নষ্ট গলি পর্ব-২৭
লেখা-মিম
ঢাকা এসে পৌঁছেছে জাহিদ আর সোহান। গাড়িতে উঠে বসেছে মায়ার গলির উদ্দেশ্যে। সাথে সালমানও আছে। ইতিমধ্যে চার পাঁচবার সোহানকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছে আমরা কোথায় যাচ্ছি? উত্তরে কিছুই বলেনি সোহান। বিরক্ত লাগছে সালমানের। এবার বেশ চেঁচিয়েই জিজ্ঞেস করলো।
– যাচ্ছি কোথায় আমরা? বলতে পারছো না?
– তোকে কিছু কথা বলবো। মন দিয়ে শুনবি।
– কি?
– মায়াকে আমি বিয়ে করিনি।
চোখ বড় হয়ে গেছে সালমানের। সেই সাথে কপালের মাঝেও কয়েকটা ভাঁজ পড়ে গেছে।
– তাহলে মায়া কি হয় তোমার?
– আগে আমাকে কথা শেষ করতে দে। এরপর কথা বলিস। মায়া আসলে নরমাল কোনো মেয়ে না৷ ও একজন প্রফেশনাল প্রস্টিটিউট ছিলো। জন্মসূত্রে। আমি ওকে ঐ পাড়া থেকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে আমার কাছে নিয়ে এসেছিলাম। ওর কাছে আমি প্রচন্ড শান্তি পাই। ভালোওবাসি খুব। আমি চাই ও আর দশটা নরমাল মেয়েদের মতো লাইফ লিড করুক। ওকে পুরো সম্মানটুকু দিতে চাই।
-…………..
– সালমান, আমার উপর খুব মেজাজ খারাপ হচ্ছে তাই না?
– আমার এই মূহূর্ত্বে কিভাবে রিএ্যাক্ট করা উচিত ভেবে পাচ্ছি না।
– আজ সাড়ে এগারোটার দিকে বাবা এসেছিলো। বাবা মায়ার সম্পর্কে সব জেনে গেছে। এখানে এসে ওকে অনেক ধরনের কথা শুনিয়েছে। তাই ও চলে গেছে। এখন আমি যাচ্ছি ওর পাড়াতে। আজই ওকে বিয়ে করবো। তুই আমার ভাই। তাই তোকে নিয়ে যাচ্ছি। আর কেও থাকুক বা না থাকুক আমি চাই তুই আমার সামনে থাক বিয়ের সময়।
-ওহ্। আমি তো নয়টার দিকেই চলে গেলাম শিমুর সাথে দেখা করতে। তাই বাবা আসার খবর জানি না।
– সত্যিটা জানার পর মায়াকে মেনে নিতে তোর অসুবিধা হবে তাই না?
– তুমি ওকে নিয়ে খুশি তো?
– আমাকে দেখে বুঝিস না?
– ব্যস। তুমি আমাকে কিছু বলোনি। আমিও কিছু শুনিনি। মায়া কোত্থেকে এসেছে সেসব আমার জানার দরকার নেই। ও কেমন সেটা জানার দরকার। আর সেটা আমি জানি। আজকের পরে এই ব্যাপারে কোনো কথা আমি শুনতে চাই না। তুমিও বলবে না। এতদিন ওর সাথে আমার সম্পর্ক যেমন যাচ্ছিলো তেমনই থাকবে।
সোহানের চোখে মুখে স্বস্তি ফুটে উঠেছে। পরম যত্নে ছোট ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সে।
-বাবার সাথে কথা হয়েছে?
– হুম।
– কি বলেছো?
– যা শোনানো অতি জরুরী ছিলো তাই শুনিয়েছি।
– বাবা কি বললো?
– মায়াকে নিয়ে চলে যাবো বলার পর বললো এভাবে না থেকে বিয়ে করো। আমি পার্টির এ্যারেঞ্জ করি।
– হা হা হা। ঘাবড়ে গেছে। তোমার জিদ কেমন তা তো জানা আছে।
– হুম।
– তো খালি হাতে বিয়ে করবে? বিয়ের শাড়ী, জুয়েলারি কিছু কিনে নিয়ে যাও।
– ঐ বেঈমানের জন্য একটা সুতাও নিবো না। যেটা পড়ে আছে সেটা পড়েই বিয়ে করবে।
– এত ক্ষেপে আছো কেনো? ঠান্ডা হও। আজ তোমার বিয়ে।
– ক্ষ্যাপার মতো কাজ করলে তো ক্ষেপবোই। ও কোন সাহসে বাসা থেকে বের হলো? বাবা কি বললো না বললো সেসব শুনে বের হয়ে গেলো। আমি যে ভালোবাসলাম সেটার কোনো মূল্য নেই?
– আচ্ছা, হতে পারে বাবার কথা শুনে নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারেনি। তাই হয়তো…..
-আমি এত কিছু জানিনা। ও বের হবে কেনো এটা হচ্ছে মূল কথা। আমি ওকে যাওয়ার আগে না করে গেছি বাসা থেকে যেনো না বের হয়। তবু কেনো বের হলো? আমি কি কুকুর বিড়াল? আমার কোনো দাম নেই?
সালমান জানে মায়ার উপর ঝাল মিটানোর আগ পর্যন্ত সোহান ঠান্ডা হবে না। তাই সে চুপ করে গেলো।
মায়ার পাড়াতে এসে গাড়ি থামলো। জাহিদ নেমে চলে গেলো পাশের গলিতে। ওখানে মসজিদ থেকে হুজুর নিয়ে আসতে৷ সোহান আর সালমান সেই গলি দিয়ে হেঁটে ভিতরের দিকে যাচ্ছে। এমন সরু গলিতে গাড়ি নিয়ে ঢুকা সম্ভব না। তাই গাড়িটা গলির মাথাতেই ড্রাইভারকে বসিয়ে রেখে এলো সোহান।
জানালার পাশে বসে আছে মায়া। সেই প্রথমদিনের মতো। যেখানে সোহান ওকে প্রথমবারের মতো দেখছিলো। নিচে থেকে মায়ার দিকে নজর পড়লো সোহানের। আজ আর সেদিনের মতো মুগ্ধতা তৈরী হচ্ছে না। মেজাজ চরম থেকে চরম স্তরে পৌঁছে যাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে এই মূহূর্ত্বে চুলের মুঠিতে ধরে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে নিচে নিয়ে আসতে। সালমানকে নিচে দাঁড় করিয়ে সোজা দোতলায় মায়ার রুমে চলে গেলো সোহান। সজোরে ধাক্কা দিয়ে মায়ার রুমের দরজাটা খুললো। আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠলো মায়া। বিছানায় শুয়ে ছিলো মায়ার মা বিউটি। এভাবে সোহানকে ঘরে ঢুকতে দেখে শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসলেন।
মায়ার দিকে এমন ভাবে সোহান তাকিয়ে আছে যেনো মনে হচ্ছে ওকে এই মূহূর্ত্বে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে ফেলবে। চোখজোড়া প্রচন্ড রাগে লাল হয়ে আছে সোহানের। আর মায়ার চোখ লাল হয়ে গেছে অনবরত কাঁদতে কাঁদতে। সোহানকে দেখে কান্নার মাত্রা আরো বেড়ে গেছে ওর। সোহান এগিয়ে এসে মায়ার ডান হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে বললো
– নিচে চল।
– বাবা, আপনে আমার মাইয়্যাডারে কই নিয়া যাইবেন?
– কোনো কথা বলবেন না আপনি। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আপনার মেয়েকে আমার দায়িত্বে নিয়েছি। অতএব আমাদের মাঝে কোনো ধরনের কোনো কথা আপনি বলবেন না।
– ঐ তুই নাম।
– হাত ছাড়েন।
– কিহ্? আবার বল?
– হাত ছাড়েন।
এবার মায়ার দু হাতের বাহু ধরে টেনে খাট থেকে নামালো সোহান৷ কোলে তুলে নিলো মায়াকে। মায়ার বাম হাতে ছোট একটা কাঁচের বোতল দেখা যাচ্ছে। সোহান জানে এটা কিসের বোতল। চাইলে এখনই এই বোতল হাতে নেয়ার অপরাধে ওর হাত ভেঙে দিতে পারতো। তবে সে এখন তেমন কিছুই করবে না। বিয়েটা হোক। এরপর বাসায় নিয়ে ওকে জন্মের শিক্ষা দিবে৷ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে মায়াকে নিয়ে। মায়া লাগাতার চেঁচামেচি করে যাচ্ছে, “আমাকে ছাড়ুন”।
অন্যান্য ঘরগুলো থেকে মেয়েরা বেরিয়ে এসেছে তামশা দেখার জন্য। তাদের কাছে মনে হচ্ছে যেনো সিনেমা দেখছে। সোহানের পিছু পিছু বাকিরাও নেমে আসছে শেষ অব্দি কি হয় দেখার জন্য। জোনাকি যেখানে বসে কাস্টমারদের সাথে দরদাম ঠিক করে সেখানে মায়াকে নিয়ে ঢুকলো সোহান। জোনাকি সোফায় দু পা উঠিয়ে পান চিবুচ্ছে আর পুরোনো দিনের গান শুনছিলো,
– হাওয়া ম্যা উড়তা যায়ে, মোরা লাল দুপাট্টা মাল মাল কা…..
সোহানকে দেখে দু পা নিচে নামিয়ে বসলো। পানের পিক দানীতে ফেলে বললো,
– কোনো সমস্যা? মাইয়্যাডারে এমনে কোলে নিয়া আইলেন যে।
– ও পালিয়ে এসেছে বাসা থেকে। তাই আজ ওকে বিয়ে করবো। যাতে আর কোথাও ছুটতে না পারে। মায়ার রেগুলার কাস্টমার কারা ছিলো ওদের নাম ঠিকানা সব রেডি করো। কাগজে লিখে আমাকে দাও। আর আরেকটা ছেলে আছে। ওর কাছে নাকি মায়ার ভিডিও আছে। ঐ ছেলের এড্রেস অতি জরুরী। ওরটা সবার আগে আমাকে ব্যবস্থা করে দিবে।
– কিয়ের ভিডু স্যার? ঐ যে নীল ভিডু?
– কিহ্? নীল ভিডিও কি?
– ঐ যে কুকামের ভিডু করে না ওগুলা?
– ওহ্। হ্যাঁ ওগুলা।
– চিন্তা কইরেন না৷ পাইয়া যাইবেন।
– টাকা লাগবে?
– না। যেই টাকা দিছেন তাতেই চলবো। ছেমড়ি দুপুরে আইছে পরেই কইছিলাম তোরে এই জায়গায় রাখুম না। স্যার অনেকটি টাকা দিছে আমারে। তুই যে পালায়া আইছোস তোরে আবার ধইরা নিয়া যাইবো দেখিস। সে তোরে ভালোবাসে। পুরুষ মাইনষের চোখ দেখলেই বুঝতে পারি। সে তোরে খালি ব্যবহারের লাইগা নেয় নাই। বিউটিও অনেক্ষণ বুঝাইসে। ছেমড়ি খালি এক কথাই কয় একট রাতই তো। এরপর সব ঝামেলা শেষ হয়া যাইবো।
– ওর ঝামেলা শেষ করাচ্ছি আমি।
পিছন থেকে জাহিদ এসে ডাক দিলো সোহানকে।
– স্যার…
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে সালমান আর জাহিদ দাঁড়িয়ে আছে। সাথে একজন হুজুর। দেখে মনে হচ্ছে সুযোগ পেলে এখনই এখান থেকে দৌঁড়ে পালাবে।
– বিয়ে কি উনি করাবে?
– জ্বি স্যার।
– শুরু করেন।
বিবাহ প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন কাজী। আপাতত তিনি মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন কবুল শোনার জন্য। মায়া মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে। সোহান খুব পীড়াপীড়ি করছে কবুল বলার জন্য। হাতের বিষের বোতলটা খুলে সোহানকে বললো
– আমাকে একদম জোর করতে আসবানা। আর নয়তো আমি বিষ খেয়ে মারা যাবো।
মায়ার গালে কষে থাপ্পর লাগালো সোহান। থাপ্পড় এতটাই জোড়ে ছিলো যে টাল সামলাতে না পেরে ফ্লোরে পড়ে গেলো ও। হাত থেকে বিষের বোতলটা ছিটকে পড়ে গেলো। হাত ধরে আবার টেনে তুললো সোহান।
– কবুল বলবি নাকি আবার থাপ্পড় খাবি?
– কবুল।
(চলবে),,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,