কেউ কথা রাখেনি পর্ব-২+৩

0
885

গল্পঃ কেউ কথা রাখে নি
পর্বঃ ০২ ও ০৩
নিঝুম জামান (ছদ্মনাম)

আরাফ কসমেটিকসের দোকান দেওয়ার পর
থেকেই লাভের মুখ দেখতে থাকে। মোটামুটি আমাদের ব্যবসা ভালোই চলতে থাকে। আমিও গোপনে আমার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকি। আমার পড়াশোনার কথা শুধুমাত্র আরাফ
জানতো। রাতে আমি পড়তে বসতাম। যাতে কেউ টের না পায়।
বাড়ির সকলে জানলে আমাকে আর আস্ত রাখবে না। তবে সারাদিন সংসারের কাজ করে রাতে
পড়তে বসাটা অনেক কঠিন। ক্লান্তিতে ঘুম চলে আসে, ঘুম বাদ দিয়ে পড়ায় মন দেই। সত্যিকথা বলতে বিয়ের আগে পড়াশোনার জন্য এতো খাটুনি করি নি, এখন যতটা করছি।
মা একটা কথা প্রায়ই বলতো,
“সুযোগ থাকতে মানুষ কাজে লাগায় না, কিন্তু সুযোগ যখন থাকে না তখন মানুষ কঠোর পরিশ্রম করে কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করে।”

মায়ের কথাটা আজ মনে পড়ছে খুব। আমার অবস্থাও ঠিক এমনই হয়েছে।
.
কিন্তু এই গোপনে পড়াশোনা বেশিদিন চালাতে
পারি নি। একদিন গভীর রাতে পড়তে পড়তে
ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। বই-খাতা গোছাতে ভুলে গিয়েছিলাম। পরদিন সকালে উঠে ঘরের সব
কাজ করতে গিয়ে বই লুকানোর কথা ভুলে
যাই, ছোট ননদ তুলি দেখে ফেলে আমার বই-খাতাগুলো; দেখতে দেরী শ্বাশুড়ি মায়ের
কাছে কথা লাগাতে দেরী হয় না। আম্মা তো
আমার পড়ার খবর শুনে রেগে আগুন! যেখানে
তার ছেলে ম্যাট্রিক ফেল, সেখানে বউয়ের পড়াশোনা করা তো মারাত্মক অপরাধ। কোথায় গেল তার “মা” ডাক, আর কোথায় তার সুমধুর কথা! ইচ্ছেমত খারাপ খারাপ ভাষায় গালি-গালাজ করল আমাকে আর বই-খাতাগুলো চোখের সামনে আগুন ধরিয়ে দিল। বইগুলো পুড়তে দেখেও সাহস হলো না কিছু বলার। আমি কিছুই বললাম না, চুপচাপ চোখের জল ফেলতে লাগলাম।।
.
সন্ধ্যায় আরাফ বাড়ি এসে দেখে মিথিলার চোখ-মুখ ফোলা। আরাফ বেশ ভালো করেই বুঝতে পারল হয়ত ওর মা মিথিলাকে বকেছে। মিথিলাকে জিজ্ঞেস করে,

— কি হয়েছে তোমার? চোখ-মুখ ফোলা কেনো? মা বকেছে?

–হুম, আমার বই-খাতাগুলো আম্মা পুড়িয়ে ফেলেছে।
বলে মিথিলা আবার কেঁদে দিল। আরাফ মিথিলার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,

–থাক মিথি, কেঁদো না। আমি তোমার বই-খাতা জোগাড় করে দিব। আমার এক বন্ধুর বোন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে ওর বই,গাইড এনে দিব। তবে একটা শর্ত আছে।

–কি শর্ত?

— তুমি যত পড়তে চাও আমি পড়াব সেটা কেউ টের পাবে না। কিন্তু কথা দিতে হবে পড়াশোনা কমপ্লিট করার পর আমার সাথে বেইমানি করতে পারবা না। আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না।

–তুমি আমাকে নিয়ে এতো ভয় করছো আরাফ। আমি কি ছেড়ে যাওয়ার জন্য তোমার কাছে এসেছি?

আরাফ কিছুটা থতমত খেয়ে বলল,
–আরে না, আমি সেটা বলতে চাই নি। আমি জানি তুমি অনেক ভালো মেয়ে। কিন্তু একটা কথা কি জানো? প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে অনেকেই তার অতীতের ঘটনা মনে করে না। তখন নিজের চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করে। আমার এক চাচা দুইবছর প্রেমের করে বিয়ে করে। তার ওয়াইফ মানে আমার কাকি তখন ইন্টার সেকেন্ড পড়তো। কাকিকে সব রকমের সাপোর্ট দিয়ে মাস্টার্স পাশ করায়। এরপর কাকি চাকরি করার ইচ্ছা পোষণ করে। চাচা চাকরি করতেও অনুমতি দেয়। কাকি পরে হাইস্কুলে চাকরি পায়। পাওয়ার পরে কি হয়েছে জানো?

— না,জানি না আর জানতেও চাই না। কখনোই তোমায় ছেড়ে যাব না আরাফ। ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি তোমায়। তোমার জন্যই আমি আমার পরিবারকে ছেড়ে এসেছি। তুমি আমাকে সারাজীবন আগলে রেখো, এভাবেই ভালোবেসো।

–তা তো অবশ্যই প্রিয়তমা..
বলে আরাফ মিথির হাতে একটা চুমো দেয়।
.
.
সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার মধ্যে দিয়েই কেটে গেছে প্রায় আটমাস। আমি ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠেছি।
আমার পড়াশোনা চালিয়ে নিতে প্রচুর সাপোর্ট করেছে আরাফ। নাইনের বার্ষিক পরীক্ষার সময় আম্মাকে মেনেজ করে আমাদের বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে আরাফ। যাতে আমাদের বাড়িতে গিয়ে ভালোমত পরীক্ষা দিতে পারি। পরীক্ষার শুরু হওয়ার আগে আমাকে বাড়ির গেট থেকে নিয়ে যেত আবার পরীক্ষা শেষ হলে আমাকে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতো। তবে কোনোদিন আমাদের বাড়িতে ঢুকত না।
সামনে এসএসসি পরীক্ষার টেস্ট পরীক্ষা। শ্বশুরবাড়িতেই লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ি। কিন্তু হঠাৎ একদিন জানতে পারি আমি মা হতে চলেছি।
একদিকে আমার পড়াশোনা করে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করা, অন্যদিকে আমার গর্ভে একজন বেড়ে উঠছে।
বয়সটাও আমার কম, যার কারনে সবকিছু হ্যান্ডেল করতে পারি না।

তাহলে কি আমি আমার পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সংসারে মন দিব?

#চলবে?
#কেউ_কথা_রাখে_নি
#নিঝুম_জামান

(ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়।)

পর্বঃ০৩

একদিকে আমার পড়াশোনা করে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করা, অন্যদিকে আমার গর্ভে একজন বেড়ে উঠছে।
বয়সটাও আমার কম, যার কারনে সবকিছু হ্যান্ডেল করতে পারি না।

তাহলে কি আমি আমার পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সংসারে মন দিব?
.
আরাফ আমার প্রেগ্ন্যাসির কথা শুনে তো খুশিতে আত্মহারা। শ্বশুরবাড়িতেও সবাই শুনে বেশ খুশি হলো। আরাফ আমার ভালোমত রেস্ট নেওয়ার কথা চিন্তা করে কিছুদিনের জন্য আমাকে বাপের বাড়ি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল।আম্মাও তাতে সায় দিলেন। কারন এবাড়িতে থাকলে সারাদিনই আমার কাজ করতে হয়। পরদিনই আমি ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্য। অবশ্য আমি একা না, আরাফ আমাকে বাড়ির গেট অবধি পৌঁছে দিয়েছে। বাড়িতে ঢুকে নি। তার কারণ আরাফকে বাবা-মা এখনো হয়ত মেয়ের জামাই হিসেবে মেনে নেয় নি। বাবা-মা বিয়ের পর এখন পর্যন্ত আরাফের সাথে সরাসরি কিংবা ফোনে কথা বলে নি। এমনকি কখনো আমাদের বাড়িতেও আসতে বলে নি। যতটুকু বলেছে আমাকে মাধ্যম হিসেবে বলেছে। তাই
আরাফও আমাদের বাড়িতে আসে না।
.
বাড়িতে যাওয়ার পর আমাকে দেখে মায়ের মুখে সেকি বিশাল হাসি! ছোটভাইটাও দৌড়ে আমার কাছে চলে এসেছে। অনেকদিন পরে তাদের দেখে আমারও বুকটা ভরে গেল।

— মা,কেমন আছো তোমরা সবাই?

–ভালো রে, তুই কেমন আছিস? তুই এমন শুকিয়ে গেছিস কেনো? ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করিস না?

–মা, তুমি আজীবনই আমাকে শুকনা দেখলে..
খাওয়া – দাওয়া ঠিকমতই করি। তা বাবার শরীরটা কেমন? ব্যবসা কেমন চলছে?

–ভালোই আছে। ব্যবসা আগের মতোই চলছে। তোর বাবা চাইছে আরেকটা কাপড়ের দোকান দিতে। কিন্তু আমি বলছি দুই-দুইটা দোকান সামলানো কঠিন কাজ! তারচেয়ে টাকাগুলো ব্যাংকে রেখে দিলেই ভালো হবে।

— বাবা যা ভালো বুঝে তাই করুক।
.
রাতে সোফায় শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছি। মা এসে আমাকে পড়ার কথা জিজ্ঞেস করছেন। মায়ের মুখে পড়াশোনার কথা শুনে আমি প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চাই। কিন্তু মা ঘুরে-ফিরে আমার পড়ালেখার কথাই বলছেন। আমি আমতা-আমতা করে মাকে সবকিছু খুলে বললাম। প্রেগ্ন্যাসির কথা শুনে প্রথমে মায়ের মুখটা খুশিতে ভরে উঠলেও কিছুক্ষন পর মুখটা কালো হয়ে গেল। আমি মাকে বললাম,

–সবকিছু সামলিয়ে আমি কীভাবে পড়াশোনা কন্টিনিউ করব মা? তুমিই বলো..

— আমি তো দুশ্চিন্তা করছি তোকে নিয়ে। তোর বয়স কম, এতো কম বয়সে মা হতে গিয়ে আল্লাহ না করুক কোনো সমস্যা যাতে না হয়। প্রেগনেন্সি চলাকালীন সময়ে কত রকমের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। আর পড়াশোনা কন্টিনিউ তো অবশ্যই করবি। আমার বিশ্বাস তুই চেষ্টা করলে সবকিছু করতে পারবি । ‘যে রাধে, সে চুলও বাঁধে।’

মায়ের কথা শুনে আমি কিছু বললাম না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম যেভাবেই হোক পড়াশোনাটা চালিয়ে যাব।
.
.
.
আমার এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে।
আমাদের বাড়িতে থেকে প্রিপারেশন ভালোই নিয়েছি। এই কয়েকমাসে শ্বশুরবাড়িতে দুই/তিনবার গিয়েছি। তাও দুই/একদিনের জন্য। প্রেগ্ন্যাসির বাহানা দিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে এসেছি
যাতে ঠিকঠাক পরীক্ষা দিতে পারি। পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে এসে কোয়েশ্চেন মিলাচ্ছি হঠাৎ আমার বাবা তড়িঘড়ি করে বাড়ি আসলেন। এমন সময়ে বাবা কখনো বাড়ি আসে না। বাবা এসেই আমার ধরে ডাকাডাকি শুরু করলেন।

–মিথি, এই মিথি, (রাগী গলায়)

আমি তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলাম বাবার কাছে।
–কি হয়েছে বাবা? ডাকছিলে কেনো?

— “নিজে বিয়ে করেছিস ভালো কথা! এমন বখাটে, গুন্ডা, ছ্যাচড়া ছেলেকেই বিয়ে করতে হলো? জানিস তোর জামাই কি করেছে? তোর জামাই প্রতিদিন জুয়া খেলে। জুয়া খেলে নিজের কসমেটিকসের ব্যবসা তো হারিয়েছেই সাথে আজকে জুয়া খেলতে টাকা নিতে আমার দোকানে এসেছিল। কর্মচারীদের সাথে মারপিট করে ক্যাশবক্স থেকে টাকা নিয়ে গেছে। আমি তখন দোকানে ছিলাম না, থাকলে তোর জামাইকে থাপড়ে গাল ফুলিয়ে দিতাম।
অসভ্য, অভদ্র, বদমাইশ কোথাকার! আজকে আবার লোকমুখে জানতেও পারলাম নেশা-টেশাও নাকি করে। তুই বলেছিলি বিয়ের পর আরাফ ভাল হয়ে গেছে। তুই ভালো পথে ফিরিয়ে এনেছিস, এই হলো তার ভালো হওয়ার নমুনা। আমি কথা বলি
না বলে নাকি তোর জামাই আমাদের বাড়ি আসে না! কপাল ভালো যে আসে না ;আসলে কি যে হতো তাই ভাবছি।
গ্রামের মধ্যে আমার একটা ভালো সুনাম, সম্মান ছিল সেটা তুই নষ্ট করেছিস। তবুও তোকে কিছু বলি নি। এখন তোর জামাই শুরু করেছে বদমাইশি।
ছিঃ আমার ভাবতেও ঘৃণা লাগছে আমার মেয়ের জামাই জুয়ারি, নেশাখোর, বখাটে গুন্ডা। ”

বাবা ক্ষিপ্ত কন্ঠে আমাকে কথাগুলো বললেন। আমার বুঝ হবার পর থেকে কোনোদিনই আমাকে বকাঝকা করতে দেখি নি। তাই বাবার কথাগুলো আমার কলিজায় গিয়ে বিঁধলো। কষ্টে আমার চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগলো।
একথা আছে না, “পর মানুষে দুঃখ দিলে দুঃখ মনে হয় না, আপন মানুষ কষ্ট দিলে মেনে নেওয়া যায় না”
বাবার জায়গায় অন্য কেউ কথাগুলো বললে আমি এতটাও কষ্ট পেতাম না।

— মিথি, তোমার ফ্যাচঁফ্যাচ করে কান্না বাদ দিয়ে রুমে যাও। (ধমক দিয়ে)

বাবার ধমকে আমি হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম আর দৌড়ে রুমে চলে এলাম। মা তখন বাড়িতে ছিলেন না, ছোটভাই সাইফের স্কুলে গিয়েছিলেন ওকে আনতে।
রুমে বসে অনেকক্ষণ কাঁদলাম, ‘ মনে মনে ভাবলাম অনেক হয়েছে আর না; পালিয়ে বিয়ে করার শাস্তি পাচ্ছি আমি। সবার চোখে শুধু আমিই দোষী, শ্বশুরবাড়ি-বাপেরবাড়িতে শুধু আমিই বকা খাই। আজকে আরাফকে সাথে আমার বোঝাপড়া হবে।’ ড্রেস পাল্টে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
সেখানে গিয়ে আম্মার সাথে, তুলির সাথে কিছুক্ষন কথা বললাম। আম্মা হয়ত জানে না আরাফ এতো বড় কান্ড ঘটিয়েছে। অবশ্য জানলেও বা কি! আমার শ্বাশুড়ি আম্মার মতে ছেলেরা হাজার দোষ করলেও তাদের কোন দোষ হয় না।
আমার রুমে আসার পরে দেখি আরাফ শুয়ে শুয়ে মোবাইল টিপছে। আমাকে দেখে আরাফ বলল,

–একি তুমি! না বলে চলে যে?

–এসে কি তোমার অসুবিধা করলাম নাকি? শুনলাম তুমি নাকি জুয়া খেলো, নেশা করো?
রাগ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

–এসব কথা তোমাকে কে বলেছে, তোমার বাপ?

–অসভ্যের মত কথা বলছো কেনো? আমার বাবা তোমার কি হয়? আর আমি যা শুনেছি এসব কি সত্যি? জুয়া খেলে দোকান খুইয়েছো, নেশা করে টাকা নষ্ট করো। ছিঃ তোমার জন্য আমার কত শুনতে হয় সবার থেকে। তুমি না বলেছিলি তুমি ভালো হয়ে গেছো?

আরাফ কিছুক্ষন চুপ থেকে উত্তর দিল,
— মানুষ ভালো হতে চাইলেই এত সহজে খারাপ পথ থেকে বের হতে পারে না। জুয়া খেলেছি ঠিক আছে,কিন্তু নেশা করার অভ্যাস নাই আমার। ওইকথা মানুষ মিথ্যা বলেছে। আর তোমার বাপের টাকা আমি পাঠিয়ে দিব দুইদিন পরে, সেটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তোমার। টাকাটা অনেক দরকার ছিল তাই এনেছি।

–কি কতক্ষণ ধরে তোমার বাপ,তোমার বাপ করছো? আমার বাবাকে আব্বা বলতে পারো না? আর তোমার গুন্ডামির জন্য আমার কত কথা শুনতে হয় জানো? টাকা দরকার ছিল ভালো কথা, আমাদের দোকান থেকেই আনতে হলো তোমার?

–না,পারি না। তোমার বাপকে আব্বা ডাকতে পারব না। আমার গুন্ডামির কথা কি আজকে নতুন শুনলে নাকি? আমি তো এমনই ছিলাম। সব জেনেই তো স্বইচ্ছায় আমাকে বিয়ে করেছো।

–তাই বলে তুমি ভালো পথে আসবেনা। তোমার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে আমি তোমাকে বিয়ে করে
বড্ড ভুল করে ফেলেছি।

–ভুল তুমি করো নি,ভুল করেছি আমি তোমাকে পড়াশোনা করতে দেওয়ার সুযোগ দিয়ে। যেই মিথিলাকে হাজার কথা শুনালেও কোন উত্তর দিত না,সে আজ আমার কাজের কৈফিয়ত চাচ্ছে, আমাকে উঁচুগলায় কথা শোনাচ্ছে। মা ঠিকই বলতো..

–এখানে পড়াশোনা টেনে আনবে না একদম। কখনো কিছু বলি না বলে এই না যে আমি উচুগলায় কথা বলতে জানি না। আর তোমাকে খারাপ পথ থেকে সরিয়ে আনাটা কি আমার অপরাধ?

— হ্যাঁ,অপরাধ। যেখানে আমার বাবা-মা আমাকে কিছু বলে না সেখানে তুমি বলার কে? আজ থেকে তোমার পড়াশোনা বন্ধ। তুমি আর পরীক্ষা দিতে যেতে পারবে না। আজ থেকে এবাড়িতেই থাকবে।

— বললেই হলো নাকি? দুইদিন পরে আমার আরেকটা পরীক্ষা। আমি এখনি চলে যাব।

–তুমি যেতে পারবে না
বলে আরাফ আমাকে বিছানায় ধাক্কা মেরে ফেলে বাইরে থেকে দরজা আটকে চলে গেল।
আমি আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লাম। তাহলে কি আমার পড়াশোনার স্বপ্ন এখানেই শেষ। নিজের পছন্দে আরাফকে বিয়ে করে আমি বড্ড ভুল করেছি। বড্ড ভুল!
.
সন্ধ্যার পরে মা ফোন দিলেন, মাকে হাবিজাবি বুঝিয়ে ফোনটা রাখলাম।
.
.
অনেক রাতে আরাফ বাড়িতে ফিরে এলো। সাথে আইসক্রিম আর চকলেট। আমার হাতে দিয়ে বলল,

— আমার ওপর রাগ করে থেকো না মিথি। তখন রাগে কি বলতে কি বলে ফেলেছি। খারাপ ব্যবহারও করে ফেলেছি, সরি। তোমার না আইসক্রিম-চকলেট পছন্দ তাই এগুলো এনেছি,
নাও। (আরাফ)

আমি চকলেট-আইসক্রিম হাতে নিলাম না। গাল ফুলিয়ে আরেকদিকে তাকিয়ে বসে রইলাম।

–কি হলো রাগ কমে নি? আরে পড়াশোনা করতে দিব না বলে এত রাগ করেছো,? আমি তো এমনি বলেছি। কালকে সকালেই তোমাদের বাড়ি তোমাকে রেখে আসব।

আরাফের কথা শুনে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ওকে বললাম,
–আর কখনো এরকম কথা বলবে না।

–আচ্ছা,বলব না। রাগ কমেছে?

–হুম।

–জানো, ঠিক করেছি আমি ভালো হয়ে যাব। আর জুয়া খেলব না। আমি ভাবছি বিদেশ চলে যাব।
.
.
পরদিন আরাফ আমাকে আমাদের বাড়িতে দিয়ে আসলো।
পরীক্ষাও ঠিকঠাক মতো শেষ করলাম। এভাবেই কেটে গেল দুইমাস। আমার বাবু হওয়ার দিন ঘনিয়ে আসতে লাগলো। এরমাঝেই শুনলাম আরাফের কাগজপত্র ঠিকঠাক হয়ে গেছে। একসপ্তাহের ভিতরে সিঙ্গাপুর চলে যাবে। ওর চলে যাওয়ার কথা শুনে বুকের ভেতর চাপাকষ্ট জমা হলো। ওকে ছাড়া আমি থাকব কি করে? মানুষটা যে আমার ভরসা ছিল। যার মুখের দিকে আমি শ্বশুরবাড়ির হাজার কষ্ট মেনে নিতে পারি।
আরাফ দেশের বাইরে চলে যাওয়ার আগে আমার ফ্যামিলির সাথে ওর ঝামেলাটা মিটে গিয়েছিল। বাবা তার অনাগত নাতি/নাতনির কথা ভেবে সবকিছু ভুলে আরাফকে মেয়ের জামাই হিসেবে মেনে নেয়।
.
আরাফ যেদিন সিঙ্গাপুরে চলে যাচ্ছিল সেদিন এয়ারপোর্টে আমি নিজের কান্না ধরে রাখতে পারি নি। ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি আমি। আরাফকে জিজ্ঞেস করি,

–আবার কবে দেখা হবে আমাদের? আমি যদি বাবু হতে গিয়ে ম/রে যাই, তাহলে আমাকে কি দেখতে আসবে?

–ধুর পাগলী। তোমার কিচ্ছু হবে না, আল্লাহ ভরসা।
খুব শীঘ্রই আমি চলে আসব। আর আমাদের ফোনে তো কথা হবেই।
বলেই আরাফ আমাকে ছাড়িয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে চলে গেল। ওর চলে যাওয়াটা আমি পলকহীনভাবে তাকিয়ে দেখলাম। আমাদের যদি
আর কখনো দেখা না হয়?
আচ্ছা,এটাই কি আমাদের শেষ দেখা?

#চলবে?
#নিঝুম_জামান
#কেউ_কথা_রাখেনি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে