Dont forget me পর্ব-০৪

0
207

#Dont_forget_me (পর্ব – ৪)

শপিং করতে গিয়ে তূর্য যতটা সম্ভব আলোকে নাজেহাল করে ছাড়ল। আলো আন্টির সামনে ঠুসঠাস জবাবও দিতে পারছিল না আর তূর্য সেই সুযোগটা ইচ্ছেমতো নিচ্ছিল। আলো যে শাড়িটাই ভালো লেগেছে বলেছে তূর্য তার বিপরীতটা নিয়েছে। মানে, যেটা তার নিজের পছন্দ হয়েছে সেটা নিয়েছে। নিজের পছন্দে নেবে বলে আন্টি তাকে নিয়ে এসেছে অথচ সব নেওয়া হচ্ছে তূর্যর পছন্দে। হবু বউ বলে শ্বাশুড়ির সামনে সে জোর দিয়ে মানাও করতে পারছে না। তার রীতিমতো কান্না পাচ্ছিল, ইচ্ছে হচ্ছিল চলে যায়। একবার সে বলেছিলও যে, তার খুব মাথা ব্যথা করছে অন্যদিন আসুক আবার? কিন্তু তূর্য সাথে সাথে মাথা ব্যথার ওষুধ এনে দিয়ে বলল- খেয়ে নাও ব্যথা চলে যাবে। তারান্নুম হোসেন অবশ্য বলেছিলেন চলে যাবার জন্য কিন্তু তূর্য ফিরতে দিল না। আজ ফুল ডে শপিং করবে সে। আলো মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে রেখে প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে শপিং করল। শপিং এর মাঝখানে খেতে বসে অবশ্য সব আলোর পছন্দেই অর্ডার করল তূর্য। কিন্তু তবু তার মন ভালো হল না। বিয়ের শপিং কী আর বার বার হবে? যদিও তূর্যর টেস্ট ভালো তবু নিজের পছন্দে তো একটা শাড়িও হলো না!

শপিং শেষে বাড়ি ফিরে আলো রাতে আদিবাকে ফোন দিল। তূর্যর ব্যাপারটা সব ওকে বলল। আদিবা ওকে বলল-

-আরে গাধী তুই এখনো কিচ্ছু বুঝিসনি তূর্যকে। ও তোকে ভীষণ পছন্দ করে। সবার ভালোবাসা প্রকাশের ধরন এক নয়। তূর্য ভাইয়া একটু বেশি দুষ্টু প্রকৃতির তাই এমন করছে। ইচ্ছে করে দেখাচ্ছে যে, ও আসলে তোকে পাত্তা দিচ্ছে না কিন্তু মনে মনে ঠিকই তোকে চোখে হারাচ্ছে, ভালোবেসে মরমে মরছে। তবে তার ভালোবাসাটা যখন প্রকাশ করবে তখন তুই নিয়ে কুলাতে পারবি না দেখিস।

-তোমাকে বলেছে এসব। ভালোবাসলে কেউ এমন করে? অন্তত বিয়ের কেনাকাটা কেউ এভাবে করে?

-আরে তূর্য হয়ত তোকে তার পছন্দের সাজে দেখতে চেয়েছে তাই এমন করেছে। সে তোকে কতটা পছন্দ করে, খেয়াল করে সেটা তো তোকে দেওয়া গিফট থেকেই অনুমান করা যায়। আর তুই নিজে কিছুই বুঝতে পারছিস না!

-তুমি ঠিক বলছ তো?

-হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক বলছি তুই মিলিয়ে নিস।

এরপর আলো আর কিছু বলল না। এভাবে যে সে নিজে ভাবেনি তা নয় কিন্তু এই ছেলে এত পাজি যে ভাবনাটাও ঠিকঠাক ভাবা যায় না!

বাকি কেনাকাটার দিনে তূর্য আর যায়নি তাই আলো ইচ্ছেমতো কেনাকাটা করতে পেরেছে। কেনাকাটা, পার্লার, দাওয়াত সব কিছু গোছাতে গোছাতে বিয়ের দিন ঘনিয়েই এলো।

রাত পেরুলেই আলোর বিয়ে… আলো নিজের ঘরে বসে আছে আর ভাবনারা তাকে ভীড়ের ভেতরও ঘিরে রাখছে। একদিকে যেমন আনন্দ হচ্ছিল অন্যদিকে পারিবার ছাড়বার বিষণ্ণতা। সে উঠে মায়ের সাথে গল্প করবার জন্য গেল। ডাইনিং রুমের কাছে আসতেই দেখল বাবা খাচ্ছে আর মা পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আলোর খারাপ লাগল, টেবিলে আরও অনেক রিলেটিভ বসে খাচ্ছিল। বাবা তো এখন এই কাজটা না করলেও পারত? সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে বাবা এই কাজটা করে। তিনি যতক্ষণ খাবেন মাকে তার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে কী লাগবে না লাগবে সব তুলে দিতে হবে। বাবা হাত বাড়িয়ে কখনো পানির গ্লাসটাও তুলে নেয় না। সব সময় মায়ের উপর ডিপেন্ড করে। এই ডিপেন্ড করাটা কখনো ভালোবাসা থেকে আসে না। কী যে বাবার মনে জমা আছে মায়ের প্রতি… যার বঃহিপ্রকাশ কেবল মাকে অপমান করেই হয়। অথচ তারা নিজেরা ভালোবেসে একে অপরকে বিয়ে করেছিল! আলোর একটু কষ্ট হলো… তার বাবা কিন্তু চমৎকার একজন মানুষ। সবার খুব কেয়ার করে শুধু মায়ের বেলায় উল্টো! ছোটবেলা থেকেই দেখেছে মা প্রচন্ড অহংকারী। তিনি যথেষ্ট সুন্দর বলেই অহংকারটা সেখান থেকে আসে কিনা কে জানে! তার মা খুব শক্ত প্রকৃতির, কখনো কখনো প্রচন্ড স্বার্থপর। নিজের স্বার্থে সে যা খুশি করতে পারে। খুব সম্ভব এটাও একটা কারণ যার জন্য বাবা তাকে পছন্দ করে না। এসব কারণে মায়ের উপর তার নিজেরও রাগ হয়। বিবেকের চোখ তো বন্ধ নয় সে সবই দেখতে পায়। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরে চলে গেল। ওর ঘরে সব কাজিনরা বসে আছে তারা ওকে ঘিরে ধরল। আজ রাত কেউ ঘুমাবে না সবাই গল্প করে, গান গেয়ে, মাস্তি করে কাটিয়ে দিবে। আলোর ছোট চাচার মেয়ে ফারিয়া খুব ভালো চা বানাতে পারে তার কাজ হলো এক ঘন্টা পরপর সবাইকে চা খাওয়ানো। অলরেডি সে তিনবার চা বানিয়ে ফেলেছে তারপর বলেছে- “চতুর্থবার চায়ের চুলকানিতে চা চাইলে সে চেঁচিয়ে চাচা চাচিকে বলে চারজন করে চারতলা থেকে চৌরাস্তার চৌমাথায় চারচাকার নিচে চাপা দিয়ে চলে আসবে।” ওর কথায় সবাই হেসে চেঁচিয়ে বলেছে- “চ” এর এত বড় রচনা শোনাবার সুখে আমাদের আরেক কাপ চা চাইইইই… ফারিয়া “পারবনা” বলে চুপ করে বসে রইল। এমন সময় আলোর ফোনে তূর্যর ম্যাসেজ এলো-

-“ছাদে এসো”।

ম্যাসেজ পড়ে আলোর কপাল কুঁচকে গেল, বাড়ি ভর্তি মানুষের মধ্যে আলো এখন কী করে ছাদে যাবে? এখন রাত ১২টার বেশি বাজে এত রাতে কী চাই ওর? আলো লিখল- “এখন! কীভাবে আসব? পারব না।”

তূর্য রিপ্লাই দিল- “তোমার কাছে কোনো অপশন চাওয়া হয়নি। আসতে বলেছি আসবে। অযথা বাড়ি ভর্তি লোকের বাহানা দিও না।”

আলো একটু ভীত হলো এটা পড়ে। কারণ এই ছেলে ভয়ানক রকম আলোর মাইন্ড রিড করতে পারে। আর গতরাতে আলো তূর্যকে নিয়ে এমন একটা স্বপ্ন দেখেছে এখন ওর সামনে যেতেও ভয় হচ্ছে যদি বুঝে ফেলে? কিন্তু জাহাপনার হুকুম অমান্য করাও যাবে না, দেখা যাবে নিজেই চলে এসেছে তারপর দুম করে সবার সামনে এমন কিছু বলে বসবে যে আলোর মুখ লুকোবার জায়গা থাকবে না। সে মনে মনে তূর্যর উপর রাগ ঝাড়তে ঝাড়তে উপরে গেল। যেতে যেতে ম্যাসেজ লিখল-

“আসছি, ছাদে অন্য কেউ নেই তো?”

তূর্য রিপ্লাই দিল- “কেন, আমাকে একা পাওয়ার ইচ্ছে? অন্ধকারের সুযোগ নেবে বলে ভাবছ নাতো?”

-“কোনো কথা সহজ ভাবে বললে কী গলা ব্যথা হয় আপনার?”

-“ম্যাসেজ লিখার সাথে গলা ব্যথার সম্পর্ক কী করে আবিষ্কার করলে? তোমাকে তো নোবেল প্রাইজ দেওয়া উচিত!” সেই মুহূর্তে আলো ছাদে উপস্থিত হলো। এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে তূর্যকে কোথাও দেখতে পেল না। আলোর ভয় হলো, তূর্য ওকে মিথ্যে বলে ডেকে আনেনি তো? ও তো ম্যাসেজ পেয়েই ফট করে চলে এসেছে কিন্তু তূর্য তো বলেনি এক্ষুনি আসতে হবে। ছাদ ভর্তি গাছগাছালি এখানে কেউ লুকিয়ে থাকলে অন্ধকারে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এত রাতে তূর্য নিশ্চই এমন মজা করবে না? সে গলা বাড়িয়ে ডাকল-

-কোথায় আপনি? আমি এসেছি?

এমন সময় তূর্য ওর পেছনে এসে বলল- এত চেঁচাচ্ছ কেন?

হুট করে এভাবে পেছন থেকে বলায় আলো তীব্রভাবে ভয় পেয়ে গেল।

-এত জোরে ভয় পায় কেউ?

-এমন করলে ভয় পাবো না?

-কাছে আসো ভয় দূর করে দেই?

-কাছে আসব না।

-তুমি না এলেও আমি কিন্তু যেতে পারি। তূর্য তখন আলোর কাছে এসে ওর কপালে টুকুস করে ছোট্ট একটা চুমু খেল। আলোর হার্টবিট এত বেড়ে গেল যে এক হাত দূর থেকেও তূর্য শুনতে পাচ্ছিল! সে একটু সরে গিয়ে বলল-

-একি, তোমার ভয় তো মনে হচ্ছে বেড়ে গেল! এই কলিজা নিয়ে আবার রোমান্টিক প্রেমিক চাও?

-আপনি ডেকেছেন কেন সেটা বলুন?

-এত তাড়া কেন? ডেকেছি যখন বলব তো।

-আমার অতো সময় নেই। সবাই হয়ত খুঁজতে শুরু করবে একটু পর। আমি কাউকে বলে আসিনি।

-আমি তোমাকে ধরে রেখেছি নাকি? যেতে চাইলে যাও?

-কী জন্য ডেকেছেন সেটা শুনব না?

-তাহলে আমি যখন চাইব তুমি তখন যাবে তার আগে কোনো কথা বলবে না।

-এভাবে অধিকার খাটালে সেখানে কিছু বলার জায়গা থাকে না, আলো চুপ রইল। তবে অন্ধকারেও ওর ভেতর প্রচন্ড অস্থিরতা টের পেল তূর্য।

-তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছ নাতো? ভয় পেলে এক মুহূর্তও দাঁড়াতে হবে না, চলে যাও।

-কী আশ্চর্য আপনাকে ভয় পাওয়ার প্রশ্ন আসছে কেন?

-তাহলে তোমাকে এমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে কেন?

-আলো ইতস্তত করতে লাগল… কই? ঠিক আছি আমি।

চাঁদের আবছা আলোয় তূর্য ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তূর্যর এমন দৃষ্টির সামনে আলোর অস্বস্তি বাড়তে লাগল। তূর্য বলল- কী হয়েছে বলো তো তোমার?

-কিছু না তো…

তূর্য আরও কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল- আর কয়েক ঘন্টা পর আমার সাথে তোমার বিয়ে হচ্ছে আর তুমি এই মুহূর্তে এমন ভাব করছ… আচ্ছা, আমাকে নিয়ে রোমান্টিক স্বপ্ন টপ্ন দেখছ নাতো?

আলোর এবার ঘাম ছুটে গেল। সে গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল- আমি কখনো ভূত-প্রেত স্বপ্নে দেখি না।

তূর্য হা হা করে হেসে বলল- তার মানে আমি ঠিক ধরেছি। আমায় নিয়ে উল্টো পাল্টা কী কী ভাবো সারাদিন তুমি?

আলো কিছু বলার আগেই ওর ফোন বেজে উঠল। আদিবা ফোন করেছে। আলো তূর্যর দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকাল… তূর্য তখন উল্টো দিকে ঘুরে এগিয়ে গিয়ে বলল- কী সুন্দর চাঁদের আলো… আমার ইচ্ছে হচ্ছে তুমি আমার সাথে দীর্ঘ সময় ধরে থাকো আজ। তারপর ঘুরে আলোর দিকে তাকাল। আলো তখন ফোন বন্ধ করে তূর্যর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তূর্য মনে মনে খুব খুশি হলো, বলল-

-ধন্যবাদ। তোমাকে একটা জিনিস দেবার জন্য ডেকেছি। তুমি তো থাকতে পারছ না তাই টেবিলের উপর রাখা বক্সটা নিয়ে চলে যেতে পারো।

আলো সামনে তাকিয়ে দেখল টেবিলের উপর বড়সড় একটা বক্স। জিজ্ঞেস করল কী আছে ওটায়?

-ঘরে গিয়ে খুলে দেখতে মানা করিনি।

-উফ, ঠিক আছে। ইয়ে… একটা কথা…

-কী?

-আমার এখন যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

-কেন, এখন আর ভয় করছে না আমাকে?

আলো রাগ দেখিয়ে বলল- ধুর, চললাম আমি। তূর্য সাথে সাথেই ওর হাত ধরে ফেলে বলল- আর দুদিন পরই পূর্ণিমা, সেদিন জ্যোৎস্নার আলোয় আজকের সময়টা পুষিয়ে দেবে তো?

আলো মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিয়ে বলল- হুম দিব। তূর্য তখন হাত ছেড়ে দিল। আলো বক্সটা নিয়ে দ্রুত নিচে চলে যায়। সে বাসায় ঢুকতেই মায়ের সামনে পড়ল। সাবীরা খাতুন চোখ কুঁচকে বলল-

-কোথায় গিয়েছিলি? আর হাতে কী এটা?

-কোথাও না, এখানেই… তূর্য দিয়ে গেল এটা।

-“রাত-বিরেতে ঢং” বলে সাবীরা তার ঘরে চলে যায়। আলো তখন সোজা নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল কিন্তু তার ঘর ভর্তি কাজিন দিয়ে। তূর্য কী দিয়েছে সে জানে না, এখন উপায়?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে