চাঁদের_আলোয়_জোছনা_ভাঙ্গে পর্ব ৬৪

0
1587

চাঁদের_আলোয়_জোছনা_ভাঙ্গে পর্ব ৬৪
লেখা আশিকা জামান

সন্ধ্যেবেলায় ইদানীং চারপাশ’টা কেমন ঘোর অন্ধকারে ছেঁয়ে যায়। মনে হয় রাত অনেক। আহনাফ সাহেবের বুকটা কেমন যেন হুঁ হুঁ করে উঠে। ভরা ঘর শূন্য হয়ে যাওয়ার ব্যথাটা ছেলে মেয়েকে বুঝতে দেন না। নিজের ভেতরেই রাখেন।

চায়ের কাপের টুং টাং শব্দ আর ব্যাস্ত রাস্তার কোলাহল ছাপিয়ে যখন দুই ভাই বোন খুনশুটিতে মেতে উঠে। তখন ইমতিয়াজ আর আয়েশা কেমন যেন গভীর অনুরাগে চেয়ে থাকেন। মনে মনে জীবনের শেষ দিন অব্দি এই দৃশ্য দেখার বাসনা পেষণ করেন।

★★★★★

এমনই এক দিন সন্ধ্যে নামার ঠিক আগ মুহুর্তে অঙ্কনরা সবাই এল কোনরকম খবর না দিয়ে। আয়েশা হতভম্ব এমন আকস্মিক আগমনে। পুরোনো কথা ভেবে আত্নীর আপ্যায়নে কোন ত্রুটি সে রাখতে রাজি নয়।

ভরা সন্ধ্যেবেলায় নেশা ধরা ঘুমের অতলে নির্বাসিত অনন্যার ঘুম ভাঙে অঙ্কনের উষ্ণ অধরের স্পর্শে। ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে যখনই চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করতে যাবে। তখনই সুযোগ বুঝে অঙ্কন মুখ ছাপিয়ে ধরে। কানের কাছে ফিঁসফিঁস করে বলে,
” আমি! ”
অনন্যা চোখ বড়বড় করে অঙ্কনের দিকে তাকায়।
” এক্ষুণি ‘তো দিচ্ছিলে মান-সম্মানের বারোটা বাজিয়ে।”

” আমি কী করে জানব তুমি! কই বললে না’তো যে আসবে।”

” বলে দিলে আবার সারপ্রাইজ হয় কী করে!” কথাটা বলেই অনন্যার অধরে উষ্ণ চুম্বন এঁকে দেয়। এরপর সানন্দে বাহুডোরে বেঁধে ফেলে বেশ খানিকটা সময়জুড়ে।

অনন্যার নিরুত্তাপ চাহনি যখন তাকে ব্যথার সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তখনও সে নিশ্চুপ থাকে। তবে বেশিক্ষণ তা স্থায়ী হয় না। আলতোভাবে অনন্যার তুলোর মত নরম গালে দু’হাত ছুঁইয়ে অঙ্কন বলে,
” সরি অনন্যা! এই কয়েকদিন আমি অনেক ভেবেছি তোমাকে আর সবটা বলা প্রয়োজন! আমি জানি তুমি আমাকে বুঝবে। তাই আজ তোমাকে সব বলব। আমি চাইনা তোমার আমার মাঝে কোন আড়াল থাকুক।”

অনন্যা উত্তরে মৃদু হাসলো তারপর শান্ত গলায় বলল, ” আমার যে কিছু শোনার নেই অঙ্কন! যে কথা বলতে তোমার নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ করতে হয় সেই সত্যি আমি শুনতে চাই না। কোন প্রয়োজন নেই এই অপ্রিয় সত্যির। আমি সরি খুব করে সরি। সেদিন তোমাকে অহেতুক প্রশ্ন করাটা আমার উচিৎ হয়নি।”

” কেন সরি বলছো। তুমি তো কোন ভুল করোনি। উলটো আমি রেগে গিয়েছিলাম যেখানে আমার উচিৎ ছিলো তোমাকে সব বলার। দোষ আমার সরি আমি বলছি।” অঙ্কন অস্বাভাবিক ভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে এনে বলল।

” ওঁকে তুমিও সরি বলেছো আমিও সরি বলেছি কাটাকাটি! ঠিক আছে। এই প্রসঙ্গে আর একটা কথা তুমি বলবে না প্লিজ।” অনন্যা দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল।

” কিন্তু! অনন্যা..” অঙ্কন মুখ খুলতেই অনন্যা তার তর্জনী ঠেঁকিয়ে দেই সরাসরি ঠোঁট বরাবর।

” ইউ নো! তুমি দিনকে দিন আনরোমান্টিক হয়ে যাচ্ছ!” অনন্যা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল।

” না আজকে জানলাম। তো এখন কী করতে হবে? না মানে এখনই প্রুভ করতে হবে! করব…” অঙ্কন বলতে বলতে মাথা ঝুঁকিয়ে আনে।
অনন্যা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলে সাথে সাথে। চাপা স্বরে বলে, ” সরো, যে কেউ এসে পড়বে। প্লিজ।”

” তোমাদের মেয়েদের না বুঝা দায়। এই মেঘ তো এই বৃষ্টি। নিজেই গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে আবার নিজেই রেড সিগন্যালের ভয় দেখাচ্ছো।”
অনন্যা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এভাবে তাকাতে দেখে অঙ্কনের চোখেমুখে দুষ্টুমি খেলে যায়। দু’হাতে আঁজলা ভরে অনন্যার মুখটা কাছে টেনে ফিঁসফিঁসিয়ে বলল, ” ওহে সুন্দরী! তোমার রুপের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন ক্রমাগত আমার মনের এন্টেনায় রেড সিগন্যাল দিয়ে যায় আর তুমি কিনা আমায় দেখাচ্ছ ভয়!” কথাটা বলেই অঙ্কন ঠোঁট ছোঁয়ায় অনন্যার উষ্ণ অধরে।

কিছুটা সময় চোখে বুজে থাকার পর অনন্যা যখন আলতো ভাবে চোখ মেলে তাকায় তখন সরাসরি দৃষ্টি নিবন্ধ হয় দরজার দিকে। অন্বেষার চোখে চোখ পড়তেই অনন্যা তড়িঘড়ি করে ধাক্কা দিয়ে অঙ্কনকে সরিয়ে দেয়।
★★★★★★

এই অনাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখার বিন্দুমাত্র আগ্রহ অন্বেষার ছিল না। সত্যিই তার লজ্জা লাগছে। উফ্ সে তো চলেই যাচ্ছিলো। অনন্যা আপুকে কে বলেছিল তাকাতে! ইশ্ চোখে চোখ পড়ার কী খুব দরকার ছিল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে পা বাড়াতেই এলোমেলো হাটার গতি দ্রুত বাধাপ্রাপ্ত হয় সজোরে ধাক্কা খেয়ে। চোখ তুলে তাকায় অনিক ধাক্কা খেয়ে ব্যালেন্স রাখতে ওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
” আপনি! এভাবে হুড়মুড়িয়ে কোথায় যাচ্ছেন।”

অন্বেষা চট করে কোন উত্তরই দিতে পারে না। অনিক নিজে থেকে আবার বলল,
” অনন্যার কাছে যাবেন। আপনি তো ওর ঘরটা পাস করে চলে এলেন। আসুন আমার সাথে।”

অন্বেষা চোখ বড়বড় করে তাকায় অনিককে আটঁকাতে হবে যেকোন মূল্যে।
কোমল হাতের হ্যাঁচকা টানে অনিক চোখ ঘুরিয়ে তাকায়। অন্বেষা মৃদু কাঁপছে। আয়তাকার চোখ দু’টো কোন কারণে বিষম খেয়ে আছে। কমলা রঙা ঠোঁট দু’টো বার বার খুলে যাচ্ছে। কিছু একটা বলার অভিপ্রায় নিয়ে মুখমণ্ডল আরক্তিম হয়ে উঠছে।
” অনন্যা আপুর ওখানে যাব না। অন্য কোথাও চলুন।”
” মানে, অনন্যার কাছে যাবেন না! ” অনিক স্বগতোক্তি করে আবার বলল, “তাহলে বলছেন আমার কাছে এসেছেন?”

” কেন! আপনার কাছে আসতে নেই?”

” না তা বলতে চাই নি। আসুন ব্যালকনিতে যাই।”
অনিকের পেছন পেছন অন্বেষা হাটে।

★★★★★

বাঁধা পেয়ে অঙ্কন প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়।
” কী হলো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে কেন?”

” তো কী করতাম, অন্বেষা দেখছিল তো! ছিঃ কোন কান্ডজ্ঞান নেই, তোমার! না করেছিলাম না, তোমাকে?” আহ্লাদে সুরের সাথে অঙ্কনের বুকেও আলতো হাতে কতগুলো আহ্লাদী ঘুষি পড়ছিলো।

” দেখলে দেখবে! তোমার সমস্যা কী? ওঁ তো আর ইচ্ছে করে কিছু দেখিনি। তোমাকে কে বলেছে এদিক ওদিকে তাঁকাতে!” কথা বলতে বলতে অঙ্কন উঠে দাঁড়ায়। শার্টের কলার ঠিঁক করতে করতে অঙ্কন বলল,

” আসলে কথা হলো তোমার কোন আগ্রহই নেই। তুমি ফিল করতেই পারোনি। ধূর আমারি ভুল হয়েছে। ভুল সময়ে ভুল কিছু করে ফেলি।”

অনন্যা অনভিপ্রেত তাকায়। চমকে উঠলেও সাথে সাথে নিজেকে সামলায়। অঙ্কনের অভিমানী মুখটা দেখতে আজ তার কষ্ট পাওয়ার বদলে ভালো লাগছে। মনে মনে হিসেব কষতে থাকতে ঠিক কতগুলো দিন পর অঙ্কন ঠিক এভাবে অভিমান ভরে কথা বলছে! নিনিত বলতো, ” ভালোবাসায় অভিমান থাকা ভালো তাতে ভালোবাসা কমে না বরংচ বাড়ে।”

অনন্যা কিছু বলতে চায় কিন্তু অঙ্কন তার পূর্বেই বলে উঠে,
” নীচে চলো! মা, বাবা এসেছে, তোমার খুঁজ করছে। আমি তোমায় ডাকতেই এসেছিলাম। এমনিতেও দেরি হয়ে গেছে। আমি আসছি। তুমিও এসো।” কথাটা বলেই অঙ্কন হনহন করে হেটে চলে গেলো।

অনন্যা বিবশ নয়নে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। আপনমনে বিড়বিড় করে বলল,
” কারণ ছাড়াই যখন তখন রেগে যাবে! যেন সব দোষ আমারই হতে হয়। উল্লুক কোথাকার! ভাল্লুক যাচ্ছে তাই।”

★★★★★★

” কী ব্যপার তখন আটঁকালেন কেন বললেন না তো!”

অন্বেষা নির্নিমেষ তাকায়।” আমি কতক্ষণ ধরে আপনার সাথে এটা ওঁটা বলছি আপনি কোন দিকেই তাল দিচ্ছেন না। সেই একই প্রশ্নে আছেন এখনো!”

অনিক হো হো করে হাসতে হাসতে বলল, ” আপনি হেজিটেট না করে বললেই পারতেন যে ওখানে আপনার ভাইয়া আছে।”

অন্বেষা কুঞ্চিত চোখে তাকায়। অনিক মৃদু হেসে বলল,
” তা না করে অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার সাথে টাইম স্পেন্ড করছেন, আমি কিন্তু বুঝতে পারছি।”

মুহুর্তেই অন্বেষার চোখ মুখ লাল হয়ে উঠে। চোখ বন্ধ করে রাখে কিছুক্ষণ।
” হ্যাঁলো মিস, আমাকে কী আপনার সেইরকম টিপিক্যাল ভাই মনে হয়। আপনার ভাইয়ার সাথে আমার বোন প্রাইভেট টাইম স্পেন্ড করছে দেখে রিএক্ট করব?”

” আপনাকে কে বলেছে যে আমি অনিচ্ছা নিয়ে আপনার সাথে টাইম স্পেন্ড করছি? অনিচ্ছা বোধ হয়, আপনার হচ্ছে। ক্লিয়ার করে বলুন। বাই দ্যা ওয়ে, আপনার গার্লফ্রেন্ডের নিষেধাজ্ঞা আছে না-কি! যে অন্য মেয়েদের সাথে কোনরকম কথাবার্তা বলা বারণ। ”

অনিক চোখ কপালে তুলে বলল,
” গার্লফ্রেন্ড সেটা আবার কবে থেকে হলো। ” তারপর কিছু একটা মনে করার ভঙ্গিতে বললো,
” বাই এনি চান্স! আপনি মেধার কথা বলছেন না তো? ওহ্ আল্লাহ মেধা আর আমি!” অনিক হো হো করে হেসে উঠলো।

অন্বেষা হতবিহ্বল হয়ে তাকায়। ভুল কিছু বলে ফেলার যন্ত্রণার চেয়ে এবার তার বড় সুখকর স্বস্তি হচ্ছে।
” তা হলে বলছেন, উনি আপনার গার্লফ্রেন্ড নন।”
” না।” অনিক আবার হাসছে। হাসি দেখে মনে হচ্ছে দারুণ রকমের জোকস শুনে ফেলেছে।
অন্বেষার এবার রাগ লাগছে।
” আমি গেলাম, আপনি থাকেন।” কথাটা বলেই সে নীচে নেমে যায়। একটুপর অনিকও নেমে আসে।
চলবে…

অনেক দিন রাইটিং ব্লকে থাকার পর লেখায় মন বসলো। প্লিজ কেউ আবার বকা দিয়েন না।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে