উছিলা

0
601

মানুষ যখন বিপদগ্রস্ত হয়ে সৃষ্টিকর্তার সাহায্য চায় তখন নাকি তিনি কাউকে বা কিছুকে উছিলা হিসেবে সেই বিপদগ্রস্তের জন্য পাঠান। আজ আমাদের পরিবারের জন্য পাঠানো সেই উছিলার গল্প বলবো। সেই মানুষটার কথা বলার আগে একটু নিজেদের কথা বলে নেই।

আমরা তিন বোন এক ভাই। বাবা ছিলেন একজন নীচু পদের সরকারী চাকুরীজীবি। বাবার চাকুরীসূত্রে আমরা থাকতাম এক মফস্বল শহরে। বাড়ির কিছু জমি বেঁচে আর বাবার বেতনের কিছু টাকা জমিয়ে আমাদের থাকার জায়গাটুকু কেনা হয়। নিজেদের বলতে এই জায়গা আর তার ওপরে টিনের তিন কামরার এক ঘর এই ছিল আমাদের সম্পদ। গ্রাম থেকে বছরে আসা খোরাকী আর বাড়ির উঠোনে মায়ের করা সবজী সাথে কিছু হাঁস মুরগী আর বাবার সামান্য বেতন দিয়ে আমাদের সংসার ভালোই চলে যাচ্ছিল। স্বচ্ছলতা না থাকলেও অন্তত অভাব ছিলনা। আমার মা নিজে ততটা পড়ালেখা করা না হলেও নিজে পড়ালেখার মর্ম বুঝতেন। তাই আমাদের চার ভাইবোনের পড়াশোনার দিকে তার ছিল কড়া নজর। সেই সময় আমাদের একদিনও স্কুল কামাইয়ের সুযোগ ছিল না যখন মফস্বলের অর্ধেক ছেলেপিলে পড়া বাদ দিয়ে বাবার সাথে কাজে যাওয়া শুরু করেছে আর মেয়েদের বিয়ে দেয়া হয়ে যেত বয়স বার তেরো না পেরোতেই।

বড় আপা যখন ফার্স্ট ডিভিশনে মেট্রিক পরীক্ষা পাস করে তখন পুরো মফস্বলে হইহই পড়ে যায়। বেশ কয়েকটা বিয়ের প্রস্তাবও চলে আসে সেসময়ে বেশ ধনী কিছু পরিবার থেকে। কিন্তু মা বাবা দুজনেই বড় আপাকে পড়াতে বদ্ধ পরিকর থাকেন। আমরা বাকী ভাইবোনরাও পড়াশোনায় মোটামুটি ফলাফল করে ক্লাসের পর ক্লাস উতরে যাচ্ছিলাম। আপা ইন্টারেও বেশ ভালো ফলাফল করেন। আপার খুব শখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। এতোদূরে মেয়েমানুষ একা একা পড়তে যাবে এই নিয়ে দোনোমনায় ছিল বাবা মা দুজনেই। শেষমেষ সিদ্ধান্ত হয় বাবা নিয়ে যাবেন ভর্তি পরীক্ষা দেয়াতে।

মানুষের ভাগ্য যদি সহায় না হয় তবে বোধহয় পাওয়া জিনিসও হাত ফসকে যায়। যেদিন বড় আপার ঢাকায় যাওয়ার কথা সেদিন সকালে বিনা নোটিশে আমার বাবা মারা যায়। আমরা এতোটাই হতবিহবল হয়ে গেছিলাম যে বড় আপা বুঝি কাঁদতেও ভুলে গেছিল। বাবার দাফন শেষ হলো পরে আত্মীয় স্বজন যে যার মত একটু তাড়াহুড়ো করেই বাড়ি চলে গেল। যাবে না ই বা কেন? পাছে কোন ঝামেলা না আবার ঘাড়ে এসে পরে। শুধু বাবা আর মাসশেষে বাবার বেতনের অনুপস্থিতি আমাদের পুরো সংসার ওলটপালট করে দিল। বাবার অনুপস্থিতিতে গ্রাম থেকে ফি বছর আসা খোরাকীও বন্ধ হয়ে গেল কেন যেন। তিনবেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারাই যখন জীবনের লক্ষ্য হয় পড়াশোনার ইচ্ছে তখন দিবাস্বপ্ন হয়ে জানালার ফাঁক গলে পালিয়ে যায়।

বাবার মৃত্যু আর নিজের স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় সবচেয়ে বেশী মুষড়ে পড়ে বড় আপা। আর মা তখন নিজের দুঃখ সামলাবে, নাকি আমাদের মুখে দুবেলা খাবারের ব্যবস্থা করবে নাকি আমাদের পড়াশোনা করাবে সেই ভাবনাগুলোর বেড়াজালে পর্যুদস্তপ্রায়। সময় তো আর বসে থাকেনা তাই দিন গড়িয়ে বড় আপার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় পেরিয়ে যায়। আমরা তখনো সরকারী স্কুলে পড়ার সুবাদে পড়াটুকু চালিয়ে নিতে পারছিলাম। মেঝো আপার মেট্রিক পরীক্ষা সামনে কিন্তু আদৌ পাস করবে কি না তারই কোন নিশ্চয়তা থাকেনা।

এরকমই এক অনিশ্চিত সকালে দেখি বড় আপা আর মা বসে কথা বলছে মুখ নীচু করে। কি কথা হয়েছে তাদের জানিনা কিন্তু বড় আপা তার পরদিন থেকে গ্রামের পাশের ডিগ্রী কলেজে যাওয়া আসা শুরু করে। মা সবজী ক্ষেতের কিছু সবজী, মুরগীর ডিম আশেপাশের বাড়িগুলোতে দেয়া শুরু করে। আমি বা ছোটভাই যেহেতু সেগুলো পৌঁছে দিতে যেতাম তাই বুঝে গেলাম ওসবের বিনিময়ে বাসায় চালের ব্যবস্থা হতো। তার কয়েকদিন পর থেকে আমাদের বাসায় এক আধজন পড়তে আসা শুরু করে বড় আপার কাছে। সাথে বড় আপা আমাদের পড়াশোনার তদারকিও শুরু করে। বড় আপার এমন ভূমিকায় বাবার মৃত্যুর মাস পাঁচেক পর থেকে বাসার গুমোট ভাব আস্তে আস্তে কাটতে শুরু করে।

কিন্তু ঐ যে বললাম কোন নিয়মিত আয় না থাকায় প্রায়শই না খেয়ে আমাদের ক্লাসে যেতে হতো। ক্ষুধার চোটে পড়তে বসলে ঝিমাতাম। আমাদের সবার চোখে বুঝি তখন স্বপ্ন ছিল দুবেলা দুমুঠো সাদা ধবধবে ভাত খাওয়া। এরকম টানাটানির সময়ে বড় আপার একটা বিয়ের প্রস্তাব আসে। ছেলে পাশের গ্রামের, পড়াশোনা জানা, সবচেয়ে বড় কথা ছেলে আমাদের সব জেনে নিজের আগ্রহে আপাকে বিয়ে করতে চায়। অথচ আমার মায়ের তখন ছেলেকে বিয়েতে উপহার কিনে দেয়ার মতো ফুঁটো পয়সাটুকুও নেই।

মফস্বলে তখন ছেলে মেয়েতে বিয়ের আগে কথা বলার নিয়ম না থাকলেও আপা জানায় সে বিয়েতে রাজী কিন্তু ছেলের সাথে তাকে একবার কথা বলতে দিতে হবে। যেদিন আতিক ভাইয়ের সাথে কথা হয় আপার সে রাতেই মায়ের পুরোনো বেনারসি শাড়ি পরে আপার বিয়ে হয়ে যায়। কোন অনুষ্ঠান না কোন আত্মীয় না, মা কিভাবে যেন শুধু একটু পোলাও আর মাংসের ব্যবস্থা করেছিলেন আমরা নিজেরাও জানিনা। আপা চলে যায় শ্বশুরবাড়ি। বাড়ির অন্য কেউ বিয়েতে রাজি না থাকাতে তেমন কোন লোক আসেনি আপার শ্বশুরবাড়ী থেকে। শ্বশুরবাড়িতে আপা কতোটা সুখে থাকতেন সে তো বলাই বাহুল্য তবু একজন খাওয়ার মানুষ কমাতে খানিক চাপ কমলো মায়ের ওপর এই যা তফাত।

সপ্তাহ দুয়েক বাদে একদিন আতিক ভাই একাই আসে আমাদের বাসায়, আমাদের পুরো মাসের প্রয়োজনীয় বাজার নিয়ে। মা সহ আমরা হতভম্ব হয়ে যাই এতো বাজার দেখে। যাবার পথে দুলাভাই বলে যায় আর কাউকে এসবের কথা বলার দরকার নেই, এমনকি আপাকে ও না। আপাকে বলতে না করায় মা একটু অবাক হলেও মেনে নেন ঘরে যে আরো তিনটে মানুষ রয়েছে যাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করাও মায়ের জন্য জরুরী। প্রতিমাসের শুরুতে বাজার চলে আসতো কোনরকম বলা কওয়া ছাড়াই। বড় আপা মাসে দুতিনবার আসতো বাটি ভরে রান্না খাবার নিয়ে। খুব সংকোচে থাকতো মাকে কিছু দিতে পারছেনা বলে। আতিক ভাইয়ের কাছে প্রতিজ্ঞার কারণে আমরা কেউ আপাকে কিছু জানাই ও না। দিন যেতে থাকে দিনের নিয়মে। শুধু আমরা জানি আপা বিয়েতে রাজী হয়ে শুধু নিজেই বাঁচেন নি আমাদেরও ডুবন্ত অবস্থা থেকে ভেসে থাকার উপলক্ষ্য করে দিয়েছেন।

আতিক ভাই যে আপাকে অনেক গয়না শাড়ি দিয়েছেন তা কিন্তু না। কিন্তু উনি আপার পড়ালেখাটুকু নিশ্চিত করেছিলেন। আপা ডিগ্রী পাস করে মাস্টার্সে ভর্তি হয় শুধুমাত্র আতিক ভাইয়ের সাহস ও ভরসায়। ডিগ্রী, মাস্টার্স শেষ করে চাকুরী পেতে পেতে আপার প্রায় বছর পাঁচেক লেগে যায়। আপা যেদিন তার চাকুরীর প্রথম বেতন নিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়ায় সেদিন আতিক ভাই আপাকে জানায় ,’আজ থেকে তোমার পরিবারের দায়িত্ব তোমার।’ সেদিন আপা প্রথম জানতে পারে যে আতিক ভাই চুপিসারে আমাদের সব খরচ চালাতেন। আপাকে কিছু জানাননি পাছে আপা নিজেকে ছোট মনে করে হতাশায় ভোগেন। এমনকি ওনার বাড়ির লোকে যদি আমাদের বা আপাকে কিছু বলেন সেজন্য বাড়ির কাউকেও কখনো কিছু জানাননি। মা চোখের জল মুছে আতিক ভাই আর আপাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার নিজের ছেলেটা যেন তোমার মতো ভালমানুষ হয় আতিক। আমাদের দুর্দিনে তুমি যেভাবে আমাদের আগলে রেখেছো আমি দোয়া করি সৃষ্টিকর্তা তোমাকে দুনিয়া ও আখিরাতে তারচেয়ে সহস্রগুণ বেশী সম্মান দান করে যেন আগলে রাখেন।’

আপা শুধু বেতনের টাকা দিয়ে আমাদের সংসার চালিয়ে নিলেও মেঝো আপার পড়াশোনা, বিয়ে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন, ফয়সালের সাথে বিয়ে, ছোটভাই তপুর পড়া শেষে দেশের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে সব সব গুলো ব্যাপারে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন আতিক ভাই।
এতিমের সরাসরি অভিভাবক নাকি সৃষ্টিকর্তা হন। বাবার মৃত্যু পরবর্তী সময়ে আমাদের খড়কুটোর মতো ভেসে যাওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি কারণ সৃষ্টিকর্তা উছিলা হিসেবে আমাদের জীবনে পৌঁছে দেন আতিক ভাইকে।

আতিক ভাইয়ের মতো কিছু ভালমানুষ পুরো দুনিয়া জুড়ে আছে বলেই বোধহয় অনেক মানুষ জীবন থেকে সহসা ছিটকে পরেনা। আর বোধ করি সেসব ভালমানুষের সংখ্যা এখনো বেশী বলেই দুনিয়া এখনো টিকে আছে।

ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে