অঙ্গীকার (৬ষ্ঠ পর্ব)

1
1976
অঙ্গীকার (৬ষ্ঠ পর্ব) লেখা- শারমিন মিশু সেদিনের পর থেকে রাদিয়া অনেকটা বদলে গেছে। আগের মত সেই চঞ্চল এখন আর নেই। নিয়মিত ইসলামিক জীবন যাপন পালন করার চেষ্টা করে। ভার্সিটিতে গেলে ও অহেতুক সময় নষ্ট না করে বাসায় চলে আসে। আবার মায়ের সাথে এখন সংসারের কাজে সহযোগিতা করে। দুপুরের পর দুইটা টিউশনি করে আগে থেকেই নিজের হাত খরচের জন্য। তবে আফিয়া আগের থেকে অনেকটা অচল হয়ে পড়েছে। ওর হাত পা গুলো ফুলে খুব খারাপ অবস্থার তৈরী হয়েছে। নামাজ ও প্রায় সময় বসে বসে পড়তে হয়। আজকাল নানারকম দুঃস্বপ্ন এসে ওর মনের মধ্যে ভর করে। এসব যখন শাফীকে বলে ও মুখের মধ্যে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে বলে,,, দূর পাগলী। তুমি অযথাই টেনশন করছো। আল্লাহর উপর থেকে ভরসা হারাবেনা। উনি সবসময় আমাদের সাথে আছে।
জবাবে আফিয়াও কিছু বলেনা। কিন্তু ও জানে যতটা চিন্তা ওর হচ্ছে তার থেকে বেশি চিন্তা শাফী করে। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়না। পুরুষ মানুষ গুলো আসলেই অনেক কঠিন মনের। এদের যত চিন্তা হোক বা যত বড় বিপদের সম্মুখীন হোক না কেন অফিসে কিংবা বাড়ীতে এরা পরিবারের কাউকে তা বুঝতে দেয়না। ঠান্ডা মাথায় সবকিছু সামাল দেয়ার চেষ্টা করে। এরা নিজেরা কষ্টে থাকলেও পাশের মানুষটাকে সেই কষ্টে নিমজ্জিত করেনা। খুব কম সংখ্যক পুরুষ আছে যারা নিজেদের কষ্টের কথাগুলো অন্যদের বলতে পারে। শাফীর ব্যবসার কাজ রেডি না হওয়াতে আফিয়ার পিছনে যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে পারছে। আসলে ও ইচ্ছে করেই ব্যবসাটা শুরু করেনি আফিয়াকে দেখভালো করার চিন্তা করে। আফিয়ার সব কাজগুলো বলতে গেলেই শাফীই করে দেয়। এমনকি আফিয়ার জামাকাপড় গুলো পর্যন্ত ও ধুয়ে দেয়। শাফী যখন থাকেনা মানে ওদের বাসায় যায় বা অন্য কোন দরকারে বের হতে হয় তখন মুনিরা কিংবা ওর রাদিয়া,,সামিহা এগুলো করে। আফিয়া শাফীকে বারবার নিষেধ করে এই বলে যে,, মা আছে রাদি আছে সামিহা আছে ওরা করতে পারবে আপনি এত কাজ কেন করবেন? -ওরা ওদের দায়িত্ব পালন করবে আর আমি আমারটা করছি। -তারপরেও আমার খুব খারাপ লাগছে। আপনি আমার কাজ করেন আর আমি শুয়ে থাকি। -তুমি কি ইচ্ছে করে শুয়ে থাকো? অসুস্থ দেখেই তো নাকি? -তারপরেও -আবার তারপরে কি? আচ্ছা আমাকে একটা কথা বলতো? আজ যদি তুমি অসুস্থ না থেকে আমি অসুস্থ থাকতাম তাহলে তুমি কি এভাবে বসে থাকতে? নাকি আমার সেবাযত্ন তুমি অন্য কাউকে করতে দিতে? -কখনোই না। -তাহলে আমার বেলায় কেন নিষেধ করছো? -আপনি পুরুষ মানুষ তাই। -আচ্ছা আমি পুরুষ বলে আমি ঘরের কাজ করলে তোমার অসন্মান হবে এটা কে বলেছে? স্বামি ঘরের কাজ করলে অসন্মানি হবে আর স্ত্রী করলে তাতে সন্মান বাড়ে? স্বামি স্ত্রীকে সাহায্য করলে এতে অসন্মান হয়না। এতে একজনের প্রতি আরেকজনের সন্মান বাড়ে,,,, তাদের মধ্যে ভালোবাসা বাড়ে। আমাদের রাসূল (সাঃ) ও তার স্ত্রীদের কাজ করতে সব সময় সাহায্য করতো। এতে কারো সন্মান কমে যায়না। কিছু পুরুষ আছে যারা নিজেদের সংসারের রাজা মনে করে থাকে। এদের কথা হলো বাহিরে কাজ করে এসে আবার ঘরে কেন করবো? কিন্তু এরা একবারো ভাবেনা ওই মেয়েটি ও ঘরে সারাদিন শুয়ে বসে থাকেনা। আমাদের তো অফিস থেকে ফিরার ওর একটু নিস্তার থাকে কিন্তু মেয়েটি সেই সকাল রাত পর্যন্ত তার ঘর সংসার আর সন্তানদের সামলাতে গিয়ে একটু বিশ্রাম নেয়ার ও সময় পাইনি আমরা যদি তাদের সাথে হাতে হাত লাগিয়ে একটু সাহায্য করি এতে তারা ও খুশি হবে এটা তারা ভাবেনা। তথাকথিত পুরুষদের মত শুয়ে বসে খাওয়ার অভ্যেস আমার নেই এটা তুমি ভালো করে জানো। আর এখন তো তুমি অসুস্থ। আর তোমাকে তো আমি ভালো করে চিনি,, তুমি সুস্থ থাকলে কখনোই আমাকে এসব করতে দিতেনা। এখন যখন একটু সুযোগ পেয়েছি তা হাতছাড়া করি কি করে। চুপচাপ বসে বসে অর্ডার করবে যা লাগবে আমি সবসময় প্রস্তুত আছি তা পালন করার জন্য। -আপনি খুব ভালো মানুষ। -জী আমি ভালো মানুষ কারন আমি আফিয়া বিনতে জাওয়াদের স্বামী। -সত্যি বলছি আমার জীবনের অনেক বড় অর্জন আপনাকে আমার করে পাওয়াটা। -জী জাযাকাল্লাহু খায়রান। আমিও ধন্য আপনাকে পেয়ে। -আচ্ছা একটা কথা বলি? যদিও এগুলো ঠিকনা তারপরও জানার ইচ্ছে আরকি। -বলো। -আপনি ছেলে নাকি মেয়ে হলে বেশি খুশি হবেন। মানে আপনার কোন ইচ্ছে আছে? -আফিয়া প্রশ্নটা আসলেই অবান্তর। ছেলে মেয়ে যা হোক না কেন আল্লাহ আমাদের খুশি হয়ে যে রহমত দান করবেন তাই আমি আনন্দচিত্তে গ্রহন করে নেবো। আর কখনো এসব বলবেনা। আমাদের কারো একটা পিপড়া বানানোর ক্ষমতা নেই সেখানে আমরা আল্লাহর দেয়া এই বিশেষ রহমতের উপর নারাজ হবো কেন? -আসলে এখন অনেক জায়গায় এই ব্যাপারগুলো নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় তো তাই জানতে চেয়েছি অন্য কোন দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। -তুমি আমাকে সেরকম ভেবেছো? -আরে না কি বলছেন আপনি সবার থেকে আলাদা। -হুম যারা এই ব্যাপারগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন আল্লাহ তাদের অভিসম্পাত করেন। এরা নামে মুসলিম কাজে নয়। সত্যিকারে মানুষ তো সেই যে সমস্ত বিপদ আপদ,, আনন্দ যাই হোক না কেন সবসময় আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করে। কত মানুষ একটা বাচ্ছার জন্য হাহাকার করে মরে আর এরা পেয়েও তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনা। এদের মতো নিকৃষ্ট মানুষ জগতে নেই। -আপনার কাছ থেকে কত কি যে শিখার আছে। সত্যি আপনার মত মানুষ হয়না। -শাফী হেসে বললো,,,আমার মত কেন হবে? আমার মতো করে আল্লাহ শুধু আমাকে বানিয়েছে আর দ্বিতীয়টা খু্জে পাবেনা। -আসলেই পৃথিবীতে এত কোটি কোটি মানুষ এদের কারো সাথে কারো বিন্দুমাত্র মিল নেই। -হুম আল্লাহ হলেন খুব নিপুণ এবং নিঁখুত কারিগর। এজন্যই তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। শুধু মানুষ কেন এইযে পৃথিবীতে এতো এতো গাছ আছে একগাছের পাতার সাথে আরেকগাছের পাতার ও বিন্দুমাত্রকোন মিল নাই। এতো পশুপাখি,, জীবজন্তু কোনকিছুর কারো সাথে কারো একটু মিলও নেই। তিনি এতো ক্ষমতাশালী যে মাত্র ছয়দিনে আসমান জমিন সৃষ্টি করেছেন কারো সাহায্য ছাড়াই। আর এজন্যই তিনি অদ্বিতীয়। -হুম এটা শুধু আল্লহই পারে। আল্লাহ ছাড়া তো এক চুল পরিমাণ নড়বার ক্ষমতা নেই। -হুম তুমি এখন কথা বন্ধ করে একটু ঘুমাও আমি একটু বাহিরে থেকে আসি এ বলে শাফী আফিয়াকে শুইয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। রাদিয়া ভার্সিটি থেকে ফিরে আসে দুপুর দেড়টা কি দুইটাই। কিন্তু এখন বাজে সাড়ে চারটা ও এখনো বাসায় ফিরেনি। আফিয়া আর ওর মা অনবরত কল দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু রিসিভ করার কোন নামগন্ধ নেই। এদিকে শাফীও আজ বাসায় নেই ওর বাবাকে ডাক্তার দেখাতে হবে তাই বাসায় গেছে। ও থাকলে ওকে দিয়ে খোঁজ খবর নেয়া যেতো। ওর বান্ধুবীদের মাঝে যে দুজনের নাম্বার আছে তাদের একজনের বিয়ে হয়ে গেছে আর অন্য মেয়েটা এখন দেশের বাড়ীতে ফোন দিয়ে জানতে পারলো। সবাই বেশ চিন্তার মধ্যে আছে। আত্মীয়দের মধ্যেও কারো কারো কাছে ফোন করাতে ওরা জানালো ওদের বাসায় যায়নি। ও যে বাসাতে টিউশনি করায় তারাও একি কথা জানালো। মুনিরা তো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। শাফীকে ফোন করতেই ও বললো বাবাকে বাসায় দিয়ে ও চলে আসবে।এই মেয়ের কোন কান্ডজ্ঞান নেই নাকি? বাসার এতোগুলো মানুষ ওর চিন্তায় অস্থির আর ও কোথায় গিয়ে বসে আছে। এতবড় মেয়ে হয়েছে যদি বুদ্ধিটা একটু থাকতো। এতক্ষন যাও ফোন ঢুকেছে এখন তাও সুইচ অফ বলছে। আচ্ছা ওর কোন বিপদ হয়নিতো? আল্লাহ না করুক এমন কিছু। আজকাল রাস্তাঘাটে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে রাস্তায় বেরোনোই মুশকিল। মুনিরা কাঁদতে কাঁদতে বললো,, আল্লাহ,,, তুমি আমার মেয়েটার হেফাজত করো পাঁচটার দিকে শাফী আসলো। ও সব কিছু শুনার পর যখনি বেরোতে যাবে রাদিয়ার কলেজের উদ্দেশ্যে ( একমাত্র ওই জায়গায় খবর নেওয়া বাকী আছে) শাফী ড্রয়িংরুমে বেরিয়ে আসতে তখনি বাসার ডোরবেলটা বেজে উঠলো……
চলবে………..

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে