ঝরা ফুল পর্ব ৬

0
3467

ঝরা ফুল পর্ব ৬

লিখা : জামিয়া পারভীন তানি

২ দিন পর
মৌরীর জ্ঞান ফিরে আসে, কেবিনে নিয়ে আসা হয়। ডক্টর দেখা করার অনুমতি দেয় তবে একজন একজন করে। শাওন কাউকে ঢুকতে না দিয়ে নিজে মৌরীর কাছে যায়। মৌরীর কপালে চুমু দিয়ে তার পাশে বসে থাকে।
মৌরি শুধু শাওনের দিকে তাকিয়ে থাকে, শাওনের চোখ রাগে লাল হয়ে গেছে, হয়তো ঘুমায়নি কিংবা কেঁদে চোখ ফুলিয়ে দিয়েছে। মনে মনে বলে, “এতো ভালোবাসো কেনো, আমিতো তোমার যোগ্য নই।” মুখে বলে,
__ “বাঁচালে কেনো আমাকে? আমি তো পাপী, তোমার অযোগ্য। মরতে দেওয়া ই ভালো ছিলো, তাহলে তোমার ক্ষতি হতো না। ” গলার আওয়াজ অনেক ক্ষীণ হয়ে গেছে মৌরীর।

__ “ আর একটাও বাজে কথা বলিস না, কেনো করলি তুই এইরকম। রিমন তোকে কি এমন বলেছে সেটা বল? ”

__ “ সে আমার সাথে যে পাপ কার্য করেছে সেটার ভিডিও করে রেখেছে। নেটে ছেড়ে দিবে সে। তখন আমি সমাজে মুখ দেখাবো কিভাবে শাওন। তোমার স্ত্রী দুশ্চরিত্রা হিসেবে তোমার কি হবে? ”

শাওন সরে যায় প্রথমে মৌরীর থেকে, নিজের ভিতরে খারাপ লাগা তৈরী হয়। কিছুক্ষণ পর শান্ত হয়ে মৌরীর কাছে ফিরে এসে বলে,

__ “ তুই চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে। ” শাওন নার্স কে কেয়ার নিতে বলে বেরিয়ে যায়।

বাইরে মৌরীর মা আর ভাই ছিলো, ওদের কে শাওন মৌরীর খেয়াল রাখতে বলে। আর তিনদিন পর ফিরে আসবে সে একথা জানিয়ে বিদায় নেয়। শাওন কোথায় যাবে সেকথা সে বলে যায়নি কাউকেই।

….

__ “ রিমন যে মৌরীকে তুলে নিয়ে বিয়ে করে ডিভোর্স ধরিয়ে চলে গেছে, এমন মেয়েকে কি আর ঘরে তোলার কোন প্রয়োজন আছে? ” শাওনের মা শাওনের বাবার উদ্দেশ্য প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।

__ “ ডিভোর্সি মেয়ে আমার ছেলের বউ মেনে নেওয়া আমার পক্ষে খুব কষ্টকর, কিন্তু বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে সব মেনে নিতে বাধ্য। তাছাড়া শাওন তো ওকে ছাড়া কিছুই বুঝেনা। ছেলেকে কষ্ট দিয়েই বা কি লাভ তোমার?”

__ “ বলছিলাম কি! আগে মেনে নিলেও সত্য জানার পর আমারও ওকে ভাবী ডাকতে ইচ্ছে করছেনা। তুমি না হয় ওকে তাড়িয়েই দাও বাবা। ” শ্যামা ওর বাবাকে বলে।

__ “ শাওন যা ভালো বুঝে তাই করবে। আমি আর এই বিষয়ে কথা বলতে চাইনা। ”

….

ঘরের দরজা লাগিয়ে শুয়ে আছে রিমন, চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে একটা সুন্দর জীবন কে নষ্ট করে দিয়েছে সে।
ছোট থেকে বিদেশে পড়াশোনা করেছে কোন মেয়েকেই ভালো লাগেনি তার, শুধু মৌরীকে ক্ষেপাতে বলেছিলো অনেক মেয়ের সাথে রিলেশন করেছে। এই প্রথম একটা মেয়েকে মন থেকে চেয়েছিলো কিন্তু পারিবারিক প্রতিশোধ নিতে গিয়ে মৌরীকে এভাবে হারিয়ে ফেলতে হবে বুঝতেই পারেনি সে। তার না হোক, অন্তত বেঁচে থাক। ভয় দেখাতে গিয়ে সুইসাইড করতে যাবে এটা বুঝতে পারেনি রিমন।

রিমন উঠে ওর বাবার ঘরে যায়, রিসাদ আহমদ একটু চিন্তিত হয়ে বলেন,

__ “ কিছু বলবে? ”

__ “ বাবা আমি মৌরীকে ফিরিয়ে আনতে চাই। ”

__ “ ফিরিয়ে আনার অনুমতি থাকলে আগেই আনতে বলতাম। তুমি সেটা ভালো করেই ভালো ওকে আমি মেনে নিতে পারবোনা। শত্রুর মেয়েকে ঘরের বউ মানা আমার পক্ষে সম্ভব না। ”

__ “ তাহলে আমি মৌরীকে নিয়ে অন্য বাসায় থাকবো। ”

__ “ পাগল হয়ে গেছো তুমি, সে এখন অন্যের লিগ্যাল ওয়াইফ। তাছাড়া তুমি যদি ওর কাছে যাওয়ার প্লান করো তাহলে তোমার বাবার লাশ ডিঙ্গিয়ে যেতে হবে। কথাটা মনে রেখো, এখন নিজের ঘরে যাও। ”

রিমন কি করবে বুঝতে পারছেনা, একদিকে নিজের বাবা অন্যদিকে প্রথম প্রেম। এমন সময় আয়া ঘরে কফি নিয়ে আসলে কফির মগ ছুড়ে ফেলে দেয় রিমন। শব্দ শুনে রিমনে মা বাবা দুজনেই ছুটে আসেন। রিমনের মা বললেন,

__ “ ওই মেয়ে তোমার কাছে এতো বড় হয়ে গেলো তাহলে, যাও তাহলে ওর কাছেই যাও। আমাদের কবর দিতে আর আসবে না। ”
উনারা চলে যান, রিমন ঠিক করে ফেলে সে চলে যাবে। মৌরীর কাছে নয়, জাহাজে। কারণ সে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। একবার জাহাজ বাংলাদেশ থেকে গেলে ফিরে আসে ৬ মাস বা এক বছর পর। জবে থাকলে তাও এতো সব প্যারা থেকে ভুলে থাকতে পারবে।

রিমন বাসার কাউকে না বলে বের হয়ে যায়, জাহাজে উঠে যায় সে। রিমনের বাবা নিজেও ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। সেই সুবাদে খবর পেয়ে যান রিমন জাহাজে। যাক ছেলে তাও নিজের কাজে মনোযোগ দিয়েছে এটা ভেবেই নিশ্চিত হলেন।

সন্ধ্যার দিকে ৫ জন পুলিশ নিয়ে রিমনের বাসায় যায় শাওন। কিন্তু রিমন কে না পেয়ে তার মাথা খারাপ হয়ে যায়।
শাওন ব্যার্থ হয়ে রিমনের বাবা কে হুমকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সন্ধ্যার বাসে চিটাগং টু রাজশাহী রওনা দিয়ে দেয়। অবশ্য চিটাগং থানায় একটা জিডি করে রাখে সে।

২ দিন পর মৌরীকে রিলিজ করিয়ে বাসায় নিয়ে যায় শাওন। শাওনের মা বা শ্যামলী কেউ খুশি হয়নি মৌরীকে দেখে। এক প্রকার মুখ বাঁকিয়ে তারা চলে যায়। শাওনের বাবা মৌরীকে মন থেকে মেনে নিতে পারছেনা, কিছু বলছেও না।

শাওন মৌরীকে ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা লক করে দেয়। মৌরী এখন অনেক সুস্থ, একটু দুর্বল মাত্র। মৌরী আস্তে করে বলে,

__ “ আমার জন্য নিজের ফ্যামিলি কে কষ্ট দিও না শাওন। তুমি তো ভালো করে জানো, আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারবোনা। অতীতের তিক্ততা আমাকে শেষ কর দিচ্ছে। তুমি বরং নতুন করে বিয়ে করে নাও। দেখো তোমার ফ্যামিলি ও খুশি হবে আর তুমিও। ”

শাওন মৌরীর হাত ধরে টেনে বুকের মাঝে মিশিয়ে নেয়। ঠোঁটে, গলায় অসংখ্য কিস করে। মৌরীর গায়ের ওড়না টা ফেলে দেয়। কোলে তুলে নিয়ে বেডে শুইয়ে দেয়। মৌরীর কামিজ উঠে গিয়ে পেটের অংশ বের হয়ে গেছে। শাওন মৌরীর পেটে অজস্র কিস করে। মৌরীর কোন কথা শুনছেনা শাওন। দুর্বলতার জন্য সরে যাওয়ার ক্ষমতা নেই মৌরীর। শাওন মৌরীর কামিজ জোর করে খুলতে গিয়ে নিজের অনিচ্ছায় মৌরীর কাঁটা যায়গায় চেপে ধরে। মৌরী ব্যথায় অনেক জোরে চিৎকার করে বসে।

এতক্ষণে শাওনের মাথায় আসে কি করছিলো সে এতক্ষণ। মেঝেতে ফেলে দেওয়া ওড়না মৌরীর গায়ে জড়িয়ে দেয়।

__ “ I’m sorry. তুই এমন করে রাগিয়ে দিলি। মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। আমি তোর অনিচ্ছায় কিছুই করতে চাইনা। ক্ষমা করে দিস আমাকে। ” আর এক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে না থেকে বারান্দায় চলে যায় শাওন।

শাওনের স্পর্শ মনে পড়লে বারবার কেঁপে উঠছে মৌরী। সে আসলে কি চায়, রিমনের মতো প্রতারক কে ভুলে যেতে নাকি শাওনকে ছেড়ে দিতে। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে মৌরী। উত্তর জানা নেই তার। রিমন তো প্রতারণা করেছে, কিন্তু বেহায়া মন যে তাকেই চাচ্ছে। আর শাওন এতো ভালোবাসে, এতো কেয়ার করে তবুও তাকে পেতে তার ইচ্ছে হয়না। মন টা হুঁহুঁহুঁ করে কেঁদে উঠে।

শাওন রুমে এসে মৌরীকে কাঁদতে দেখে পাশে এসে বসে,

__ “ কাঁদিস না প্লিজ, তোর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারিনা।”

__ কান্না জড়ানো কণ্ঠে মৌরী বললো, “ আমি তোমাকে মানতে পারছিনা শাওন, তুমি আমার বন্ধু ছিলে, যাকে ছাড়া আমার খেলা জমতো না। খেলার সাথী কে তো বন্ধুইই বলে। কখনো তোমাকে প্রেমিক হিসেবে ভাবিনি। হয়তো আমার এক্সিডেন্ট টা না হলে তোমাকে মেনে নিতে পারতাম। কিন্তু রিমনের সাথে কাটানো খারাপ স্মৃতি আমাকে খুব কষ্ট দেয়। আমি চাই তুমি আমার থেকে দূরে থাকো। ”

__ “ হুম, আমি তোর উপর অনেক জোর করে ফেলেছি। সরি তার জন্য, আজ থেকে তোর বন্ধুর মতো ই থাকবো। তোর আগের শাওন হয়ে থাকবো। এইবার একটু হাসি দে প্লিজ। ”

শাওন মৌরীর চোখ মুছিয়ে দেয়, মৌরী মুচকি হাসি দেয়।
__ “ আমি জানি তুমি চাইলেই পারবে। ”

শাওন মৌরীকে বলে বাসা থেকে বের হয়ে যায়, তখন মৌরী নিজের ফোন হাতে নেয়। ফেসবুকে লগইন করে আগে রিমনের আইডি তে ঢুকে। কাল হয়ে গেছে আইডিটা। মৌরী মনে মনে বলে, “ ব্লক করে দিলে আমায় শেষ পর্যন্ত। ”

কিছুক্ষণ পর দেখে মেসেজ রিকুয়েস্ট এসেছে, সেটা ওপেন করে দেখে একটা ফেইক আইডি থেকে অনেক গুলো মেসেজ এসেছে। মেসেজ গুলো ছিলো,

“ মৌরী তুমি কোথায়? আমাকে ব্লক দিলে কেনো? তোমার জন্য খুব টেনশন হচ্ছে। ”
“ শাওন বলেছে তুমি সুইসাইড করতে গিয়েছিলে, আমি সত্যিই এমন চাইনি। আমি তোমাকে ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি এমন করলে কেনো। ”
“ আজ বাবাকে বলেছিলাম তোমাকে বউ করে আনার কথা, উনি বললো তার লাশের উপর দিয়ে গিয়ে যেনো তোমায় বউ করে আনি। আমি এমন চাইনি বিশ্বাস করো। তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। ”
“ শাওন থানায় আমার নামে জিডি করেছে, দেশে ফিরলে আমায় গ্রেফতার করা হবে। তোমার প্রতারক প্রাক্তন এবার শাস্তি পাবে। আমি খুব খুশি হয়েছি জানো। ”
“ শুনলাম তুমি এখন অনেকটা সুস্থ। খুব খুশি লাগছে তোমার কিছু হয়নি তাই। ”

কিছুক্ষণ আগে লাস্ট মেসেজ এসেছে,
“ মৌরী, তুমি তো জানো তিন মাস না হলে ডিভোর্স পুরোপুরি হয় না। শাওনের সাথে তোমার বিয়েও তো বৈধ না। ফিরে কি আসা যায় না আমার জীবনে? ”

মৌরী ছোট্ট একটা রিপ্লে দেয়,
“ আমি অকৃতজ্ঞ না। ”

সাথে সাথে রিপ্লে আসে,
“ আর একবার ভেবে দেখো প্লিজ।”
মৌরী লিখে,

“ যেদিন প্রতারণা করে চলে গিয়েছিলে সেদিন শাওন আমাকে সম্মান করেছে, স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছে। যেদিন মরতে গিয়েছিলাম প্রথম ব্যাগ রক্ত সে দিয়েছে। পরের রক্ত সে জোগাড় করেছে অনেক কষ্ট করে। আমি তাকে ভালোবাসি না ঠিকই। কিন্তু সে আমার ছোট বেলা থেকেই বন্ধু। যেই বন্ধু আমাকে নিয়ে এতো ভাবে তাকে কষ্ট দিলে আমার পাপ হবে। কিন্তু তুমি ভালো করেই জানো আমি তোমাকে ই ভালোবাসি। আমি এটাও জানি শাওন আমাকে কখনো কষ্ট দিবেনা। ”

মেসেজ সেন্ট করে ব্লক করে দেয় রিমন কে। জানেনা কাজ টা ঠিক না ভুল করেছে সে।

হটাৎ শ্যামলী ঘরে ঢুকে,
__ “ তা মহারাণী, সারাক্ষণ বিছানায় বসে থাকলে চলবে? ”

__ “ কি করতে হবে বল? ”

__ “ কি আবার করবি? মা যে অসুস্থ হয়ে গেছে তোর জন্য। তুই কি ছেড়ে যাবিনা? ”

__ “ থাকতে তো চাইনা, শাওন যে কষ্ট পাবে। ”

__ “ ওই শোন! শাওনের সাথে তোর বিয়ে বৈধ না। তুই এই বাড়িতে থাকলেও শাওনের ঘরে আর থাকবি না। ”
__ “ কোথায় যাবো? ”

__ “ তোদের বাসায় গিয়ে থাক। তোর মা এসে তোকে নিয়ে যাবে আজ। শাওন আসার আগেই চলে যাবি তুই। ”

চলবে………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে