অঙ্গীকার (শেষ পর্ব)

1
2430
অঙ্গীকার (শেষ পর্ব) লেখা – শারমিন মিশু শাফী বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবছে কত সহজেই আফিয়ার শূন্যতাটা পূরণ হয়ে গেছে। শাফীর ধারণা ছিলো আফিয়ার শূন্যস্থানটা কেউ পূরণ করতে পারবেনা। কিন্তু উপরওয়ালা কখন কার জন্য মনের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেয় এটা শুধু সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ জানতে পারেনা। যদি মানুষ জানতে পারতো কখন কার সাথে কি হবে তাহলে কেউ এভাবে শূন্যতায় ভুগতে পারতোনা। হ্যা আজ আফিয়ার শূন্যতাটা পূরণ হয়ে গেছে! না আফিয়াকে ভুলে যেতে পারিনি,, সেটা কোনদিনই সম্ভব না! তবু রাদিয়ার ভালোবাসার অনুভূতি গুলো আমি বুঝতে পারি! ওর প্রতি আমি অনেকটা দূর্বল হয়ে গেছি। নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয় আফিয়াকে স্ত্রী রূপে পেয়ে। কেননা ওর দ্বারাই আমি রাদিয়াকে আমার করেই পেয়েছি। সেদিন যদি আমাকে দিয়ে অঙ্গীকার না করাতো আমি হয়তো কখনোই রাদিয়াকে বিয়ে করতাম না। তবে রাদিয়া বোধহয় জানেনা,, ও যে গভীর রাতের নির্জনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে একা একা কাঁদে আমি তা দেখি! কি বলবো ওকে? ওর নিরব আর্তনাদ মাঝে মাঝে আমার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিতো। মেয়েটা রাগ দেখাতে পারে শুধু ভালোবাসাটা প্রকাশ করতে পারেনা। রাদিয়া যে কখন পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে শাফী বুঝতেই পারেনি। মৃদু ফোঁপানির শব্দে শাফীর চেতনা ফিরলো। শাফী তাকাতেই ও দ্রুত হাতে চোখের পানি মুছে নিলো। শাফী জানে রাদিয়া কেন কাঁদছে! বিয়ের দিন আফিয়ার প্রিয় শাড়ীটা পরার কারণে শাফী একদিন রাদিয়াকে অনেক কথা শুনিয়েছে। আজ আবার সেই একই ডিজাইনের শাড়ী শাফী রাদিয়াকে আজ গিফট দিয়েছে। তবে আফিয়ার শাড়ীটা নয় একই ডিজাইনের আরেকটা শাড়ী বেনারসী পল্লীতে গিয়ে অর্ডার দিয়ে রাদিয়ার জন্য বানিয়েছে। আফিয়ার শাড়ীটা তোলা থাক ওর স্মৃতি হিসাবে তাই শাফী দ্বিতীয় শাড়িটা বানিয়েছে। কি ব্যাপার কাঁদছো কেন? -আপনি আমার জন্য এই শাড়ীটাই কেন এনেছেন? -কেনো কোন সমস্যা? -আমি এ শাড়ী পরতে পারবোনা। হঠাৎ মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। আচ্ছা তুমি কি আমাকে বোকা ভাবো? নাকি ভাবো তোমার কষ্টটা আমি বুঝিনা। এখন এই মুহুর্তে প্রশ্নটা করা কি বড্ড জরুরী নাকি আমার আবদারটা পূরণ করা। আর কোন কথা না বলে রাদিয়া গিয়ে শাড়ীটা পরে নিলো। চোখে গাঢ়ো করে কাজল পরেছে। খোপায় শাফীর প্রিয় রজনীগন্ধার মালা। হাত ভর্তি লাল চুড়ি পরেছে। তারপর এক পা দু পা করে বারান্দার দিকে এগুলো। শাফী রাদিয়াকে দেখে হা হয়ে গেলো। মেয়েটা তো অনিন্দ্য সুন্দরী শাফী কাব্যের মত বিড়বিড় করে বললো,,, হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ির,, রিনিঝিনি আওয়াজ তুলে,, কে এলো হৃদয়ে কাঁপন ধরাতে! চোখে ধ্যাবড়ানো কাজল পরে,, সে আমায় মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিয়েছে! পরনে তার টুকটুকে লাল বেনারসী খোপায় তার প্রিয়তমের প্রিয় রজনীগন্ধ্যা জড়ানো। কে এই রমনী? চোখ তুলে তাকাতেই দেখি এযে… আমারি প্রেয়সী।
রাদিয়ার চোখে পানি চিকচিক করছে। রাদিয়া কিছু না বলেই ঘুরে দাঁড়ালো হয়তো আমার এই ড্যাবড্যাব করে তাকানোতে ওর লজ্জা লাগছে। রাদিয়া চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তার এই নীরবতা অসহ্য লাগছে এখন! কি হলো ওদিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছো কেন? শুনছো আমার কথা? – বলুন শুনছি রাদিয়ার কন্ঠে অভিমান। -ভালোবাসি!!! -বিশ্বাস করিনা!! -কেনো? -আপনি দায়ে পড়ে আমায় বিয়ে করেছেন। আর আমি আপনার স্ত্রী হওয়ার যোগ্য না!! -এবার খুব খারাপ লাগলো। ধমকে উঠলাম,, কেন বিশ্বাস করোনা? তোমার জন্য কি আমি কিচ্ছু করিনি? তুমি কেন বুঝোনা তোমাকে ভালোবাসি? তোমার বিশ্বাস করিনা কথাটা শুনে কতটা কষ্ট লেগেছে আমার তা তুমি বুঝোনা? একদিন কথার চলে হয়তো বলেছি তুমি আমার যোগ্য না আর আজ সেই কথাটাই তুমি ধরে বসে আছো! এতভাবে এখন ভালোবাসার প্রমাণ দিচ্ছি তবু ওইটুকু গ্লানি মুছে দিতে পারিনি তাইনা? হঠাৎ শাফীকে জাপটে ধরে ওর বুকে মুখ গুঁজে রাদিয়া শব্দ করে কেঁদে উঠলো। অনেকক্ষণ হলো কাঁদছে। শাফীর পুরো টিশার্ট টা ভিজে গেছে ও টের যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর রাদিয়ার মাথাটা তুলে দুহাতে মুখ ধরে শাফী কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। রাদিয়া কান্না ভেজা চোখগুলো আবেশে বন্ধ করে নিলো। ৪বছর পরে!!! এইযে শুনছেন!!! কি হলো তাড়াতাড়ি উঠেন! ফজরের নামাজের সময় চলে যাচ্ছে!! ভোরের আলো না ফুটতে রাদিয়ার সেই মায়া কন্ঠ। হুম আযান আমিও শুনেছি তবুও ইচ্ছে করে উঠিনি! রোজ অপেক্ষা করি ওর এই ডাকটার জন্য! অপেক্ষা করতে ভালো লাগে! কিন্তু আজ রাদিয়া ধরে ফেললো,,, বুঝেছি তো আপনি ইচ্ছে করে উঠেন না তাইনা!! রাদিয়ার হাতটা টেনে বসিয়ে দিলাম,, মুচকি হেসে বললাম,, হুম! -কেনো? -তুমি উঠাবে তাই। রাদিয়ার মুখটা লজ্জায় লাল নীল হয়ে যেতে দেখলাম। কোনমতে বললো,, হইছে আর ঢং করতে হবেনা। নামাজের সময় চলে যাচ্ছে বলে হ্যঁচকা টান মেরে শাফীকে উঠিয়ে দিলো। নামাজ পড়ে শাফী কোরআন তেলাওয়াত করে বাইরে বেরুলো হাটাহাটি করতে। এই কয়বছরে অনেক কিছু পাল্টে গেছে। বাবা মারা গেলো দুবছর আগে, ক্বাফী ইফতিকে নিয়ে এখন চিটাগাংয়ে থাকে। ওদের একটা ছেলে আছে নাম ইরাম। সালেহা বেগম ঢাকার বাসাতেই বেশি থাকে। মাঝে মাঝে ক্বাফীর ওখানে গিয়ে বেড়িয়ে আসে। রাদিয়া আগের থেকে অনেক বেশি সংসারী হয়ে গেছে। শাফী আর দুই মেয়ে ৭বছরের বুশরা আর ৪বছরের সায়রা কে নিয়ে ওর সংসার গড়ে উঠেছে। সকাল আটটায় শাফী বাসায় এসেছে। টেবিলে নাস্তা করতে বসেই মেয়েদের নিত্যদিনকার দৃশ্য চোখে পড়ে গেলো। প্রতিদিন এই মেয়ে দুইটার নাস্তা খেতে বসলেই ঝগড়া লাগবেই। এটা হবেই!! কখনো মিস হয়না। কিন্তু পরক্ষনেই আবার তাদের মিল দেখে কেউ বুঝবেনা এরা একটু আগেই ঝগড়া করে বেরিয়েছে। আজকের ঘটনা হলো,, ট্রেতে দুটো গ্লাসে মিল্কশেক রাখা!! অথচ তারা একটা নিয়ে টানাটানি করছে,, কারণ ওটা নাকি দুজনে প্রথমে দেখেছে তাই ঐটাই চাই। রাদিয়া যতই বুঝাতে চেষ্টা করছে যে যে দুইটাই একই জিনিস ওরা মানেনা! রাদিয়া তাও চেষ্টা করে যাচ্ছে। দেখার মত দৃশ্য। ওদের মারতে পারেনা আমার জন্য কারণ আমার কড়া নির্দেশ আমার বাচ্ছাদের গায়ে কোনভাবে হাত তোলা যাবেনা। আমাকে বেরুতে হবে! চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই রাদিয়া করুণ চোখে আমার দিকে তাকালো,, আপনি হাসছেন? সায়রাকে কিছু বলছেন না কেন? বড় বেয়াদব হচ্ছে দিন দিন বড় বোনকে মানে না! আমি কৃত্তিম রাগ দেখালাম! ওর কি দোষ বাচ্ছা একটা মেয়ে। তোমার বড় মেয়েটাও তো কম না! সে ছেড়ে দিলেই তো পারে। হয়েছে একেবারে মায়ের মত! কথায় কথায় আজকাল তো প্রায় বলে ক্ষিধে লাগলে নাকি তার পেটে ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। -আমরা মা মেয়ে না হয় একটু খাওয়া পাগল এজন্য আপনি সারাজীবন কথা শুনাবেন। আমি গম্ভীরভাব মুখে রেখে মনে মনে হাসতে থাকি। আমি জানি রাদিয়া এখন রাগ দেখিয়ে মনে মনে বকতে থাকবে। আমি ওখান থেকে সরে এলাম আস্তে করে। প্রায় প্রতিদিন এভাবেই শুরু হয় আমাদের সকাল। দিনশেষে যখন ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরি তখন রাদিয়ার এক কাপ চা সামনে বাড়িয়ে ধরা রাদিয়ার হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকাটা আমার সব ক্লান্তি দূর করে দেয়। আফিয়াকে করা অঙ্গীকারের মূল্য রাখতে আমি বাঁধা পড়ে গেছি রাদিয়াকে ভালো রাখার এক কঠিন অঙ্গীকারের বাঁধনে। যা থেকে বেরিয়ে আসার কোন সুযোগ নেই ১৫বছর পরে। রাদিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে একনাগাড়ে কেঁদে যাছে। আজ যে তার বুশরাটার বিয়ে হয়ে গেছে। আর মেয়েটা ওদের ছেড়ে অন্যের অধীনে চলে গেছে। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে রাদিয়া ঘুরে দাঁড়ালো। শাফী পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখেও পানি চিকচিক করছে। এই মানুষটা সহজে কাঁদেনা। আজ কয়েক বছর পরে রাদিয়া ওর চোখে পানি দেখলো। শাফী রাদিয়ার দুই কাঁধে হাত রেখে বললো,,, রাদি কাঁদছো কেন? আজ তো তোমার আনন্দের সময়? -আপনার চোখেও তো পানি। আপনি কাঁদছেন কেন? শাফী আর নিজেকে সামলাতে পারেনি। রাদিয়াকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। মনে হয় এতক্ষণ কান্না করার জন্য একটা জায়গা খুঁজছিলো এখন তা পেয়ে নিজের কষ্টগুলো প্রকাশ করছে। দুজনে কেঁদে যাচ্ছে সমানে। রাদিয়া কাঁদতে কাঁদতে বললো,,, আমি আমার কর্তব্য পালন করতে পেরেছি তো? -শাফী মাথা নেড়ে বললো,,, রাদিয়া তুমি সফল হয়ে গেছো। কিন্তু আমি কি পেরেছি এই কয়েক বছরের জীবনে তোমাকে ভালো রাখার যে অঙ্গীকার করেছি তা পূরণ করতে? -রাদিয়া কাঁদতে কাঁদতে বললো,,, আপনার মত ভালো জীবনসঙ্গী পাওয়া অনেক ভাগ্যের ব্যাপার। – পরক্ষণে শাফী মুখ তুলে বললো,,, আচ্ছা রাদি,, আজ যে সারাদিন কিছু না খেয়ে আছো তোমার পেটের ভেতরের ইঁদুর গুলা দৌড়াদৌড়ি করছেনা। -আচ্ছা আমাকে সারাজীবন এই একটা কথায় শুনিয়ে যাবেন নাকি? বয়স হয়েছে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে শুধু এই একটা অভ্যাস বদলাতে পারিনি বলে আপনি এভাবে কথা শুনাবেন? আর খুব যে বেশি খায় তাও তো না!!
-আচ্ছা আমাদের বুশরার কি হবে বলোতো? ও তো তোমারি মতো খাওয়া পাগল। তোমায় না হয় আমি সহ্য করেছি ওর জামাই কি আর ওর এই স্বভাব সহ্য করবে? -একদম আমার মেয়েকে নিয়ে কিছু বলবেন না। ওর বাবা যদি ওর মাকে আজ অবদি সহ্য করতে পেরেছে ওর জামাই ও পারবে। সবসময় এই এক খাওয়া নিয়ে কথা শুনা নো। আপনি যে ভীষন রকমের চা খোর তাই নিয়ে আমি কখনো কিছু বলি? -আমি তো একটু চা শুধু খাই তাও দিনে চার বার! কিন্তু তুমি তো সারাদিনই খাইতে থাকো। -আপনাকে আমি!! -কি করবে!! -কিছুনা -বাব্বাহ বেশ রাগ হয়েছো দেখছি! -রাগের আর কি দেখেছেন! এমন সময় সায়রা দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে বললো,, মা আপু ফোন করেছে তোমার সাথে কথা বলবে ? রাদিয়া আনন্দের সাথে বুশরা ফোন করেছে বলে বেরিয়ে যেতে যেতে শাফির দিকে আঙুল তুলে বললো,,, আমায় খাওয়ার খোটা দেওয়ার শাস্তি হিসেবে আপনার আজ রাতের চা বন্ধ। বুশরার সাথে কথা বলতে বলতে রাদিয়া অন্যরুমে চলে গেলো। শাফী ওদিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। জানে রাদিয়া ঠিকই কিছুক্ষণ পরে চা নিয়ে হাজির হবে। শাফী বললো,, এই তো আছি বেশ আছি। আল্লাহ আমার সংসারটাকে আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছে। রাদিয়া আসার পরে আফিয়ার শূন্যতাটা পূরণ করে পূর্ণতায় ভরিয়ে দিয়েছে। শাফী মনে মনে আফিয়াকে স্মরণ করে বললো,,, আফিয়া তোমাকে করা সেই অঙ্গীকারটা আজ আমি পরিপূর্ণ করেছি। তুমি শুনছো আজ আমি সফল হয়েছি। মসজিদ থেকে সুমধুর কন্ঠে ঈশার নামাজের আযানের শব্দ ভেসে আসছে। চোখের কোণের পানিটা হাতের পিঠ দিয়ে মুছে শাফী বেরিয়ে পড়লো নামাজের উদ্দেশ্যে। ভালো থাকুক ভালোবাসা। জীবনে একটু হতাশায় ভেঙে না পড়ে জীবনকে আরো একবার সুযোগ দেয়া উচিত। কে জানে কখন সৃষ্টিকর্তা আপনার জীবনে চমৎকার কিছু এনে দিবে। পাশের মানুষটিকে নিয়ে ভালো থাকুন আর ভালো রাখুন। সমাপ্ত জানিনা কতটুকু ভালো হয়েছে বা কতটুকু আপনাদের মন ছুঁয়েছে তা আপনারা বিবেচনা করবেন। তারপরও আপনারা মন দিয়ে আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কারণ আপনাদের মত পাঠকরা আছেন বলেই আমি লেখার শক্তি পায়।

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে