আমি তুমিতেই আসক্ত পর্ব-০৪

0
1943

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_৪
#সুমাইয়া_মনি।

সকালের মনােরম পরিবেশ মানবমনকে প্রফুল্ল করে। সারা আকাশ জুড়ে বৃষ্টিহীন সাদা মেঘের বিচরণ মনে প্রশান্তি এনে দেয়। বড়ো একটি প্রশান্তির নিশ্বাস নেয় নবনী। হাতে তার সে-ই টিফিনবাক্স। সকাল সকাল নাস্ত তৈরি করে নিলুফা বেগম নবনীকে দিয়ে নিভ্রর বাড়িতে যেতে বলে। নবনী আজ খুশি মুডে যেতে আরম্ভ করেছে। সেদিনের মতো রাগ দেখায় না। অবশ্য এর কারণ আছে। নবনী নিভ্রকে দেখতেই মূলত তার বাড়িতে যাচ্ছে। হোক সেটা খাবার দিয়ে আসার বাহানায়। নিভ্রকে দেখার অধিক ইচ্ছে পোষণ করছে মন। তাই আম্মুর কথা অনুযায়ী দ্রুত টিফিনবাক্স হাতে নিয়ে বের হয়। মাঝপথে আকাশের দিকে তাকিয়ে সকালের মনোরম পরিবেশটা একটু উপভোগ করে নিলো। সোজা হাঁটা ধরল নিভ্রর বাড়ির উদ্দেশ্যে। গেট আগের দিনের মতোই খোলা ছিল। যার দরুণ ভেতরে যেতে অসুবিধা হয় না। ভেতরে এসে দু তিন কদম এগোতেই সে-ই কুকুরটির মুখোমুখি হয় নবনী। ভয়াবহ দৃষ্টিতে কুকুরটি তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেন চোখ দিয়ে তাকে গিলে খেতে প্রস্তুত! শুঁকনো ঢোক গিলে নেয় নবনী। প্রচণ্ড ভয় লাগছে।
একবার ভাবে নিভ্রকে ডাকবে। কিন্তু পরক্ষণে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে ঘরের দরজা খোলা। তাই আল্লাহর নাম স্মরণ করে জোরে দৌড় দেয় ঘরের দিকে। কুকুরটি ঘেউঘেউ করতে করতে নবনীর পিছু ছুঁটতে আরম্ভ করে। নবনী এক দৌড়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে নিভ্রর রুমে ঢুকে আলমারির পিছনে লুকিয়ে রয়।

এদিকে কুকুরটি নিভ্রর রুমের সামনে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড জোরে ঘেউঘেউ করছে। নবনী ভয়তে বাটি শক্ত করে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। ভাবছে এই বুঝি কুকুরটি ভেতরে প্রবেশ করে কামড় দিবে।
রীতিমতো নিভ্র টাওয়াল পড়া অবস্থায় বাথরুম থেকে বের হয়। দেখে মনে হচ্ছে সদ্য গোসল সেরে বের হয়েছে। তার পোষা কুকুর টমির ঘেউঘেউ আওয়াজ শুনে দ্রুত পায়ে রুমের বাহিরে আসে। নিভ্রকে দেখে টমি থেমে যায়। নিভ্র টমিকে শান্ত ভঙ্গিতে ইশারায় জিজ্ঞেস করে,
-“কি হয়েছে?”

টমি চুপ থেকে নিভ্রর রুমের দিকে তাকায়। নিভ্র টমির চাহনি দেখে কিছু একটা আন্দাজ করে। মাথায় হাত রেখে চুলকিয়ে দিয়ে টমিকে যেতে বলে। টমি চলে যায়।
নিভ্র রুমে ফিরে আসে। রুমে এসে চারদিক নজর বুলায়। নিভ্রর আন্দাজ যদি সঠিক হয়, তাহলে রুমে কেউ আছে।
তাই হয়। আলমারির পিছনে দু’টি অচেনা পা দেখতে পায়।
নিভ্র দ্রুত বিছানার উপর থেকে স্লিক হোয়াইট নাইটিটি পড়ে নেয়। কন্ঠে কিছুটা গম্ভীর ভাব এনে বলে,
-“আলমারির পিছন থেকে বেরিয়ে এসো।”

হঠাৎ নিভ্রর কন্ঠের স্বর শুনে চট করে চোখ মেলে তাকায় সে। এখন আর কুকুরের ঘেউঘেউ শব্দ কানে আসছে না। নিভ্র কোথায় দাঁড়িয়ে ডাকছে সেটা দেখার জন্য মাথা সামনের দিকে ঝুঁকে। দেখে নিভ্র সে-ই শান্তশিষ্ট নরম ভাবভঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নবনী দ্রুত মাথা পিছিয়ে নিয়ে চোখ জোড়া ফের হালকা বন্ধ করে নেয়। মনে মনে ব্লাশিং হয়ে বিড়বিড় করে,
-“উফফ! এই লোকটাকে যতবার দেখি, ততবারই আমি কেমন কেমন যেন হয়ে যাই। যেন নিজের মধ্যে থেকে দূর দূরন্তে কোথাও হারিয়ে যাই।”

-“ক্যান ইউ হেয়ার মি?”

নিভ্রর ফের কন্ঠের স্বর শুনে চোখ মেলে তাকায়। তারপর নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করে মাথা নত করে বেরিয়ে আসে আলমারির পিছন থেকে। নিভ্রর চোখেমুখে এক জাঁক বিরক্ত এসে ভর করল। নবনীকে দেখে নয় বরং এমন দৃষ্টি নত করে রাখার জন্য। নিভ্রকে রাগিয়ে বিরক্ত করে তুলে। সব আসামি,চোর দের দৃষ্টি এমন নত দেখে এসেছে সে। কিন্তু নবনীর ক্ষেত্রে এটা আলাদা। না সে আসামি,না চোর। তবে কেন দৃষ্টি নত তার। ভেবেই বিরক্ত নিভ্র। বলে,
-“আমার রুম থেকে কিছু চুরি করেছো কী?”

নবনী অবাক! দ্রুত মাথা এদিক সেদিক দুলিয়ে না সূচক জবাব দেয়। নিভ্র এবার রাগ ঝেড়ে বলে,
-“তাহলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

-“এমনি।” আমতা আমতা করে জবাব দেয় নবনী।

-“আই ডোন্ট লাইক ইট। লুক এট মি?”

ধীরেধীরে চোখ তুলে তাকায় নবনী। নিভ্র ফের শান্ত কন্ঠে বলে,
-“গুড!”

নবনী হাতের টিফিনবাক্স এগিয়ে দিয়ে নরম স্বরে বলে,
-“আম্মু দিয়েছে।”

-“ওয়েট!” বলেই নিভ্র কিচেন থেকে আগের টিফিনবাক্স টা নিয়ে এসে নবনীর দিকে এগিয়ে দেয়।

-“এটা নিয়ে যাও। আর এটা দেও আমাকে।” আগেরটা দিয়ে নতুনটা নিয়ে নেয় নিভ্র।

নবনী ফের দৃষ্টি নত রেখে বলে,
-“আমি আসি।”

-“যেতে দেবো না।” নিভ্র অকপটে বলে ওঠে।

নবনী হতবিহ্বল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিভ্রর দিকে। নিভ্র মুখে বিরক্ত ভাব টেনে বলে,
-“আমার সামনে মাথা নিচু করে কক্ষনো দাঁড়াবে না। চোখে চোখ রেখে কথা বলবে। মাইন্ড ইট। নাউ গো..।”

নবনী অতিদ্রুত পায়ে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। গেট পর্যন্ত এক প্রকার দৌড়ে বের হয় কুকুরের জন্য। বুকে হাত রেখে বড়ো নিশ্বাস নেয়। নিভ্রর সম্পর্কে বিড়বিড় করতে করতে বাড়ির ভেতরে আসে।
___________________
আপনের বিয়ের তোড়জোড় চলছে। সামনের মাসের তেরো তারিখে বিয়ের ডেট ফেলেছে। হাতে মাত্র অল্প ক’দিন বাকি আছে। আদি সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে ফোন টিপছে। পাশেই তার মা ও চাচি মা পাশে বসে ফোনে তাদের আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আদির বাবা আর আপনের বাবা দু ভাই৷ সম্পর্কে আদি,আপন চাচাত ভাই। জয়েন্ট ফ্যামিলি ওদের। মেয়ের সংখ্যা কম তাঁদের বংশে। বোন নেই বললেই হয় ওদের। কার্ড ছাপানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দু চাচা মিলে কার্ড সিলেক্ট করছিলেন। আদির বাবা আজিম উদ্দীন আপনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করল,
-“আপন এই কার্ডটি কেমন বল?”

আপন পাশের টেলিবে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল। চাচ্চুর ডাকে ঘুরে তাকায়। বলে,
-“তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ। একটা সিলেক্ট করে নেও চাচ্চু।”

আজিম উদ্দীন মৃদু হেসে নজর সরিয়ে নিয়ে ফের কার্ড দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে আপন হঠাৎ আনমনা হয়ে যায়। চোখ তুলে একবার সবার দিকে তাকায়। তার বিয়ে নিয়ে কত খুশি তারা। দেখে মনে হচ্ছে যেন ঈদের চাঁদ হাতে পেতে চলেছে। নজর সরিয়ে সরু নিঃশ্বাস ফেলে আপন।
আবার কাজে মন দেয়। আপনের এমন করুণাময় মুখখানা সবার চোখ এড়ালেই আদির চোখে এড়ায়নি। সে কিছু একটা ঠিক আন্দাজ করতে পেরেছে।
.
.
পরের দিন করেজে নবনী,মায়া ক্লাস শেষ করে বের হতেই কিছু মেয়েদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখতে পায়। আর তাঁদের চেহারায় কেমন লজ্জাজনক ভাব ফুটে ওঠেছে। কাকে দেখে মেয়েরা এত লজ্জা পাচ্ছে সেটা দেখার জন্য নবনী ও মায়া রেলিং ধরে উঁকি দিতেই নিভ্রকে দেখতে পায়। নিমিষেই নবনীর রাগ ওঠে যায় মেয়েদের ওপর। রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাঁদের দিকে। এতে তাঁদের তোয়াক্কা নেই।

নিভ্র মূলত কলেজের প্রফেসরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। এই কলেজ সম্পর্কে কেউ একজন ইনফরমেশন দিয়েছে, এখানের ছাত্ররা গাঁজা ও ইয়াবা লুকিয়ে বিক্রি করে। যার মাধ্যমে আজ তার এখানে আসা। ইউনিফর্ম পরিধান নিভ্র প্রফেসরের সঙ্গে একা দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় কিছু মেয়েদের নজরে পড়ে। তারা নিভ্রর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
নবনীর সেটা সহ্য হচ্ছে না, কিছুতেই না। মায়ার হাত ধরে নিচে আসে। নিভ্রর কাছ থেকে যাওয়ার সময় তার নজরে পড়ে না নবনী। সে তো কথা বলায় ব্যস্ত। এটা দেখে নিভ্রর ওপর ক্ষেপে যায় সে। নিভ্রর কয়েক হাত পিছনে দাঁড়িয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। মায়া সন্দিহা চোখে নবনীকে দেখছে। এই মেয়ে করতে চাইছে কি? বুঝতে সমস্যা হচ্ছে মায়ার। চট করে নবনী মায়াকে বলে,
-“আমাকে ধাক্কা দে।”

-“কেন?” সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে মায়া।

-“দে! তারপর বলছি।”

মায়ার অনিচ্ছা সত্ত্বেও নবনীকে আস্তে করে ধাক্কা দেয়। এতে নবনী এক চুল পরিমাণও নড়ে না। তা দেখে নবনী রাগী নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
-“আরে জোরে ধাক্কা দে বাল।”

বলতে দেরি মায়ার ধাক্কা দিতে দেরি হয় না। নবনীর বাহুতে হাত রেখে জোরে ধাক্কা দেয়। এতে করে নবনী কাত হয়ে দ্রিম করে পড়ে যায়৷ মায়া মুখে হাত রেখে চোখ বড়ো করে দাঁড়িয়ে রয়। কথা বলার এই পর্যায়ে নিভ্র পিছন থেকে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকায়। একটি মেয়েকে মাটিতে পড়া অবস্থায় দেখে চটজলদি হেঁটে হাঁটু গেড়ে বসে দু বাহুতে হাত রাখে। শান্ত কন্ঠে বলে,
-“তুমি ঠিক আছো?”

নবনী খুশিতে আত্মহারা। নিভ্রর এটেনশন পেতেই তো এমন কারসাজি করতে হলো। এখন নিজের কাছে কি যে ভালো লাগছে। ভাষায় প্রকাশ কথা সম্ভব নয়। নবনী কিছু না বুঝার ভান ধরে নিচুস্বরে বলে,
-“আমি ঠিক আছি স্যার।” বলেই নবনী নিভ্রর দিকে তাকায়।

-“নবনীতা তুমি?” সেই আগের মতো শক্ত ভাবভঙ্গিতে প্রশ্ন করে নিভ্র।

-“জি।” ছোট উত্তরে বলে।

-“পড়ে গেলে কি করে?” কথাটা বলতে বলতে নবনীকে ধরে ওঠায় নিভ্র।

নবনী আমতা আমতা কেটে নিভ্রর দিকে একবার তাকিয়ে নজর সরিয়ে নেয়। বলে,
-“মায়াকে ধরতে গিয়ে..।”

-“পায়ে ব্যথা পেয়েছো?”

-“নাহ! স্যার।”

-“ওকে,বাই।” বলেই নিভ্র ফের প্রফেসরের সঙ্গে কথার বলতে এগিয়ে যায়।

এতক্ষণ নীবর স্রোতার মতো সেই মেয়ে গুলোর সঙ্গে মায়াও নবনীর কারসাজি দেখে যাচ্ছিল। তারা নির্বোধ। নবনী ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের দিকে ক্রোধ চোখে তাকায়। তারপর নিভ্রর আর নিজের দিকে হাতের ইশারায় কিছু একটা বলে। ইশারাটা ছিল এমন “সে আমার,তোমরা ভাগো।”
এমন মারাত্মক ইশারা পেয়ে মেয়েরা আহাম্মক হয়ে তাকিয়ে রয়। সঙ্গে মায়াও। নবনী ভাব নিয়ে পিছনে ফিরে মায়ার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল কলেজের বাহিরে। মায়া বিস্ময়কর দৃষ্টিতে এখনো নবনীকে দেখছে। এ মেয়ে যে পুলিশের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, সেটা যে কেউ তার হাবভাবে বুঝতে বাধ্য। মায়া নিজেও বুঝতে পারে। এখন শুধু নবনীকে প্রশ্ন করা বাকি রয়েছে।
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে