হারিয়ে যাওয়া অনুভূতি পর্ব-২৯

0
2511

হারিয়ে যাওয়া অনুভূতি পর্ব-২৯
#আরিশা অনু

-অফিস থেকে বাসায় আসার পর রোহান একটা ফোন ও দিলনা আর রুহির কোনো খোঁজ ও নিলনা।আবার আমি ফোন দিলাম দাও ধরলো না। কি হল কে জানে কিছুই বুঝতে পারছি না।একরাশ অসস্তি চেপে ধরেছে যেন।বার বার মনে হচ্ছে কোনো অঘটন ঘটতে চলেছে আবার।

-সকাল থেকেই মনটা কেমন কু ডাকছে। বার বার মনে হচ্ছে কোনো বিপদ আসতে চলেছে। এত অস্থির কেন যে লাগছে কিছুতেই বুঝতে পারছি না।অবশেষে রুহিকে স্কুল এ দিয়ে আমি অফিসে রওনা দিলাম। মেয়েটা কতবার বাবাই কোথায় বলল কিন্তু আমি কোনো উওর দিতে পারিনি।অফিসে যেয়ে আগে রোহান কে জিজ্ঞেস করব এমন এড়িয়ে কেন যাচ্ছে আমায়।সব কিছুতে কেমন যেন গা ছাড়া ভাব।হঠাৎ হল কি ওর।

-প্রায় বিশ মিনিট পর অফিসে পৌঁছালাম। সবাই কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে বাট কি বলছে সেটা বুঝতে পারছি না আমি।এসব এ কান না দিয়ে সোজা রোহানের কেবিনে চলে গেলাম।দেখি তৃধা আর রোহান বসে আছে।

-আরে অনন্যা তুমি চলে এসেছো বাহ্ ভালো করেছো। এতক্ষণ তো তোমার ই অপেক্ষায় ছিলাম আমরা।তারপর অনন্যার দিকে একটা কার্ড এগিয়ে দিলাম।নাও আজ সন্ধায় আমার আর রোহানের এংগেজমেন্ট পার্টতে তোমায় কিন্তু অবশ্যই থাকতে হবে।কোনো কথা শুনতে চাইনা আমি।আর হ্যাঁ রুহিকে ও নিয়ে এসো আফটারঅল ওর বাবাইয়ের এংগেজমেন্ট বলে কথা।আচ্ছা এখন তাহলে আমি আসি অনেক জায়গায় কার্ড দিতে যেতে হবে আমার আবার।তারপর তৃধা একটা শয়তানি হাসি দিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

-কি বলব বুঝতে পারছি না।রোহানের দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রুম ছেড়ে বেবিয়ে আসলাম।এই অঘটন টা ঘটতে যাচ্ছে বলেই আমার মনটা এত অস্থির হচ্ছিল কাল থেকে।বুঝতে পারছিনা চোখদুটো বার বার ঝাঁপসা কেন হয়ে উঠছে।বুকের ভেতরটা ও অদ্ভুত এক যন্ত্রনায় অবশ হয়ে যাচ্ছে।নাহ্ কাঁদবো না আমি কিছুতেই কাঁদবোনা।আমার দুর্বলতা আর বুঝতে দেবনা রোহানকে কিছুতেই না।ও যদি তৃধাকে নিয়ে সুখে থাকে তাহলে থাকনা। আমি না হয় আমার মেয়েটাকে নিয়ে বাকি জীবনটা পার করে দিব।তারপর চোখের জল মুছে নিজেকে শক্ত করে কাজে মন দিলাম।

-অনন্যাকে আজ সত্যিই অনেক অদ্ভুত লাগছে।এতবড় একটা ঘটনাকে ও এত হালকা ভাবে নেবে কখনো ভাবেনি রোহান।অবশ্য আমার বিয়েতে ওর কি বা আসে যাই। যার জন্য আমায় ছেড়ে দিতেও ওর বুকটা কাঁপলোনা সে তো ওর পাশে আছে।আমি শুধু শুধু এতদিন ভেবে এসেছি।

-সন্ধায় পার্টি উপলক্ষে সকল স্টাফ কে দুপুরে ছুটি দেয়া হয়েছিল।এখন বাজে সন্ধা সাতটা।অনন্যা এখনো ভাবছে পার্টিতে যাবে কি না।
বসে বসে ভাবনা চিন্তা করতে করতে উঠে পড়লো ও।পার্টি ড্রেস হিসেবে কি পরবে বুঝতে না পেরে আলমারি থেকে একটা ধবধবে সাদা রংয়ের নেটের শাড়ী বের করল অনন্যা।পুরো শাড়ীর ভেতর টাই সাদা আর দুইপাশের পাড় টা টকটকে লাল।একবার মনে হল পার্টিতে যাবনা।কিন্তু পার্টিতে না গেলে তো পরদিন অফিসে গেলে সবাই হাজারটা প্রশ্ন করে মাথা খারাপ করবে সাথে রোহান ও ভাববে আমি আপসেট।নাহ্ রোহানকে কিছুতেই বুঝতে দেওয়া যাবেনা আমার কষ্টের কথা।কি লাভ ওকে আমার মায়ায় আটকে রেখে আর আটকাব না ওকে মুক্ত করে দিলাম ওকে চিরতরে।কথাগুলো ভাবতেই চোখদিয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়লো।সাথে সাথে চোখ মুছে ফেললাম।তারপর শাড়িটা পরে নিলাম।কানে দুইটা সাদা টপ আর গলাই চিকন চেনের সাথে একটা সাদা পাথরের লকেট।চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে গাড়ো করে লালা লিপস্টিক দিলাম।আজ চুলগুলো খোলা রেখে কানের পাশে চুলের সাথে লাল টকটকে একটা জারবারা ফুল গুজলাম।আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই ধাক্কা খেলাম।তারপর নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম এত সাজ কার জন্য অনন্যা?প্রতিউত্তরে বুকচিরে বেরিয়ে আসলো একরাশ দীর্ঘশ্বাস। হয়ত তার জন্যই শেষ বারের মত সাজা।আর কখন তার সামনে যেয়ে দাঁড়াতে পারবো কি না সত্যই যানিনা আমি।

-রুহিকে আম্মুর কাছে রেখে আম্মুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ওবাড়ির উদ্দেশ্যে। সারা রাস্তা নিজেকে বুঝিয়েছি যাই হয়ে যাকনা কেন আমি আজ কাঁদবোনা কিছুতেই না।যদিও কেঁদে ফেলেছি বার বার তারপর ও ওবাড়িতে কারোর সামনে কিছুতেই কাঁদবোনা আমি আজ।অবশেষে দীর্ঘ বিশ মিনিট পর রোহানের বাসায় এসে পৌঁছালাম আমি।

-সবার সাথে কথা বললে ও চোখটা বার বার দরজার দিকে চলে যাচ্ছিল আমার।অনন্যা আসবে তো বার বার এক প্রশ্ন করে যাচ্ছিলাম নিজের মনকে কিন্তু কোনো উওর খুঁজে পাচ্ছিলাম না।এক এক করে সবাই চলে আসছিল কিন্তু ও আসছিল না।প্রচন্ড খারাপ লাগছিল তখন আমার।কিন্তু একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না যে তৃধার সাথে একটু পরেই আমার এংগেজমেন্ট অথচ আমার মনটা এখনো অনন্যাতেই আটকে আছে।আমি কি সত্যিই পারবো সবটা ভুলে আবার সবকিছু নতুন করে তৃধাকে নিয়ে শুরু করতে। একা একা কথাগুলো মনে মনে ভাবছিল রোহান হঠাৎ কার ডাকে হুস ফিরল ওর সামনে তাকিয়ে চমকে উঠল ও।একি এ যে একটা সাদা পরি।এক মুহুর্তের জন্য যেন রোহানের চারদিক স্তব্ধ হয়ে গেল।কোনো কথায় আর ওর কানে ঢুকছেনা এখন।হা করে অনন্যা কে দেখছে বেচারা।

-স্যার শুনছেন হঠাৎ অনন্যার কথায় ঘোর ভাঙল রোহানের।

-হ-হ্যাঁ বল।

-একগুচ্ছ ফুলের তোড়া রোহান আর তৃধার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম নতুন জীবনের অনেক অনেক অভিনন্দন আপনাদের।তারপর ওখান থেকে সরে আসলাম।এটুকু সময় খুব কষ্ট করে চোখের জল আটকে রেখেছিলাম। কিন্তু আর আটকাতে পারলাম না সাইডে এসে মুখ চেপে ধরে কেঁদে ফেললাম।কিছুক্ষণের মধ্যে রোহান আর তৃধার এংগেজমেন্ট হয়ে গেল।এবার কাপল ডান্স এর আয়োজন করা হল তৃধা আর রোহান একটা গানে নাচলো।বুকের ভেতরটা ছিড়ে যাচ্ছিল ওদের কে একসাথে নাচতে দেখে তারপর ও কিছু বললাম না শুধু অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দুচোখের জল ফেলছিলাম তখন।

-একটু পর রিসব এসে জোর করে আমাকে ডান্স ফ্লোরে টেনে নিয়ে গেল। আমি যেতে চাইনি ও কিছুতেই শুনলো না।তারপর মিউজিক অন করলো সব কাপল রা এবার এক সাথে নাচতে শুরু করলো।একটা ইংলিশ রোমান্টিক গানের সাথে সাথে সবাই নাচে মেতে উঠল।
.
.
.
.
“””””””Every night in my dreams I see you I feel you….

“””””””There is how i know you go on……

-সফট্ মিউজিক এর সাথে সাথে সবাই যার যার মত নেচে যাচ্ছিল। অপূর্ব এক মুহূর্তের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল যেন সবাই।খুব সুন্দর এক পরিবেশের মধ্যে দিয়ে সবাই সবার কাপলের সাথে আনন্দে নেচে যাচ্ছিল। অথচ এত সুখের মাঝেও দুটি মানুষের বুকে হারানোর ব্যাথা যেন খাঁ খাঁ করছিল।

-অনন্যা যতটা সম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে রিসবের সাথে নেচে যাচ্ছিল।আসলে ও রোহান কে বোঝাতে চাইছিল যে ও একদম ঠিক আছে।কিন্তু রোহান আর সহ্য করতে পারছিল না। অনন্যা আর রিসব কে এভাবে নাচতে দেখে ওর মাথা আগুন হয়ে গেল। ও তখনি তৃধাকে ছেড়ে দিয়ে অনন্যা কে রিসবের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে স্বজোরে এক থাপ্পড় বসালো অনন্যার গালে।

-ঘটনা হঠাৎ ঘটে যাওয়ায় কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারলো না সবাই এ ওর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কি হল সেটা।

-তারপর রোহান মুখ খুলল এবার।অনন্যা কে উদ্দেশ্য করে বলল এই তোমার চরিএ কি কোনো দিন ও ঠিক হবেনা।সারা জীবন এমন নোংরামি করে যাবে।আর কত জনকে ঠকাবা তুমি।আমাকে ঠকিয়ে তমালের কাছে গিয়েছো তাতে ও মন ভরলো না। কখনো তো ভালো হও আর কত নষ্টামি করবা।এর থেকে তো একটা পতিতালয় খুলে নিতে পারতে তাহলে আর কষ্ট করে বাড়ি বাড়ি যেয়ে সার্ভিস দিতে হতনা।না যানি কার সাথে নষ্টামি করে পাপের ফসল স্বরূপ রুহির জন্ম দিয়েছো।

-এতক্ষণ রোহানের সব কথা মুখবুজে সহ্য করলে ও এবার মুখ বুজে থাকতে পারলো না অনন্যা। সর্ব শক্ত দিয়ে জোরে এক থাপ্পর বসালো রোনানের গালে।এনাফ ইজ এনাফ।খবরদার আমার মেয়ের নামে আর একটা নোংরা কথা বললে তোমার জ্বীব টেনে ছিড়ে ফেলবো আমি।কোন সাহসে তুমি আমার সন্তান কে পাপের ফসল বলো।তুমি কি ভুলে গেছো দু দুটো বছর তোমার সাথে সংসার করেছি আমি।আর যাকে তুমি পাপের ফসল বলছো সে পাপের ফসল নয় আমাদের ভালোবাসার অংশ।আমার সন্তানের শরীরে তোমার রক্ত বইছে রোহান।একটানা কথা গুলো বলে থামলো অনন্যা।

-এতক্ষন অনন্যার মুখে এগুলো শুনে সারা বাড়ি যেন এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল।আর রোহানের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে অনন্যা কে জিজ্ঞেস করলো কি বললে তুমি….?

-হ্যাঁ ঠিক ই বলছি।ঠিক পাঁচ বছর আগে এমনি এক সন্ধায় আমায় বাসা থেকে ঝড় বৃষ্টির মধ্য অসুস্থ অবস্থায় বের করে দিয়েছিলে মনে পড়ে সেদিনের কথা মিস্টার রোহান খান?সেদিন হাজার বার আমি সত্যিটা বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনি কিছু না শুনে আমায় বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলেন।একটা বার আমার কথা শোনার প্রয়োজন মনে করেন নি।

-তবে আজ আমি সব বলবো আর আপনায় সবটা শুনতে হবে।

-রোহান কিছু না বলে নির্বাক দিষ্টিতে অনন্যার দিকে তাকিয়ে আছে আর মাথার ভেতর বার বার একটা কথা ঘুরছে ওর যে রুহি ওর সন্তান।

-শুনুন তবে পাঁচ বছর আগে ঠিক কি হয়েছিল। তোমার নিশ্চয় মনে আছে যে আমি অসুস্থতার জন্য ডক্তারের কাছে যাব বলে বাসা থেকে বেরিয়ে ছিলাম সেদিন বিকালে।আমি গাড়ি থেকে নেমে হাসপাতালের ভেতরে যাব তখন ই হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল।খুব শরীর খারাপ লাগছিল আমার তখন। হঠাৎ আমার ছোট বেলার বেস্ট ফ্রেন্ড তমাল সামনে দিয়ে যাচ্ছিল আমায় এমন অসুস্থ দেখে ও আমাকে ধরে হাসপাতালের ভেতরে নিয়ে যাই।আর ঐ সময় তৃধা কোনো ভাবে আমার আর তমালের কিছু ছবি তুলে নেই আর তোমায় উল্টা পাল্টা বোঝায়।আর তুমি ও সবটা সত্যি ভেবে নাও তখন।তারপর ডক্তর সবকিছু পরিক্ষা করে বলে আমি মা হতে চলেছি।খুশিতে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল।তখন ইচ্ছা করছিল ছুটে যেয়ে তোমায় খুশির খবর টা জানাতে।কিন্তু পরে ভাবলাম রাতে তুমি বাসায় ফেরার পর তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বাট বাসায় ফেরার পর আমি নিজেই বড় সড় একটা সারপ্রাইজ পেলাম।

-সেদিন যদি অন্তত একটা বার আমায় সুযোগ দিতে তাহলে এতগুলো বছর আমাদের কাউকে কষ্ট পেতে হতোনা রোহান।তুমি যানতে যে তৃধা যে কোনো মূল্যে আমাদের আলাদা করতে চাই আর এটা জানার পর ও কি তোমার উচিত ছিলনা আমার কথা একটা বার শোনা।আজ আবার সেই একই ভুল পথে হেটেছো তুমি বার বার আমায় কষ্ট দিয়েছো সেটা ও মাথা পেতে নিয়েছি আমি।বাট আমার সন্তান সম্পর্কে কোনো নোংরা কথা আমি সহ্য করবোনা মিস্টার রোহান খান।আর তোমার সাথে আমার সব সম্পর্ক আজ এখানেই শেষ। আজকের পর না তুমি আমার স্বামী আর না আমি তোমার স্ত্রী। আর হ্যাঁ খবরদার ভুল করেও আমার সন্তানেরর দিকে চোখ তুলে তাকালেও খারাপ হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি।কথাগুলো এক নাগাড়ে বলে এক দৌঁড়ে রোহানের বাসা থেকে বেরিয়ে গেল অনন্যা।

-এদিকে বাড়িতে উপস্থিত সকলে যেন অনন্যার কথায় হতভম্ব হয়ে রইল কি হচ্ছে কেউ যেন কিছু বুঝে উঠতে পারছে না এখনো।

-দুচোখ ভরা জল নিয়ে ছুটতে ছুটতে অনন্যা কখন যে হাইওয়েতে চলে এসছে সেদিকে তার খেয়াল ই নেই।বার বার একটা কথা মাথায় ঘুরছে ওর যে আজ ও রোহানের সব ভুল ভাঙতে পেরেছে।আজকের পর রোহানের চোখে অনন্যা আর কখনো অপরাধী থাকবে না।এসব ভাবতে ভাবতে রাস্তার মাঝদিয়ে হেটে চলছিল ও হঠাৎ ওর চিন্তার ছেদ ঘটালো চোখের উপর একরাশ আলো আশায়।অন্ধকারে তিব্র আলো চোখের উপর পড়তেই চোখটা আবার বন্ধ হয়ে গেল কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্রাকটা……….
.
.
.
.
Continent….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে