#Dont_forget_me (পর্ব – ১২/শেষ পর্ব)
মোতাহার উদ্দিন তার পুরো পরিবার নিয়ে কোর্টে উপস্থিত হয়েছেন। আজ তার মামলার রায় ঘোষণা হবার কথা। যদিও তথ্য প্রমাণ সব কিছুই জুলির বিপক্ষে তবুও মোতাহার উদ্দিনের বুক ধুকপুক করছে… যদি কিছু হয়ে যায়? জুলির তো রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড বেশ শক্ত!
জুলিকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবার পর খুব দ্রুতই মামলা কোর্টে উঠানো হয়। ফাতিমের মায়ের মত জাদরেল উকিলের সামনে জুলি দাঁড়াতেই পাড়ল না। একেবারে বাসি ফুলের মত মিইয়ে গেল। জুলির ফোন রেকর্ডের ভিত্তিতে জয়নালকে ধরে আনে পুলিশ। আদালত তাকে ৩দিনের রিমান্ড দিলে পুলিশ তার মুখ থেকে সব সত্য উগরে বের করে নিয়ে আসে। জাল কাবিন করে বিয়ের প্রতারণা সহ স্বামীকে হত্যার সকল অপরাধ প্রমাণিত হয়। জুলি এবং তার ভাই জামালের নামে বিয়ের এমন প্রতারণার মামলা আগেও ছিল। স্বামী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে জুলি ও হত্যা করে জুলির পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দিয়ে সহযোগিতা করায় আদালত জয়নালকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। উক্ত খুনের ঘটনায় জুলির ভাই জামাল এবং জামালের দুই পুত্রের সংপৃক্ততা পাওয়া গেছে বলে পুলিশ তাদের নামেও গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেছে। জামাল এবং তার বড় ছেলেকে গ্রেফতার করা গেলেও ছোট ছেলে পলাতক আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেফতার করতে জামাল ও তার বড় ছেলেকে দফায় দফায় রিমান্ডে নিয়ে তথ্য আদায়ে যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আসামীদের আদালত জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেওয়ার পর জুলিকে যখন পুলিশি হেফাজত থেকে জেলে হস্তান্তর করা হলো তখন সে তূর্যকে কড়া গলায় বলেছিল-
-don’t forget, one day I will be back…
তূর্য হেসে বলেছিল- I wouldn’t forget you either. Hope you will come back civilized by then. bye… জুলি এরপর আর দাঁড়ায়নি।
কোর্টে মামলার শুনানি পর্যন্ত জাওয়াদকে আলো নিজের কাছেই রাখল। আলোর কাছে আদরে থাকলেও জাওয়াদ তার মাকে মিস করত… ছোট মানুষ… মাকে ছাড়া কখনও থাকেনি তো! আলো ওকে যথেষ্ট আদর দিল ওই কয়েকটা দিন। মামলার রায়ের সাথে কোর্ট জাওয়াদের custody তার দাদা দাদীকে দিয়েছে। ওর দাদা আব্দুর রশিদ যখন ওকে নিতে এলো তখন আলোকে জড়িয়ে ধরে মন খারাপ করে কেঁদে ফেলেছিল। আলো বলেছে স্কুল ছুটি দিলে যেন এখানে বেড়াতে আসে। জাওয়াদের দাদা জুলির কারাদন্ডে অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। তার একমাত্র পুত্র রাজীবকে হারিয়ে একেবারেই ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। তার উপর ছেলে হত্যার সঠিক বিচার তিনি পাননি। জামাল আর জামালের ছেলেরা মিলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের সহ জুলিকে নির্দোষ প্রমাণ করে মামলা খারিজ করে দিয়েছিল। হত্যাকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে প্রমাণ করে দিব্যি স্বাভাবিক জীবন যাপন করছিল ওরা সবাই। এসব দেখে আব্দুর রশিদ সাহেব শোকে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন, ভেঙে পড়েছিল তার পুরো পরিবার। জুলি শুধু তার ছেলেকে হত্যা করেনি, হত্যা করেছে তার পুরো পরিবারের শান্তি আর আনন্দ! দুই বছর পরে হলেও ছেলে হত্যার শাস্তি হওয়ায় তিনি প্রাণভরে তূর্য আর আলোকে দোয়া করে গেছেন। তিনি বাবা হয়ে যে কাজটা করতে পারেননি দূরের মানুষ হয়েও তূর্যরা সেটা করে দেখিয়েছে!
মামলার রায় কার্যকর হবার পর থেকে মোতাহার উদ্দিন খুব ফুরফুরে মেজাজে আছেন। কারণ এই বয়সেও সুন্দরী মেয়েরা তাকে বিয়ের জন্য পাগল! তারান্নুম হোসেনের সামনে ইদানীং খুব ভাব নিয়ে চলছেন। রীতিমতো পাত্তাই দিচ্ছেন না তাকে। বুড়ো বয়সে এসব ঢং তারান্নুম হোসেনের একদমই সহ্য হচ্ছে না।
ওদিকে অনেকদিন পর বাড়িতে স্বস্তি নেমে এসেছে বলে সেই খুশিতে আজ পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। আলো বলেছে পার্টির সব খাবার সে নিজে রান্না করবে। তাকে কারো সাহায্য করার পর্যন্ত কোনো দরকার নেই। এমনকি আজ রান্নাঘরের আশেপাশেও কারো যাওয়া নিষেধ! তূর্য আর তারান্নুম হোসেন এটা নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন অবস্থায় আছেন, কারণ আলো চা বানানো ছাড়া কিছুই রান্না জানে না। ২/৪বার কিছু রান্না করার ট্রাই করেছে যার কোনটাই মুখে তোলা যায়নি! আজ আনন্দের দিনে কী হবে কে জানে! ইউটিউব দেখে নাকি খুব টেস্টি সব খাবার রান্না শিখেছে। এবার তার রান্না খেয়ে নাকি আঙুল সুদ্ধ খেয়ে ফেলবে সবাই। একেবারে নো ফেইল সব রেসিপি শিখেছে। এখন ইউটিউবের রেসিপি দেখে কতটা কী হবে কে জানে! সেখানে তো এক কাপ গুড়া দুধে ৬টা ডিম দিয়ে নো ফেইল মিষ্টির রেসিপিও আছে!!!
তারান্নুম হোসেন মোটেও ভরসা করতে পারছেন না তাই তূর্যকে বলল- আলো কী করছে কে জানে… আমাদের কাউকে কিছু বলছেও না দেখতেও দিচ্ছে না। যদি…
-তুমি যা ভাবছ আমিও তাই ভাবছি মা… যদি ওর রান্না খাওয়া না যায় তখন?
-আজ রাতে কী তাহলে না খেয়ে থাকতে হবে?
-একরাত না খেয়ে থাকাটা ব্যাপার না কিন্তু দাওয়াত খাবার কথা থাকলে খিদেটা তখন রাক্ষস হয়ে যায় এই অবস্থায় খেতে না পারাটা কষ্টদায়ক!
-কী করবি তাহলে?
-ও তো রান্নাঘরেই আছে সেই সুযোগে তাহলে আমরা রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু খাবার অর্ডার করে ফেলি?
-ও মন খারাপ করবে।
-আরে কিছুই হবে না। আমি ম্যানেজ করে নেব তুমি টেনশন নিও না।
-ম্যানেজ করা যাবে হয়ত কিন্তু মেয়েটা কষ্ট পাবে।
-সারাক্ষণ আলোর প্রতি সফট কর্ণার না দেখিয়ে তোমার যে একটা পুত্র আছে সেটা মাথায় রেখো। আর ওকে একটু রান্নাবান্না শেখাও।
-তোকে মাথায় রাখি না তো কোথায় রাখি?
-কে জানে কোথায় রাখো! আমি খাবার অর্ডার করছি। বলে তূর্য উঠে যায়।
রাত ৯ টায় আলো খাবার রেডি করে সবাইকে ডাইনিং টেবিলে ডেকে পাঠাল। খাবারের দিকে তাকিয়ে সবার রীতিমতো চোখ কপালে ওঠার জোগাড়… এত লোভনীয় সব খাবার… তূর্য তো উত্তাজনায় বলেই ফেলল- wow! looks like restaurant!!!
তূর্যর কথা শুনে আলো চমকে উঠল। তারপর শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা গলায় বলল- রেস্টুরেন্ট মানে কী? আমি সব নিজে রান্না করেছি… শিখেছি না?
তারান্নুম হোসেন বললেন- আসলেই দেখতে চমৎকার হয়েছে। খেতেও নিশ্চই ভালো হয়েছে। কথা না বাড়িয়ে সবাই খাওয়া শুরু করো।
সবাই খুব তৃপ্তি নিয়ে খেল। কেউ কল্পনাই করেনি আলো হুট করে এত ভালো রান্না করে ফেলবে! ওদিকে আলো খুশিতে গদগদ হচ্ছে। তারান্নুম হোসেন ঘোষণা করলেন এখন থেকে আলোকেই রান্নাঘর সামলাতে হবে। এত ভালো রান্না রেখে আর যাই হোক হালিমার হাতের রান্না খাওয়া ঠিক হবে না।
এসব শুনে আলোর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করলেও হেসে বলল- হ্যাঁ হ্যাঁ করব তো… ওদিকে খাবার শেষ হতেই কলিংবেল বাজল। তূর্য বুঝল এটা নিশ্চই ডেলিভারি বয়! খাবার নিয়ে এসেছে। মায়ের কথা না শুনে খাবার অর্ডার করাটা খুব ভুল হয়ে গেছে। পেট ভরে খাওয়ার পর এই খাবার গুলোর গতি কী হবে এখন? সে হতাশ মুখে দরজা খুলে দেখল ডেলিভারি বয় খাবারের প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তূর্য বলল- আচ্ছা আমি যদি এই খাবারের অর্ডারটা ক্যান্সেল করতে চাই সেটা কী সম্ভব?
-সম্ভব না স্যার।
-মুশকিল হয়ে গেলো…
-কেন স্যার? আমাদের তো কোনো ভুল হয়নি! আপনারা তো প্রথমে ৫ জনের খাবারই অর্ডার করেছিলেন। পরে আবার ৫ জনের খাবার চাইলেন। আমরা সেভাবেই তো ডেলিভারি দিলাম!
-আবার ৫ জনের অর্ডার মানে?
-মানে স্যার, আমি দুই ঘন্টা আগে এ বাসায় খাবার দিয়ে গেছি। আবার একই ঠিকানায় অর্ডার আসায় আমিই এলাম খাবার নিয়ে।
তূর্যর মাথা ঘুরতে লাগল… বলল- তুমি শিওর এবাসাতেই খাবার দিয়েছ?
-জ্বি স্যার। একজন মেডাম খাবার গুলো রিসিভ করেছেন।
তূর্য বুঝে গেল আলোর রান্না আসলে কোন কিচেনে হয়েছে! সে খাবারগুলো নিয়ে ছেলেটাকে বিদায় করে দিল। তারপর সেগুলো সোজা নিজের ঘরে নিয়ে গেল।
আলো ঘরে এসে খাবারের প্যাকেট দেখে অবাক হল। তূর্যকে জিজ্ঞেস করলে তূর্য পুরো ঘটনা খুলে বলল। আলো তখন তূর্যকে বকতে শুরু করল এটা বলে যে, বাড়িতে খাবার রান্না হবার পরও সে কেন বাহির থেকে খাবার আনালো?
তূর্য অবাক হয়ে বলল- ওরে বাবা… এ তো দেখি চোরের মায়ের বড় গলা! তুমি কী এখনও ভাবছ আমি কিছু বুঝিনি?
আলো চুপ করে ধরা পরা মুখ নিয়ে মন খারাপ করে বসে রইল। সে তো ভালো ভেবেই এটা করেছে। আনন্দের দিনে খারাপ খাবার খাইয়ে কারো মন খারাপ করাতে চায়নি। আজকের পার্টি পার হলে রান্নাটা শিখে নেবে তারপর সবাইকে শুধু নিজের হাতের রান্না খাওয়াবার জন্যই একটা পার্টি দেবে। অথচ… এভাবে ধরা পরবে ভাবতেও পারেনি। তূর্য ওর মুখ দেখে বলল- রান্নাটা শিখে নিলেই তো পারো?
-এতদিন তো সময়ই পেলাম না…
-ঠিক আছে এখন তো বাসায় আর কোনো ঝামেলা নেই। এখন থেকে রোজ রান্না শিখবে।
-হুম…
-আচ্ছা চলো ছাদে যাই। বেশ কিছুদিন হলো যাওয়া হয় না। কাল বিকেলে গিয়ে একটা জিনিস দেখে অবাক হয়েছি, চলো তোমাকেও দেখাব।
-ইচ্ছে করছে না এখন।
আরে চলো তো… বলে তূর্য আলোর হাত ধরে টেনে ছাদে নিয়ে যায়। গিয়ে টর্চ জ্বালাতেই আলো বিস্ময়ে চিৎকার করে বলল… Don’t forget me!!! কবে ফুটল ফুল?
-আজই ফুটেছে। আমি গতকাল এসে দেখে গেছি কিন্তু তোমাকে বলতে ভুলে গেছি…
-এর ফুলের জন্য কবে থেকে অপেক্ষা করছি আর তুমি বলতে ভুলে গেলে?
-কী করব বলো… আমাকে তুমি এত ব্যস্ত রাখো…
আলো মুচকি হেসে ফুলের ছবি তুলে তার উপর “don’t forget me” লিখে সেটা তূর্যর ফোনে সেন্ড করল।
তূর্য সেটা দেখে আলোকে জড়িয়ে ধরল। কানের কাছে ফিসফিস করে শুধু বলল- “never…”
সমাপ্ত।।