Dont forget me পর্ব-০৬

0
185

#Dont_forget_me (পর্ব – ৬)

তূর্যর বিয়ের কিছুদিন পর এক সকালে সবাই নাশতার টেবিলে বসেছে। মোতাহার উদ্দিন অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ যেন একটু বেশিই চিন্তিত অবস্থায় আছেন। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারা রাত ঘুমাননি। তূর্য বলল-

-বাবা তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে? মনে হচ্ছে রাতে ঘুমাওনি?

-ওই ক’দিন ধরে ঘুম হচ্ছে না।

-আমার মনে হচ্ছে তুমি কোনো কিছু নিয়ে অত্যন্ত টেনশনে আছ?

তারান্নুম হোসেন বললেন- কয়দিন ধরে কী নিয়ে এত টেনশন করছে আল্লাহ জানেন। আমাকে তো কিছুই বলছে না। এভাবে চেপে রেখে রেখে কখন যেন শরীরটা দুম করে খারাপ করে বিছানায় পড়ে যাবে। কিছুদিন আগে যে চট্টগ্রাম গেল সেখান থেকে ফেরার পর কী যে হলো আল্লাহ জানেন। কিছু বলেও না শুধু টেনশন করে। টেনশন করে করে শরীর কত খারাপ করে ফেলছে। বিয়ের পুরো সময়টা ধরে থম মেরে ছিল আর ইদানীং তো আরও বাজে অবস্থা! না বললে বুঝবটা কী?

মোতাহার উদ্দিন চুপ রইলেন। তূর্য বাবার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বুঝল বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ অথচ বাবা কাউকে বলবারও সাহস পাচ্ছে না। সে মাকে থামাল তারপর খাওয়া শেষ করে বাবার সাথে তার ঘরে গিয়ে বসল। বলল-

-বাবা তুমি কিছু একটা নিয়ে ভয়ানক দুঃশ্চিন্তায় আছ কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারছ না। কোনো কিছু না ভেবে আমাকে এখনই বলে ফেলবে, কী সেটা?

মোতাহার উদ্দিন ঘামতে লাগলেন। বুঝলেন এখন আর চুপ থাকা যাবে না। তাছাড়া এখন আর চেপে রাখার মত পরিস্থিতিও নেই। যেকোনো মুহুর্তে ঝামেলা এসে উদয় হয়ে যেতে পারে। স্ত্রী পুত্রকে বলে রাখলে বরং কিছুটা প্রস্তুতি নিয়ে রাখা যাবে। তিনি বলতে শুরু করলেন-

-চেপে রাখার মত শক্তি বা পরিস্থিতি কোনটাই এখন নেই আমার। তাছাড়া এই মুহূর্তে বলতে না পারলে ঝামেলা বরং বাড়বে। কিন্তু তোদের…

-বাবা আমি তো তোমারই ছেলে, এত কিছু ভাবার দরকার নেই, বলে ফেলো।

-তোমার মা তো বললই চট্টগ্রাম থেকেই আমি টেনশন সাথে নিয়ে এসেছি। ওখানে আমি অফিসের কাজে গিয়েছিলাম এক সপ্তাহের জন্য। হোটেলে উঠবার কথা ছিল কিন্তু ওখানকার অফিসের ম্যানেজার জামাল উদ্দিন কোনো ভাবেই উঠতে দিলেন না। তার বাসায় নিয়ে গেলেন। বাসাটা বেশ বড়, বিশাল বাংলো বাড়ির মত। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। তার বাসায় তার স্ত্রী দুই ছেলে সহ তার বোন থাকত তার দুই সন্তান নিয়ে। এত মানুষের ভীড়ে আমি উটকো ঝামেলা হতে চাইলাম না। কিন্তু জামাল আমাকে কিছুতেই ছাড়ল না। বর্ষাকাল যখন তখন বৃষ্টি হয়। আমি ওর বাসায় ওঠার পরদিন বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিলাম আফিসে যাবার পথে। সেই ভেজা নিয়েই অফিস করলাম। দুপুরের পর থেকেই দেখলাম গা গরম হতে শুরু করেছে। বাসায় ফিরলাম প্রচন্ড জ্বর নিয়ে। অসুখ বিসুখ আমার শরীরে সয় না খুব অল্পতেই একেবারে কাহিল হয়ে যাই সেটা তো তোমরা জানোই। জ্বরে একেবারে অচেতন হয়ে গেলাম। ওরা আমার বেশ যত্ন করল। আসলে অচেতন অবস্থায় কে যত্ন করেছে আমি তাও জানি না। যখন একটু হুসে থাকতাম তখন তোমার মায়ের সাথে কথা বলতাম। তোমার মা তো আমাকে জানে তাই আমি যে এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছি সেটা বলিনি শুনলে ভীষণ অস্থির হয়ে পড়বে। ৩দিন পর জ্বর কমতে শুরু করল। আমার শরীর ততদিনে একেবারে দুর্বল। জামালই আমাকে সব এগিয়ে দিত। ওর স্ত্রী ২/১ বার সামনে পড়লেও ছেলেরা কখনো কাছে ভীড়েনি তবে বোনের ছেলেটা আসত সব সময়। মাঝে মাঝে বোনটাও আসত। জামালের উপর খুব কৃতজ্ঞ হয়ে পড়েছিলাম ওই মুহুর্তে। মনে হয়েছিল সে জোর করে বাসায় এনে আমার কত বড় উপকার করল। হোটেলে থাকলে এই শরীর নিয়ে কী অবস্থা হত কে জানে! কিন্তু আমি যেদিন চলে আসব তার আগের দিন জামালের প্রতি এই মনোভাব জামাল সম্পূর্ণ রূপে বদলে দিল। আমি বিস্মিত হয়ে দেখলাম জামালের এই ভদ্র চেহারার পুরোটাই একটা মুখোশ! যার পেছনে কী ভয়ানক এক পিশাচ বাস করে!

তূর্য পিনপতন নিরবতায় অপেক্ষা করতে লাগল বাবা কী বলে সেটা শুনবার জন্য। মোতাহার উদ্দিন কিছুক্ষণ থেমে থেকে দম নিয়ে আবার শুরু করলেন… জামাল আমাকে সরাসরি বলল-

-স্যার কী আগামীকাল ঢাকায় ফিরে যাচ্ছেন?

-হ্যাঁ, কাজ তো তেমন কিছু দেখতে পারলাম না। তবে শরীরের সাথে আর পারছি না। তাই ঢাকায় গিয়ে আবার কিছুদিন পর ব্যাক করব।

-তাহলে যাবার আগেই কাজটা করে যান?

-কী কাজ?

-আমার বোনকে বিয়ে।

-মানে!!!

-মানে, আমার বিধবা বোনটা তো এতদিন এমনি এমনি আপনার সেবা করেনি। সেটা বুঝতে হবে না? আমার তখন রাগে ঘাম ছুটে গেল। বললাম কী সব বলছ জামাল?

জামাল কুটিল হাসি হেসে বলল- না বোঝার কিছু নেই স্যার। আমাদের এই বাড়িটার আশেপাশে খুব একটা মানুষ থাকে না। খুব অল্প যারা থাকে তারা গত কয়েকদিনে দেখেছে আমার বিধবা বোনটা আপনার কী সেবাটাই না করেছে। একটা মেয়ে নিশ্চই বিনা কারণে একটা পর পুরুষকে ফ্রি ফ্রি সেবা করবে না। সবাই বুঝে গেছে আপনার সাথে আমার বোনের কিছু একটা আছে। এই নির্জন বাগান বাড়িতে শহরের সামর্থ্যবান মানুষ তো এমনি এমনি থাকতে আসেনা। আপনিও যে কিছু একটার লোভেই এসেছেন সেটা বুঝতে কারো বাকি নেই। এই পর্যায়ে এসে জামালের কথায় আমার চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল। জামাল তখনও বলতে থাকল- স্যার আমার বোনটা অনেক সুন্দরী। অল্প বয়সে জামাইটা মারা গেল। ছোট ছোট দুইটা ছেলেমেয়ে আছে। তাদের একটা ভবিষ্যৎ আছে না? আমার মা বাবা কেউ বেঁচে নাই বোনের ভালো তো আমাকেই দেখতে হবে তাই না? স্যার কিছু বলতেছেন না যে?

আমি সারা জীবন নির্ভেজাল শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলাম। আমার সাথে এমন একটা শয়তানি আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। আমি বুঝতে পারছিলাম আমি এখন ঘোর বিপদে পড়তে যাচ্ছি যতটা সম্ভব শক্ত থাকতে হবে। ভেঙে পড়লেই পেয়ে বসবে জামাল। অনেক সাহস সঞ্চার করে বললাম-

-জামাল তুমি কী সব আবোলতাবোল বলছ বুঝতে পারছ?

-আমি সব বুঝেই বলছি স্যার।

-আমি পুলিশ ডাকব।

-পুলিশ ডেকে কোনো লাভ নাই স্যার। আমার দুই ছেলেকে তো দেখছেন? তারা পড়ালেখা কিছু করে না, করে ছাত্র রাজনীতি। সরকার তার পালতু ছেলেপেলেদের কতটা শেলটার দেয় সেটা তো আপনি জানেনই। সরকারের অতি তুচ্ছ কাজেও তারা হেলমেট পড়ে দেশিও অস্ত্র হাতে রাজপথে নেমে পড়ে। এই পুরা চট্টগ্রাম তাদের নামের প্রভাব প্রতিপত্তিতে কাঁপে। আমার শালাও সরকার দলের বড় নেতা। পুলিশ আমাদের হাতের মুঠোয় নাচে। আপনি তো এইখানে থাকেন না তাই কিছু জানেন না। আপনার “না” বলার যে কোনো অপশন নাই আশা করি সেটা বুঝতে পারছেন।

জামালের কথায় আমার পায়ের তলা থেকে পুরোদমে মাটি সরে গেল। বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করতে লাগলাম… পুরোপুরি বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। জামাল আমার অবস্থা টের পেয়ে বলল- স্যার কি ভয় পেলেন? ভয় পাবেন না। আমার বোন খুবই ভালো। তার ছেলে মেয়ে দুইটাও ভালো। আপনার সম্পর্কে সব জেনেও সে আপনাকে খুব পছন্দ করে ফেলেছে। বুঝতেই পারতেছেন সে কত ভালো? সে নিজেই আমাকে বলছে সে আপনাকে বিয়ে করতে চায়। আমার বোনটা আবার আমার কলিজার টুকরা। সে একটা কিছু চাবে আর আমি দিব না তা হইতে পারে না। স্যার কাজি কি এখনই ডাকব?

আমি কপালের ঘাম মুছে বললাম- তুমি যতই ভয় দেখাও কাজে আসবে না। আমি এসব কিছুই করব না। বলে পকেট থেকে ফোন বের করতেই সে ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে নেয়। তারপর সেটা বন্ধ করে দিয়ে বলল- স্যার আমি আপনাকে এখনও কোনো ভয় দেখাই নাই। দেখালে বলতাম, আমার শালাবাবু তার দলবল নিয়া আশেপাশেই অবস্থান করতেছে। আর আমার ছোট ছেলেটা গতকাল ঢাকায় চলে গেছে। সে আপনার ছেলের ডিটেইলস নিয়েই গেছে। ছেলেটা আবার আমার মত মায়ার শরীর নিয়ে জন্মায় নাই। ঢাকায় তার মতই দয়ামায়াহীন কয়েকজন বন্ধু আছে যারা চোখ বন্ধ করে মানুষের বুকে… বুঝতেই পারছেন মনেহয় আর বললাম না। আমি কিন্তু এগুলা কিছুই বলে আপনাকে ভয় দেখাইনি। আপনি ভয় পাবেন না। কাজি ডাকি স্যার?

আমি তখন জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম। জ্ঞান ফিরতেই দেখলাম আমি বিছানায় শুয়ে আর আমার পাশেই জামালের বোন বসে আছে। আমার চোখ মেলতেই সে বলল-

-আপনি এখন কেমন আছেন? এত ভয় দেখিয়ে দিয়েছেন না!

আমি লাফিয়ে উঠে বললাম- আপনি এখানে কী করছেন? বের হন এখান থেকে?

-ওমা! এইটা তো আমার ঘর আর আমার ঘর থেকে আমাকেই বের করে দিচ্ছেন?

-আমি তখন খেয়াল করলাম ঘরটা আমার পরিচিত নয়। আমি দ্রুত উঠে বের হতে গেলে সে বলল-

-দরজা খুলে বাঁচতে পারবেন ভেবেছেন? আপনি জানেন না দরজার ওপাশে কী আছে…

আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। সে বলল- বাইরে এলাকার লোকজন বসে আছে দরজা খোলা মাত্রই কী হবে আশা করি বুঝতে পারছেন?

-আপনারা কেন আমার সাথে এমন করছেন? আমি নির্ভেজাল মানুষ। আমার একটা পরিবার আছে, স্ত্রী সন্তান আছে। আপনি সব জেনেও কেন আমাকে এভাবে ফাঁদে ফেলছেন?

-কী করব বলুন… আপনাকে আমার খুব পছন্দ হয়ে গেছে। আর যা একবার আমার পছন্দ হয়ে যায় তা আমি চাই-ই চাই।

আমি বুঝে গেলাম আমার বাঁচার কোনো উপায় নেই!

তূর্য আতংকিত হয়ে শুকনো গলায় বলল- তারপর? আর এমন সময় কলিংবেল বাজল। মোতাহার উদ্দিন চমকে উঠলেন। তিনি আতংকিত গলায় বলল- ওই যে… ওরা…

-ওরা কারা???

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে