একটি অন্যরকম ভোর

0
789

আর দশটা সাধারণ ভোরের মতোই ছিল আজকের ভোর। আমি সবসময় বেশ ভোরে ঘুম থেকে উঠি। ফজরের নামাজ শেষে এককাপ চা হাতে পূর্বমুখী এ বারান্দায় বসি। নীলা মানে আমার স্ত্রী অবশ্য নামাজ শেষে একটু ঘুমিয়ে নেয়। সকালের সূর্যটা যখন কুয়াশা ভেদ করে আলতো নরম আলো ছড়ায় চারদিকে তখন যে অপার্থিব সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি হয় তা সারাদিনভর কাজ চালিয়ে নেবার মতো মনের রসদ যুগিয়ে দেয় যেন। আমার বাসার এই বারান্দাটা থেকে মূল রাস্তার অনেকটাই দেখা যায়।

শহরে প্রাণের স্পন্দন মোটে জাগতে শুরু করেছে। একটা দুটো রিকশা টিংটিং শব্দে যাত্রী নিয়ে ছুটে চলেছে। কত গল্প একেকটা রিকশার ছুটে চলার পেছনে লুকিয়ে আছে কে জানে? কেউ হয়তো বাড়ি যাচ্ছে ভোরে বাস, কেউবা হয়তো অফিস একটু দূরে তাই আগে যাত্রা, কারো বা হয়তো সকালের শিফটে স্কুল। বেশীক্ষণ সময় কাটানোর সুযোগ হয়না। নিজেকে তৈরী হয়ে অফিসে ছুটতে হবে যে ঘন্টাখানেকের মধ্যে।

মাত্র চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই বাঁচাও বলে নারীকন্ঠের একটা আর্তচিৎকার যেন ভোরের মৃদু শব্দ জড়ানো নিস্তব্ধতাকে টুকরো টুকরো করে দেয়। দৌড়ে যাই বারান্দার রেলিংয়ের কাছে। রাস্তায় একটা মেয়ে পড়ে আছে। রিক্সা থেকে পরে গেছে বোঝাই যাচ্ছে। পেছন থেকে ধাক্কা দেয়া ট্রাক ততক্ষণে হাওয়া হয়ে গেছে। চারদিক রক্তে ভেজা। রিক্সাওয়ালা হতবিহবল হয়ে সাহায্যের আশায় চারদিকে তাকাচ্ছে। অন্যসময় এতোক্ষণে চারদিকে লোক জমে যেত। ভোর হওয়াতে আশেপাশে তেমন কেউ সাহায্য করতেও এগিয়ে আসেনি। দৌড়ে নীচে নেমে এসে দেখি মেয়েটার জ্ঞান আছে কিন্তু ব্যথায় কাতরাচ্ছে তখনো। গাড়ি বের করে রিক্সাওয়ালার সাহায্যে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাই কাছের এক সরকারী হাসপাতালে।

মেয়েটার ব্যাগে রাখা কাগজ থেকে তার বাসায় ফোন দিলে এক ভদ্রলোক আসেন একটা ছোট বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে। আমার ঠিকানা দিয়ে চলে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হাসপাতালে আনার কিছুক্ষণ পর থেকে তার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এমন একটা দোটানায় পরে যাই। ফেলেও যেতে পারছিনা, এদিকে নিজের অফিসে যেতে হবে। ঘুমাচ্ছিল দেখে আমার স্ত্রী নীলাকেও বলে আসিনি। ভদ্রলোকের কাছে জানতে পারি তিনি শান্তা নামের ভদ্রমহিলার দুঃসম্পর্কের আত্মীয় হোন। ওনার বাসায় শান্তা তার ছেলেকে নিয়ে ভাড়া থাকে। ছোট বাচ্চা ছেলেটা ছাড়া শান্তার আর কেউ নেই। স্বামী মারা গেছে সড়ক দূর্ঘটনাতেই। বাচ্চা ছেলেটার জন্য এতো কষ্ট লাগলো। এতো অল্প বয়সের কত কঠিন জীবনের মুখোমুখি তাকে হতে হলো। বেচারা কিছুতেই বুঝতে পারছেনা তার মায়ের কি হয়েছে। তিন বছর বয়সে কি বা আর বুঝবে?

বাসায় অফিসে ফোন করে জানালাম কি হয়েছে। শান্তার মাথায় কোথাও রক্তক্ষরণ হয়েছে বিধায় তাকে সাথে সাথেই ওটিতে নেয়া হয়। খেয়ে আসি আপনি একটু বাচ্চাটাকে রাখেন বলে সেই ভদ্রলোক বেরিয়েছে প্রায় ঘন্টা দুয়েক আগে। বারেবার ঘড়ি দেখছি উনি এলেই আমি বাসায় যাব। কিন্তু বিকেল পর্যন্তও কেউ ফিরে এলোনা। সকালের ফোন নাম্বারে ফোন করে দেখি সেটা বন্ধ। কি বিপদ? সৃষ্টিকর্তা আমাদের কোন সন্তান দেননি তাই ছোট বাচ্চার ব্যাপারে আমি খুবই অনভিজ্ঞ। তবে অদ্ভুত হলেও সত্য ছেলেটা আমার হাত ধরে চুপ করেই বসেছিল পুরোটা সময়। একটুও বিরক্ত করেনি। আরো কয়েক দফা চেষ্টা করেও যখন ভদ্রলোকের নাম্বারে কোন রিং হলোনা তখন আমার বোঝার বাকী রইলোনা বাচ্চাটাকে আমার কাঁধে দিয়ে সেই লোক পালিয়েছে। কে শুধু শুধু দূরের এক আত্মীয়ের জন্য নিজের ওপর বিপদ ডেকে আনতে চায়?

কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে নীলাকে ফোন দেই। পরিস্থিতি কতোটা বোঝাতে পেরেছি জানিনা কিন্তু আমার গলার স্বরে নিশ্চয়ই কিছু ছিল। নীলা শুধু বললো, কোথায় আছো ঠিকানা দাও। তার পরের কয়েক ঘন্টায় অনেক গুলো ঘটনা ঘটলো। ডাক্তার শান্তার মৃত্যু সংবাদ দিল। মায়ের কি হয়েছে সে ব্যাপারে ভুলে গিয়ে তিন বছরের ছোট্ট শাওন নীলাকে জড়িয়ে তার কোলে ঘুমিয়ে গেলো। প্রতিটা মেয়ে বুঝি তার মাঝে একটা মা কে লালন করে। নয়তো নিতান্ত অপরিচিত একটা বাচ্চাকে নীলা যেভাবে জড়িয়ে ধরে রেখেছে কেউ বলে না দিলে কেউ বুঝতেও পারবেনা নীলা এই বাচ্চার মা নয়। কোন আত্মীয় পরিজনের খবর না জানায় আমাদেরকেই শান্তার দাফন করতে হলো।
আর বেলা শেষে শাওন জায়গা করে নিল আমাদের ঘরে নতুন সদস্য হিসেবে।
নীলা আর আমার শূন্য ঘরে পূর্ণতা দিতেই বুঝি শাওনকে সৃষ্টিকর্তা এভাবে আমাদের জীবনে পাঠালেন। জীবনের আয়োজন কার জন্য কিভাবে করা হবে তা বোঝার সাধ্যি বুঝি মানুষের নেই।

………………

‘বাবা, তুমি কোথায়? তাড়াতাড়ি নীচে চলো আমাদের বাসার সামনে বিরাট এক্সিডেন্ট হয়েছে।’ শাওনের গলার স্বরে চায়ের কাপ নামিয়ে কি হয়েছে জানতে বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকি।
শাওনের উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো পনের বছর আগে এরকমই একটা সকাল এসেছিল আমার জীবনে যেদিনের ঘটনা পরিক্রমায় বেলাশেষে শাওন আমার পুত্ররূপে এসেছিল আমার জীবনে।
শাওনের ব্যাপারে দারুন পজেসিভ নীলা বেরিয়ে এসে বললো, ‘রাস্তায় কি দেখার লোকের অভাব যে তোকে দৌড়ে যেয়ে দেখতে হবে?’ এটুকু বলেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের কথার সুরটুকু পাল্টে নেয়, ‘থাক যা, দেখে আয় কি হলো? আমাদের জানিয়ে যাস কোন দরকার হলে।’

জীবনের গল্পগুলো বুঝি এমনই। মানুষ ঘুরেফিরে একই ঘটনার মুখোমুখি পরে। কেউ অতীত ভুলে নিজেকে গুটিয়ে রাখে আর কেউ বুঝি অতীতের স্মৃতিতে নতুন কিছু যোগ করতে আবার একই পথে এগিয়ে যায়।

ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে