#Revenge_of_love
#Nusrat_Jahan_Bristy
#Part_12
জ্যামের মাঝে বসে আছে রাফি প্রায় পনেরো মিনিট ধরে। চোখে মুখে ফুটে আছে বিরক্তের ছাপ। মন চাইছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলার উপর দিয়ে নিজের গাড়ি চালিয়ে চলে যেতে। মনে মনে রাফি ইচ্ছে পোষণ করছে যদি নিজের কাছে কোনো পাওয়ার থাকতো তাহলে খুব ভালো হত এভাবে রোবটের মতো বসে থাকতে হত না। রাফি তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে স্টেয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়িটা সামনে নিয়ে যায় ফাঁকা জায়গাটা পূরণ করার জন্য। চোখ বন্ধ করে সিটে মাথাটা হেলান দিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই একটা দৃশ্য দেখে ম্লান হেসে উঠলো।
রাফির গাড়ির পাশেই একটা রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে। আর রিক্সাতে বসে আছে দুজন কপোত কপোতী। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সদ্য বিবাহিত একটা দাম্পত্য। মেয়েটা লজ্জা রাঙা মুখ নিয়ে বসে আছে আর ছেলেটা তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ছেলেটি হাত বাড়িয়ে মেয়েটার খোপায় থাকা বেলি ফুলের মালাটা স্বযত্নে ঠিক করে দিলো। রাফি এই মনোরম দৃশ্যটা দেখে চোখ বন্ধ করে নেয়। তার মস্তিষ্ক এমন একটা সুন্দর স্মৃতি রয়েছে। যে স্মৃতিটা চোখ বন্ধ করে মনে করার প্রচেষ্টা করে রাফি।
অতিত……
নন্দিতা আর সুহা মুখোমুখি হয়ে লাইব্রেরীতে বসে আছে। দুজনেরই সামনে বই আছে কিন্তু বই পড়াতে কোনো মনযোগ নেই, মনযোগ আছে আড্ডা মারাতে। এর মাঝে সুহা হঠাৎ করে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। সুহাকে এমন করে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে নন্দিতা অবাক হয়ে বলে।
“কি হলো? এভাবে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? মনে হচ্ছে যেন কেউ তোর চেয়ারের নিচে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে আর তুই সেটা সহ্য করতে না পেরে ঠাস করে দাঁড়িয়ে পরলি।”
সুহা মুচকি হেসে বলে, “আসলে কি বলত আমার না একটু ওয়াশরুমে যেতে হবে।”
নন্দিতা ভ্রু কুচকে বলে, “মাত্রই তো ওয়াশরুম থেকে আসলি।”
সুহা চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলে, “এত প্রশ্ন করছিস কেন তুই হুম? পুলিশও মনে হয় এত প্রশ্ন করে না আসামিদের তুই যতটা করছিস।”
কথাটা বলেই সুহা কাঁধে ব্যাগ চাপিয়ে ড্যাং ড্যাং করে লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে যায়। নন্দিতা সুহার যাওয়ার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে বলে।
“মানেটা কি? কি এমন বললাম যে ও নিজেকে নিজেই আসামি বানিয়ে ফেলল। অদ্ভুত।”
“বান্ধবীকে যদি দেখা শেষ হয়ে থাকে তাহলে এবার পাশ ফিরে তাকান ম্যাডাম।”
হঠাৎ করে পুরুষালী কন্ঠ ভেসে আসাতে নন্দিতা পাশ ফিরে তাকাতেই চমকে যায় রাফিকে দেখে। হাস্যজ্জল চেহারা নিয়ে নন্দিতার দিকে তাকিয়ে আছে হাতে লাল টকটকে একটা কাঠ গোলাপ ফুল নিয়ে। নন্দিতা কিছুক্ষণ রাফির দিকে তাকিয়ে দেখে বুঝতে পারলো সুহা কেন এভাবে চলে গেলো। নন্দিতা রাফির দিক থেকে নজর সরিয়ে নিয়ে লাইব্রেরীর চারপাশটা ভালো করে নজর বুলিয়ে নেয়। লাইব্রেরীতে বেশি স্টুডেন্ট নেই হাতেগোনা কয়েকজন স্টুডেন্ট হবে। নন্দিতা চাপা স্বরে বলে।
“আপনি এখানে কি করছেন?”
রাফি অভিমানী স্বরে বলে, “ফোন ধরো না কেন হুম? ইগনোর করা হচ্ছে বুঝি আমাকে।”
“ইগনোর করার কি আছে এখানে। ফোন সাইলেন্ট করা তাই বুঝতে পারে নি।”
“ওও আচ্ছা বুঝালম। এটা তোমার।”
রাফি কাঠ গোলাপ ফুলটা এগিয়ে দেয় নন্দিতার কাছে। নন্দিতা মুচকি হেসে ফুলটা নিতে যাবে সাথে সাথে রাফি ফুলটা সরিয়ে নেয়। নন্দিতা অবাক হয়ে বলে।
“কি হলো দিন?”
রাফি নিঃশব্দে হেসে হাত বাড়িয়ে নন্দিতার কানের সাইডে পড়ে থাকা চুল গুলা সরাতে থাকে। নন্দিতা রাফির কার্যক্রম দেখে চোখ বড় বড় করে বলে।
“কি… কি করছেন?”
রাফি চাপা স্বরে বলে, “চুপচাপ বসে থাকো।”
নন্দিতা ঢোক গিলে চুপচাপ বসে থাকে। রাফি স্বযত্নে নন্দিতার কানে কাঠ গোলাপ ফুলটা গুজে দিয়ে বলে।
“নাও পারফেক্ট আর দেখতেও খুব মিষ্টি লাগছে।”
নন্দিতা লাজুক হেসে মিহি গলায় বলে, “থ্যাঙ্ক ইউ।”
রাফি নন্দিতার লজ্জা পাওয়া দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসে। মনে মনে দুষ্টু বুদ্ধি এঁটে গলা খাকারি দিয়ে বলে।
“নন্দিতা তুমি না দেখতে খুব মিষ্টি সেটা কি তুমি জানো?”
নন্দিতা পিটপিট চোখে তাকালো রাফির দিকে। হঠাৎ করে এমন ভাবে কথা বলছে কেন রাফি? নন্দিতার বিস্ময়কর চেহারা দেখে রাফি ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে নন্দিতা দিকে হালকা একটু ঝুঁকে ফিচেল স্বরে বলে।
“ইচ্ছে করছে এই মিষ্টিটাকে এক্কেবারে খেয়ে ফেলতে।”
রাফি কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালো নন্দিতা। মানে লোকটা কি সব বলছে এগুলা মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি। নন্দিতার এখন মনে হচ্ছে এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে থাকলেই এই লোক উল্টা পাল্টা কথা বলে আর ওকে অস্বস্তিতে ফেলে দিবে। তাই নন্দিতা উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে উদ্যত হতে নিলে রাফি নন্দিতার হাত চেপে ধরে বলে।
“কোথায় যাচ্ছো?”
নন্দিতা চাঁপা গলায় বলে, “বাইরে যাচ্ছি। আর হাতটা ছাড়ুন প্লিজ কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।”
রাফি কাঁধ নাচিয়ে বলে, “কে কি ভাবলো তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।”
“কিন্তু আমার যায় আ…… ”
নন্দিতা কথাটা সমাপ্ত করতে পারলো না তার আগেই রাফি হেচকা টান মেরে নন্দিতাকে পুনরায় চেয়ারে বসিয়ে দিলো। নন্দিতা কপট রাগ দেখিয়ে বলে।
“কি করছেন টা কি আপনি?”
রাফি এবার কিছুটা রেগে বলে উঠে, “এই তোমাকে বলেছিনা আমাকে আপনি করে ডাকবে না।”
রাফির রাগ দেখে নন্দিতা নরম গলায় বলে, “তাহলে কি বলে ডাকবো?”
রাফি দু ভ্রু উচু করে বলে, “তুমি করে বলবে।”
“পারবো না। এটা আমার দ্বারা সম্ভব হবে না আর আপনি আমার থেকে বয়সে অনেক বড়।”
রাফি হতাশ হওয়ার ভান ধরে বলে, “কিহ? এই মাত্র কি তুমি আমাকে বুড়ো বললে নন্দিতা।”
নন্দিতা হতভম্ব হয়ে বলে, “আমি আপনাকে কখন বুড়ো বললাম।”
“তুমি জানো আমার বয়স কত, মাত্র পঁচিশ হবে হয়তো। আর আমার বয়স এতটাও বেশি নয় যে তোমাকে আমায় আপনি করে বলতে হবে।”
নন্দিতার মাথা ভনভন করছে রাফির কথা শুনে। এই লোকের মাথায় নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে না হলে এমন কথাবার্তা বলে কেন? নন্দিতা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে।
“তো আপনি চাইছেন আপনাকে তুমি করে বলি আমি।”
“আজ্ঞে ম্যাডাম।”
“আচ্ছা ডাকবো। এখন হাতটা ছাড়ুন আমাকে যেতে হবে।”
রাফি চেঁচিয়ে বলে ওঠে, “যাবে মানে আগে তুমি করে বলে যাও আমাকে।”
“আরে আস্তে কথা বলুন আমি বলছি তো আপনাকে তুমি বলে।”
“ওকে বলো! আই এম ওয়েটিং।”
রাফির কানে গাড়ির হর্নের আওয়াজ আসতেই নিজের সম্মতি ফিরে পায়। অতিতে স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এসে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে জ্যাম প্রায় জুটে গেছে। রাফি গাড়ির স্টেয়ারিং ঘুরাতে নিবে এমন সময় পাশে দাঁড়ানো ট্রাকের চালক বলে উঠে।
“আরে ওই মিয়া ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া গাড়ি চালান নাকি হুম। কহন থেকে ডাকতাছি আপনারে কানে কি কথা ঢুহে না।”
রাফি কিছু বলতে গিয়েও কিছু বলল না। অযথা নিজের জবান নষ্ট না করাই ভালো। তাই গাড়ি চালিয়ে নিজের গন্তব্য স্থানে এসে পৌঁছায়। অফিসে ঢুকতেই রাফির পিএ বিপ্লব সাহেব এসে বলেন।
“স্যার আপনার সাথে সিয়াম স্যার দেখা করতে এসেছেন?”
রাফি ভ্রু কুচকে বলে, “এত সকালে ও হঠাৎ আমার সাথে দেখা কেন করতে আসলো?”
“তা তো জানি না ওনি আপনার কেবিনে আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।”
“আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যান কাজ করুন গিয়ে।”
“ওকে স্যার।”
রাফি কেবিনের দরজা খুলে কেবিনে ঢুকে দেখে সিয়াম সোফায় পায়ের উপর পা তুলে পেপার পড়ছে। রাফির আসার শব্দ শুনে সিয়াম পেপারে নজর রেখেই বলে।
“এসেছি তাহলে তুই কতক্ষণ ধরে ওয়েট করছিলাম তোর।”
রাফি সোফায় বসতে বসতে বলে, “এত সকালে আমার অফিসে কি মনে করে?”
সিয়াম পেপার ভাঁজ করে টেবিলের উপরে রেখে বলে, “কেন তোর সাথে কি আমি দেখা করতে আসতে পারি না। নাকি এখন তোর সাথে দেখা করতে চাইলে আগে থেকে এপয়েন্টমেন্ট করে আসতে হবে।”
রাফি “চ” জাতীয় শব্দ উচ্চারণ করে বলে, “আমি এটা কখন বললাম তোকে। তুই একটু বেশিই বুঝে ফেলছিস না।”
“ঠিক যেমন তুইও একটু বেশি বুঝিস।”
রাফি ভ্রু কুচকে বলে, “আমি আবার কি বেশি বুঝে ফেললাম?”
সিয়াম তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে ঠান্ডা গলায় বলে, “দেখ রাফি অতিতে যা হওয়ার হয়ে গেছে এটা নিয়ে এখন পড়ে থাকলে হবে না। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাব।”
“তুই ঠিক কি বুঝাতে চাইছিস আমাকে একটু পরিষ্কার করে বলবি।”
“তোর আর নন্দিতার ব্যাপারটা। দেখ নন্দিতা এখন তোর বউ, তোর রেসপন্সিবিলিটি আগে যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন তোরা দুজনে চাইলে একটা সুন্দর সাবলীল জীবন কাটাতে পারিস।”
রাফি ক্ষীণ গলায় বলে, “এ ব্যাপারে কিছু না বললেই খুশি হব আমি সিয়াম।”
“তুই প্লিজ একবার ভেবে…… ”
রাফি সিয়ামকে থামিয়ে বলে, “প্লিজ সিয়াম এই বিষয়টা নিয়ে কথা না বলাটাই উত্তম। আমি চাই না তোর সাথে এসব বিষয় নিয়ে রাগারাগি করতে। আর আমার একটা ইন্টারভিউ নিতে হবে এগারোটায় তাই এই বিষয় ছাড়া অন্য কোনো কথা থাকলে বলে ফেল।”
সিয়াম তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, “এই বিষয় ছাড়া আর কোনো কথা বলার নেই আমার।”
দুই বন্ধুই নিরব। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। শেষমেষ সিয়াম বলে, “আমি আসি রে”
রাফি নিচু গলায় বলে, “হুম।”
সিয়াম দাঁড়িয়ে বলে, “চেয়েছিলাম বন্ধুর পীড়া কমাতে। কিন্তু বন্ধু আমার এই পীড়া থেকে মুক্তি পেতে চায় না।”
কথাটা বলেই সিয়াম চলে যায়। সিয়াম চলে যেতেই রাফি গা হেলিয়ে দেয় সোফায়। আসলে সে এক অদ্ভুত পীড়ার মধ্যে পড়ে গেছে যে পীড়া প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে। আগে তাও এই যন্ত্রণাদায়ক পীড়া সহ্য করতে পারত কিন্তু এখন আর সহ্য করতে পারছে না। চোখের সামনে যদি প্রতিনিয়ত ভালোবাসার মানুষটা থাকে আর সেই ভালোবাসার মানুষটাকে যদি কাছে না পায় সেই যন্ত্রণাটা সত্যি পীড়াদায়ক।
#চলবে________