদের খুজে বের করতে যাদের ছাড়া রোজ অসম্পূর্ণ!

🍁🍁🍁

বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে লম্বা শ্বাস নিলো ছেলেটি। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে নিজেদের রিসোর্টে উঠলো। এখানে তাদের বাড়ি আছে তবে তা সিলেটে। ঢাকায় রিসোর্ট আছে শুধু। সে আপাতত ঢাকা ছাড়তে চায়না। সেজন্য বাড়ি ফিরে সময় নষ্ট না করে ঢাকাতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। ছেলেটা পেশায় কন্ঠশিল্পী। ফেসবুকে একটা মেয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিনের আলাপ তাঁর। মেয়েটাকে সে দেখেনি, কখনও কন্ঠ শোনেনি। মেয়েটার আইডির নাম ছিল “মনিমালা”। সে নাম দিয়েছিলো ‘জিয়নকাঠি’। কারন মেয়েটা আশার পর ওর জীবন বদলে গিয়েছিল। হতাশার থেকে মুক্তি ও বাঁচবার নতুন উপায় ছিল মেয়েটি। এজন্যই তাঁর নাম সে জিয়নকাঠি রেখেছিল যার অর্থ “বাঁচবার উপায়বিশেষ।” রূপকথায় বর্ণিত প্রাণসঞ্চারের মন্ত্রপূত কাঠিবিশেষ। মেয়েটিও তাঁর কাছে ঠিক রূপকথার মত ছিল। যাকে সে সর্বদা কল্পনা করে গেছে, তাঁর সম্পর্কে কিছুটা জেনেছে, কিছু তথ্য শুনেছে। তবে বাস্তবে তাকে পায়নি। না দেখে, না শুনে এক অচেনা, অজানা মেয়ের প্রেমে পড়ে যাবে,তা কস্মিনকালেও ভাবেনি ছেলেটি। মেয়েটা কেমন? বয়স কেমন? দেখতে কেমন কিছুই জানে না। এমনকি মেয়েটা তাকে ভালোবাসে কিনা সেটাও জানে না সে। মেয়েটাকে প্রপোজ করার পর মেয়েটি বলেছিল,

-“আমাকে না দেখে, আমার কন্ঠ না শুনে আমাকে খুজে বের করতে পারলেই আমি আপনাকে সুযোগ দেবো। কারন আমি মানুষটা সবার মত ভাবতে পারিনা। সবাইকে ভালোবাসতে পারিনা, ভীর! আমার জীবনটা সবার মত সহজ নয়। কঠিন! ভীষণ কঠিন! ”

ছেলেটার আইডির নাম ছিল ভীর! ছেলেটাও নিজের সম্পর্কে তেমন কিছু বলেনি মেয়েটাকে। টুকটাক ভালো মন্দ কথাতেই সীমাবদ্ধ ছিল তাদের ইন্টারনেটওয়ালা ফ্রেন্ডশীপ। তবে এই বন্ধুত্ব শেষ পর্যন্ত কোন দিকে মোড় নেবে? সেটা একমাত্র সৃষ্টিকর্তা জানেন।

চলবে?

[নাইস, নেক্সট কমেন্ট না করে, এক দু লাইনে অনুভূতি জানিয়ে যাবেন। ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে