গল্পটা নিশ্চুপ বালিকা’র
(৩য় অংশ)
রচনায়- অনামিকা ইসলাম ‘অন্তরা’
পুরো এলাকা ঘুরে ব্যর্থ মনোরথ নিয়ে ফিরে আসে ওরা। কাঙ্খিত বাসা খুঁজে পায়নি নীলিমা। শুভ্র ফিরে তাকায় নীলিমা’র পানে। দেখতে দেখতে অনেকটা সময় বয়ে গেল। লাঞ্চের টাইমও পেরিয়ে যাচ্ছে। নতুন জায়গা। রাস্তাঘাটও তেমন চিনেন না। বাসায় আপনার জন্য চিন্তা করবে সবাই। আপনি তাহলে আজ যান। ইনশাআল্লাহ! আগামীকাল আবারো আমরা বের হবো। মলিন মুখে শুকনো হাসির রেখা ফুটে উঠে নীলিমা’র। পুরোটা দিন আমার সাথে থেকে আমার কাজে সাহায্য করেছেন। ধন্যবাদ। আসি। আসসালামু আলাইকুম। সালাম দিয়ে পায়ে পায়ে মন্থর গতিতে সামনের দিকে এগুচ্ছিল নীলিমা। অকস্মাৎ পিছু হটে। ফিরে আসে পূর্বের জায়গায়। শুভ্র তখনো সে স্থানে দাঁড়িয়ে। নীলিমা’কে দেখে প্রশ্ন করে, কিছু বলবেন? নীলিমা শুভ্র’র হাত ঘড়িটির দিকে ইঙ্গিত করে। প্রশ্ন করে, কয়টা বাজে? হালকা হাসিতে শুভ্র’র জবাব, এইতো! ২টা বেজে ১৭মিনিট। ক্ষাণেক ভেবে নীলিমা’র প্রশ্ন, ঢাকা শহরে একেলা আমার এটাই প্রথম পদার্পণ। যদিও এর আগে বহুবার এসেছি। কিন্তু সেটা একা নয়। আরো ছোট ছিলাম তো। সবসময় আমার হাতটা ধরে কাউকে না কাউকে ধরে রাখতেই হয়েছে। জবাবে কিচ্ছু বলেনি শুভ্র। নীলিমা আবারো বলতে শুরু করে, আসলে বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে শহরটা একটু ঘুরে দেখতে। ঘড়ি’র সময় বলছে, সন্ধ্যা হতে এখনো অনেক দেরী। তো যাবেন আমার সাথে? অবশ্য যদি আপনার সমস্যা না হয়। মনের খুশিতে আত্মহারা শুভ্র। তথাপি সে আনন্দ ভেতরে চেপে রাখে। সাড়া দেয় নীলিমা’র ডাকে। একটা রিক্সা ডাকে। রিক্সায় চেপে দুজন রওনা দেয়। দুজনেই নিরব। রিক্সা চলছে তার আপন গতিতে। হঠাৎ ঝাকুনিতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল নীলিমা। ধরে ফেলে শুভ্র। সোজা হয়ে বসে নীলিমা। শুভ্র তখনো নীলিমা’র হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। স্তব্ধ নীলিমা। মুঠোবন্দি হাতটা মৃদু কাঁপছে ওর। ছাড়ানোর অনেক চেষ্টা চলছে কিন্তু পারছে না। একটা সময় ঘোর কাটে শুভ্র’র। ছেড়ে দেয় হাতটা। ক্ষাণেক মাথা চুলকিয়ে ‘স্যরি’ বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। জবাবে কিচ্ছু বলেনি নীলিমা। মিনিট ক্ষাণেক পর সোজা হয়ে বসে শুভ্র। সামনের দিকে তাকিয়ে নীলিমা। শুভ্র লক্ষ্য করল নীলিমা’র নাকের ডগায় মুক্তোদানা’র ন্যায় জমে আছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। শুভ্র’র বড্ড ইচ্ছে হচ্ছিল মাঝের দূরন্তটুকু কমিয়ে নীলিমা’র কাছে যেতে। আলতো করে ওর হাত দু’খানি ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। তাই অত্যন্ত সংগোপনে মনের ইচ্ছেকে ভিতরেই ধামাচাপা দিয়ে দেয়। ইচ্ছেগুলোকে বুকের ভেতরে ধামাচাপা দিলেও নীলিমা’র সাথে শুভ্র’র চোখাচোখি হয়েছে বেশ কয়েকবার। নীলিমা যখন এদিকওদিক তাকাতো, শুভ্র তখন নীলিমা’র দু’চোখে বিচরণ করতো। আবার কখনো বা ধরা পড়ে যেত। কিছুক্ষণের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছালো ওরা। নদীর পাড়ে কোলাহল মুক্ত একটি জায়গায় গিয়ে বসল। কাটালো স্বপ্নময় একটা দিন। তারপর সন্ধ্যা নাগাদ বাসায় ফিরলো। পরদিন প্রতিদিনকার ন্যায় নির্ধারিত সেই স্থানে’ই গোল বৈঠকে বসে শুভ্র’র বন্ধু’রা। শুভ্র’র সবচেয়ে কাছের বন্ধু আতিক। আর সেই আতিকের থেকে সবাই ইতোমধ্যে জেনে গেছে চঞ্চল শুভ্র’র হঠাৎ এভাবে বদলে যাবা’র কারণ। তাই তখনকার আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু ছিল ‘শুভ্র…’ আলোচনা’র এক পর্যায়ে সেখানে উপস্থিত হয় স্বয়ং শুভ্র। ওকে দেখে সবাই চুপসে যায়। আতিক ওর জায়গা থেকে ক্ষাণিকটা সরে জায়গা করে দেয় বসার জন্য। ওখানে বসে’ই সামনে বসে থাকে তাসনিয়ার দিকে দৃষ্টি যায় শুভ্র’র। কি ব্যাপার? তুই হাসছিস যে?! আরে দোস্ত! কই হাসলো ও? ও তো গতকাল থেকেই মুখে তালা লাগিয়েছে। পাশ থেকে রুবেলের জবাব। মুখে রাগের আভা ফুটে উঠে শুভ্র’র। ফিরে তাকায় রুবেলের দিকে। আর কত? আর কত দালালী করবি ওর হয়ে? আর একটা কথা বলতো! তোর এত জ্বলে কেন’রে? বিকৃত স্বরে রুবেলের জবাব, ওরে! আমার কেন জ্বলবে? আমি তো শুধু…. যখন’ই ওরে কিছু বলি তুই ঝাপিয়ে পড়িস আমার উপর। যা নয় তা বলিস। আবার তোর কিছু হলে সবার আগে ও এগিয়ে আসে। ঘটনা কি? মুখ খুলে তাসনিয়া__ — মানে কি শুভ্র? তুই তখন থেকে কিসব উল্টাপাল্টা বকে যাচ্ছিস…?! — উল্টাপাল্টা নয় যা দেখছি তাই বলছি। — তোর দেখার মধ্যে ভুল আছে শুভ্র। আমি শুধু রুবেলের বিপদে নয়, সবার বিপদে ঝাপিয়ে পড়ি। — ওরে বাহ্! তাই নাকি…?! — কেন? কোন কনফিউশন আছে?! — কেন? বললেই কি তুই কনফিউশন দুর করে দিবে নাকি? — তুই শুধু বল কি করতে হবে তোর জন্য? আমি সেটাই করে দিতে রাজি। — বেশী কিছু করতে হবে না। আপাতত ঐ যে লাল ড্রেস পরোয়া মেয়েটা আছে না আমার হয়ে তাকে গিয়ে প্রপোজ করবি। বলবি যে, শুভ্র তোমাকে ভালোবাসে। — মানে কি? (বিস্ময়ে হতবাক তাসনিয়া) — কি? চুপসে গেলি যে? খুব না বললি… — ওয়েট! কোন মেয়েটাকে বলতে হবে?! — ঐ যে লাল ড্রেস, মাথা’য় ওড়না দেয়া… — ও মাই গড! ঐ টুনটুনি পাখিকে! আগে বলবি না! তোরা বস। আমি এখন’ই আসছি… — এই তাসু, যাসনে। মজা করছি আমি…. — হাঃ হাঃ হাঃ (সবাই উচ্চস্বরে) — আল্লাহ! এ তো সত্যি সত্যি চলে গেছে… — যাবে না তো কি করবে? এভাবে কেউ কাউকে পঁচায়? না হয় একটু আমার বিপদে এগিয়েই আসে। তাই বলে…(রুবেল) — চুপ কর রুবেইল্যা! — …… —- উফ! এ আবার না জানি কি করে বসে! মাঠের মধ্যিখানে পত্রিকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে তার উপর গোল করে বসেছে নীলিমা এবং তার ক্লাসমেট’রা। সেখানেই গোল বৈঠকের ফাক দিয়ে তাসনিয়াও বসে পড়ে নীলিমা’র পাশে। মিশুক তাসনিয়া মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পরিচিতি পর্ব সেরে ভাব জমিয়ে ফেলে নীলিমার ক্লাসমেটদের সাথে। বাকি রইল নীলিমা। নীলিমা’র ক্লাসমেট’দের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাসনিয়া তাকায় নীলিমার দিকে। ‘বাহ্! খুব সুন্দর তো তোমার ডায়েরী’টা! কোথা থেকে কিনেছ এটা?’ নীলিমা’র সাথে তাসনিয়া’র গল্পের শুরুটা এখান থেকেই। তারপর অনেক অনেক কথা হয়। সেই অনেক কথার ফাঁকে তাসনিয়া মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলে নীলিমা’কে ঠিক কিভাবে বলবে শুভ্র’র কথা! মনে মনে আল্লাহ নাম জপে কাঙ্খিত কথাটা বলার জন্য মুখ খুলে তাসনিয়া। আচ্ছা, নীলিমা শুনো… বিনীত ভঙ্গিতে নীলিমা’র জবাব, জ্বী আপু! বলুন… — আসলে তোম….(….)….??? — জ্বী, বলুন… — একমিনিট। (তাসনিয়া’র দৃষ্টি যায় নীলিমা’র ফোনের ওয়ালপেপারের দিকে। এক সুদর্শন যুবকের পিকচার নীলিমা’র ফোনের ওয়ালপেপারে সেট করা। সেটা দেখে থেমে যায় তাসনিয়া।) — …….. — একটা প্রশ্ন করবো নীলিমা? — কেন নয়? অবশ্যই…. — স্ক্রিনের ঐ ব্যক্তি’টি কে? আমি কি জানতে পারি? — (নীলিমা নিশ্চুপ) — বয়ফ্রেন্ড?! — হু…(নিচের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়) — কি করে ভাইয়া? — ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াশুনা করে। — কত বছরের রিলেশন? — সাড়ে তিন বছর। — ওহ, আচ্ছা! আমার ক্লাস আছে। আজ তাহলে আসি… — আল-বিদা! মন খারাপ করে শুভ্র’র পাশে গিয়ে বসে তাসনিয়া। ওপাশ থেকে আতিকের প্রশ্ন, কিরে? বলেছিস? কি বলল? নিশ্চয় প্রিন্সিপালের কাছে বিচারের হুমকি দিয়েছে? পাশ থেকে নিপা’র জবাব, আরে ব্যাটা চুপ কর! তুই দেখছি রিলেশন শুরু’র আগেই ভেঙে দিবি…! সুমাইয়ার প্রশ্ন, তাসু! রিপ্লাই কি আসলো? পজিটিভ নাকি নেগেটিভ? কিছুটা কৌতূহলের সাথে রুবেলের জবাব, তারপর তাসু বেবি! কি বললো আমাদের ভাবি সাহেবা? রাগটাগ দেখায়নি তো?! মন খারাপ করে তাসনিয়া’র জবাব, ওই মেয়ে’র বয়ফ্রেন্ড আছে….! কিহ? একসাথে সবাই লাফিয়ে উঠে। চুপচাপ সবার কথা শুনছিল শুভ্র। অকস্মাৎ তাসনিয়া’র এ হেন কথা শুনার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কিছুটা কৌতূহলের সাথে প্রশ্ন করে তাসনিয়া’কে, মানে কি? তুই সত্যি সত্যি ওকে আমার কথা বলে এসেছিস নাকি? অকপটে তাসনিয়া’র জবাব, জ্বী! বলে এসেছি। নিপা’র প্রশ্ন, আসল ঘটনা কী? একটু ঝেড়ে কাশলে হতো না? শুকনো কাশি দিয়ে নড়ে বসে তাসনিয়া। তারপর সবটা খুলে বলে। সব শুনে মাথা নিচু হয়ে যায় শুভ্র’র। বন্ধু-বান্ধব’রা যে যার মতো এ বিষয়কে কেন্দ্র করে হাসাহাসিতে মেতে উঠেছে। তখনো শুভ্র বিষণ্ন মনে নিচের দিকে তাকিয়ে। অজানা কষ্টে ভেতরটা দুমড়ে, মুচড়ে যাচ্ছে ওর। কাঁধে হাত রাখে আতিক। মলিন মুখে সেদিকে ফিরে তাকায় শুভ্র। ‘চল! ওদিকটাই হেটে আসি…’ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় শুভ্র। আতিকের সাথে ক্যান্টিনের দিকে চলে যায়।
গল্পটা_নিশ্চুপ বালিকা’র
(৩য় অংশ)
রচনায়- অনামিকা ইসলাম ‘অন্তরা’