#চন্দ্রকণার_রাহা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৫
শাহিয়ান হুট করেই গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
“আজ রাতে তোমাকে কিছু কথা বলবো। আশা করছি তোমার সমস্যার সমাধান সেখানেই হবে।”
নিত্তিকা ভ্রুকুচকে তাকালো শাহিয়ানের দিকে। শাহিয়ান তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলল,
“নিজেকে ঠিক করে নেও। মেহমান আসতে শুরু করছে।”
বলেই শাহিয়ান উঠে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবী ঝাড়া দিলো। নিত্তিকা কিছুটা থমকে দাঁড়িয়ে রইলো।
———————
রাতের প্রায় শেষভাগ হতে চলল। শাহিয়ান দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার কাণিশ ঘেঁষে। নিত্তিকা বসে আছে চেয়ারে। শাহিয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি আর কখনো তোমার বড় বোনের কল রিসিভ করবেনা।”
নিত্তিকা ভ্রুকুচকে বলল,
“কেন!”
শাহিয়ান ফোন হাতে নিয়ে একটা নাম্বারে কল দিয়ে ফোনটা নিত্তিকার হাতে ধড়িয়ে বলল,
“আমি কাল থেকে ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি বেশ ক্লান্ত লাগছে। সব কাহিনী কলের অপরপাশের জন তোমাকে বলে দিবে। নো টেনশন বেইবি। রেডি ফর এ টুইস্ট সুইটহার্ট।”
বলেই ভাবলেশহীন ভাবে রুমে চলে গেল। নিত্তিকা অবাক হয়ে ফোন কানে নিতেই একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো,
“ভালো আছো তো নিত্তিকা!”
নিত্তিকা কপাল কুচকে বলল,
“কে আপনি?”
মেয়েটা আরামে চেয়ারে বসে টেবিলের উপর দু পা তুলে বলল,
“আমি মিষ্টি, তুমি আমাকে চিনবেনা সুইটি। তারচেয়ে বরং তুমি আমার কথা গুলো মন দিয়ে শোনো। ওও আর একটা কথা, কথার মাঝে কথা বলবেনা। ঠিক আছে?”
নিত্তিকা দ্বিমত করবে ভেবেও বলল,
“আচ্ছা”
মিষ্টি বলতে লাগলো,
“আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো শাহিয়ানের বড় ভাই সারোয়ার। ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড় হয়েছি দুইজন। মাস্টার্স এর শেষের দিকে সারোয়ার একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে। মেয়েটা সদ্য অনার্সে উঠেছিলো। মেয়েটাই সারোয়ারের পিছু ঘুরতো। পরে একসময় সারোয়ার মেনে নেয়।”
মিষ্টি খানিকটা দম নিলো। সমস্ত কিছু যেন সে নিজের চোখের সামনে দেখছে। কথাগুলো দলা পাকিয়ে গেছে। শাহিয়ান বললেই পারতো নিত্তিকাকে। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“জানো তো কবি বলেছে ছেলে মেয়ে কখনো বন্ধু হতে পারেনা। প্রথমে আমি এটা বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু দিন যত যাচ্ছিলো কথাটা আমি মানতে শুরু করেছিলাম জানো। কারণ…!”
মিষ্টির কথার মাঝেই নিত্তিকা বলে উঠলো,
“আপনি খুব ভালোবাসতেন ভাইয়াকে তাইনা।”
মিষ্টি হাসলো নিত্তিকার কথা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“একতরফা ভালোবাসা ভিষণ কষ্টকর। যে করে সেই বুঝে। দিন যাচ্ছিলো সারোয়ার মেয়েটার উপর দুর্বল হয়ে পরছিলো। মেয়েটা পড়াশোনা থেকে শুরু করে নোট করে দেওয়া সবটাই করতো। সপ্তাহে সপ্তাহে সপিং, রেস্টুরেন্ট সবটাই হয়েছে। মেয়েটা কিছু বলার আগেই সারোয়ার সবটা করতো। জানো তো আমার সামনে যখন এসব বলতো তখন আমার খুব কষ্ট হয়েছিলো।তবুও হাসিমুখে সবটা মেনে নিয়েছিলাম। ভালোবাসা তার ভালোবাসার কাছে ভালো ছিলো আর কি চাই বলো। আমি চলে গিয়েছিলাম বিদেশে। পরবর্তীতে সারোয়ারের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলেও হয়ে উঠেনি। দুই বছর পর ফিরে এসে শুনি সারোয়ার মারা গেছে।”
মিষ্টির কথা আটকে গেল। নিত্তিকাও থমকে গেল। মিষ্টি কান্না করে দিয়েছে। নিত্তিকা অস্থির কন্ঠে বলল,
“আপু শান্ত থাকুন প্লিজ। আর ভাইয়া কি ভাবে মারা গেল কিছু জানতে পেরেছিলেন। আর ওই মেয়েটা, ওই মেয়েটার কি খবর!”
মিষ্টি নাক টেনে এক গ্লাস পানি খেলো। হুট করেই হেসে বলল,
“ওই মেয়ে আর কি বিন্দাস ছিলো।”
নিত্তিকা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“মানে!”
মিষ্টি আবারো বলতে লাগলো,
“মেয়েটাই সারোয়ারের খুনি।”
নিত্তিকা অবাক হয়ে হা হয়ে রইলো বেশ খানিকক্ষণ। কি বলবে বুঝতে পারলো না। মিষ্টির কথাগুলো যেন কানে বাজছে রীতিমত। মেয়েটা কি বলছে এসব?
মিষ্টি তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“মেয়েটা শুধু খেলেছে সারোয়ারকে নিয়ে। যখনি সারোয়ার বিয়ের কথা বলে তখনি মেয়েটা সারোয়ারকে ইগনোর করতে শুরু করে। সারোয়ার জোর করায় সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় সে। সারোয়ার পাগল প্রায় হয়ে উঠেছিলো। মানসিক ভাবে দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে গেছিলো ও। এতো মানসিক চাপ নিতে না পেরে আত্ম*হত্যা করে ও।”
মিষ্টি কান্না করছে। নিত্তিকার চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পরলো। আচ্ছা খুব কি ক্ষতি হতো যদি মিষ্টি সারোয়ারকে পেতো।নিত্তিকার মাথার ভেতর যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। মিষ্টির শেষ কথাগুলো তার কানে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো বারবার,
“মেয়েটাই সারোয়ারের খুনি!”
তার আঙুল শক্ত হয়ে এঁটে গেল ফোনে। গলার স্বর কাঁপছে থরথর করে।তবু নিজেকে সামলে বলল,
“আপনি নিশ্চিত? মানে… এটা কি প্রমাণিত?”
মিষ্টি একটু হাসল, বিষাদমাখা তিক্ত হাসি।
“প্রমাণ? সমাজ কি কখনো মানসিক অত্যাচারকে খুনের পর্যায়ে ফেলে? আত্ম*হত্যা প্ররোচনা তো শুধু কাগজে-কলমে লেখা আইন। বাস্তবে এসবের বিচার হয় না, নিত্তিকা।”
নিত্তিকা মুখটা ছোট হয়ে গেল। আসলেই তো আত্ম*হত্যার কি কোনো বিচার আছে।
মিষ্টি কিছুক্ষণ চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, যেন নিজের ভেতরের ক্ষতচিহ্নগুলোকে সামলাচ্ছে। তারপর ধীর গলায় বলল,
“মেয়েটার নাম বলার দরকার নেই, নিত্তিকা। নাম জেনে কী হবে? সে তো দিব্যি ভালো আছে, সুখে আছে, অন্য কারও জীবনে জায়গা করে নিয়েছে। অথচ সারোয়ার? সে তো আর নেই। শুধু একটা নাম শুনে কী লাভ বলো?”
নিত্তিকা কোনো উত্তর দিল না। ওর হাত থেকে ফোনটা পড়ে যেতে যেতে ধরে ফেলল। বুকের ভেতর কেমন একটা শূন্যতা লাগছিল।
মিষ্টি আবার বলল,
“আমি জানি, তুমি ভাবছো যে এই গল্পটা শোনানোর মানে কী, তাই তো? শাহিয়ান কেন চেয়েছিল তুমি এসব জানো? কারণ সে চায় না, তুমি ওর ভাইয়ের মতো একই ভুল করো। শাহিয়ান কারও ওপর অন্ধবিশ্বাস করতে শেখেনি, বিশেষ করে যাদের সে একবার বুঝে ফেলেছে।”
নিত্তিকার ঠোঁট শুকিয়ে এলো। ও ধীরে ধীরে বলল,
“আপু তুমি কি বলতে চাইছো, আমার জীবনেও এমন কিছু হতে পারে?”
মিষ্টি হাসল, তিক্ত এক হাসি,
“আমি কিছু বলছি না। শুধু বলছি, সবকিছু চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস কোরো না, নিত্তিকা। বিশ্বাসটা যখন ভাঙে, তখন শুধু হৃদয় নয়, পুরো পৃথিবীটা ভেঙে পড়ে।”
নিত্তিকা একদম নিশ্চুপ হয়ে গেল। ফোনের ওপাশ থেকে আসা মিষ্টির নিশ্বাস কেমন ভারী শোনাচ্ছে।
#চলবে