এক অভিমানীর গল্প
পর্ব- ০২
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
খাটের নিচ থেকে মায়ার বের হতে দেরী, ওর গালে শুভ্রর দেওয়া থাপ্পরটা পরতে এক মুহূর্তও দেরী হয়নি। তারপরের ঘটনা তো সবাই জানেন।
একে তো বাঁধনের সাথে রাগ করে সারাটা দিন অনাহারে থেকেছে, তারউপর কান্নাকাটি। মায়ার মাথাটা কিরকম ভারী ভারী লাগছে। মনে হচ্ছে উঠে দাঁড়ালেই বুঝি মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু দাঁড়াতে তো হবেই। বহুকষ্টে হেঁটে হেঁটে ওয়াশরুমে যায় মায়া। চোখেমুখে পানিরছিটা দিয়ে কোমড়ে আঁচল বেঁধে রান্না করতে দাঁড়ায়। যদিও রান্নার ‘র’ ও পারে না ও। তথাপি আজ মায়া রান্না করতে ঢুকেছে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে, আমাকে পারতে হবে। যে করেই হোক আমাকে পারতেই হবে।
সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠে বাঁধন। ব্রাশ হাতে ওয়াশরুমের দিকে এগুনোর সময় চোখ যায় কিচেনের দিকে। বটিতে বসে চোখ বন্ধ করে হাতে পেয়াজ নিয়ে বসে আছে। চোখ থেকে অঝোরে জল গড়িয়ে পরছে ওর। মায়া রান্নায় অভ্যস্ত না সেটা বাঁধনসহ ওর পরিবারের সবাই জানে। আর জানে বলেই ওরা কখনো ওদের
পুত্রবধূকে রান্নার জন্য চাপ দেই নি। যদিও মায়া ৮মাসের বৈবাহিক জীবনে হাতে গোনা কয়েক দিন শ্বশুর বাড়িতে থেকেছে। আর যে কয়দিন থেকেছে মায়া সে কয়দিন ঐ বাড়িতে মেহমানের মতই ছিল। আজই প্রথম মায়া নিজ ইচ্ছেতে কিচেনে ঢুকেছে। আর প্রথম দিনেই এই অবস্থা। হেসে দিল বাঁধন। ব্রাশটা রেখে তাড়াতাড়ি চোখে মুখে পানিরছিটা দিয়ে বাঁধন এগিয়ে যায় মায়ার দিকে। হয়ছে তোমার রান্না আমার খাওয়া হয়ে গেছে, এবার আমাকে দাও দেখি আমি পারি কি না। কথাটা বলে বাঁধন মায়ার হাতের পেয়াজটা নিতে যাচ্ছিল। মুহূর্তেই মায়া চোখ খুলে বাঁধনের দিকে তাকাই। তারপর ওড়নার একপ্রান্ত দিয়ে চোখের জল মুছে পেয়াজ কাটতে শুরু করে। বাঁধন বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পরে মায়ার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে। বাঁধনের বলা রাতের ঐ কথাগুলোই মায়ার ফর্সা মুখটাকে অমাবস্যার কালো অন্ধকারের ন্যায় করে দেয়। রাগে একটার পর একটা পেয়াজ কাটতেই থাকে মায়া। কাজের অসাবধানতায় মায়ার আঙ্গুলের ক্ষাণিকটা কেঁটে যায়। ওহ স্বরে কুঁকিয়ে উঠতেই দাঁড়ানো থেকে বসে মায়ার হাতটা ধরে ফেলে বাঁধন। কিছুক্ষণের জন্য মায়া রাতের ঘটনাটার কথা ভুলে গিয়ে বাঁধনের চোখের গহীনে হারিয়ে যায়। ভেঁজা চোখে বাঁধন তখন মায়ার আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে।উৎকন্ঠার সাথে বাঁধন বলে উঠে, কি যে করনা তুমি! ২দিনের জন্য আমার কাছে এসেছ, এতেই কিচেনে ঢুকে গেছ। বাঁধনের কথায় ঘোর কাটে মায়ার। বাঁধন যখন আঙ্গুল কতটুকু কাটছে এটা দেখায় ব্যস্ত, মায়া তখনই একঝটকায় ওর হাতটা ছাড়িয়ে নেয় বাঁধনের থেকে। তারপর আবার কাজে লেগে যায়। পিছন থেকে বাঁধনের হাজারো নিষেধ, হাজারো কথা কোনোটাই শুনেনি মায়া। রান্না শেষে খাবারগুলো থরে বিথরে টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখছিল মায়া, তখনি সেখানে উপস্থিত হয় বাঁধন। চেয়ার টেনে টেবিলের কাছে বসে মায়ার দিকে অশ্রুভেঁজা চোখে তাকিয়ে আছে বাঁধন। মায়ার সেদিকে একটুও ক্রক্ষেপ নেই। একমনে পাক্কা গৃহিনীদের মত মুখটা ভার করে প্লেটে খাবার দিয়ে তরকারীর বাটিগুলো সামনে রাখে। বাঁধন খাবারের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে তখনই চুপিসারে অভিমানী মায়া সে স্থান ত্যাগ করছিল। নিচের দিকে তাকিয়েই মায়ার হাতটা ধরে ফেলে বাঁধন।
মায়া বাঁধনের হাত থেকে ওর হাতটা ছাড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু কোনো ভাবেই পেরে উঠছে না। বাধ্য মায়া মুখ খুলে, ছাড়ুন! কিন্তু বাঁধন আগের মতই শক্ত করে ধরে মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সেটা দেখে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয় মায়া। অন্যদিকে তাকিয়েই ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে, আমি এখন খাবো না। বাঁধন এবার বসা থেকে উঠে যায়। একটানে মায়াকে কাছে নিয়ে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, স্যরি লক্ষ্মী! মায়া কোনো কথা না বলে চোখ বন্ধ করে আছে। দু’চোখের লোনাজলে মায়ার গাল ভিঁজে একাকার। বাঁধন মায়াকে দু’বাহু ধরে ওর দিকে ফিরায়। চোখের জল মুছে দিয়ে বলে, ভালোবাসি তো লক্ষ্মী! মায়া চোখ মেলে বাঁধনের চোখের দিকে তাকায়। জল ছলছল চোখে কিরকম করুণ দৃষ্টিতে বাঁধন মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখেরই মায়ায় বাঁধা পরার আগেই চোখ ফিরিয়ে নেয় মায়া। অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, আমি খাব না এখন। ছাড়ুন আমাকে। বাঁধন ছাড়ার পরিবর্তে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মায়াকে। একটানে ওর কাছে নিয়ে জোর করে মায়ার নাকে, মুখে, গালে, কপালে ভালোবাসার এক উষ্ণ পরশ এঁকে দেয়। তারপর মায়ার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলে, স্যরি! আমার ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ আমায় মাফ করে দাও। আর কখনো এমনটি হবে না। মায়া কোনো কথা না বলে চুপসে দাঁড়িয়ে আছে। বেশকিছু ক্ষণ পর বাঁধন ওর চোখ মুছে বলে, আচ্ছা! মাফ করতে হবে না। বসো এখন খাবে। টেবিলে বসাতে দেরী, কিন্তু বাঁধনের হাতে কামড় দিয়ে সে স্থান ত্যাগ করতে এক মুহূর্তও দেরী হয়নি মায়ার।
চলবে…….