জীবনের ডায়েরী পার্ট: ১

0
5387

জীবনের_ডায়েরী

পার্ট: ১

লেখিকা: সুলতানা তমা

আজ সকাল থেকেই আকাশটা মেঘলা ঠিক আমার মনের মতো, আমার মনের আকাশটাও আজ মেঘলা জানিনা কেন কিছু ভালো লাগছে না তাই নাস্তা না করেই বেড়িয়ে পড়লাম এতিমখানার উদ্দেশ্যে।

আমি তমা একাই থাকি একটা এতিমখানায় বাচ্চাদের দেখাশুনা করি আর দুই একটা টিউশনি করি এতেই আমার দিন চলে যায়, এর চেয়ে বেশি কিছু নেই আমার পরিচয় দেবার মতো, একসময় সব ছিল এখন আমি একা খুব একা

এতিমখানায় চলে আসলাম ভালো লাগছে না কিছু তাই মাঠের এক কোনায় গিয়ে বসলাম, হঠাৎ ব্যাগে থাকা ডায়েরিটার কথা মনে পড়লো, ডায়েরিটা আমার একজন প্রিয় মানুষ আমাকে দিয়েছিলেন খুব যত্ন করে রেখে দিছিলাম কিছুই লিখিনি আজ খুব লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে, নিজের জীবনের গল্পই না হয় লিখবো আর ডায়েরিটার নাম দিবো জীবনের ডায়েরি।

ডায়েরিটা খুলে লেখা শুরু করলাম আমার জীবনের গল্প গুলা, ডায়েরির প্রথম পাতায় বড় করে লিখলাম “জীবনের ডায়েরি” তারপর লেখা শুরু করলাম——

আমি তমা আমার যখন চার বছর বয়স তখন আম্মু মারা যান, বাবা মেয়ে খুব একা হয়ে যাই বাবা একটা সরকারী চাকরি করেন তাই প্রতিদিন অফিসে যেতে হয় আর আমি বাসায় কাজের বুয়ার কাছে থাকি

আমার কথা ভেবে আব্বুকে সবাই আবার বিয়ে করতে বলে কিন্তু আব্বু আম্মুর জায়গা কাউকে দিতে চান না আর আমাকে সৎ মার যন্ত্রণা দিতে চান না তাই বিয়ে করতে রাজি হন নি এভাবেই চলে গেলো ছয় মাস, আমি একা বাসায় থাকি খুব কষ্ট হয় তাই নিজেই আব্বুকে বলি আমাকে নতুন আম্মু এনে দিতে তখন তো আর বুঝতাম না সৎ মা কি

আমার কথা ভেবে সবার বলাবলিতে আব্বু বিয়ে করতে রাজি হলেন

আজ আব্বুর বিয়ে, আব্বুর এক ফুফাতো বোনের সাথে, আমি অনেক আনন্দ করছি অনেক মেহমান আসছে বাসায়, সবাই আমাকে অনেক আদর করছে, বিয়েটা হয়ে গেলো, রাতে আমার নতুন আম্মু আমাকে কোলে নিলেন সবাই খুব খুশি আমার একটা আশ্রয় হয়েছে ভেবে

আমার নতুন আম্মু আমাকে অনেক আদর করে, এভাবেই চলছে দিন আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন আম্মুই আমাকে স্কুলে দিয়ে আসে আবার নিয়ে আসে, আম্মু আমাকে এতো ভালোবাসে দেখে আব্বুও অনেক খুশি

এখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি একটু একটু বুঝতে শিখেছি সব, আম্মু প্রেগন্যান্ট আমি অনেক খুশি আমার একটা খেলার সাথী হবে কিন্তু আম্মু দিন দিন কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে আমাকে আগের মতো ভালোবাসে না আদর করে না

আজ আমার একটা বোন হয়েছে সবাই বলছে আমার মতই নাকি দেখতে হয়েছে আমি খুব খুশি, আমার পছন্দে ওর নাম রাখা হলো তুলি

যতো দিন যাচ্ছে আমার প্রতি আম্মুর অবহেলা বাড়ছে আমি বুঝি কিন্তু আব্বুকে বুঝতে দেই না

আমার পিচ্ছি বোনটা এখন আস্তে আস্তে হাটতে পারে, তুলি যতো বড় হচ্ছে আমার প্রতি আম্মুর অবহেলা ততো বাড়তেছে

এখন আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি অনেক কিছুই বুঝি, আম্মু এখন শুধু অবহেলাই করে না মাঝে মাঝে বকা দেয়, কাজ করতে বলে না পারলেই তাপ্পর দেয়

আজ আমার ১৩তম জন্মদিন আব্বু চেয়েছিলেন বড় করে অনুষ্ঠান করতে আম্মু বাধা দিলেন বললেন শুধু শুধু টাকা নষ্ট করার কি দরকার, কথাটায় আব্বু অনেক কিছু বুঝে গেছেন, আমি যে সব নিরবে সহ্য করি সেটাও বুঝলেন, রাতে আব্বু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরলেন একটা কেক নিয়ে আসলেন খুব সুন্দর, আম্মু আব্বু তুলি আর আমি মিলেই ছোট করে আমার জন্মদিন পালন করা হলো, আব্বু আমাকে অনেক গুলো নতুন ড্রেস আর এই ডায়েরিটা জন্মদিনে উপহার দিলেন, সেদিন থেকে ডায়েরিটা খুব যত্ন করে রেখেছি কারন আমার আব্বুর দেওয়া উপহার এটা আমার কাছে অনেক দামী।

আস্তে আস্তে বড় হচ্ছি তুলিও বড় হচ্ছে আর আমার প্রতি আম্মুর অত্যাচার বাড়তেছে, মাঝে মাঝে খুব কান্না পায় আম্মু কেন আমাকে একা রেখে চলে গেলেন আমাকে সাথে নিয়ে গেলে তো আর এতো অত্যাচার সহ্য করতে হতো না

এভাবেই দিন যাচ্ছে যতো বড় হচ্ছি ততোই আম্মুর ঘাড়ের বুঝা হয়ে যাচ্ছি আর আমার উপর আম্মুর অত্যাচার বেড়েই যাচ্ছে, অত্যাচার শুধু দিনে যখন আব্বু অফিসে থাকেন আব্বুর সামনে তেমন বকাও দেন না আমাকে

এখন আমি দশম শ্রেণীতে পড়ি তুলিকেও স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন, আম্মু প্রতিদিন তুলিকে স্কুলে দিয়ে আসেন আবার নিয়ে আসেন আর আমি স্কুল থেকে এসেই বুয়ার সাথে কাজ করতে হয় ভালোই লাগে নিজের বাসার কাজ করতে, আমার এস.এস.সি পরিক্ষা সামনেই এক মাস আছে তাই পড়ার চাপে বাসার কাজ করার সময় পাই না এতে আম্মু অনেক বকা দেয় শুধু শুনে যাই আর চোখের পানি ঝরাই

আচ্ছা আজ যদি আমার আম্মু বেচে থাকতো তাহলে কি আমাকে কাজ করতে দিতো, পরিক্ষা যেহেতু সামনে কাজ তো করতেই দিতো না, হয়তো পড়ার ফাকে মাঝে মাঝে এসে আমার কপালে চুমু দিতো, আচ্ছা মায়ের ভালোবাসা কেমন হয় সন্তান বড় হবার সাথে সাথে কি ভালোবাসা কমে যায় যেমনটা আমার নতুন আম্মুর কমে গেছে, আচ্ছা আল্লাহ আমার আম্মু কে নিয়ে গেলেন কেন আমি কি কোনো পাপ করেছিলাম যে আমার কপালে মায়ের ভালোবাসা জুটলো না, যখন চার বছরের ছিলাম তখন তো ভালোবাসা কি ভালো ভাবে বুঝতামই না আর আল্লাহ এই অল্প বয়সেই আমাকে মা হারা করলেন, এসব ভাবছি আর দুচোখ বেয়ে পানি ঝরছে এই পানি আম্মুকে হারানোর জন্য এই পানি আম্মুর স্নেহ ভালোবাসা না পাবার জন্য, যার মা নেই সেই একমাত্র এই কষ্ট বুঝবে।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে