#চন্দ্রকণার_রাহা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৪
নিত্তিকা হুট করেই একটা কামড়ে দিলো শাহিয়ানের বুকে। শাহিয়ান তাও ছাড়লো না। নাছোড়বান্দার মতো নিজের বুকের সাথেই মিশিয়ে রাখলো নিত্তিকাকে। নিত্তিকা অনেকটাই অবাক হলো। সে তো কম জোরে কামড় দেয়নি। ধূসর রাঙা টিশার্ট দিয়ে স্পষ্ট রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে। নিত্তিকা অবাক দৃষ্টিতে শাহিয়ানের দিকে তাকাতেই মেয়েটা যেন থমকে গেল। লোকটার চোখে পানি চিকচিক করছে। নিত্তিকা মনের মাঝে এবার অপরাধ বোধ কাজ করতে লাগলো। শাহিয়ানের চোখে চোখ মেলাতে না পেরে মাথা নিচু করে বলল,
“সরি, আপনার…!”
নিত্তিকার কথার মাঝেই হুট করে শাহিয়ান নিত্তিকাকে জড়িয়ে ধরলো। থমকে গেল মেয়েটা। অনুভূতিরা যেন থেমে গেছে এক জায়গায়। সময় থমকে গেছে। থমকে গেছে মনের রাগ। নিত্তিকার কেন যেন মন চাইলো শাহিয়ানকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সে পারলো না এক অদশ্য বাঁধা কাজ করলো মনের গহীনে।
হুট করেই ফুঁপিয়ে কান্না করার আওয়াজে উত্তলা হলো ছোট্ট হৃদয়টা। অস্থির কন্ঠে বলল,
“একি আপনি কান্না করছেন কেন?”
শাহিয়ানের কোনো সারা পাওয়া গেল না। নিত্তিকা যেন এতে আরো অস্থির হয়ে পরলো। মনের মাঝে উঁকি দিতে লাগলো হাজারো প্রশ্ন। কি হয়েছে ওনার? সামান্য একটা কামড়ে তো এমন করে কান্না করবে না তাহলে কি! তার বোনের জায়গায় নিশ্চই তাকে মেনে নিতে পারছেনা। হ্যাঁ তা নয় তো কি? নিজের মনে প্রশ্নগুলো দমাতে না পেরে নিত্তিকা বলে উঠলো,
“আপনি যদি চান আমি আপনাকে ছেড়ে দিবো। আসল কথা হচ্ছে, আপনাদের তো আমরা মূলত ধোঁকাই দিয়েছি। কথা ছিলো বড় বোনের সাথে বিয়ে হওয়ার। ফর্সা, সুন্দরী, শিক্ষিতা, ভদ্র মেয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা হয়ে। এখন নাকি আমার মতো একটা মেয়েকে আপনার বিয়ে করতে হলো। সবাই তো মুখের উপরেই বলে। আপনি আর লুকিয়ে কি করবেন। ছেড়ে দিন আমায়। আমি সইচ্ছায় আপনাকে মুক্তি দিবো।”
নিত্তিকা কথা শেষ হতেই শাহিয়ান নিত্তিকাকে খামচে ধরলো। আকাশী রঙের জামাটা ভেদ করে নখ একদম বসে গিয়েছে হয়তো নরম কোমরে। নিত্তিকা ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলো। শাহিয়ান এবার মুখ তুলে নিত্তিকা কপালে কপাল ঠেকিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলতে লাগলো,
“আমি চেয়েছি তোর কাছে মুক্তি। মনে রাখবি আমৃত্যু পর্যন্ত তুই আমার কাছ থেকে মুক্তি পাবিনা।আর একবার মুক্তির কথা তোর মুখে শুনলে শেষ করে দিবো সব।”
বলেই নিত্তিকাকে ধাক্কা দিয়ে গটগট পায়ে রুম ছেড়ে চলে গেল শাহিয়ান। নিত্তিকা বিছানায় পড়ে থমকে বসে রইলো। সবটা যেন গোলকধাঁধাঁর মতো লাগছে তার কাছে। যার অন্যতম রহস্যময় চরিত্র শাহিয়ান খন্দকার।
শাহিয়ান যেতেই রুমে ঢুকলো সায়রা। সাথে তার দাদি আছিয়া বেগম। নিত্তিকা ওদের আসতে দেখেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে সালাম দিলো হাসি মুখে। দাদি হাঁটুতে হাত রেখে বিছানায় বসে ইশারায় নিত্তিকাকেও বসতে বললেন। নিত্তিকাও বাধ্য মেয়ের মতো দাদির পাশে বসলো। দাদি নিত্তিকা থুতনিতে হাত রেখে নিত্তিকার মুখটা উঁচু করে ধরে মুচকি হাসি দিয়ে বললেন,
“মাশাআল্লাহ তোরে তো দেখতে একদম আমার যুবতী কালের মতো। বাহ বাহ ভালোই হইছে তোর বড়টা পালাইছে। চাঁদের টুকরা যেন ঘরে আইছে।”
নিত্তিকা বেশ অবাক হলো। মহিলাটা কি সুন্দর করে তার প্রশংসা করলো। কোথায় আগে তো সবাই দোষত্রুটি ধরে। তিনি তো তার করলেননা। ভাবতেই মনের মাঝে এক ভালো লাগা কাজ করে গেল নিত্তিকার। সায়রা দাদির কথায় নাকোচ করে বলল,
“দাদি তুমিও না চাঁদের টুকরা আবার কি বলো পূর্ণিমার চাঁদ।”
সায়রার কথায় হেসে দিলেন আছিয়া বেগম। নিত্তিকা লাজুক হাসলো।
নিত্তিকা রিনরিনে গলায় বলে উঠলো,
“দাদি আপনিও অনেক সুন্দর।”
আছিয়া বেগমের হাসিমুখ নিভে গেল। নিত্তিকা ভরকালো। আছিয়া বেগম একটা শ্বাস টেনে বললেন,
“আর বলিসনা তোর দাদাজান ও বেঁচে থাকাকালীন প্রতিটা সময় বলতো তুমি অনেক সুন্দর গো বউ। হ্যাঁ ছিলাম শ্যামলা তাতে কি ওনার কাছে বিশ্বসুন্দরী।”
নিত্তিকা বুঝতে পারলো আছিয়া বেগমের মন খারাপ হয়েছে। নিত্তিকা চুপ হয়ে গেল। আছিয়া বেগম পরক্ষনেই হেসে বললেন,
“আরে তুই মন খারাপ করছিস কেন, বাদ দে এসব। দাদুভাইয়ের সাথে তোকে কিন্তু মানাবে দারুন।”
নিত্তিকা উপরে উপরে হাসলেও মনে মনে বলল,
“মানাবে নাকি ছাই ব্যাটা যে একটা রহস্যের কারখানা। তার সাথে আমাকে জীবনেও মানাবেনা।”
নিত্তিকার ভাবনার মাঝেই শাহানা বেগম রুমে এসে বললেন,
“সায়রা নিত্তিকাকে রেডি কর। কতটা দেড়ি হয়ে গেছে খেয়াল আছে। বেলা এগারোটা বাজে।”
বলেই হাতের সব জিনিস বিছানায় রাখলেন। সায়রা সবটা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলো। নীল রঙের একটা লেহেঙ্গা, সাথে সাদা স্টোনের গহনা।
সায়রা নিত্তিকাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে নিজের কাজ শুরু করে দিলো। সায়রা সব কাজ ভালোভাবে পারে তাই তা লোক আনতে হয়নি। অবশ্য শাহিয়ানই সায়রাকে সাজাতে বলছে।
——————
সায়রা যখন নিত্তিকাকে সাজাতে ব্যস্ত তখনি নিত্তিকার ফোনটা বেজে উঠলো। নিত্তিকা সেদিকে তাকাতেই সায়রা মুচকি হেসে বলল,
“আপি তুমি ফোনে কথা বলো আমি একটু আমার জামা কাপড় গুলো বের করি।”
নিত্তিকা সম্মতি দিতেই সায়রা চলে গেল। নিত্তিকা ফোন হাতে নিয়ে দেখলো অপরিচিত নাম্বার। প্রথমে কেটে দিবে ভাবলেও কি যেন মনে করে রিসিভ করে কানের কাছে ধরতেই থমকে গেল। অপরপাশ থেকে কান্নার আওয়াজ ভেঁসে আসছে। নিত্তিকা হুট করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। অস্থির কন্ঠে বলল,
“আপু এই আপু তুই কান্না করছিস কেন? তুই কোথায়? এভাবে কান্না করছিস কেন, কি হয়েছে তোর?”
অপর পাশ থেকে কান্না ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না । এতে যেন নিত্তিকার অস্থিরতা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেল।
নিত্তিকাকে এমন করতে দেখে সায়রা এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো কি হয়েছে। নিত্তিকা কিছু বলছেনা। হুট করে কলের লাইন কেটে গেল। নিত্তিকা ধপ করে বসে পরলো বিছানায়। মাথা কাজ করছেনা তার। অজানা আতঙ্কে হাত পা রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে। সায়রা কিছু বুঝতে পারছেনা। নিত্তিকা জোরে জোরে শুধু শ্বাস নিচ্ছে।
সায়রা ছুটে সোজা শাহিয়ানের ঘরে গেল। ছেলেটা কেবলি ফ্রেশ হয়ে পাঞ্জাবী পায়জামা পরেছে। সায়রাকে এমন হন্তদন্ত হয়ে নিজের রুমে আসতে দেখে কপাল গুটিয়ে ফেলল সে। সায়রা গড়গড়িয়ে বলতে লাগলো,
“ভাইয়া দেখনা ভাবি কেমন যেন করছে!”
সায়রার বলতে দেড়ি শাহিয়ানের হন্তদন্ত পায়ে রুম থেকে বের হতে দেড়ি হলো না। শাহিয়ান দ্রুত সায়রার রুমে এসে দেখলো নিত্তিকা জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। শাহিয়ান নিত্তিকাকে নিজের বুকের মাঝে আগলে ধরে অস্থির কন্ঠে বলতে লাগলো,
“এই তোমার কি হয়েছে, কোথায় কষ্ট হচ্ছে, বলো আমাকে। আমি আছি তো তোমার পাশে।”
নিত্তিকার কানে যেন বারবার বেজে উঠলো একটা কথা,
“আমি আছি তো তোমার পাশে।”
হুট করেই নিত্তিকা শাহিয়ানকে আকড়ে ধরে কান্না করতে লাগলো। থমকে গেল শাহিয়ান। যতদিন যাবত মেয়েটাকে দেখছে মেয়েটা যে এভাবে কান্না করতে পারে তা মনে হয়নি। এমনকি জোর করে যে বিয়েটা দেওয়া হলো তখনো চোখে মুখে শুধু রাগ লেপ্টে ছিলো মেয়েটার। তাহলে কি এমন হলো!
শাহিয়ার দুইহাত দিয়ে নিত্তিকা ছোট গোলগাল মুখটাকে উপরে তুলে বলল,
“কি হয়েছে বলো আমাকে?”
নিত্তিকা নাক টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ সে। কান্নার তোপে কথা বলতে পারছেনা মেয়েটা। শাহিয়ান বিষয়টা বুঝতে পেরে শান্ত গলায় বলল,
“রিলাক্স, এত চাপ নিতে হবে না। পানি খাবে?”
নিত্তিকা জবাব দেওয়ার আগেই শাহিয়ান পিছনে ফিরে সায়রাকে ইশারা করলো। সায়রা ভাইয়ের ইশারা পেতেই চটজলদি পানির গ্লাস এনে এগিয়ে দিলো। শাহিয়ান নিজ হাতে গ্লাস নিয়ে নিত্তিকাকে খাইয়ে দিলো। কান্নার কারণে কাজল লেপ্টে একাকার অবস্থা। পানিটুকু শেষ হতেই নিত্তিকার মাথা নিজের বুকে ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে রইলো শাহিয়ান। নিত্তিকাও যেন বাচ্চাদের মতো গুটিয়ে গেল তার বুকের মাঝে।
দৃশ্যটা দেখে হুট করেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো সায়রার। কি যেন মনে করে ফোনটা নিয়ে ছবি তুলে ফেলল। আলগোছে সরে পরলো সেখান থেকে নিজের জামা কাপড় নিয়ে। আর চিন্তা নেই। তার ভাই যখন আছে সবটা সামলে নিবে।
বেশ অনেকক্ষন পরেই নিত্তিকা ভাঙা গলায় বলে উঠলো,
“আপু কল করেছিলো।”
নিত্তিকার কথায় কপাল গুটিয়ে ফেলল শাহিয়ান। নিত্তিকাকে বুকের সাথে জড়িয়েই বসে রইলো। নিত্তিকা একটা সরে আসার চেষ্টা করতেই ছেড়ে দিলো শাহিয়ান। নিত্তিকা শাহিয়ানের দিকে না তাকিয়ে নিচের সাদা চকচকে টাইলসের মেঝে দৃষ্টি রেখে বলল,
“আপু ভালো নেই। নিশ্চই আপু কোনো বিপদে পড়েছে। কান্না করছিলো অনেক কল করে।”
#চলবে