হারিয়ে যাওয়া অনুভূতি অন্তিম পর্ব
#আরিশা অনু
-ঘড়ির কাটাই রাত নয়টা বাজে।অপারেশন থিয়েটারের সামনে পাঁচজোড়া চোখ চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে আছে।প্রত্যেকের মনে অজানা এক আতঙ্ক এসে ভর করেছে।কি হতে চলেছে আর এক মুহূর্তের মধ্যে কি হয়ে গেল সেটা নিয়ে এখনো সবার বিস্ময় যেন কাটেনি।ঘড়ির কাটা টিক টিক করে আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে আর পাঁচজন মানুষের মনের ভয় ও একটু একটু করে বাড়তে শুরু করেছে।শেষ রক্ষা কি হবে?নাকি মুহূর্তের মাঝে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়ে যাবে এই অজানা কালবৈশাখি ঝড়।সবার মনে একটাই প্রশ্ন বার বার উঁকি দিচ্ছে বাঁচবে তো অপারেশন থিয়েটারে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে যে সে কি সত্যি আগের মত আবার ফিরে আসতে পারবে?মনকে প্রশ্ন করে বার বার ব্যর্থ সবাই।
-অবশেষে নিরবতা ভেঙে নিপা কথা বলা শুরু করলো।স্যার রুহিকে আমার কাছে দিন আমি ওকে কিছু খাইয়ে দি।মেয়েটা সন্ধা থেকে না খেয়ে আছে হয়ত।না আমি কাবো(খাব)না আমি আম্মু যাব কথাটা বলে রুহি কেঁদে উঠলো।রোহানের বুকটা ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে বার বার। হ্যাঁ সে আজ তার সকল ভুলের জন্য অনুতপ্ত। কিন্তু অনুতপ্ত হয়ে ও কি হবে এখন।বড্ড দেরি হয়ে গেল যে।যখন রোহান তার সব ভুল বুঝলো তখন অনন্যা অনেক দূরে চলে যেতে শুরু করেছে।
-হ্যাঁ ট্রাকটা স্বজোরে ধাক্কা দিয়ে আপন গতিতে শা শা করে চলে গেছিল তখন।আর অনন্যা ছিটকে যেয়ে রাস্তার পাশে রাখা ইটের উপরে পড়ে।মাথার পেছন দিকটা ইটের উপরে পড়ায় অনেকটা ক্ষত র সৃষ্টি হয়।তারউপর কিছুদিন আগের এক্সিডেন্ট এ ও মাথায় আঘাত পেয়েছিল অনন্যা। গল গল করে রক্ত বের হতে শুরু করে সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে যায় অনন্যা।প্রায় পনেরো বিশ মিনিট পর স্থানিয় লোকেরা অনন্যা কে রাস্তার পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে হাসপাতালের নিয়ে আসে।মূলত অনন্যা যেখানে এক্সিডেন্ট করেছিল ঐ জায়গাটা একটু ফাঁকা আর অন্ধকার ছিল সেজন্য এক্সিডেন্ট এর সাথে সাথে কেউ দেখতে পাইনি।যখন দেখতে পেল সাদা শাড়িটা ততক্ষণে অনন্যার রক্তে লাল বর্ন ধারন করেছে।
-প্রায় মৃত অবস্থা অনন্যাকে হাসপাতালে আনা হয়।তারপর ওর বাসার সবাইকে জানানো হয়।রোহান বা অনন্যার বাড়ির কেউ প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না এটা।
-খবরটা শোনার পর ছুটে চলে আসে সবাই হাসপাতালে।পার্টিতে রিসব আর নিপা উপস্থিত ছিল তখন তাই ওরা ও রোহানের সাথে চলে আসে হাসপাতালে।
-অনন্যা কে যে হাসপাতালে আনা হয় সেটা রোহানের আঙ্কেলের হাসপাতাল।উনি অনন্যাকে এ অবস্থা দেখার সাথে সাথে রোহান কে ফোন করেছিলেন।তারপর আর দেরি না করে তিনি অনন্যার অপারেশন এর ব্যবস্থা করেন।
-আড়াই ঘন্টা পার হয়ে গেছে ইতিমধ্যে কিন্তু অনন্যার কোনো খবর রোহান জানেনা।অনন্যার অপারেশন হতে এত সময় কেন লাগছে অজানা ভয়ে বার বার বুকটা কেঁপে উঠছে রোহানের।এদিকে মিসেস শাহেলা জামান একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে তার কলিজার টুকরা যে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে চলেছে প্রতিটা সেকেন্ড সেটা আর বুঝতে বাকি নেই তার।মায়ের মন হয়ত তাই আগে থেকে সবটা বুঝতে পারে।শাহেলা জামান এক মুহুর্ত শান্ত হতে পারছে না বার বার আল্লাহতালার কাছে তার সন্তানের জীবন ভিক্ষা চেয়ে যাচ্ছে।
-আর রোহান যেন পাথর হয়ে গেছে।আজ বার বার তার মনে পড়ছে কত কষ্ট, যন্ত্রনার মধ্যে রেখেছিল সে তার অনুসোনা কে।যদিও সে নিজে ও একটা দিন শান্তিতে থাকতে পারেনি তারপর ও কি করে তার অনুসোনা কে সে এত কষ্ট দিতে পারলো।বার বার একরাশ ঘৃনায় গা টা ঘিন ঘিন করে উঠছে রোহানের। তার অনু সোনা তাকে কখনো ক্ষমা করবে তো একটা প্রশ্ন বার বার রোহানের ভেতরটা নাড়া দিয়ে তুলছে।
-হাজার চিন্তার মধ্যে দিয়ে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা পর অনন্যার অপারেশন শেষ হল।থিয়েটারের ভেতর থেকে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে আসলেন ডক্তর আঙ্কেল। রোহান সহ বাকিরা দৌঁড়ে উনার কাছে চলে গেলেন।
-আঙ্কেল আমার অনন্যা কেমন আছে। ও ঠিক আছে তো ওর কিছু হয়নি তো আঙ্কেল।এমন দেখাচ্ছে কেন তোমায়।কিছুতো বল ঠিক আছে তো আমার অনন্যা।
-রোহান শক্ত কর নিজেকে।অনন্যার অবস্থা খুব একটা ভালোনা।অনেক কষ্টে জ্ঞান ফিরেছে ওর।মাথার পেছনের অংশটা খুব বিচ্ছিরি ভাবে থেতলে গেছে আর ডিপ হয়ে গেছে অনেকখানি।বার বার জ্ঞান হারাচ্ছে ও। অনেক কষ্টে জ্ঞান ফিরেছে তবে এবার জ্ঞান হারালে আর শেষ রক্ষা হবেনা।যাও দেখা কর ওর সাথে ওর হাতে সময় খুব কম।কথাগুলো একটানা বলে থামলেন ডক্তর আঙ্কেল। এক মুহূর্তের জন্য সবার মাথায় যেন বাঁচ পড়ল।কি বলছে এসব।রোহান আর এক সেকেন্ড ও লেট না করে দৌঁড়ে ভেতরে চলে গেল।
-এখনো অক্সিজেন চলছে অনন্যার। পাশে বসে অনন্যার একটা হাত নিজের দুহাতের মধ্যে নিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল রোহান।চোখ খুলতে খুব কষ্ট হচ্ছে তারপর ও আস্তে আস্তে চোখটা খুলে কাটা কাটা গলায় বললাম এই পা-পা গো-ল কা -কাঁ-দ-ছো কেনো হু। তু তুমি এভাবে ভে ঙে পড়লে রুহি কে কে দেখবে বলোতো?
-প্লিজ আর একটা সুযোগ দাও আমায় আর কখনো তোমায় কষ্ট দেবনা অনুসোনা।এই তোমাকে ছুয়ে কথা দিচ্ছি আমি এবার প্রুভ করে দেখাবো একজন ভালো হাসবেন্ড আর বাবা হিসেবে ও।তাও যেওনা আমায় ছেড়ে।প্রয়োজনে যে কোনো শাস্তি দাও আমায় তারপর ও প্লিজ আমায় ছেড়ে যেওনা অনুসোনা।
-আ-আমি জানি তু-তুমি একজন ভালো বা-বা রোহান সে-জন্য তো শান্তি-তে মরতে পারবো আমি।
-প্লিজ এমন বলোনা অন্তত রুহির কথা ভেবে থেকে যাও প্লিজ। মেয়েটা তোমায় ছাড়া একদম থাকতে পারবে না।
-রু-র -হি কোথায় ওকে একবার শেষ বা-রের মতো দেখব।
-একটু পর রোহান রুহিকে নিয়ে আসলো রুহি তার আম্মু কে এভাবে দেখে কেঁদে ফেলল।
-আম্মু তুমি ওতো(ওঠো)এবাবে (এভাবে)শুয়ে আতো(আছো)কেন।
-রোহানের সাহায্যে একটু বেডে হেলাম দিয়ে বসলো অনন্যা তারপর রুহিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে অনেক আদর করল।রোহান তুমি রুহিকে বাইরে দিয়ে এসো।
-অনন্যার কথায় রুহিকে বাইরে ওর নানুর কাছে রেখে আসল রোহান।তারপর আবার অনন্যার পাশে এসে বসল।
-রোহান আ-আমার শেষ একটা চাওয়া পূরন করবা…?
-বল অনুসোনা আজ তোমার সব চাওয়া আমি পূরন করবো শুধু আমায় ছেড়ে কোথাও যেওনা কথাটা বলে ডুকরে কেঁদে উঠলো আবার রোহান।
-আমায় শেষ বারের মত একটাবার বুকে জড়িয়ে নেবে রোহান।আমি তোমার বুকে মাথা রেখে মরতে চাই।
-কোনো কথা না বলে রোহান তার অনুসোনা কে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিল যেন ছেড়ে দিলে এখনি তার অনুসোনা পালিয়ে যাবে।অনুও শেষ বারের মত তার রোহান কে দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে পরম শান্তিতে শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করলো রোহানের বুকে।
-কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর হঠাৎ রোহানের খেয়াল হল তার অনুসোনা আর শ্বাস নিচ্ছে না বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো ও সাথে সাথে অনন্যার মাথাটা বুক থেকে নামিয়ে বার বার অনন্যাকে ডাকতে শুরু করল রোহান।
-অনুসোনা এই অনুসোনা তুমি কথা বলনা কেন?এই তাকাও তুমি কি শুনতে পাচ্ছনা আমি ডাকছি তো তোমায় কিছু বলনা কেন তুমি, না এভাবে আমায় একা করে চলে যেতে পারোনা তুমি।রোহানের চিৎকারে ততক্ষণে সবাই ভেতরে চলে এসেছে।
-আম্মু আম্মু তুমি ঘুমিয়ে আতো(আছো)কেন ও আম্মু ওতো (ওঠো)বাবাই কানতে (কাঁদছে)তো।ও আম্মু তুমি ওতোনা (ওঠোনা)কেনো আমাল(আমার) অনেক ক্ষুদা লাকছে (লাগছে)ছেই(সেই) ককন (কখন)তেকে (থেকে)না কেয়ে (খেয়ে)আচি(আছি) ও আম্মু আমায় খাইয়ে দিবানা।অনন্যার হাতে বার বার ধাক্কা দিয়ে দিয়ে কাঁদছে আর কথা গুলো বলছে রুহি।আর রুহির অবস্থা দেখে বাকিরা কেঁদে ফেলেছে ততক্ষণে।মিসেস শাহেলা তার একমাএ মেয়ের মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি সাথে সাথে জ্ঞান হারিয়ে মরার মত পড়ে আছে।কোনো মা ই হয়তো সন্তান এর মৃত্যু এত সহজে মেনে নিতে পারেনা।
-এদিকে রোহান ও পাগলের মত কেঁদে কেঁদে ডেকে চলেছে তার অনুসোনা কে।এই অনুসোনা দেখ রুহি কাঁদছে ওর জন্য হলেও প্লিজ ওঠে।আমার ভুলের জন্য এতবড় শাস্তি দিতে পারোনা আমায়।এই তুমি বলতে না আমরা দুজন মিলে আমাদের বাবুকে অনেক বড় করবো।তারপর বাবুটা যখন বড় হবে তখন ওর বিয়ে দেব।একসাথে বৃদ্ধ হব আমরা।তাহলে এভাবে স্বার্থপরের মত চলে কেন যাচ্ছ তুমি।
-রোহানের আত্মনাদে মধ্যরাতে সারা হাসপাতাল যেন কেঁপে উঠেছে সাথে রুহির আম্মু ওঠো আম্মু ওঠো শব্দ গুলো যেন চারপাসটা আরো ভারি হয়ে উঠেছে আজ।এক করুন সময়ের সৃষ্টি হয়েছে চারপাশে।ওদের আত্মনাদে সারা হাসপাতালের মানুষ কেঁদে বুক ভাষিয়েছে আজ।
.
.
.
.
-সময় তার আপন গতিতে এগিয়ে চলেছে আজ চৌদ্দ বছর পর রোহান তার অনুসোনার রেখে যাওয়া কলিজার টুকরা রুহিকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে।আজ রুহির আঠারো তম জন্মদিন। বাড়ির ডান সাইডে পাকুড় গাছের তলায় শায়িত অনন্যার সমাধির সাথে এতক্ষণ রোহান কথা বলছিল যে আজ তাদের মেয়ের আঠোরো তম জন্মদিন। আজকের পর তাদের রুহি এডাল্ট বলে গন্য হবে।আজকের পর রুহি তার সব সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারবে।একা একা কথা গুলো অনন্যাকে বলছিল তখন পেছন থেকে কার ডাকে যেন হুশ ফিরল।
-বাবাই এদিকে তাকাও তো আজ আমার জন্মদিন এটা জেনেও কাঁদছো এটা ঠিক না আমি কিন্তু আম্মুর কাছে নালিশ দেব।তারপর এক নজর মায়ের কবরের দিকে তাকিয়ে চোখের জলটা মুছে বাবাকে নিয়ে বাসার ভেতর এগিয়ে চলল রুহি।এইতো বাবা মেয়ের দিন গুলো এভাবেই চলে যাচ্ছে।অনুভূতি হারায়নি অনুভূতি গুলো বেঁচে আছে আজো রোহানের বুকে।দিন শেষে রোহান এসে অনন্যার কবরের সামনে বসে রুহি আজ এটা করেছে আজ এটা বলেছে বলে গল্প শোনায়।আর রোহান যখন রুহির আবদার গুলো মেটাবো না বলে আড়ালে হাসে তখন রুহি ও বাইনা ধরে বলে আম্মুর কাছে নালিশ দেব কিন্তু। বাবা মেয়ের পাগলামি দেখে হয়ত দূর থেকে হেসে ফেলে অনন্যা।এইতো বাবা মেয়ের খুনশুটির মাঝেই বেঁচে আছে অনন্যা।এভাবেই বা কতজন বাঁচতে পারে।
সমাপ্ত,,,,,,,,
Khub sundor ।।। Eto sad kende fellam last e…
চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না
এই গল্পের শেষ পরিণতি যে এটা হতে পারে আশা করি নাই গল্প টা পড়ে কষ্ট হচ্ছিল আবার মজাও করেছিল কিন্তু শেষে ত চোখ দিয়ে জল চলে এসেছে