কষ্ট

0
2256

কষ্ট

শুক্রবার সকাল ১০ টা,
নবিন সাহেব চা হাতে বসে চুমুক দিচ্ছেন আর খবরের কাগজ খুটে খুটে পড়ছেন। আজকাল খবরের কাগজ পড়লেই মন খারাপ হয়ে যায়। এমনকি বিনোদনের পাতা পড়লেও মন খারাপ হয়ে যায়। মানুষ যে এত্তো কষ্টে আছে তা খবরের কাগজ না পড়লে জানাই যেতো না। তাজা তাজা কতো প্রাণ প্রতিদিন চলে যাচ্ছে এই মায়ার দুনিয়া ছেড়ে৷ এসব পড়তে পড়তে যখন নবিন সাহেবের মন বিষন্ন হয়ে উঠে ঠিক তখনই তার একমাত্র ছেলে ইমন তার সামনে এসে বলে,

ইমনঃ বাবা ৫০০০ টাকা দেও।

নবিন সাহেব চায়ের কাপে চুমুকটাও ঠিক মতো দিতে পারেনি। তার আগেই তার ছেলে পারমাণবিক বোমা মেরেছে তার উপর। চায়ের কাপটা রেখে পেপারটা ভাজ করে ছেলের দিকে তাকায়। খবরের কাগজে এইমাত্র একটা ছেলেকে দেখেছে যে খুবই কষ্টে মারা গেছে। ঠিক সেই ছেলের মতোই নবিন সাহেবের ছেলে ইমন। নবিন সাহেব গলাটা কড়া করে বললেন,

নবিনঃ গত সপ্তাহে তোমাকে ২০০০ টাকা দিয়েছি। এখন আবার কিসের টাকা। এতো টাকা দিয়ে তুমি করবে টা কি?? রাগী ভাবে।

ইমন বিরক্ত নিয়ে বলে,

ইমনঃ বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখতে যাবো। আজ আমি ওদের সিনেমা দেখাবো।

নবিন সাহেবঃ ইমন তুমি কি ভুলে গেছো আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের??? আমি যা আয় করি তার ৮০% তোমার পিছনেই যায়। তার উপর আবার এতো গুলো টাকা চাচ্ছো বন্ধুদের পিছনে উড়াবে বলে!!! রাগী গলায় বললেন।

রান্নাঘর থেকে ইমনের মা দ্রুত চলে এলেন চিল্লাচিল্লি শুনে।

মাঃ কি হয়েছে চিৎকার করছেন কেনো?? অবাক হয়ে।

নবিন সাহেবঃ তোমার ছেলে আমার কাছে ৫০০০ টাকা চাচ্ছে বন্ধুদের সিনেমা দেখাবে বলে। ওর মাথা কি ঠিক আছে??

মাঃ কি বলিস বাবা, আমরা কি অতো বড় লোক নাকি?? আমাদের সামর্থ্য আছে নাকি এসবের??

ইমনঃ মা,….

নবিন সাহেবঃ আরে বিথি কি বলো তুমি!! যদি আমাদের সামর্থ্য থাকতও তাও আমি ওকে টাকা দিতাম না৷ শুধু ১ টা টাকা ভিক্ষা ছাড়া আয় করে আন। শুধু ১ টা টাকা। পারবি?? পারবি না। কারণ সেই যোগ্যতা তোর মধ্যে নেই। তোর মধ্যে যোগ্যতা আছে শুধু বাপের টাকা উড়ানোর। এই চারটা দেয়ালের বাইরে বের হয়ে দেখ মানুষ একটা টাকার জন্য কেঁদে কেঁদে মরে। জোর দিয়ে বললেন।

ইমনঃ ঠিক আছে৷ টাকা যখন দিবানা আমার বন্ধুদের সামনে আমাকে অপমানিত করবা তাহলে আমিও এখন এই চার দেয়ালের বাইরে বের হয়ে যাচ্ছি। থাকো তুমি।

মাঃ খোকা কি করছিস কোথায় যাচ্ছিস?? দাঁড়া…দাঁড়া বলছি…

নবিন সাহেবঃ বিথি ওকে যেতে দেও। আমি বলছি। রাগী ভাবে।

ইমন ওর মানিব্যাগ আর মোবাইল নিয়ে নাস্তা না করেই বের হয়ে পরে রাস্তায়। মানিব্যাগে ১০০০ টাকা আছে। বাবার কথা গুলোই মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ইমন ওর সবচেয়ে কাছের একটা বন্ধুকে ফোন দেয়।

ইমনঃ হ্যালো দোস্ত কই তুই??

বন্ধুঃ আমিতো বাসায়। কেনরে??

ইমনঃ দোস্ত বাসা থেকে বের হয়ে আসছি বাবার সাথে ঝামেলা করে। তোর ওখানে কদিন থাকতে দিবি??

বন্ধুঃ আসলে দোস্ত হয়েছে কি আমার পরিবার বাইরের কাউকে এলাও করেনা বাসায়। তবে আমি দেখছি অন্য কোথাও কিছু হয় কিনা। আর কোনো হেল্প লাগলে বলিস।

ইমনঃ বুঝছি ভাই৷ রাখি পরে কথা হবে।

ইমন ওর আরেকটা বন্ধুকে ফোন দিলো।

ইমনঃ হ্যালো দোস্ত।

বন্ধুঃ হ্যাঁ বল।

ইমনঃ দোস্ত বাসা থেকে বের হয়ে গেছি বাবার সাথে রাগ করে। তুই কিছু টাকা দে না আমাকে।

বন্ধুঃ হায়রে বন্ধু এটা কি বললি। আমি এই মাত্র সাহাবকে টাকা ধার দিসি। এখনতো টাকা নাই৷ সরি ভাই।

ইমনঃ বুঝছি ভাই। সব বুঝছি। রাখি।

ইমন একটু আগে সাহাবের সাথেই কথা বলছিলো। মানে নাসির মিথ্যা কথা বলল ওকে। এই হলো বিপদের সময় বন্ধু৷ ইমন মন খারাপ করে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলো। চায়ের দোকানটায় এখন তেমন একটা লোক নেই। কারণ এখন সবাই সবার কাজে৷ ইমনের মতো বেকার লোকেরাই এখন চায়ের দোকানে যায়। ইমন এককাপ চা দিতে বলল।

কিছুক্ষণ পরই একটা ছোট মেয়ে চা বিক্রেতার কাছে এসে বলল,

মেয়েঃ বাবা কয়টা টাকা দেওয়া না আইসক্রিম খাবো৷

ইমন দেখলো চা বিক্রেতার মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুহূর্তেই। তিনি মেয়েটাকে কাছে নিয়ে বলল,

চা বিক্রেতাঃ মা, রাইতে তোমার লইগা আমি একটা না দুইটা আইসক্রিম আইনা দিমু। এহন তো মা টাহা নাই৷ তুমি মন খারাপ কইরো না।

মেয়েঃ আচ্ছা বাবা। আইনো কিন্তু। আমি যাই।

বলেই মেয়েটা হেলেদুলে চলে গেলো। ইমন চা বিক্রেতা মানে একজন বাবার চোখের দিকে তাকালো। অশ্রুসিক্ত হয়ে আছে। মেয়েকে টাকা দিতে পারে নায় বলে একজন বাবার চোখ আজ অশ্রুসিক্ত। চা বিক্রেতা ইমনকে চা দিতে দিতে বলল,

চা বিক্রেতাঃ কেমনে টাহা দিমু কন ভাই। দোকানের ভাড়া, বিল দিয়া হাতে ৫০০ টাকা থাকে মাস শেষে। কেমনে মাইয়াডারে খুশি করমু?? কেমনে??

সেই দুঃখী বাবা কেঁদেই দিলো। পারলো না চোখের পানি ধরে রাখতে। ইমন শুধু অবাক হয়ে সবটা দেখছে আর বুঝছে। কতো কষ্টে আছে এই চা বিক্রেতা এই বাবা। ইমন চা খেয়ে উঠে পরে। ৫০ টাকা দিয়ে আসে দাম হিসেবে। ইমনের মনটা অনেক খারাপ। হাঁটতে হাঁটতে একটা পার্কে গিয়ে বেঞ্চে বসে বাতাস খাচ্ছে। হঠাৎ একটা ১৪/১৫ বছরের ছেলে এসে বলে,

ছেলেঃ ভাই বাদাম খাবেন??

ইমন দেখে ছেলেটা বাদাম বিক্রি করছে। এত্তো অল্প বয়সে ও বাদাম বিক্রি করছে। ইমন বলল,

ইমনঃ হ্যাঁ খাবো। তার আগে বল তুই বাদাম বিক্রি করিস কেন স্কুলে না গিয়ে??

ছেলেঃ হাহা কি যে কন না ভাই। আমি আর আমার অসুস্থ মা আছি। আমগো আর কেউ নাই৷ মাডা বাদাম বিক্রি করতো। কিন্তু কেন জানি কয়দিন ধইরা বিছানা থেকে উঠতেই পারেনা। গা খুব গরম। ডাক্তার যে দেখামু হেই টাকাটাও নাই। তাই আমিই বাদাম বেচতে নাইমা গেসি। কয়ডা টাকা পাইলে মায়রে ডাক্তার দেখামু। আমগো কোনো স্কুল নাই ভাই। এক বেলা খাইতেই অনেক কষ্ট হয়ে যায় ভাই। খুব কষ্ট।

ইমন কি বলবে বুঝতে পারছে না৷ ছেলেটার কাছ থেকে ১০ টাকার বাদাম নিয়ে ওকে ৫০ টা দিয়ে দিলো ইমন৷ ছেলেটা খুশি হয়ে চলে গেলো। ইমনের খুব খারাপ লাগছে। তাই পার্ক থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে কোথাও যাবে বলে ঠিক করে। অনেক গুলো রিকশা দাঁড়িয়ে আছে। সব রিকশাওয়ালাই একে একে লোক দিয়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু একজন বয়ষ্ক রিকশাওয়ালার কাছে কেউ যাচ্ছে না। সে লোক ডেকেও কেউ তার রিকশায় যাচ্ছে না। মোট কথা তাকে কেউ পাত্তাই দিচ্ছেনা। ইমন দূর থেকে এসব দেখছিলো। ইমন ওই রিকশাওয়ালার কাছে এগিয়ে যায়।

ইমনঃ চাচা যাবেন??

চাচাঃ হ হ বাবা যামু। ভাড়া লাগলে একটু কমায় দিও। তাও আমার রিকশায় একটু চলো। উত্তেজিত কণ্ঠে।

ইমনঃ আচ্ছা চলেন।

ইমন উঠে বসলো তার রিকশা। ইমন বলেছে একটা রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে যেতে। ভাড়া হবে ৫০ টাকা এতোটা দূর। ইমন দেখে চাচা অনেক কষ্ট করে তবে খুশি মনে রিকশা চালাচ্ছে। ইমন বলল,

ইমনঃ চাচা আপনিতো অনেক বয়ষ্ক তাহলে রিকশা চালাচ্ছেন কেনো??

চাচাঃ বাবা, আমি রিকশা চালাইতাম না। আমার পোলারা আমারে আর আমার বউরে ঘর তেইকা বের কইরা দিসে। আমার বউডা মানে তোমার চাচি হে খুব অসুস্থ। তার চিকিৎসার লইগা পোলাগো কাছে হাত পাতছিলাম। একটা টাকাও দেয় না। আরো তাড়ায় দিসে। তাই রিকশা নিয়া নামছি রাস্তায়। আমি বয়ষ্ক দেখে কেউ আমার রিকশায় আসে না। তোমার মতো এক দুজন উঠে। আমি লাগলে শেষ হয়ে যামু তাও আমার বউডারে আমি কষ্ট পাইয়া মরতে দিমুনা৷ কান্না করতে করতে বলল।

ইমন স্তব্ধ হয়ে গেলো। কিছু বলার মতো শক্তি বা ভাষা ওর মধ্যে নেই। কিছুক্ষন পর স্টেশনে পৌঁছে যায় ইমন। চাচা ঘেমে একাকার অবস্থা। ইমন চাচাকে জোর করে ৩০০ টাকা দেয়। চাচা শেষমেশ টাকাটা নিয়ে অনেক খুশি হয়ে ইমন কে দোয়া দিয়ে চলে যায়৷ ইমন সামান্য এই কয়জন মানুষের কষ্ট দেখে হতাশ হয়ে যাচ্ছে৷ ওর কাছে এখন ৬০০ টাকা আছে৷ স্টেশনে ঢুকে এমনিই হাঁটছে ইমন। হাঁটতে হাঁটতে একটা কুলির দিকে নজর যায় ইমনের। যাবেই বা না কেনো?? কুলিটা যা একজন মহিলা। একজন মা। একজন যোদ্ধা। মহিলাটা তার ৯/১০ মাসের শিশুকে বুকের সাথে বেঁধে সমানে কুলিগিড়ি করে যাচ্ছেন। বাচ্চাটাও মায়ের সাথে লেগে আছে চুপ করে। ইমনের চোখ ভেঙে আসছে৷ ইমন আর নিতে না পেরে স্টেশনে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসে। কিছুক্ষণ চোখ দুটো বন্ধ করে বসে আছে৷ হঠাৎ ওর পাশে বসে কে যেন সমানে কাঁদছে। ইমন চোখ খুলে পাশে তাকিয়ে দেখে একটা লোক বয়স হবে ২৭-২৮ বছরের। সে কান্না করছে। কান্না করতে করতে কাকে যেনো ফোন দিলো৷

লোকঃ সুমি, বোন আমার কাঁদিস না। আমি আসছি। তুই মায়ের খেয়াল রাখ। মায়ের যেন কিছু না হয়। আমি আসছি বোন।

বলেই লোকটা কাঁদতে কাঁদতে ফোন রেখে দেয়। ইমন লোকটাকে বলল,

ইমনঃ ভাই কি হয়েছে??

লোকটা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

লোকঃ ভাই আমার আব্বা আজকে সকালে মারা গেছে। আমার বোন আর মা একা আব্বার লাশ নিয়া বইসা আছে। আমি ছাড়া তাদের আর কেউ নাই৷ আমার আব্বা আর নাই ভাই আমার আব্বা আর নাই। লোকটার কান্না ইমনের হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে কষ্টে। লোকটা উঠে চলে গেলো।

ইমনের পক্ষে আর সম্ভব না। স্টেশন থেকে বেড়িয়ে সোজা বাসায় চলে গেলো।

মাঃ খোকা এসেছিস তুই। তোর চোখে পানি কেনো?? কি হয়েছে বাবা?? চিন্তিত গলায়।

ইমনঃ মা বাবা কই??

মাঃ তোর রুমে।

ইমন ওর রুমে গিয়ে দেখে, ওর বাবা ওর রুমে ওর গিটার হাতে নিয়ে বসে আছে। ইমন বাবা বলে চিৎকার করে প্রচন্ড কান্না করতে করতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। ইমনের বাবাও কেঁদে দেয় ছেলের কান্না দেখে।

ইমনঃ বাবা আমাকে মাফ করে দেও। অামার কোনো টাকার প্রয়োজন নেই। তুমি সত্যিই বলেছো এই চার দেয়ালের বাইরে অচেনা মানুষগুলোর যে কতো কষ্ট তা উপলব্ধি করা আমাদের পক্ষে অার সম্ভব নয়। আমি শুধু তার ১% উপলব্ধি করেছি। বাবা বিশ্বাস করো আমি নিতে পারিনি। বাবা আমি অনেক ভালো আছি। আমার কোনো টাকা লাগবে না। আমার শুধু তোমাদের লাগবে৷ তোমাদের দোয়া লাগবে। ইমনের মা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছেন আর কাঁদছেন৷ এ যে খুশির কান্না। তাদের ছেলে আজ বুঝে এসেছে কষ্ট কি জিনিস।

নবিন সাহেবঃ বাবা, আমি এটাই চেয়ে ছিলাম তুই কষ্ট কি জিনিস একটু বুঝিস। কষ্ট অনেক কঠিন। সবাই সব কষ্ট নিতে পারেনা৷ সবচেয়ে বড় কষ্ট কি জানিস বাবা?? বেঁচে থাকা।

ইমন শুধু বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই যাচ্ছে বাবাকে কষ্ট দিয়েছে যে।

কিছু কথাঃ—–> আমাদের সমাজে এমন হাজারো মানুষ হাজারো কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে৷ বেঁচে থাকার যুদ্ধ করছে। তাদের এই কষ্টের ১% উপলব্ধি করারও শক্তি আমাদের নেই। আর যারা করেছেন তারা জীবন কি জিনিস তা বুঝেছেন। সবাই সবার বিভিন্ন কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছেন৷ আমি শুধু বলবো, এমন কিছু করেন না যার কারণে আপনি কারো কষ্টের কারণ হন। কারণ কষ্ট সহ্য করা খুব কঠিন সবাই পারে না।
ধন্যবাদ।

– সমাপ্ত।

#কষ্ট

© আবির খান।

– কোনো ভুল হলে মাফ করবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে