এন এডপটেড চাইল্ড

0
614

মা, তুমি এতো পজেসিভ কেন? তুমি জানো আমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে তুমি রোজদিন আমার কলেজে আমায় আনতে যাও বলে।

– তোকে কিছুক্ষণ না দেখলে যে আমার অস্থির লাগে। আর তোর বন্ধুগুলোই বা এতো পাজী কেন? কত্ত সাহস আমার রাজপুত্রকে নিয়ে হাসাহাসি করে।

রাজপুত্র না কোটালপুত্র জানিনা, তুমি এরকম আর করবেনা। মোবাইল আছে ফোন দেবে, কেমন?

– আচ্ছা রোজদিন যাবোনা, মাঝে মাঝে যাব; এটাই ডিল।

মাথা নেড়ে অবুঝ মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে তার রুমে চলে যায় আমার কলেজ পড়ুয়া একমাত্র ছেলে কৌশিক।
ও যদি জানতো ওর বয়সে আমি এভাবে একজন মানুষের উপস্থিতি কতটা ব্যাকুল হয়ে খুঁজেছি তাহলে বোধহয় কখনোই আমায় না বলতো না।

আমার বয়স যেদিন ষোলো শেষে সতের হয় সেদিন আমি প্রথম জানতে পারি আমাকে মা বাবার স্নেহে বড় করে তোলা মানুষ দুজনের সাথে আমার জন্মের কোন সূত্র নেই। একটা এতিমখানা থেকে চার বছর বয়সে আমায় তারা তুলে এনেছে। আমার জন্ম নিয়ে শুধু দুটো তথ্য তারা জানে। এক, আমাকে রেখে যাওয়ার সময় মা পরিচয় দেয়া মহিলাটির নাম আতিয়া বেগম। দুই, ভরনপোষণে অক্ষমতার দায়ে আমাকে আমার মা নামক ঐ মহিলা স্বেচ্ছায় এতিমখানায় দিয়ে গেছে। কি যে এক অদ্ভুত দোটানায় কেটেছে আমার কৈশোর আর তারুণ্যের সেই দিনগুলো! প্রতি মূহুর্তে ভাবনায় ছিল কে আমার বাবা মা? কেন তারা আমায় ফেলে দিল এভাবে? আমি একটা মানুষের ভার কি এতোটাই বেশী হয়েছিল তাদের জন্য?

আমার পালক মা কখনোই চাননি আমার পালক বাবা আমাকে এসব কথা জানাক। কিন্তু আমার বাবার কথা ছিল আমার বুঝদার জীবনের শুরুতেই সত্যিটা আমার জানা থাকা উচিত অন্যলোকের মুখ থেকে শোনার চেয়ে। আমি এজন্য তাকে শ্রদ্ধা করি ভীষণভাবে। আমার প্রতি মূহুর্তের অবর্ণনীয় কষ্ট নয়তো দ্বিগুণ হতো যদি অন্য কারো মুখ থেকে জীবনের এই অমোঘ সত্যটুকু শুনতে হতো। আমার পালক মায়ের ভয় ছিল এ ধরনের কথা আমার নিজের মনের ওপর চাপ ফেলবে আর তা আমার নিজের পড়াশোনা বা ভবিষ্যত ক্যারিয়ারের অন্তরায় হতে পারে। আমাকে ভালবেসে মাতৃস্নেহে এতোটা পথ টেনে আনার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমি পড়াশোনাটা তাই তাদের মনের মতো করে চালিয়ে গেছি। যদিও সেই ষোলো বছরের জন্মদিনের রাত থেকে চোখের নির্বাক নোনাজল ছিল আমার প্রতিরাতের সঙ্গী।

ষোলো বছরের ঐ আমার সাধ্য ছিলনা আমার জন্মদাত্রীকে তখন তখনই খুঁজে বের করার। কিন্তু মনের ভেতর প্রতিজ্ঞা ছিল একদিন ঠিকই খুঁজে বের করে জানতে চাইবো, আমি আদতে কতোটা ভারী ছিলাম তার জন্য? আমার পালক বাবা বুঝতে পেরেছিলেন আমার মনের আকুতিটুকু। মায়ের অজান্তে আমাকে এতিমখানার ঠিকানা দিয়ে, আমার দত্তক সংক্রান্ত কাগজ দিয়ে আমাকে যতোটা সম্ভব সাহায্য করেছেন। কিন্তু আর কোন তথ্যই পাচ্ছিলাম না অনেক চেষ্টা করেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জার্নালিজমে খুব ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাস করে দেশের নামকরা সেরা দৈনিকগুলোর একটাতেই চাকুরী পেয়ে যাই এই আমি। আদিলের সাথে পরিচয় একই অফিসে কাজের সুবাদে।

আপন বাবা মা থাকা মেয়েদেরই বিয়েতে দুনিয়ার ঝামেলা হয় আর আমার কথাতো বলাই বাহুল্য। আর তাই নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত রেখেছিলাম একাকীই জীবন কাটিয়ে দেব বলে। সম্ভব হয়নি আদিলের জন্য। আমার সব কথা জেনেও ও পিছপা হয়নি। এমনকি বিয়ের রাতে আমায় সে প্রতিজ্ঞা করে আমার মাকে সে খুঁজে বের করবে। যেদিন আমার হাতে মায়ের বাসার ঠিকানা আদিল তুলে দেয় আমি সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারিনি। ততদিনে আমার ছেলের বয়স একবছর। মনের এক অংশ শুধু বলছিল, একজন মা হিসেবে একজন মেয়ে হিসেবে আরেকজন মাকে এমন একটা জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো কি ঠিক হবে? অন্যদিকে মনের আরেক অংশ বলছিল, এতোগুলো রাতের কান্নার কারণ না জানলে যে এতোদিন এই খুঁজে বেড়ানোর চেষ্টা পুরোটাই বৃথা।

হাতের মুঠোয় ঠিকানা লেখা কাগজটা শক্ত করে ধরে মুগদাপাড়ার এক চারতলা বাসার ফ্লাটের কলিংবেল বাজাই। পুরোটা পথ শুধু মনে হচ্ছিল, কেমন হবেন উনি দেখতে? উনি কি স্বীকার করবেন আমার অস্তিত্ব? কি করবো আমি যদি উনি আমায় পুরোপুরি অস্বীকার করেন?

‘কাকে চাই?’ দরজায় আমার চেয়ে বয়সে ছোট এক ব্যক্তির উপস্থিতি।

– জ্বি আমি আতিয়া বেগমের কাছে এসেছিলাম। ওনার পরিচিত। একটু ডেকে দেয়া যাবে? আমার নাম শবনম।

মাকে আপনি কিভাবে চেনেন?

– ঐ না মানে পরিচিত আর কি। না মানে ওনাকেই বলতাম যদি একটু ডেকে দিতেন।

মা মারা গেছেন মাস তিনেক হলো। বাবা বাসায় আছেন। ডেকে দেবো?

‘মা মারা গেছেন’ এই তিনটা শব্দ যেন আমার আপাদমস্তক কাঁপিয়ে দিল। জানা হলোনা তবে আমার এতোদিন ধরে মনে পুষে রাখা প্রশ্নের জবাব? তবু ভদ্রলোকের পিছু পিছু চলে এলাম ঘরের ভেতর। বৃদ্ধ একজন বেরিয়ে এলো পাশের রুম থেকে। উনিই কি তাহলে আমার বাবা?

– কে গো মা তুমি? তুমি করে বললাম, তোমাকে আমার ছেলের বয়সীই মনে হচ্ছে।

আমি শবনম। আপনি একটু বসবেন, আমার কিছু কথা ছিল বলার।

– হ্যা বলো।

‘এই কাগজটা আমার এতিমখানার কাগজ। আমার মায়ের নাম লেখা আছে আতিয়া বেগম। জীবনের এতোগুলো বছর পেরিয়ে শুধু একটা প্রশ্নের জবাব খুঁজতে আমি আজ এসেছিলাম। কেন উনি আমাকে একলা ফেলে গিয়েছিলেন? আমার মনে হয় আমি ভুল ঠিকানায় এসেছি।’ কিভাবে যে এতোটুকু কথা আমি বলতে পেরেছিলাম আমি নিজেও জানিনা। তার পরের কথাগুলো জড়িয়ে যায় কান্নার নোনাজলে।

‘আপা, আপনি শান্ত হোন। আমার মনে হয় আপনি ভুল ঠিকানায় এসেছেন।’ কথা বলে ওঠে দরজা খোলা ভদ্রলোকটি।

চোখ মুছে উঠে আসার মূহুর্তে থেমে যাই বৃদ্ধ লোকটির কথায়।

– তোমার কথা আমি জানতে পারি আতিয়ার মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে। আতিয়ার সাথে আমার পরিচয় গার্মেন্টেসে। কাজের সূত্রে। আমি তার সুপারভাইজার ছিলাম। নিতান্তই গরীব পরিবার থেকে উইঠা আসা আতিয়ার আগে একবার বিয়ে হইসে, স্বামী ফালায়া গেছে এইরকম কথা জাইনাও আমি তারে ভালবাইসাই বিয়া করি। কিন্তু ঐ ঘরে তার কোন মেয়ে ছিল সেটা আমি নিজেও জানতামনা। মৃত্যুর আগে সে আমারে বইলা গেছে তুমি যদি কোনদিন তার খোঁজ করো আমি যেন তার হইয়া তোমার কাছে ক্ষমা চাইয়া নেই। পৃথিবীর লগে যার এখন কোন সম্পর্ক নাই তার লগে রাগ রাখা আর না রাখা সমান ব্যাপার। বাকীটা তোমার ইচ্ছা। আমি আতিয়ার হইয়া তোমার কাছে ক্ষমা চাই মা। জীবন বড় অদ্ভুত জায়গা গো মা। তবে অভিজ্ঞতা বলে কোন মা একদম নিরুপায় না হইলে তার কোলের বাচ্চারে অচিন পৃথিবীতে একলা ছাইড়া দেয়না।

আর পিছু ফিরে তাকাইনি আমি। আমার যা জানার আমি জেনে গেছি। কোন কিছুর জন্য একটা লম্বা সময় অপেক্ষায় থেকে তার অন্যরকম কোন জবাব পেয়ে গেলে কেমন যেন একটা ফাঁকা ধরনের অনুভূতি হয়। সেই শূন্যতা ভরা অনুভূতি নিয়ে ঘরে ফিরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি আমার এক বছরের কৌশিককে।

আমার ষোলো বছরের ছেলেটা আজো জানেনা আমার জীবন গল্পের ঐ অংশটুকু। আমার পালক মায়ের মতো আমি নিজেও বড় দোনোমনায় ভুগি এমন একটা গল্প ছেলের কাছে করা কি ঠিক হবে?

#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে