এক অভিমানীর গল্প
পর্ব- ১০
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
মায়া বাঁধনের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে।
—– কি হলো? এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
– যান, আপনি লুঙ্গি চেঞ্জ করে আসুন।
—– লুঙ্গি চেঞ্জ করে তোমার ওড়না পরব?
বাঁধনের কথায় মায়া রাগান্বিত ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকালো।
—— দেখো, রাগ করার কোনো কথা বলিনি।
এত রাত্রে আমি পরব’টা কি? লুঙ্গি যে
যে রুমে সে রুমে তো ভাইয়া(কাজিন)
শুয়ে আছে।
– আপনি বসুন, আমি আসছি।
—– এই শুনো, যেও না…. ওরা কিন্তু ভেবে নিবে…..(….)….???
মায়া লাইটটা জ্বালিয়ে ফোনের টর্চ জ্বেলে রুম থেকে বের হয়ে চলে গেল। বাঁধন মাথায় হাত দিয়ে বসে কিছুক্ষণ পর দরজায় হেলান দিয়ে গিয়ে দাঁড়ায়। এদিকে মায়া?!!!
এত রাত্রে ভাবিকে ডাক দিব কি না এটা ভাবতে ভাবতে একটা সময় ডাক দিয়েই ফেলল। মায়ার ডাকে ভিতর থেকে দরজা খুলে বাঁধনের কাজিন রাকিবের বউ। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে বাঁধনের ভাবি জিজ্ঞেস করে-
— কি হয়েছে মায়া?
—— মায়া আমতা আমতা করে বলেই ফেলে, ভাবি প্যান্ট লাগবে।
বাঁধনের ভাবি যেন আঁকাশ থেকে পরল।
ঘুম ঘুম ভাবটা আর ওনার চোখে নেই। মায়া যা বলল তা শুনে চোখ দুটো বড় বড় করে ফেলল। তারপর প্রশ্ন করল-
” কিসের প্যান্ট? কার প্যান্ট?”
মায়া মাথা নিচু করে বলে,
আসলে ভাবি বাঁধন ভাইয়া আছে না?
ওনার একটা প্যান্ট দরকার।
মায়া মাঝে মাঝে এমন সব কথা বার্তা বলে যে- জীবনে যে কখনো হাসেনি সেও হেসে ফেলে, আর পলি ভাবি’তো হলো হাসির ডিব্বা, এমনিতে আজকে মায়া যা বলেছে তাতে ওনার হাসি থামবে বলে মনে হয় না।
মায়ার কথাটা শুনার পর থেকে পলি ভাবি হাসছে তো হাসছেই। ওনার হাসির আওয়াজে ওনার হাজবেন্ড রাকিব উঠে আসেন। স্ত্রীকে পিছন থেকেই থামিয়ে দেন মুখে হাত চেপে। রাগান্বিত ভঙ্গিতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন-
” কি? শুরু করছ’টা কি এই রাত বিরাতে?”
মিসেস পলি কোনো রকম মুখ থেকে হাজবেন্ডের হাতটা সরিয়ে বলেন, আর হাসব না। রুমে যাও মায়ার সাথে একটু কথা বলেই চলে আসছি।
রাকিব রুমে চলে গেলে পলি ভাবি আবারো হাসা শুরু করে, তবে এবার আর উচ্চস্বরে নয়, এবার মুচকি মুচকি।
এদিকে বোকা মায়া জা’য়ের দুষ্টু হাসির কারণ বুঝতে না পেরে অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে বসে, কি হলো ভাবি? আসছ কেন?
পলি বাবা মুখে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে বলেন, এখনো তো অনেক রাত বাকি মায়া। এখনি গোসল করে নিলে বাকি রাত কেমনে কি???
রাত, গোসল?!!!
কি সব বলছেন ভাবি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
পলি ভাবি মায়ার গাল টেনে দিয়ে বলে, ওরে ন্যাকা! যেন ভাঁজা মাছটা উল্টিয়ে খেতেও জানে না। দাঁড়াও, প্যান্ট এনে দিচ্ছি। কথাটা বলেই বাঁধনের ভাবি রুমে চলে যায়।
বোকা মেয়ের টনক নড়ে যখন দেখে পলি ভাবি হাতে প্যান্টের সাথে সাথে ওর জামা কাপড়ও নিয়ে আসছে। পলি ভাবির হাত থেকে প্যান্ট কিংবা থ্রি-পিছ কোনোটা না নিয়েই সে স্থান একরকম দৌঁড়ে ত্যাগ করে মায়া। দরজার সামনে বাঁধনের দাত বের করা হাসি দেখে রাগে জ্বলতে থাকে মায়া, কিন্তু কিচ্ছু বলেনি। চুপচাপ মায়া বিছানায় গিয়ে ধপাস করে বসে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
দরজা আটকে সোফায় বসে হো, হো করে হাসতে থাকে বাঁধন।
মায়া রাগে, লজ্জায় শেষ। বাঁধনের প্রতি প্রচন্ড রাগে অভিমানে মায়া লাইট অফ করে বিছানায় শুয়ে পরে মুখ ঢেকে।
সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় বাঁধন। হাসতে হাসতে লাইট’টা জ্বালিয়ে দিয়ে মায়ার মাথার পাশে গিয়ে বসে।
মায়ার মুখের উপর থেকে ওড়নাটা সরিয়ে দিয়ে দুষ্টু হাসির সাথে ঠাট্টাই মেতে উঠে বাঁধন। প্রচন্ড রাগে বিছানা থেকে উঠে বাঁধনের বুকে, পেটে এলোপাথাড়ি কিলঘুসি মারতে থাকে মায়া। বাঁধন তখনো হাসতেই আছে। ক্লান্ত মায়া কিলঘুসি থামিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করে।
বাঁধন হাসি থামিয়ে অভিমানীকে বুকে টেনে নেয়।
মিনিট পাঁচেক হয়ে গেল। মায়া তখনো বাচ্চাদের মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মায়ার কান্নার জলে বাঁধনের বুকের একপাশের শার্ট ভিঁজে গেছে। বাঁধন ওর অভিমানীকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। অন্যদিনের মত আজ আর মায়া বাঁধনের পরশে বিরক্ত কিংবা হাত পা ছুঁড়াছুঁড়ি করেনি। বাঁধনের জড়িয়ে ধরার সাথে সাথে সেও বাঁধনকে নিভিড় করে জড়িয়ে ধরে।
মিনিট দশেক কেটে যাওয়ার পর অভিমানীর চোখের জল মুছে দেয়ার জন্য বাঁধন ওকে কাঁধ থেকে সরায়।
কিন্তু একি?!!!
মায়া ঘুমিয়ে গেছে। খুব বেশী কান্না করলে কিংবা কষ্ট পেলে মায়া যে সে অবস্থায় ঘুমিয়ে যায়, সেটা বাঁধন রিলেশন চলাকালীন সময়েই মায়ার বান্ধবীদের থেকে শুনেছিল, আজ তা স্বচক্ষে দেখল।
আস্তে ধীরে বাঁধন মায়াকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। মায়ার চোখের নিচে গড়িয়ে পরা জলের দাগ এখনো রয়ে গেছে। পরম আদরে বাঁধন ওর অভিমানীর চোখের জল মুছে, কপালে আলতো করে চুমু পরশ বুলিয়ে দেয়। ফ্যানের স্পিডটা পূর্বের ন্যায় কমিয়ে বাঁধন ওর কাথাটা মায়ার গায়ে ভালো করে টেনে দেয়।
এক হাতে ভর দিয়ে বাঁধন মায়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
না চাইতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে বাঁধনের। মনে মনে ভাবে-
“এতটা বোকা হয় কি করে মানুষ?”
মাঝরাত্রিতে ঘুম ভেঙে যায় মায়ার। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় মায়া দেখতে পায় খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বাঁধন ঘুমিয়ে আছে।
গা থেকে কাথাটা সরিয়ে বাঁধনের উপর দিয়ে, ফ্যানের স্পিডটা বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে কম্বলটা এনে গায়ে দিয়ে শুয়ে পরার আগে আরো একবার বাঁধনের দিকে তাকায় মায়া।
ফ্যানটা এতটাই দ্রুতগতিতে চলছিল যে এই গরমেও বাঁধন কেঁপে উঠে। বাঁধনের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ার মায়া হয় খুব। কম্বলটা গা থেকে সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসে মায়া। তারপর বাঁধনকে টানতে টানতে বালিশে এনে শুইয়ে দিয়ে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত কম্বলের কিছু অংশ দিয়ে বাঁধনের শরীর ঢেকে দেয়।
বাঁধনের এত বড় শরীরটাকে টেনে ঠিক জায়গায় আনতে গিয়ে ঘেমে একাকার মায়া। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই কারেন্ট চলে যায়। মুহূর্তেই পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে যায়।
অন্ধকারে বিছানায় হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খায় মায়া। তখনি ধপাস করে পরে যায়।
নাহ! মায়া ফ্লোরে পরেনি।
বাঁধনের পায়ের সাথে হোঁচট খেয়ে বাঁধনের বুকের উপরই পরে মায়া। তড়িঘড়ি করে উঠতে গিয়ে মায়া টের পাই বাঁধন মায়ার দু’বাহু শক্ত করে ধরে আছে।
—- উফফ, ছাড়ুন।
— নাহ,
—- এমন কেন করছেন?
— কারণ এখনো কারেন্ট আসেনি।
—— তো?!!!
—- পরের বার পরলে কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। ভুলে যেওনা পরনে কিন্তু লুঙ্গি আমার।
—— এত্ত খারাপ ক্যা আপনি?
—- বংশগতি রক্ষার জন্য এতটুকু তো খারাপ হওয়ায় যায়।
—– ওহহোহোহোহোহো….
কারেন্ট চলে আসে। মায়া তখনো বাচ্চাদের মত চোখ বন্ধ করে ঠোঁট বাকিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। বাঁধন মুগ্ধ নয়নে মায়ার দিকে তাকিয়ে।
বাঁধনের কোনো আওয়াজ না পেয়ে চোখ খুলে মায়া।
— হাসছেন কেন?
—- কই, হাসলাম?
— খুব এনজয় করেন, নাহ?
—- কিসের কি, মায়া?
বাঁধনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বাঁধনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বাহিরে চলে যায় মায়া, মিনিট পাঁচেক পর ফিরে আসে।
ফিরে এসে কোনো কথা না বলে বাঁধনের গা থেকে কম্বলটা টেনে নিয়ে আসে। তারপর ফ্যানের স্পিড পুরোটা বাড়িয়ে কম্বল দিয়ে নাক মুখ ঢেকে শুয়ে পরে।
একটা নিরব হাসি দিয়ে বাঁধন কাথা নিয়ে শুয়ে পরে।
ঘন্টাখানেক যেতে না যেতেই ঘুম ভেঙে যায় মায়ার। মনে হচ্ছে তেলাপোকারা গিলে খাবে ওকে। কোথা থেকে যেন একের পর এক তেলাপোকা এসে মায়ার নাকে, মুখে, হাতে, পায়ে, মাথা, চুলে ছিটকে পরছে।
বাধ্য মায়া বাঁধনকে পিছন থেকে ধাক্কাতে শুরু করে। বাঁধন ছিল তখন ঘুমে অচেতন, তাই মায়ার ডাকে সাড়া দিতে পারেনি। অসহায় মায়া লাইট জ্বালিয়ে ফ্লোরে গিয়ে দাঁড়ায়। মায়া দেখতে পায় পুরো রুম জুড়ে তেলাপোকারা ছুটোছুটি করছে। ফ্লোরের দিকে তো তাকানোই যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে যেন তেলাপোকার কারখানা। ওড়না হাতে নিয়ে এপাশ ওপাশ দেখতে দেখতেই দুটো তেলাপোকা উড়ে এসে ওড়নায় বসে। ভয়ে ওড়নাটা খাটের পাশে চেয়ারের উপর রেখে রীতিমত লাফাতে থাকে মায়া।
বাঁধন জেগে যায়। ব্যর্থ মায়া তখন চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে।
একটা হাসি দিয়ে বাঁধন মশারীটা টানায়।
তারপর মায়াকে মশারীর ভেতর নিয়ে আসে।
মশারীর ভেতর এসে চুপসে বসে আছে মায়া।
এটা দেখে বাঁধনের প্রশ্ন, কি হলো? ঘুমোবে না???
মায়া করুণ চোখে বাঁধনের দিকে তাকিয়ে বলে, এমনিতেই অসুস্থ, তারউপর আজ রাত্রিতে একটুও চোখের পাতা এক করতে পারিনি। আবার যদি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে তাহলে মাথাটা প্রচন্ড যন্ত্রণা শুরু করবে। আপনি কি একটু আমার পাশে বসবেন? মানে আমি ঘুমালে যাতে তেলাপোকা শরীরে বসতে না পারে, সেই জন্য।
মায়ার প্রশ্নের উত্তর সরূপ বাঁধন শুধু একটা হাসি দেয়, তারপর কিছু না বলেই মায়াকে টেনে বাঁধন ওর বুকে মাথা রেখে শুইয়ে দেয়। মিনিট দশেকের ভিতর পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পরে মায়া।
ক্লান্ত বাঁধন তখনো মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর এদিক ওদিক তাকিয়ে তেলাপোকা আসছে নাকি দেখছে।
এ যেন তেলাপোকার হাত থেকে বউকে বাঁচানোর জন্য তেলাপোকা পাহাড়া দেয়া হচ্ছে…..
চলবে……