#Dont_forget_me (পর্ব – ১০)
তূর্য ৩টার দিকে বাসায় ফিরে দেখল আলো খুব আয়েস করে দুপুরের ভাত-ঘুম দিয়েছে। সে আলোকে আর জাগাল না। ভাবল- এই সুযোগ, ওর জন্য যে সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে সেটা রেডি করে ফেলা যাক… সে সাথে করে আনা ফুল দিয়ে ঘরটা সাজাতে বসল। গোলাপের পাপড়ি ছিঁড়ে মেঝেতে হার্ট শেপ করল। তারপর ছোট ছোট ডেকোরেশন বাতি জ্বালিয়ে দিল। হার্ট শেপের পাশে আলোর জন্য আনা গিফটটা রেখে দিল। এমন সময় দরজায় নক পড়ল। আসলে নক বললে ভুল হবে যেটা পড়ল সেটাকে প্রায় থাবা বলা যায়। আলোর ঘুম ভেঙে যাবে বলে সে দ্রুত দরজা খুলে দেখে জাওয়াদ দাঁড়িয়ে। তূর্য চাপা রাগী গলায় বলল-
-কিরে জাম্বু দুপুরবেলা না ঘুমিয়ে ভূতের মত মানুষের দরজায় দরজায় থাবা মারছিস কেন?
-মা ডাকছে তোমাকে।
-আমাকে কেন ডাকছে?
-আমাকে তো বলেনি কেন ডাকছে।
-আমি এখন ব্যস্ত, পরে যাব যাহ…
-এক্ষুণি যেতে বলেছে। এক্ষুণি না গেলে মা মারবে তোমাকে। মা’র অনেক রাগ।
-আমাকে মারতে পারলে তো? যা গিয়ে তুই মার খা আমি আসতে পারব না।
-তোমাকে যেতেই হবে নয়ত আমি এখনই চিৎকার করব।
-তোরা সব ক’টা এমন বিষের হাড়ি, না? আচ্ছা যাচ্ছি। শোন, এই বেলুন গুলো ওই বিছানার পাশে বেঁধে দিতে পারবি? কোনো শব্দ করতে পারবি না। তোর ভাবির ঘুম ভেঙে গেলে আমি কিন্তু তোর নাক ভেঙে ফেলব।
-ওই গ্যাস বেলুনগুলো? আমাকে একটা দিবে ভাইয়া?
-যদি ঠিকঠাক বাঁধতে পারিস তাহলে দিব।
-ঠিক আছে। তুমি যাও আমি সুন্দর করে বেঁধে রাখব।
তূর্য ওকে বেলুনগুলো দিয়ে সোজা গেস্টরুমে জুলির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল- আমাকে ডেকেছেন কেন?
-তুমি বাসায় এসেছ জাসিয়া কোথায়?
-জাসিয়া কোথায় মানে? আমাকে তো দুই ঘন্টা আগেই ও ছেড়ে দিয়েছে। বলল, একাই বাড়ি যাবে আমি যেন আমার কাজে চলে যাই। ফেরেনি এখনও?
-কী বলছ এসব? ওকে একা ছেড়ে দেবার জন্য তোমাকে সাথে পাঠিয়েছি নাকি?
-কী আশ্চর্য আমাকে কথা শোনাচ্ছেন কেন? আপনার মেয়েই তো আমাকে চলে যেতে বলেছে।
-ও বলল আর তুমি শুনে নিলে! বাচ্চা একটা মেয়ে… কত সময় চলে গেছে… এখনও ফিরল না…
-ফোন করুন?
জুলি ফোন দিল কিন্তু ফোন বন্ধ দেখাল। জুলি তখন আতংকিত হয়ে পড়ল। বলল- তোমার সাথে যাবার পর ও কী কী করেছে?
-কেনাকাটা করতে যেয়ে কী করবে আবার? কেনাকাটা দেখে তো মনে হয়েছে বিয়ের বাজার করছে! মেয়েকে কিছু কিনে টিনে দেন না নাকি?
-বিয়ের কেনাকাটা!
-তাই তো মনে হলো। এত ব্যাগ নিয়ে এখন রাস্তায় পড়ে আছে কিনা খোঁজ নিয়ে দেখুন?
-জাসিয়া কী কারো সাথে ফোনে কথা বলেছে? তুমি কী ওর সাথে বা আশেপাশে কাউকে দেখেছ?
তূর্য খেয়াল করল জুলির চেহারায় আতংক ভর করেছে! যেটা তাকেও চিন্তিত করে ফেলল বলল- না, কাউকে দেখিনি। তবে একটা ফোন এসেছিল। আমার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেনি। আর ফোন আসার পরই সে আমাকে চলে যেতে বলল।
জুলির চেহারা সাথে সাথে রক্তিম হয়ে গেল! সে দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল- যদি আমার মেয়ের কিছু হয়ে যায় তাহলে তোমাকে আমি ছাড়ব না। তোমাদের কাউকে ছাড়ব না। আমার মেয়েকে গুম করে দেবার দায়ে সব ক’টাকে জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়ব। যাও এখন আমার চোখের সামনে থেকে। বলেই সে তূর্যকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
তূর্য বাইরে দাঁড়িয়ে বুঝল জাসিয়া কেন তখন ওকে টেনশনের কথা বলেছিল! তার মানে ওর বাড়ি না ফেরার বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আছে। সে দ্রুত পকেট থেকে ফোন বের করে জাসিয়ার নাম্বারে ডায়াল করল কিন্তু ফোন বন্ধ দেখাল। মেয়েটার জন্য ওর চিন্তা হতে লাগল। পরক্ষণেই মনে পড়ল জাসিয়া এটাও বলেছিল রাতের মধ্যে টেনশন দূর করে দেবে। সে জুলির দরজায় নক দিয়ে বলল- দরজাটা একটু খুলুন, জাসিয়ার ম্যাসেজ আছে…
জুলি দরজা খুলে বলল- কী বললে?
-জাসিয়া যাবার সময় আমাকে বলেছে আমি নাকি টেনশনে পড়ে যাব তবে রাতের মধ্যে সে টেনশন দূর করার ব্যবস্থা করবে। তাই আমার মনেহয় চিন্তার কিছু নেই। ও যেখানেই আছে নিজের ইচ্ছেতেই আছে এবং ভালো আছে। আমাদের এখন ওর ম্যাসেজ পাওয়া অব্দি অপেক্ষা করে যেতে হবে।
তূর্যর কথায় জুলির মেজাজ আরও বেশি খারাপ হলো। বলল- এ কথা এতক্ষণ কেন বলোনি? এখন এসব ফালতু কথা বলে নিজের দোষ আমার মেয়ের ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাও, না?
-কারো ঘাড়ে কী করে দোষ চাপাতে হয় তা আমরা কেউ শিখিনি। ওসব আপনাদের বিজনেস। জাসিয়া যেটা বলেছে আমি সেটাই বললাম। বলে তূর্য আর দাঁড়াল না চলে এলো। এসে নিজের ঘরে ঢুকে তার প্রায় চিৎকার বের হয়ে যাচ্ছিল অনেক কষ্টে সেটাকে চাপা দিল। জাওয়াদকে বলে গেছে বিছানার পাশে বেলুনগুলো বাঁধতে আর বেঁধেছে কিনা আলোর চুলে! ৮টা বেলুনের ৪টাই বাঁধা শেষ। চুলসহ বেলুন উড়ছে… মনে হচ্ছে ডাইনি মেডুলাসের চুল, কী ভয়ংকর দৃশ্য! আলো চুল ঝুটি করে বেঁধে ঘুমিয়েছিল বলে এখনও কিছু টের পায়নি। নয়ত ওর ঘুম ভেঙে যেত আর সারপ্রাইজের ১২টা বেজে যেত। এরা কেউ-ই কী কাউকে শান্তি দিতে জানে না? সে প্রচন্ড রেগে জাওয়াদের কান টেনে ধরে বলল- আমি তোকে কী বলে গেছি আর তুই কী করেছিস এগুলো?
-আরে আমি তো বাঁধার জন্য বিছানার পাশে কিছুই পেলাম না তাই চুলের সাথে বেঁধেছি। আমি তো ভাবলাম তোমার পছন্দ হবে!
তূর্য ওর কান আরও জোরে চেপে ধরে টান মারল আর সাথে সাথে ও এমন জোরে চিৎকার করল যে আলোর ঘুম ভেঙে গেল। সে লাফ দিয়ে উঠে বলল-
-কী হয়েছে? ওকে মারছ কেন?
-দেখ না ভাবি আমি কত সুন্দর করে বেলুন বেঁধে দিলাম আর ভাইয়া আমাকে মারছে!
-হ্যাঁ অনেক সুন্দর করে বেঁধেছিস বলে ওর কপালের উপরের চুলগুলো মুঠো পাকিয়ে ধরে ঝাঁকিয়ে দিল। তারপর বলল- তোর ভাবি দেখার আগে দৌড়ে পালা। বলে কান ছেড়ে দিয়ে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। ওদিকে আলো মাথা ভাড় লাগছিল বলে আয়নার সামনে গিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল… তূর্য ওর দিকে তাকিয়ে আর পারল না শব্দ করে হেসে ফেলল। আলো রেগে বলল-
-ওই মোটকাটার কান যদি আমি না ছিঁড়েছি…
-আহা রাগ হচ্ছ কেন? ভালোই তো লাগছে… ইউনিক আইডিয়া… বলে আবার হাসতে লাগল।
-ইউনিক আইডিয়া না? আসো তোমার মাথায় বেঁধে দেই?
-তোমার ভালো লাগলে সে নাহয় দিও একদিন। এখন এদিকে এসো, বলে টেবিলের উপর থেকে কেকটা নিয়ে বিছানার উপর রেখে বলল- Happy birthday sweet heart…
-আলো তখন খেয়াল করল তূর্য ঘরটা অনেক সুন্দর করে সাজিয়েছে। সে অবাক হয়ে বলল- তুমি জানতে আজ আমার জন্মদিন?
-একটা মাত্র বউ জানব না?
আলো খুব খুশি হলো। তূর্যকে জড়িয়ে ধরে গালে আলতো করে চুমু খেয়ে বলল- thank you dear husband.
-কেকটা তাড়াতাড়ি কেটে ফেল জাম্বু এসে পড়লে আর ভাগে পাব না।
-আলো চুলে বেলুন নিয়েই কেক কাটল সাথে সেল্ফিও নিল। সেই সেল্ফি দেখে দুজনে হেসে গড়িয়ে পড়ল। তূর্য বলল- আজ মায়ের বাসায় গিয়েছিলে?
-হুম গিয়েছিলাম। না গেলে ওরা চলে আসত তখন জুলি গুন্ডিদের দেখে ফেললে ঝামেলা হয়ে যেত। তাছাড়া ওরা গোছগাছ নিয়ে ব্যস্ত, কালই তো চলে যাচ্ছে।
-তোমাদের বাড়ির কাজটা শেষ হয়েছে বলে রক্ষা। কাল উনারা চলে গেলে হয়ত এসব দেখা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
-তুমি চিন্তা করো না এবাড়ির এসব ওরা কেউ কখনও জানবে না।
-এত বড় ঘটনা কী আর চাপা থাকে। একদিন হয়ত ঠিকই জানবে। তাছাড়া জুলি আন্টি যেরকম ডেঞ্জারাস… কখন কী করে বসে ঠিক আছে? ও ভালো কথা, তোমাকে তো বলাই হয়নি জাসিয়াকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না।
-মানে! ও তো তোমার সাথেই গেল, পাওয়া যাবে না কেন?
তূর্য পুরো ঘটনা খুলে বলল আলোকে। সব শুনে আলো বলল- আমার ধারণা জাসিয়া ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়েছে।
-তুমি কী করে বুঝলে?
-আরে আমি বলেছিলাম না ওকে দেখলে মনেহয় ও প্রেম করছে? আর দেখলে না মেয়েকে তোমার সাথে পাঠাল যাতে তুমি পাহারা দিয়ে রাখতে পারো। সরাসরি তো আর মেয়ের কান্ড বলতে পারে না। দাঁড়াও জাওয়াদকে ডাকি ওর কাছ থেকে অনেক ইনফরমেশন পাওয়া যাবে।
আলো ড্রইংরুমে গিয়ে দেখল জাওয়াদ ফোনে ইউটিউবে কার্টুন দেখছে। কেক খাবার কথা বলতেই জাওয়াদ দৌড়ে এলো। আলো ওকে ঘরে নিয়ে বড় এক স্লাইস কেক দিয়ে বলল- জাওয়াদ তোমার ফোনটা একটু দেবে আমিও কার্টুন দেখব?
-উহু, মা তোমাদেরকে ফোন দিতে না বলেছে।
-ঠিক আছে দিও না। তাহলে কেকও খেতে পারবে না। বলে আলো ওর সামনে থেকে কেকটা সরিয়ে নিতেই জাওয়াদ মুখটা করুন করে বলল- কেকটা অনেক মজা প্লিজ ভাবি দাও না…
-তাহলে ফোন দে?
জাওয়াদ কী করবে বুঝতে পারছিল না। আলো তখন দুটো চকলেটবার বের করে বলল- ফোন দিলে কেকের সাথে এগুলোও পাবি। দিবি কিনা বল?
-ঠিক আছে নাও কিন্তু মাকে বলো না, হ্যাঁ?
-বলব না, প্রমিস।
জাওয়াদ ফোনটা আলোর হাতে দিতেই আলো আর তূর্য মিলে পুরো ফোন ঘাটতে লাগল। দেখল ফোনে ওর মায়ের ফেসবুক আইডি লগইন করাই আছে। সেখানে ঢুকে প্রফাইল ঘেটে জাসিয়ার আইডি পেল। তূর্য সেটা নিজের প্রফাইল থেকে খুঁজে দেখে রাখল। হয়ত কোনো সময় কাজে লাগবে। তারপর ম্যাসেঞ্জার ঘেটে সেখানে অসংখ্য পুরুষের ইনবক্স পেল যেখানে প্রেমালাপ হয়! আলো বলল-
– মাই গড! আমরা যতটা ভেবেছিলাম এই মহিলা তো তারচেয়েও জঘন্য!!! তূর্য কিছু না বলে ফটাফট ম্যাঞ্জারের বেশ কিছু ছবি তুলে নিল নিজের ফোনে। এরপর হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে যা দেখল তাতে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগাড় হলো…। এখানে একটা নাম্বারে তার প্রায়ই কথা হয়। ফোন তো আসেই, খুব অল্প কয়েকটা ম্যাসেজও আছে। সেখানে ৪দিন আগের একটা ভয়েস ম্যাসেজ পেল যেটা প্লে করতেই শুনতে পেল- “অনেকদিন ধইরা টাকা না দিয়া ঘুরাইতেছেন। বিয়া কইরা ফালাইলেন আর টাকা শোধ করতেছেন না। ভাবছেন কী বিয়া কইরা আমাগো চোখ ফাকি দিয়া পগার পার হইয়া যাইবেন? সাবধান… মামলা কিন্তু এখনো ঝুলতাছে। টাকার জন্য আপনার জামাইরে যেমন খুন করছি টাকা না পাইলে আপনেরে খুন করতেও আটকাইব না। আপনের তো নিজের জামাইরে খুন করাইতে কলিজা কাঁপে নাই টাকা না পাইলে আপনেরে খুন করতেও আমাগো কাঁপব না। তাছাড়া আপনের ঘরে একটা কচি মাইয়া আছে সেইটা ভুইলা যাইয়েন না। কথা কী কিলিয়ার?” এই ভয়েস ম্যাসেজের পর জুলি ফোন দিয়েছিল তাই জুলি কী জবাব দিয়েছিল সেটা বোঝা গেল না। তবে গতকাল আরেকটা ভয়েস ম্যাসেজ এসেছে সেটা প্লে করতেই শুনতে পেল- “টাকা না দিয়া পলাইছস, তুই কী ভাবছস তরে খুঁইজা পামু না? আমি জয়নাল তোর মত কুত্তার দুধ খায়া বড় হই নাই যে ল্যাজ গুটায় পলায় যামু। তর এমন ব্যবস্থা নিমু… তুই খালি চায়া দেখ।” এই ভয়েস ম্যাসেজের কোনো রিপ্লাই নেই। তুর্য বুঝে গেল এখন কী করতে হবে? বাবাকে বাঁচাতে এগুলোই হাতিয়ার হবে। সে দ্রুত নাম্বারটা নিজের ফোনে তুলে নিল। এমন সময় জুলির গলা পাওয়া গেল… সে জাওয়াদকে খুঁজছে তার ফোনের জন্য!!!
চলবে…