প্রত্যাখান_পর্ব(০১)
রচনায়- অনামিকা ইসলাম ‘অন্তরা
পড়ন্ত বিকেল। উদ্ভ্রান্ত আমি ভেবে কোন কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। যে আমার পেছনে একসময় শতাধিক মেয়েরা সিরিয়াল ধরত, হাজারো তরুণী যে আমাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখত, সেই আমাকে কি না সে প্রত্যাখান করল। এক অতিকায় সাধারণ তরুণী মুখ ফিরিয়ে নিল আমার থেকে! ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যে হলো। সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত। শহরে যখন ঘুমের আয়োজন চলছে তখনো আমি উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ছাদের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেটে পায়চারি করছি। হিসেবের খাতায় গড়মিল দেখা দিয়েছে। যা ভেবেছিলাম তা মিলছে না, যা মিলছে তা কল্পনারও অতীত। বোনের মুখ থেকে শুনেছি পাত্রী দেখতে আহামরি কেউ নন, খুবই সহজ-সরল, শান্তশিষ্ট তরুণী সে। তবে বিয়েতে কেন সে রাজি হলো না? তবে কি সে…. নাহ! ভাবতে পারছি না আর। ফোন করলাম বন্ধু সুমনকে। পরপর তিনবার কল দিলাম। রিং হলো কিন্তু রিসিভ করলো না কেউ। ফোনটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ছটফট যন্ত্রণায় সারাটা রাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করার পর শেষ রাতের দিকে নিদ্রাদেবী চোখে ধরা দিল। সকালে রিংটোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে আমার। ঘুম জড়ানো কন্ঠে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরলাম। ওপাশ থেকে সুমনের কন্ঠস্বর ভেসে আসে। — কিরে? কই তুই? কতবার কল করছি, রিসিভ কেন করছিস না? — উম্ম…বল…(ঘুম জড়ানো গলায়) — কিসের উম্ম? রাতে এতবার কল কেন দিয়েছিলিস? — ভালো লাগছিল না।(উঠে বসে) — আচ্ছা, কি হয়েছে তোর, বলবি তো? আর দু’দিন ধরে এভাবে গুম মেরে কেন আছিস? — সুমন…. — হুম, বল। — আমাকে না মেয়েটি প্রত্যাখান করে দিয়েছে। — কিহ? কি বলছিস কি এসব? প্রত্যাখান করেছে? তাও আবার তোকে?!!! — হ্যাঁ। — কে সে? — ঐ, যে মেয়েকে দেখে মা আমার হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল বিয়ে করানোর জন্য। — ওহ, আচ্ছা…. — ঐ বলনা, কেন এমনটি করল? — আরে ইয়ার! এত সিরিয়াস কেন হচ্ছিস? রিজেক্ট’ই তো করেছে। আর তাছাড়া তোর তো খুশি হওয়ার কথা। তুই তো শুনেছিলাম, বিয়ে করবি না, করবি না করে পুরো বাসা মাথায় তুলে রাখতি। — সেটা ঠিক আছে, কিন্তু… — দ্যাখ, শুভ্র। এসব ফালতু বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো টাইম আমার নেই। রাখছি। — এই শুন……. সুমন ওর নিজের কথা শেষে কলটা কেটে দেয়৷ অপেক্ষা করেনি আমার উত্তরের। ঘড়িতে সময় তখন ৮টা বেজে ০৭মিনিট। বোনকে কলেজে দিয়ে আসার সময় বয়ে গেল বলে। ফ্রেশ হয়ে তাই দ্রুত ছুটলাম নাস্তার টেবিলের দিকে। মা জননী আমার পূর্ব থেকেই নাস্তার টেবিলে অপেক্ষা করছিল। কাছে গিয়ে মাকে সালাম দিয়ে চেয়ার টেনে বসলাম। খাবার খেতে বসলে আমার নরম স্বরে জানালেন, ওপথ দিয়ে ফেরার পথে মেয়েটার ছবিটা দিয়ে আসিস। ওহ, হ্যাঁ! আপনাদের তো বলায় হয়নি। আমার জন্য যে পাত্রীকে পছন্দ করা হয়েছিল, সে পাত্রী ইতোমধ্যে আমায় প্রত্যাখান করে দিয়েছে। জানিয়ে দিয়েছে, বিয়ে করবে না। মেয়েটার এক কপি ছবি মায়ের কাছে ছিল। বিয়েটা যেহেতু হচ্ছে না, মা তাই ছবির মালকিনকে ছবিটা ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছে। মায়ের কথা রক্ষার্থে ছবিটা পকেটে নিয়ে, বোনকে সঙ্গে করে, বাসা থেকে বের হলাম। বোনকে পৌঁছে দিলাম কলেজে। ফেরার পথে পাত্রীর বাড়ির সামনে গাড়ি থামালাম। বাড়ির সামনেই দেখা হয়ে গেল মেয়ের বাবার সাথে। ভদ্রলোক আমায় ভেতরে যেতে অনুরোধ করলেন৷ মুরুব্বি মানুষ। ফেলতে পারিনি কথা। ভদ্রলোকের পিছুপিছু বাসায় ঢুকলাম। বোনের কথায় ঠিক হলো৷ ভাঙাচোরা ছোট্ট একটা রুম। রুমের দু’প্রান্তে দুটো কাঠের চৌকি। মাঝখানে বেতের বেড়া দেয়া। পুরনো, ধুলোবালিতে ভরপুর একটা কাঠের চেয়ারে আমাকে বসতে দেয়া হলো। কিছুক্ষণ বসলাম। উঠতে যাবো, সেই মুহূর্তে গৃহকর্ত্রী তথা পাত্রীর মা এসে বসলেন, বাবা একটু বসো। এই প্রথম আইছ, খালি মুখে যাইবা, তা ক্যামনে অয়। কি আর করা। এত করে যখন বলছেন তাই বসলাম। একটু পর দেখলাম এক সুন্দরী ষোড়শী হাতে দুটি ডিম অমলেট ও একগ্লাস শরবত নিয়ে এলো। আমার চোখ আটকে গেল তার দুই চোখে। কি সুন্দর! কি অপরূপা! যেন কোন শিল্পী তার বিশাল ক্যানভাসে তুলির রং ছড়িয়ে দিয়েছেন। হয়তো একেই বলে গোবরে পদ্মফুল। তার চোখের গভীরতায় নিজের অবস্থান ভুলে গেলাম। তুমি, নাকি আপনি বলব ঠিক করতে পারলাম না। জিজ্ঞাসা করলাম, কি নাম? কিসে পড়া হচ্ছে? ঝটপট উত্তর। লাবণ্য। এইচএসসি পরীক্ষার্থী। কোন কলেজ? জিজ্ঞাসা করলাম। সরদার আসমত আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ, মনোহরদী। লাবণ্যর জবাব। বিন্দুমাত্র জড়তা নেই তার কথায়। মুহূর্তে মনের ক্যানভাসে তার ছবি এঁকে ফেললাম। পরবর্তীতে জানতে পারলাম, এ সেই মেয়ে, যাকে আমার মা, আমার পাত্রী হিসেবে পছন্দ করেছিল। ওপথ দিয়ে বোনকে কলেজে নিয়ে যাওয়ার সুবাদে এবং বিভিন্ন অজুহাতে নাকি অদৃশ্য সুতোর টানে জানি না, অসংখ্যবার ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বিভিন্ন সময় লাবণ্যর অপলক দৃষ্টির কাছে আমি হার মানতাম। আমার চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হতাম। চলবে….