অপ্রেমের একাত্তর দিন পর্ব-১১

0
104

অপ্রেমের একাত্তর দিন
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১১.

হসপিটাল জীবনের আজ মোহর পনেরো তম দিন। ঘুমটা ভাঙতেই সে দেখলো এক সম্পূর্ণ নতুন দৃশ্য। সতেরো বছরের এই ছোট্ট জীবনে এরকম দৃশ্য মোহ আগে কখনো দেখে নি। বাবা বেডের একপাশে হাত রেখে তার উপর মাথা ঠেকিয়ে ঘুমোচ্ছে। বাবা কি সারারাত এই অবস্থায়ই মোহর শিয়রে বসেছিলো? প্রশ্নটা মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই মোহ কিছুটা আপ্লুত হয়। হয়তো বাবার কাছে তার চাওয়া এতটুকুই ছিলো। মা হারা মেয়েটার মনের কোণে ছোট্ট চাওয়া হিসেবে বাবার সান্নিধ্যটাই কাম্য ছিলো আজীবন।

মোহ এবার তাকায় নিজের দু’পাশে। দুটো বালিশ দিয়ে কি সুন্দর তাকে অনেকটা ঘেরাও দেওয়া হয়েছে দু’পাশ থেকে। মোহর কাছে এই ব্যাপারটাও ভাল্লাগে। এই কাজটাও নিশ্চিত তার বাবা করেছে? মোহ কিছুটা জড়তা এবং সংকোচ নিয়ে শিহানকে ডাকতে নেয়। কিন্তু ডাকতে পারে না। এভাবে ডেকে বাবাকে কখনো ঘুম থেকে তুলে নি সে। ওসব তো মায়ার কাজ। সবার আম্মা সেজে বেড়ানোর অদ্ভুৎ শখ লালন করে ওই মেয়ে।

মোহ এক হাত বাড়িয়ে আঙুল দিয়ে শিহানের বাহুতে একটা গুতা মারে। শিহান জাগে না। মোহ আরেকবার একই কাজ করে নিজের হাত গুটিয়ে নেয়। এবার শিহান জেগে যায়। কাঁচা ঘুম ভাঙায় কিছুটা বিরক্তির রেশ তার কপাল জুড়ে। কিন্তু চোখ তুলে মেয়েকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই অস্বস্তিতে কাঠ হয়ে যায়। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে একাই বিড়বিড়িয়ে বলে,

“ ওওও! সকাল হয়ে গিয়েছে! আমার মর্নিং ওয়াক করতে হবে। হসপিটালে বসে থেকে পেট বেড়ে যাচ্ছে। ওজন কমাতে হবে। “

আপনমনে কথা গুলো বলতে বলতেই শিহান কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। মোহ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে বাবার যাওয়ার পানে। এই হসপিটালে মর্নিং ওয়াক কিভাবে করবে? এটা কি তাদের বাড়ির ফ্রন্ট ইয়ার্ড নাকি?

__________

বিকেল বেলা তখন। মোহ বসে ফোনে গ্রুপ চ্যাটিং পড়ছিলো। তাদের বন্ধুদের একটা মেসেঞ্জার গ্রুপ রয়েছে। সেই গ্রুপে মায়া এবং মোহও আছে। সবাই মূলত আজকের পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর মেলাতে ব্যস্ত। মোহর সেখানে বলার মতো কিছু নেই। তাই সে নীরবে কেবল দেখছে। গ্রুপে মায়াকেও মোটামুটি সরব দেখা যাচ্ছে। এম সি কিউর উত্তর মিলিয়ে দেখা গেলো মায়া ২৫ এর মধ্যে ২৩ টা এম সি কিউ ই সঠিক দাগিয়েছে।

গ্রুপের অন্যতম সদস্য জান্নাত আচমকা প্রশ্ন করে বসে,

“ মোহ, তোর কি অবস্থা? পরীক্ষার জন্য তোকে দেখতে আসতে পারছি না। এই ভিডিও কলে আয় না। অনেকদিন তোকে দেখি না। “

জান্নাতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরো কয়েকজন একই কথা বলতে থাকে। ফিহা তো সরাসরি গ্রুপে ভিডিও কল দিয়ে বসে। মোহ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। দ্রুত ফোনের ওয়াই-ফাই অফ করে ফোনটা কিছুটা দূরে বিছানায় পায়ের কাছে ছুড়ে মারে। সে এদের কাউকে ফেস করতে চায় না। খুব ইনসিকিউরড ফিল করে সে। ওরা যদি মোহকে নিয়ে আড়ালে মজা করে? মোহকে দেখতে যে ভয়ংকর লাগছে এটা নিয়ে যদি ঠাট্টা করে? কিংবা এমন কিছু যদি বলে বসে যেটা শুনে মোহর মনে কষ্ট জাগবে? উহু। মোহ এরকম কিছু চায় না। তাই তো সে ইচ্ছে করেই এদের ইগনোর করছে।

মোহর এরকম ভাবনার মাঝেই শিহান একজন নার্স সহ কেবিনে প্রবেশ করে। হাসি মুখে ট্রে হাতে প্রবেশ করা নার্সটা বলে উঠে,

“ গুড আফটারনুন মেহনামা! ইঞ্জেকশন দিতে হবে তোমাকে একটা। আজকে আমরা পোর্টের মাধ্যমে ইঞ্জেকশন দিবো। “

বলেই নার্সটা শিহানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“ স্যার, আপনি একটু কেবিনের বাহিরে যান কাইন্ডলি কিছুক্ষণের জন্য। “

শিহান একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,

“ বাহিরে যাবো? ভয় পাবে না তো? কান্নাকাটি করবে? “

মোহ মুহুর্তেই নিজেকে গম্ভীর দেখিয়ে বলে,

“ সবাই তোমার মতো ভীতু না। তুমি তো সামান্য তেলাপোকা দেখলেও এখনো লাফাও। আমি তোমার মতো ভীতু হই নি। “

শিহানের মুখটা থমথমে হয়ে গিয়েছে। হাঁটুর বয়সী একটা নার্সের সামনে তার মেয়ে উল্টো তাকেই নাস্তানাবুদ করে দিলো। আর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো শিহানের আরো ব্যক্তিগত ভয়ের ব্যাপার গুলো তার মেয়ে ফাঁস করে দিবে। সেরকম কিছু ঘটার পূর্বেই শিহান দ্রুত কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

নার্স হাসতে হাসতে মোহকে বলে,

“ সোজা হয়ে শুয়ে পড়ো। “

মোহ তা-ই করে। মনে মনে যথাসম্ভব চেষ্টা করছে ভয় না পেতে। কিন্তু তবুও ভয় করছে তার। পোর্টের মাধ্যমে ইঞ্জেকশন নেওয়ার অভিজ্ঞতা তার এই প্রথম। নার্স এসে আগে মোহর হসপিটাল গাউনের গলার কাছের দুটো ফিতা খুলে ড্রেসিংটা দেখে নেয়। পরপর নিজের হাত ভালো করে পরিষ্কার করে নেয় সে। ততক্ষণে আরেকজন নার্স এসে উপস্থিত হয়েছে রুমে। উনার কাজ হলো এক এক করে সব মেডিসিন এবং ড্রেসিং এর সরঞ্জামের প্যাকেট গুলো খুলে দেওয়া।

মোহ চোখ খিচে বন্ধ করে ফেলে। এসব প্রসেস সে দেখতে চায় না। মুহুর্তেই সে টের পায় তার বুকের এখানের ড্রেসিংটা ধীরে ধীরে খোলা হচ্ছে। ঠান্ডা জীবাণুনাশক তরল দিয়ে সম্ভবত জায়গাটা পরিষ্কার করছে নার্স। তারপর আচমকাই মোহ অনুভব করলো উক্ত জায়গায় কিছু একটার মাধ্যমে তাকে তরল মেডিসিন ইঞ্জেক্ট করা হচ্ছে। মোহ কিছু দেখলো না। তবে অনুভব করলো তার দম বন্ধ হয়ে আসছে যেনো। বুকের ভেতর অনুপ্রবেশকারী মেডিসিনটার অস্তিত্ব সে টের পেলো। সাধারণ ইঞ্জেকশন দেওয়ার মতো নয় এই অনুভূতি। খুবই ভিন্ন। আরো বেশি যন্ত্রণাময়। তবে মোহ বিড়বিড়িয়ে আল্লাহকে স্মরণ করতে করতে পুরোটা যন্ত্রণা হজম করলো। কারণ সে জানে কেবিনের দরজার ওপারেই তার বাবা আছে। ওই মানুষটা, যার সামনে মোহ পুরো জীবন নিজেকে শক্ত দেখিয়ে এসেছে। ওই মানুষটার সামনে দূর্বল হওয়া মোহকে সাজে না। তীব্র লজ্জা, অস্বস্তি এবং আড়ষ্টতা কাজ করে তার মাঝে।

__________

তেরো তলায় সর্বশেষ পেশেন্টকে ভিজিট করে কেবল বের হলো মনন। করিডোর হয়ে লিফটের দিকে অগ্রসর হতে হতে পকেট থেকে ফোনটা বের করে নেয় সে। অনলাইনে যেতেই নোটিফিকেশন বারে এক এক করে বিভিন্ন নোটিফিকেশন ভীড় জমাতে থাকে। এতো নোটিফিকেশনের ভীড়ে একটি নোটিফিকেশনে গিয়ে মননের দৃষ্টি স্থির হয়। দাদু তাকে মেনশন করে কিছু একটা পোস্ট করেছে। সেই পোস্টটা কি হতে পারে ভাবতে ভাবতে মনন লিফটে উঠে দাঁড়ায়।

লিফটের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সে ফেসবুকে প্রবেশ করে। মুহুর্তেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। দু বছরের মননের ছবি। সদ্য গোসল করে বের হওয়া দু বছরের মননের ভেজা চুল গুলো একপাশে বিলি কেটে আঁচড়ানো হয়েছে। কপালের এককোণে দেখা যাচ্ছে কাজল দিয়ে আঁকা বৃত্তাকার চাঁদ। পুরো শরীরটা একটা তোয়ালে দিয়ে মোড়ানো। মনন অনেকটা বিদ্রোহ করে সেই প্যাঁচানো তোয়াল ছেড়ে বের হতে চাইছে। ঠিক এমন সময় হাচ্চি আসার ফলে তার নাকে সর্দি দেখা যাচ্ছে।

কি লজ্জাজনক এবং বিব্রতকর একটা ছবি! মননের রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। বুড়োটা তাকে আর শান্তি দিবে না। মননকে হাড়ে জ্বালিয়ে এই লোক কি মজা পায় তা মননের জানা নেই। সে কঠিন দৃষ্টি বুলিয়ে একবার আলী আকবর সাহেবের লেখা ক্যাপশনটা পড়ে নেয়।

“ My dearest grandson Wasif Kaiser Monon. My one & only. A picture of his golden childhood. “

দুই ঘন্টা আগে আপলোড দেওয়া ছবিটাতে ইতিমধ্যে ৩০০ এর অধিক রিয়েক্ট এসে পড়েছে। কমেন্ট সংখ্যা দেখাচ্ছে ১২৭ টা। মননের আর ধৈর্য্য হয় না এসব দেখার। সোজা ফোনটা অফ করে সে পকেটে ভরে নেয়। তার ইজ্জতের নিহারি বানিয়ে বুড়োটা হয়তো এখন পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে খুব। মননের ইচ্ছে করছে মার্ক জাকারবার্গের কাছে বিশেষ আবেদন করতে যেনো আলী আকবর কায়সারের ফেসবুক ব্যবহারের লাইসেন্স ক্যান্সেল করে দেয়। তাহলে যদি একটু মনন স্বস্তি ফিরে পায়!

লিফট নির্দিষ্ট ফ্লোরে এসে থামে। দরজা খুলে যেতেই রাগের মাথায় মনন লিফট থেকে নেমে পড়ে। দেখার প্রয়োজন বোধ করে না কোন ফ্লোরে নেমেছে সে। দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দু চারটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলতেই ডাক শুনে,

“ আরে! বাচ্চাদের ডক্টর আপনি? “

মনন চমকে পাশ ফিরে তাকায়। দেখে একটা বেঞ্চিতে বসে থাকা মোহকে। পরপর সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় লিফটের দরজার পাশে লেখা ফ্লোর নাম্বারে। দশম তলায় নেমে পড়েছে সে ভুলবশত!

মোহ আবার ডাকে,

“ কি হলো? আপনি কি হারিয়ে গিয়েছেন? রাস্তা ভুলে গিয়েছেন? “

মনন লিফটের বাটনে ক্লিক করে মোহর পাশে এক সিট সমান দূরত্ব রেখে বসে পড়ে। শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে,

“ কেমন আছেন এখন? “

“ খারাপ তো ছিলাম না কখনো। ভালোই আছি। আপনার কি অবস্থা? “

“ আলহামদুলিল্লাহ। “

বলে মনন আশেপাশে তাকায়। লিফটের এই এরিয়াটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। সামনের করিডরে দু একজন পেশেন্টকে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে কেবল। মনন প্রশ্ন করে,

“ কেবিন ছেড়ে এখানে বসে আছেন কেনো? “

“ ডিনার করেছি একটু আগে। খাওয়ার পরে রুমে বসে থাকতে অস্থির লাগছিলো। তাই একটু হাঁটাহাঁটি করতে এসেছিলাম। “

“ একা কেন? ফ্যামিলি কোথায় আপনার? নার্সকে ডেকে নেন নি কেন? “

“ বাবা একটু বাহিরে সুপারশপে গিয়েছে। এখনই এসে পড়বে। নার্সও ছিলো এতক্ষণ সাথে। আমি কিছুক্ষণ বসবো বলায় কাউন্টারের ওদিকে গেলো। বাবা আসলেই রুমে চলে যাবো। “

মনন আর কিছু বলতে পারে না। দেখে লিফট প্রায় এসে পড়েছে। সে উঠে দাঁড়াতেই মোহ বুঝতে পারে ভদ্রলোক প্রস্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে তাড়া নিয়ে বলে,

“ আপনি ছাদে যান প্রতিদিন? “

মনন কিছুক্ষণ চুপ থাকে। কি বলবে সে? সত্যটা নাকি মিথ্যাটা? মোহ অবশ্য উত্তরের অপেক্ষা করে না। নিজেই আপনমনে বলে উঠে,

“ আমি ছাদে যাওয়া মিস করি। পুরো হসপিটালে ওই একটা জায়গাই আমার পছন্দের। মন খুলে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। “

আরে! কি মিল! মননের বলতে ইচ্ছে করে,

“ আমিও ওই জায়গাটায় স্বস্তি খুঁজে পাই। “

কিন্তু সে সেরকম কিছু বলে না। লিফট এসে হাজির ততক্ষণে। দরজা খুলে গিয়েছে। মনন ধীর গলায় বলে,

“ খেয়াল রাখবেন। আসি। “

মনন লিফটে উঠতেই নিবে এমন মুহুর্তে মোহ পিছন থেকে বলে উঠে,

“ কেবিনে বসে থেকে আমি বিরক্ত। আগামীকাল ছাদে যাবো। রাতের মুক্ত বাতাস খেতে। “

কথাগুলো মননের কানে পৌঁছায়। তবে সে আর পা থামায় না কিংবা পিছনে ফিরে তাকায় না। পিছনে ফিরে তাকানোর মতো কোনো কারণ নেই তার কাছে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে