ঝরা ফুল পর্ব ৩
লেখা : #জামিয়াপারভীনতানি
মৌরী এমন এক পরিস্থিতিতে পড়েছে, হাসবে নাকি কাঁদবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। যেই রিমন কে প্রথম দেখাতে পছন্দ করেছিলো সেই রিমন তাকে প্রথমে বোন ডাকলো, এরপর ধোঁকা দিলো, তার প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা আসলো আর যখন জানতে পারলো মৌরীকে রিমন বিয়ে করেছে মনে মনে যতো টা না খুশি হয়েছে ডিভোর্স এর কথা শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছে। আর এখন সবার সামনে মৌরীকে বিয়ের কতজা বলছে। রিমন এমন কেনো করছে তার সাথে। কিছুই বুঝতে পারছেনা মৌরী। শাওন মৌরীর সামনে হাতে তুড়ি মেরে বলে,
__ “ আর চুপ করে থাকিস না, দয়া করে বলবি রাতে কোথায় ছিলিস! ”
__ মৌরী একবার রিমনের দিকে তাকিয়ে আবার নিচে দিকে তাকিয়ে বলে “ বান্ধবীর বাসায়, গত রাতে ওর আম্মু হটাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এমার্জেন্সীতেও এডমিট করে। সেইজন্য গিয়েছিলাম। ”
__ “ আর তোর পোশাক! ” মৌরীর আম্মু জিজ্ঞেস করে।
__ “ মিতার আম্মু আমার ড্রেসে বমি করে দিয়েছিলো, তাই এই পোশাক মিতা আমাকে দিয়েছে। ”
রিমন মৌরীর দিকে তাকিয়ে ভাবছে “ কি অনর্গল মিথ্যে বলে দিলো।”
রিমন তখন মৌরীকে জিজ্ঞেস করে,
__ “ তোমার বান্ধবীর নাম্বার টা দাও, আমরা যোগাযোগ করি। ”
রিমনের কথা তে সবাই সুর মিলালো, সবাই মিতার নাম্বার চাচ্ছে। মৌরী বাধ্য হয়ে নাম্বার দেয়। বিপদ বুঝতে পেরে মিতা কে সব আগেই খুলে বলেছিলো মৌরী। তাই এই যাত্রায় বেঁচে যায় মেয়েটা।
মিতার সাথে কথা শেষ করে রিমন বলে,
__ “ মেয়েকে যে এতো বকাঝকা করলেন, এখন বুঝলেন তো মৌরী কতো ভালো মেয়ে। ওকে বিয়ে করতে চেয়ে আমি তো কোন ভুল করিনি তাহলে। ”
রামিজা অবাক হয়ে গেছে রিমনের কথাতে, রিসাদ ভাই কি তার মেয়েকে বউ হিসেবে মেনে নিবে। রামিজা ভালো করেই জানে তার ভাই কখনোই এই বিয়ে মেনে নিবেনা। ইতস্ততভাবে বলে,
__ “ ভাই কি মেনে নিবে এমন সম্পর্ক! ”
__ “ আপনার ভাইকে আমিই বেশি চিনি তাই নয় কি আন্টি। তার একমাত্র ছেলে যা চাইবে তাই দিবে আপনার ভাই। ”
রিমনের কথা অনুযায়ী বিয়ের ডেট ফিক্সড করা হয় দুইদিন পর। ছোটো খাটো একটা অনুষ্ঠান করে রিমন মৌরীকে বিয়ে করতে চায়। মৌরী অবাক হয়ে সব শুনছে, ঘুমের ওষুধের একশনের জন্য একটু ঝিম মেরে যাচ্ছে।
রিমনের সাথে মৌরীর বিয়ের কথা শুনার পর শাওন অস্থির হয়ে গেছে। ছাদে গিয়ে পায়চারী করছে, এটা কিভাবে সম্ভব । তার ছোট বেলার খেলার সাথী, কৈশোর বয়সের প্রেম কি আজ তাকে ছেড়ে চলে যাবে। মনে মনে প্রচণ্ড রকম ভালোবেসেছে মৌরীকে কিন্তু মৌরী কিনা রিমনের বউ হয়ে যাবে। পাশে থাকা কয়েকটা ফুলের টবে লাত্থি দিয়ে ভেঙে ফেলে শাওন।
শব্দ শুনে শ্যামলী ছাদে আসে,
__ “ কিরে ভাইয়া! তুই ফুলের টব ভাঙলি কেনো! ”
__ শাওন রাগী গলায় বলল, “ আহহহহ শ্যামা! বিরক্ত করিস না আমাকে। নিচে যা, দেখ কে কি করছে। ”
__ “ মৌরীকে ভালোবাসিস! ”
__ “ কি যা তা বকছিস পাগলের মতো। অন্যের বউ কে আমি কেনো ভালোবাসবো। এখন যা আমার চোখের সামনে থেকে। আমি একা থাকতে চাই। ”
•
রিমন কে একা পেয়ে মৌরী এগিয়ে যায়,
__ “ এমন নাটকের মানে কি রিমন!”
__ মৌরী এই সময় তার ঘরে দেখে বেশ অবাক হয় রিমন, সাহস আছে বৈকি এই মেয়ের। রিমন বলে, “ তোমার জীবন টা তছনছ করে দিতে চাই। ”
__ মৌরী রিমনের কলার ধরে বলে, “ কেনো! কি ক্ষতি করেছি আমি আপনার! ”
__ “ সময় হলেই জানতে পারবে। ”
__ মৌরী রিমনকে জড়িয়ে ধরে বলে , “ প্লিজ আপনি এমন করবেন না, ডিভোর্স দিয়েন না দয়া করে। আমি কখনোই কটু কথা সহ্য করতে পারিনা। কেউ এমন করলে আমি সত্যিই মরে যাবো। ”
__ “ রিমন নিজেকে মৌরীর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “ বেহায়া মেয়ে! আমার বুকে মাথা রাখতে লজ্জা করেনা। ”
__ “ না করেনা, আপনার আমাকে নিয়ে খেলতে লজ্জা না লাগলে আমার কেনো লজ্জা লাগবে। ”
__ “ আজ অব্দি কতো মেয়েরসতীত্ব নষ্ট করেছি জানো?”
__ “ ছিহহ! ”
__ “ আমার খুব মজা লাগে মেয়েদের সাথে খেলতে, তাই তোমাকে নিয়ে মজা করলাম আর কি। এখন তো জাস্ট ছুড়ে ফেলে দেওয়া বাকি। ”
__ মৌরী রিমনের গালে চড় মেরে বসে, “ আমি আপনাকে মনে মনে ভালোবেছিলাম, বিয়ে করেছেন জানার পর শ্রদ্ধাবোধ জন্মেছিলো আপনার প্রতি। বিনা কারণে একটা মেয়ের এতো ক্ষতি করলেন তো। মনে রাখবেন পরকালে এর জবাবদিহি করতে হবে আপনাকে। ”
শাওন রিমনের ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মৌরীর লাস্ট কথা গুলো শুনে ফেলে। এরপর ঘরের পাশে লুকিয়ে যায়, দেখে মৌরী দৌড়ে বের হয়ে যায়। শাওন অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কি এমন হয়ে গেলো তার মৌরীর। তাহলে কি রিমন ওকে গতরাতে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো? তাহলে বিয়ে করতে কেনো চাইলো? মৌরীই বা কাঁদছে কেনো? কোন প্রশ্নের সমাধান সে পায়না।
মৌসুমী কে বিদায় দিয়ে সব গার্জেন রা গোল টেবিল মিটিং এ বসে মৌরীর বিয়ের জন্য। সব কিছু ঠিক করে ফেলেন, কথা হয় বিয়ে আজই হবে। মৌরীর ঘরে গিয়ে গার্জিয়ান দের ডিসিশন জানিয়ে দেওয়া হয়। মৌরী খুব ভালো করে বুঝে গেছে রিমন তাকে বিয়ে করলেও ডিভোর্স দিয়েই ছাড়বে সেইজন্য খুব চিন্তিত। শ্যামা এসে মৌরীকে হালকা সাজিয়ে দেয়। একটা জামদানি শাড়ির সাথে হালকা সাজে মৌরীকে নতুন বউয়ের মতো ই লাগছিলো। মৌরী ঘরে বসে আছে, এই সময় রিমন আসে।
__ “ মিস মৌরী, লাস্ট টাইম কিছু বলার জন্য এসেছি। ”
__ মৌরী চুপ করে বসে থাকে।
__ একটা পেপার এগিয়ে দিয়ে বলে, “এই নাও তোমার উপহার। আমি চলে যাচ্ছি আজ, আর কখনো দেখা হবেনা। ”
__ মৌরী বিছানা ছেড়ে নেমে এসে রিমনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে খুব, রিমন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় মৌরীকে। হনহন করে হেটে চলে যায়। মৌরী পড়ে গিয়ে খাটের কোণাতে লেগে মাথা কিছুটা কেটে যায়। উঠে বসে মৌরী, মাথায় এক হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে আর অন্য হাত দিয়ে ডিভোর্স পেপার আঁকড়ে ধরে রাখে।
রিমন যে বিয়ের আসর ছেড়ে চলে গেছে সেটা জানাজানি হতে বেশি সময় লাগলোনা। রিমন বাসা থেকে বের হয়েই রামিজা কে ফোন দিয়ে জানিয়ে দেয়, “ আন্টি, কি ভেবেছিলেন! আপনার মেয়েকে আমি উদ্ধার করবো। হুহহহহ! আপনার মেয়ের না আছে কোন যোগ্যতা না আছে সতীত্ব। আমি চলে যাচ্ছি। ” বলেই ফোন কেটে দেয় রিমন।
রামিজা দৌড়ে গিয়ে দেখে মৌরী কপালে হাত দিয়ে বসে আছে। মেয়ের যে মাথা কেটে গেছে সেদিকে কোন হুশ নেই রামিজার। মেয়েকে টেনে চড় বসিয়ে দেয়। এরপর বলে,
__ “ মরতে পারিস না মুখপুড়ি, আর কতো চুনকালি মাখাবি মুখে। ”
রিমনের চলে যাবার খবর শাওনের কানে পৌঁছে যায়, শাওন দৌড়ে আসে মৌরীর ঘরে, যেখানে মৌরীকে বউ সাজিয়ে রাখা হয়েছিলো। এসেই ফুপি কে বলে শাওন,
__ “ ফুপি তুমি কি পাগল হয়ে গেছো, ওকে মারছোই বা কেনো, গালিই বা দিচ্ছো কেনো। ওর কি দোষ রিমন ভাই যদি বিয়ে করতে চেয়েও বের হয়ে যায়। ”
ততক্ষণে সব রিলেটিভ চলে এসেছে মৌরীর ঘরে, কাজী সাহেব ও চলে এসেছিলেন। রামিজা শাওন কে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে,
__ “ কি আর করবো বল, ওর মতো মেয়ের জন্ম দেয়াও পাপ। রিমন বিয়ে করতে চেয়েও চলে গেছে, আর বলে গেছে আমার মেয়ে অসতী। তাহলে কোন মায়ের মাথা ঠিক থাকে বল। ”
মৌরী অবাক হয়ে যায়, “ হায় রে রিমন। তুমি আমার সর্বণাস করে বলো আমি অসতী। ”
শাওন সবাইকে ডেকে নিয়ে বাইরে যায়, বাইরে গিয়েই মৌরীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। শাওওনের বাবার মত থাকলেও শাওনের মা বিগড়ে বসে ।কিন্তু বোনের মেয়ের দিকে তাকিয়ে শাওনের বাবা রাজি হয়ে যায়। শাওন যখন রাজি হতেই পারে এই বিয়ে।
রামিজা মৌরীকে গিয়ে এই কথা জানায়, মৌরী অবাক হয়ে বলে,
__ “ কি করে সম্ভব মা ! আমি তো বাজে মেয়ে। শাওনের জীবন টা নষ্ট করতে চাইনা। ”
__ “ তুই যদি বিয়েতে কবুল না পড়িস, মনে রাখিস আজ তোর মায়ের মৃত্যু কারণ হবি তুই। ”
মৌরী বাধ্য হয়ে বিয়েতে রাজি হয়, দুই পক্ষের মত অনুসারে সেদিন রাতেই মৌরীর সাথে শাওনের বিয়েটা হয়ে যায়। মৌরীর বাবার বাসা কিছুটা দূরে, মৌসুমীর বিয়ে উপলক্ষে মৌরী ওর নানার বাসায় এসেছিলো। পাশের বাসাটাই শাওনদের বাসা।
শাওন নিজ হাতে ধরে মৌরীকে নিয়ে যায় নিজের ঘরে। শাওনের ঘরে মৌরীকে বসিয়ে রেখে শাওন বাইরে যায়, কিছু খাবার নিয়ে এসে মৌরীকে খাইয়ে দেয়। মৌরীর চোখে জল, সে যে শাওনকে কখনোই ভালোবাসতে পারবেনা। শাওনকে কিভাবে ঠকাবে সে। তাও বাধ্য মেয়ের মতো খাবার খেয়ে নেয় মৌরী।
শাওন ওর মাথার কাটা অংশে ফার্স্ট এইড দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়। মৌরী এক হাতে ডিভোর্স পেপার আঁকড়ে ধরে বাম কাতে শুয়ে পড়ে।
চলবে……..