আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে পর্ব-০১

0
799

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(1)
#Fiza siddique

ভরা কলেজের মাঠে, ঠিক একদমই মাঝবরাবর দাড়িয়ে আছে অরুনিকা। জায়গাটা যেনো কেউ বাছাই করেই দিয়েছে ওর জন্য। সূর্য ঠিক মাথার উপর থাকে এটাই পরিকল্পনাকারীর উদ্দেশ্য যেনো। তপ্ত প্রখর সূর্যের তাপও আজ হার মানছে এই তেজস্বীর কাছে।

অরুনিকার ভেতরে জ্বলতে থাকা তেজ এই সূর্যের তেজের কাছে হার মেনে নিলো। হঠাৎই দগ্ধ উত্তাপ পরিবেশটা কেমনই শীতল হতে লাগলো। নিজের পরাজয়ে লজ্জিত সূর্য খুব সন্তর্পনে মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়ে ফেলেছে। পরিবেশ শীতল হলেও অরুনিকার ভেতরে জ্বলতে থাকা তেজ যে এখনও বিদ্যমান। আকষ্মিক মুষলধারে বৃষ্টিতেও একচুল পরিমাণও নড়লোনা সে। পাশ থেকে ভেসে আসছে কিছু ছেলেমেয়ের চিৎকার। তারা সবাই চিল্লিয়ে অরুনিকাকে ভিজতে বারণ করছে। কিন্তু বরাবরের মতোই এবারেও ফলাফল শূন্য।

ভীষণ জেদী এই মেয়েটার মনটা কাঁচের মতোই স্বচ্ছ, একদমই পরিষ্কার। নেই কোনো জটিলতা, নেই কোনো হিংসা। সূর্যের মতো তেজ অথচ ভোরের আলোর মতো পবিত্র। দূর থেকে এইসব চিন্তা করতে করতে এগিয়ে আসে আদাভান। তবে এখনও যে মাঠের মাঝে অরুনিকাকে এইভাবে দেখতে পাবে তা কল্পনাতীত ছিলো তার। শাস্তিটা যদিও সেই দিয়েছিলো তাও ভীষণ রাগ লাগছে এভাবে এই মুহূর্তে অরুনিকাকে দেখে তার। রাগের কারণটাও তার কাছে অজানা।

কারোর ডাক শুনে সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে দেখে অরুনিকার বন্ধুরা তাকে কিছু একটা বলতে চাইছে সেই সাথে ভয়ও পাচ্ছে। আলেয়া, নূর আর আদিত্যকে অভয় দেখিয়ে কি হয়েছে বলতে বলে আদাভান।

“স্যার অরুর বৃষ্টির পানিতে অ্যালার্জি আছে। প্লীজ আপনি একটু ওকে বলুননা সরে আসতে। আমাদের কারোর কথা শুনছেনা অরু। আপনি বললে সরে আসবে।” ভয় নিয়ে একদমে কথাটা বলে শেষ করে আলেয়া। তবে এরপর যে আদাভান কী করবে তা কারোরই জানা নেই। কলেজের বেশ রাগী স্যার হিসেবে পরিচিত উনি। কমবেশী সবাই বেশ ভয় পেয়েই চলে ওনাকে।

আদাভান একবার অরুনিকার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে গেলো বৃষ্টির মাঝে। উদ্দেশ্য অরুনিকাকে ফিরিয়ে আনা সেখান থেকে। অরুনিকাকে বেশ ভালো করেই চেনে, নিজে গিয়ে যদি না নিয়ে আসে তবে আরও কিছুটা সময় এইভাবেই দাড়িয়ে থাকবে সে। এতে কারোর কিছু হবে কিনা জানা নেই তবে তার ভিতরে ভীষণ জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে যাবে। মাঠের মাঝবরাবর গিয়ে অরুনিকার ঠিক সামনে গিয়ে দাড়ায় আদাভান। অরুনিকার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে। কয়াকমুহূর্তেই মেয়েটার মুখ র/ ক্ত/ বর্ণ ধারণ করেছে। চোখ দুটো টকটকে লাল, গালে একটু টোকা দিলেই যেনো র/ ক্ত বেরিয়ে আসবে, গোলাপি ঠোঁট কেমন ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে। বুকের মধ্যে কোথাও যেনো ছ্যাত করে উঠলো আদাভানের। আর একমুহুর্ত অপেক্ষা না করে নিজের ডানহাতে অরুণিকার বাম হাতটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে যাই কলেজ বিল্ডিংয়ের দিকে। অরুনিকাও আর জোর খাটায়নি নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য। শরীরের সমস্ত শক্তি যেনো ফুরিয়ে আসছে, দুই চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় সবাই বাড়ির দিকে রওনা দেয়। অরুনিকা আর আলেয়াকে রিক্সায় তুলে দিয়ে সেও বেরিয়ে পড়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে জবুথবু অবস্থা তার। দ্রুত বাড়ী ফিরে শাওয়ার নেয় আদাভান। রাতে ঘুমানোর আগে আজ সারাদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো সৃতিচারণ করে আদাভান।

আজকে অরুনিকাদের প্রথম ক্লাস ছিলো আদভানের। লেকচারের মাঝে হটাত করে কারোর কণ্ঠ পেয়ে পুরো ক্লাস সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

মে আই কামিং স্যার? অরুনিকার কথাতে ভীষণ বিরক্ত হয় আদাভান। লেকচারের মাঝে ডিস্টার্ব তার একদমই পছন্দ নয়। আদাভানের নাহবাচক উত্তরে ভীষণ মন খারাপ হয় অরুনিকার। তারপর আবার বললো,

“সরি স্যার। আজকেই লেট হয়ে গেছে। আর কখনও হবেনা। প্লীজ এবারের মতো ক্লাসে আসতে দিন।”

“ওকে। বাট নেক্সট টাইম যেনো খেয়াল থাকে কথাটা।” আদভানের সম্মতি পেয়ে চুপচাপ গিয়ে বসলো তার বন্ধুবান্ধবের পাশে। আদাভানও লেকচার কন্টিনিউ করলো। মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করার মাঝে নূর অরুনিকার বিনুনী ধরে টান দেওয়ায় মৃদু চিৎকার করে ওঠে অরুণিকা। অরুনিকা নিজেও বুঝতে পারেনি শব্দটা এত জোরে হবে। সামনে তাকাতেই ভীষন ঘাবড়ে যায় সবাই। রাগী চোখে তাকিয়ে আছে আদাভান। তারপর দাঁতে দাঁত চেয়ে বলে, গেট আউট ফ্রম মাই ক্লাস। অরুনিকা আবারো মাথা নীচু করে বলে, সরি স্যার।

সরি? বারবার ভুল করবে আর বারবার সরি বললেই সব ঠিক হয়ে যাবে নাকি? এমনিতে দেরিতে এসেছো তার উপর ক্লাসের মাঝে অসভ্যতামি। তুমি এখনই আমার ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাবে। আর মাঠের মাঝখানে দাড়িয়ে থাকবে পুরো ক্লাস। অরুনিকা একবার বাইরের তাকায় তো একবার স্যারের দিকে। তারপর কিছু না বলেই বেরিয়ে যায় ক্লাস থেকে। এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লো আদাভান।

পরেরদিন কলেজে গিয়ে আদাভানের চোখ পরে উত্তর দিকের মেহগনি গাছের নীচে বসে থাকা আলেয়া, আদিত্য আর নূরের উপর। পরক্ষণে ভ্রু কুঁচকে ফেলে আদাভান। অরুণিকাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছেনা সে। কালকের অরুনিকার অবস্থার কথা মনে পড়তেই ভীষণ ভয় হতে লাগে আদাভানের, মেয়েটার কিছু হলোনা তো! বারবার এই কথাটা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। পরক্ষণে নিজের কাজে নিজেই বিরক্ত হয়ে ওঠে। মেয়েটার কিছু হলেও বা তার কি? তার চিন্তা করার জন্য ফ্যামিলি আছে, কিছু হলে ডক্টর আছে। ওর এতকিছু চিন্তা না করলেও চলবে। নিজেকে নিজে এসব বোঝাতে বোঝাতে এক পর্যায়ে বিড়বিড় করে বলে ওঠে, সব নারীই ছলনাময়ী। এরপর এক তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে ফুটে ওঠে। যেনো কোনো এক বেদনা লুকানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা। প্রচেষ্টা কোনো এক অতীতের পাতা বন্ধ করার।

টানা দুইদিন কলেজে আসেনি অরুনিকা। আদাভানের চোখ দুটো কলেজের আনাচে কানাচে খুঁজে বেরিয়েছে তাকে প্রতিটা মুহূর্ত। দুশ্চিন্তারা গ্রাস করে রেখেছে তাকে ভীষণ ভাবে। অরুনিকা কখনও ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার মতো মেয়ে নয়। চিন্তাটা হয়তো এখানেই বেশি। ভীষন অস্থিরতায় কেটেছে এই দুটো দিন আদাভানের। শেষে সিদ্ধান্ত নিলো আদিত্যর কাছে ব্যাপারটা জানার। নিজের মানসিক দুশ্চিন্তা দূর করার জন্য হলেও তাকে সবটা জানতে হবে। নিজের কেবিন থেকে বেড়িয়ে সিড়ির দিকে এগোতেই দেখতে পেলো আদিত্য আর নূরকে এদিকেই আসতে। কিভাবে জিজ্ঞাসা করবে কিছুই মাথায় আসছেনা আদাভানের। এভাবে একটা স্টুডেন্টের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা বিষয়টা ভীষণ দৃষ্টিকটু। প্রতিদিন তো কতো স্টুডেন্ট আসেনা, তাদের তো এইভাবে খোঁজ নেয়না সে। তবে আজ কেনো এমন মানষিক অশান্তিতে ভুগছে সে। প্রশ্ন অনেক থাকলেও উত্তর একটারও নেই আদাভানের কাছে। তাই বেশি কিছু ভেবে আদিত্যকে ডাক দিয়ে ফেলে।

স্যার এর ডাক শুনে সেদিকে এগিয়ে যায় আদিত্য আর নূর। ওদেরকে কাছে আসতে দেখে খানিকটা কাশি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নেয় আদাভান। তারপর সরাসরিই জিজ্ঞাসা করে, আসলে অরুনিকাকে দুইদিন কলেজে আসতে দেখছিনা। সেদিন তোমরা বললে ওর নাকি বৃষ্টিতে অ্যালার্জি আছে। চোখমুখও কেমন দেখাচ্ছিল। ঠিক আছে তো ও? না মানে বাড়াবাড়ি কিছু হয়নি তো আবার?

আদাভানকে এমন অগোছালো ভাবে কথা বলতে দেখে ভীষণ অবাক হয় দুজনে। তারপরও বলে, আসলে স্যার সেদিন থেকে ভীষণ রকম জ্বর অরুর। হসপিটালে অ্যাডমিট করতে হয়েছিলো। আজকে সকালেই হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরলো, অনেকটা ভালো আছে এখন। আপনি চিন্তা করবেন না। কাল থেকেই হয়তো আবার কলেজে আসতে শুরু করবে। আদিত্যর কথায় ভীষণ খারাপ লাগা কাজ করলো আদাভানের মনে। এই সবকিছুর জন্য নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছে তার।

আবারও রাতে শুয়ে শুয়ে অরুনিকার কথা চিন্তা করতে ঘুমিয়ে যায় আদাভান। পরের দিন সকাল সকাল নাস্তা সেরে খুব তারাতারিই বেরিয়ে যায় কলেজের উদ্দেশ্যে।

পরপর তিনদিন জ্বরের জন্য কলেজে যেতে পারেনি অরুনিকা। সেজন্য তার মনটা ভীষণ খারাপ। নিজের জেদের জন্য বারবার নিজেরই ক্ষতি করে বসে সে। কিন্তু রাগ, জেদের উপর ওর নিজের কোনো কন্ট্রোল থাকলে তো। ওইদিন কোনো দোষ না করেই আদাভান ওকে এমন শাস্তি দিলো তাইতো রাগে, জেদে এমন করলো। কিন্তু পরে নিজেকেই পস্তাতে হয়েছে। যার উপর জেদ করে নিজের ক্ষত করলো সে তো দিব্যি সুস্থ ছিলো। একটা বার তার খোঁজও নিয়েছে বলে মনে হয়না। করলা একটা, জন্মের সময় কেউ ওনার গালে মধু দেয়নি। কথা বললে মনে হয় কাক কা কা করছে। কলেজের মেয়েরা এই ব্যাটার উপর নাকি ক্রাশ খায়। বইন তোদের খাওয়ার আর জিনিস নেই? শেষমেষ ক্রাশ খেতে হলো তোদের? তাও আবার এই করলার উপর? এই চামচিকা কোনদিক দিয়ে ক্রাশ খাওয়ার যোগ্য বলে মনে হয় তোদের? নিজেকে তো মনে হয় আয়নায় দেখেনা কখনো। এক তো খাম্বার তো লম্বু, তার উপর রেগে গেলে মনে হয় অজগর ফ/ ণা তুলেছে। আজকে আসুক আমার সামনে ওই নিমতিতা, করলা। আমিও বুঝিয়ে দেবো আমি কি জিনিস। হুহ নিজেকে চকোলেট বয় মনে করে, আরে চকোলেট এত তিতা নাহ, চকলেট হওয়ার জন্য সুইট হতে হয় অনেক। যার এক বিন্দুও নেই ওইটার মধ্যে। নিজের মনে বকবক করতে করতে কলেজে ঢোকে অরুণিকা। আচমকা সামনে কিছু একটার সাথে ধাক্কা লাগায় মাথা তুলে তাকিয়ে ভয়ে চুপসে যায়। কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে এখান থেকে কেটে পড়ার চিন্তা করতেই সামনের মানুষটার কথা শুনে থমকে যায় সে। চোখদুটো বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে