#Dont_forget_me (পর্ব – ১১)
মোতাহার উদ্দিন আর তারান্নুম হোসেন এশার ওয়াক্তের নামাজ শেষ করে উঠেছেন। তারান্নুম হোসেন দেখলেন মোতাহার উদ্দিন কেমন চুপ হয়ে আছেন… বুঝতে পারলেন কিছু একটা নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তায় আছেন। পাশে বসে জিজ্ঞেস করলেন- কী হয়েছে? এভাবে ঝিম মেরে বসে পড়লে যে?
-ভাবছি, গত ৩দিন শুক্রবার শনিবার আর মাঘী পূর্ণিমার কারণে রবিবার পর্যন্ত অফিস বন্ধ ছিল। কাল থেকে তো অফিস… বাসার এই অবস্থায় অফিস করব কী করে?
-তূর্য তো বলল অফিস ও ম্যানেজ করবে। তুমি ততদিন বাসায় থাকো। তারান্নুম হোসেন কথা শেষ করতেই জুলি এসে মোতাহার উদ্দিনকে বলল- জাসিয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না আর আপনারা দুজন এমন শান্তিতে বসে আছেন?
মোতাহার উদ্দিন ঠান্ডা গলায় বলল- কী করব তাহলে?
-পুলিশে খবর দিচ্ছেন না কেন?
-২৪ ঘন্টা পার না হলে পুলিশ কোনো কেস নেবে না।
-কেস নেবে না নাকি আমার মেয়েকে আপনারা সবাই মিলে প্ল্যান করে গুম করে রেখেছেন?
-আবোল তাবল বলতে ইচ্ছে হলে তোমার নিজের লোককে গিয়ে বলো। অযথা আমাদের সময় নষ্ট করবে না। পাশ থেকে তারান্নুম হোসেন বললেন-
-মেয়ের বয়ফ্রেন্ডকে ফোন দিয়ে খোঁজ নিলেই তো জানতে পারবে তারা কোথায় আছে?
-আমার মেয়ের যে বয়ফ্রেন্ড আছে সেটা আপনাকে বলে গেছে?
-বলতে হবে কেন? দেখলেই তো বোঝা যায় কেমন ইচরেপাকা মেয়ে ওটা!
-এভাবে অপমান করার মাশুল কী হতে পারে জানেন?
-অপমান করার কী আছে যেমন মা তেমন তার ছা হবে এটাই তো বলেছি, ভুল কী বললাম?
জুলি আরও কিছুক্ষণ শাসায় কিন্তু মোতাহার উদ্দিনকে এবার আর কাবু করতে পারল না। তিনিও পাল্টা জবাব দিয়ে গেলেন। এমন সময় তূর্য এসে বলল-
-আন্টি, অযথা চেঁচিয়ে গলা খারাপ করবেন না। আপনার মেয়ে ভালো আছে, ইনফ্যাক্ট সে খুবই ভালো আছে।
-মানে! তুমি কী করে জানলে?
তূর্য ওর মোবাইলটা জুলির মুখের সামনে ধরতেই জুলি দেখল জাসিয়া তার ফেসবুক এ্যাকাউন্টের প্রফাইল পিক চেঞ্জ করেছে। সেখানে জাসিয়াকে বাসরঘরে বসে নববধূর বেশে দেখা যাচ্ছে আর সাথে সেই নে*শাখোর ছেলেটা বর সাজে! ক্যাপশন দিয়েছে, “আলহামদুলিল্লাহ, ৩মাসের প্রেমের মধুর পরিণতি। আমার জান আমার হাবি- রকি ❤️❤️ সবাই আমাদের নতুন জীবনের জন্য দোয়া করবেন।” জুলির টাশকিত অবস্থা দেখে আলো আর তূর্য দুজনই যেন শান্তি পেল। তূর্য বলল-
-বলেছিলাম না জাসিয়া বিয়ের কেনাকাটা করেছে বলে মনে হয়েছে? দেখলেন তো? আপনার মেয়ে আমার দুশ্চিন্তা দূর করতে তার হাজবেন্ডের সাথে তোলা বেশ কিছু রোমান্টিক ছবি আমার ইনবক্সে পাঠিয়েছে। দেখবেন?
জুলি কোনো কথা না বলে তার নিজের ঘরে চলে গেল। এবাড়ির সবাই আজ ৩দিন পর একটু স্বস্তি পেল। তূর্য তখন সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল-
-ফাতিম ভাইয়ের মায়ের সাথে আমি দেখা করে এসেছি। একটু আগেও উনাকে বেশ কিছু নতুন ইনফরমেশন দিয়েছি। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন এখন কী করতে হবে। তোমাকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করার দায়ে আগামীকাল পুলিশ নিয়ে আসব ওনাকে এরেস্ট করতে। বাবা, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো সত্যের জয় হবেই। এপর্যন্ত বলে তূর্য থামল। জুলির ফোনের ব্যাপারটা ইচ্ছে করেই চেপে গেল… কারণ দেওয়ালেরও কান আছে!
জাসিয়ার কারণে এই প্রথম জুলিকে একটু বিধ্বস্ত দেখাল। সে নিজের ঘর থেকে আর বের হলো না। পরের দিন সকালে সে মোতাহার উদ্দিনের কাছে গিয়ে বলল- তাকে কাবিনের পুরো ২০লাখ টাকা এখনই দিতে হবে।
মোতাহার উদ্দিন অবাক হয়ে বললেন- কাবিনের টাকা! টাকা দিয়ে কী করবে এখন?
-আমার টাকা দিয়ে আমি যা খুশি করব আপনাকে কৈফিয়ত দিব কেন?
-টাকাটা যেহেতু আমাকেই দিতে হবে সেহেতু কৈফিয়ত তো চাইতেই পারি?
-কাবিনের টাকার ব্যাপারে কোনো কৈফিয়ত চাইবার নিয়ম নেই। টাকাটা আমার লাগবে। এক্ষুণি দেবেন।
তূর্য এসে বলল- এতদিন তো স্ত্রীর অধিকার চেয়ে চেয়ে মাথা খারাপ করেছেন আজ হঠাৎ টাকার জন্য এত মরিয়া?
জুলি মোতাহার উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলল- আপনি টাকাটা দেবেন নাকি আমি পুলিশের কাছে যাব?
মোতাহার উদ্দিন গম্ভীর গলায় বললেন- চাইলেই তো হুট করে এতগুলো টাকা দেওয়া যায় না। ব্যবস্থা করতে সময় লাগবে না?
-কত সময় লাগবে?
তূর্য বলল- সেটা এখনই কী করে বলবে? দুই সপ্তাহ তো লাগবেই…
-এত সময় আমার হাতে নেই। আমি এক সপ্তাহ সময় দিলাম। এর মধ্যেই ব্যবস্থা করুন। টাকা না পেলে ঠিক এক সপ্তাহ পর বাড়িতে পুলিশ আসবে। বলে জুলি চলে গেল।
-এখন কী করবি তূর্য? এ তো আমাদের শেষ করেই ছাড়বে মনে হচ্ছে!
-কে কাকে শেষ করবে সেটা এখন সময় মাত্র… আমি থানায় যাচ্ছি পুলিশ আনতে… দোয়া করো সব কিছু যেন ঠিকঠাক করতে পারি।
-যাও, আল্লাহ ভরসা। সব কিছু ভালোই হবে ইনশাআল্লাহ।
জয়নাল জুলিকে আবার ফোন করেছে। জুলি ফোন ধরেই ঝাঁজালো গলায় বলল- তোকে না বলেছি এভাবে ফোন দিবি না? টাকার ব্যবস্থা হবে শীঘ্রই। আমাকে ১০ দিন সময় দে। এরপর আমি নিজেই তোকে ফোন দিব।
-ঠিক আছে। তবে এইবার শেষবারের মত সময় দিলাম। ১০দিন শেষ হইলে আমি জয়নাল তরে মাটির তল থিকা হইলেও খুঁইজা বাইর কইরা টাকা আদায় কইরা ছাড়ুম। মনে থাকে যেন। বলেই জয়নাল ফোন কেটে দিল। জুলি ভাবতে লাগল জয়নালকে আর ঘাটানো যাবে না। ১০ দিনের জন্য তো ওকে ঠান্ডা করা গেল। এই ফাঁকে মোতাহার উদ্দিনের কাছ থেকে তাগাদা দিয়ে টাকাটা আদায় করতে হবে। তিনি গাধা হলেও তূর্য ছেলেটা খুব চালাক। কখন জেনে ফেলবে ওর বাবাকে মিথ্যে কাবিনে ফাঁসিয়েছি তখন আর টাকা তোলা সম্ভব হবে না। আম ছালা সব যাবে। ওদিকে জিল্লুর ছোকরাটা বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে। বিয়ে করেই ব্যাংকক চলে যাবে বলেছে। সব কিছু গোছানোই আছে… টাকাটা হাতে পেলেই উড়াল দিবে দুজনে। জাসিয়া ভেগেছে ভালোই হয়েছে। আমার রাস্তা বিনা ঝামেলায় পরিষ্কার হয়েছে। জাওয়াদটা একটা ঝামেলা রয়ে গেছে। ছেলেটা সারাদিন এত খায়… খেতে খেতে কবে জানি ফেটে যাবে! তাও মায়া লাগে… খাক, একটু খেলে কী হয়? ওকে নাহয় ভাইয়ার কাছে দিয়ে যাব। ভাইয়া অবশ্য নিতে চাইবে না। হাতে কিছু টাকা দিলে ঠিকই নেবে, লোভী একটা। ব্যাংককে কিছুদিন আয়েস করে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বছর খানেক পর নাহয় জাওয়াদের একটা ব্যবস্থা করা যাবে। তারপর যা সব জাহান্নামে… বলে আয়েসি ভঙ্গিতে ফোন হাতে নিল। জিল্লুরের সাথে কিছুক্ষণ রসের আলাপ করতে হবে। ছেলেটার সাথে গতরাতে একটু ঝগড়া হয়ে গেছে বলে রাগ হয়ে আছে। বেশি রাগ হয়ে গেলে আবার ব্যাংককের টিকিট হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে!
জুলি দরজা বন্ধ করে যখন ফোনে জিল্লুরের সাথে গল্প করছিল তূর্য তখন পুলিশ নিয়ে বাসায় এলো। জুলির ঘর দেখিয়ে দিতেই পুলিশ দরজায় থাবা মারতে লাগল… জুলি ভেতর থেকে চিৎকার করে বলল-জাওয়াদ হারামাজাদা দরজা ভেঙে ফেলবি নাকি? খেয়ে খেয়ে তোর শরীরে মহিষের মত শক্তি গজিয়ে গেছে। মার খেতে না চাইলে ভাগ এখন। কিন্তু দরজা থেকে কেউ সরল না বরং আগের চেয়েও দ্বিগুণ জোরে থাবা পড়ল! জুলি তখন রেগে ইচ্ছেমত গালি দিতে দিতে দরজা খুলল। দরজা খুলেই তার চোখ কপালে উঠে গেল পুলিশ দেখে। বলল- আমি তো আপনাদের ডাকিনি!?
-আমাদের ডাকতে হয় না আমরা গন্ধ শুকে জায়গামত হাজির হয়ে যাই।
জুলি মনে মনে ভয় পেল, এরা জাল কাবিন বিষয়টা বুঝে ফেলল? নাকি অন্য কিছু জেনেছে? সে নিজেকে শক্ত রেখে একবার তূর্যর দিকে তাকাল তারপর বলল- আপনাদের আমি ডাকব তবে সময় হলে।
-আপনার দেখানো সময়ে আমরা চলব? আপনাকে এক্ষুনি থানায় যেতে হবে আমাদের সাথে। তারপর পাশে থাকা মহিলা পুলিশকে নির্দেশ দিলেন ওকে হ্যান্ডকাফ পরাতে। মহিলা পুলিশ হাত ধরতেই জুলি এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল-
-কী হচ্ছে এসব? আপনারা আমাকে কেন ধরছেন? আমাকে এবাড়ির লোক স্ত্রীর অধিকার দিচ্ছে না আর আপনারা তাদের না ধরে আমাকে ধরছেন? এই আপনাদের আইনশৃঙ্খলা?
-কে কী অধিকার পাবে সেটা থানায় গেলেই জানতে পারবেন। আমাদের সময় নষ্ট না করে চলুন এবার।
-তার আগে বলুন কী অপরাধে আমাকে থানায় যেতে হবে?
-অপরাধ তো অনেকগুলো কোনটা থেকে শুরু করব? তবে এই মুহূর্তে বিয়ে সংক্রান্ত জালিয়াতির মামলায় এরেস্ট করছি। থানায় চলুন আরামে বসে সব জানতে পারবেন। তখন আপনার হাতে অফুরন্ত সময় থাকবে।
জুলি এতটা মোটেও আশা করেনি। “অভিযোগ অনেক” এই শব্দটাতে ওর বুকে কাঁপন ধরে গেছে। সে ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছে কিন্তু সে অবস্থা কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না। কঠিন গলায় বলল- আমি একটা ফোন করতে পারব?
-পারবেন, তবে আমাদের সামনে বসে কথা বলতে হবে। নিরাপত্তার জন্য…
-জুলি তার ভাইকে ফোন দিল। জামালকে কেঁদে কেঁদে সব বলল। ওপাশ থেকে জামাল কী বলল জানা গেল না। তবে কথা শেষ হতেই পুলিশ অফিসার ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নেয়। ফোন নিতেই জুলি চোখে মুখে আগুন ঢেলে বলল-
-আমার ফোন নিচ্ছেন কেন?
-ফোনে ক্রাইমের অনেক এভিডেন্স পাওয়া যায়। তাই এটা এই মুহূর্ত থেকে পুলিশি হেফাজতে থাকবে।
-আপনারা এভাবে আমার ফোন নিতে পারেন না।
-অবশ্যই পারি। আপনার নামে মামলার সাথে এটাও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে ফোনটা যেন বাজেয়াপ্ত করা হয় নয়ত মামলার অনেক প্রমাণ সরিয়ে ফেলা হবে।
জুলি আর কোনো কথা বলতে পারল না তবে তূর্য আর মোতাহার উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে কাউকে ছাড়বে না বলে শাসিয়ে গেল।
জুলিকে নিয়ে যেতেই বাড়ির সবাই স্বস্তি পেল। তূর্য বলল- বাবা তুমি কিচ্ছু টেনশন করো না, এই মহিলা যেন অন্তত ১৪ বছরের আগে ছাড়া না পায় সে ব্যবস্থা আমি করে ফেলব। আর তোমাকেও নির্দোষ প্রমাণ করে ফেলব। টেনশনের দিন শেষ এবার টেনশন দেবার পালা।
সেই মুহুর্তে জাওয়াদ এসে বলল- আমার আম্মুকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল কেন?
চলবে…