#Dont_forget_me (পর্ব – ৩)
অনেক রাত হয়ে গেছে অথচ আলোর ঘুম আসছিল না। তূর্যর ভাবনা তাকে দিশেহারা করে দিচ্ছে। ছেলেটাকে তার কী পছন্দটাই না ছিল… হ্যাঙলা পাতলা গড়নের লম্বা চওড়া, চশমা পড়া, শান্ত স্বভাবের ছেলে। সিল্কি সিল্কি বড় বড় চুলগুলো কপালের উপর ঝুলে থাকে, দেখলেই এলোমেলো করে দিতে ইচ্ছে করে। এত কিউট একটা ছেলে অথচ কথাবার্তায় কেমন মারমুখী। দাঁত ভেঙে দিতে ইচ্ছে করে। আর তখনই মনে পড়ল তূর্যর ম্যাসেজটা সে এখনো সীন করেনি! ফোন হাতে নিয়ে ম্যাসেজ ওপেন করতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। ঐ মারমুখী ছেলেটা লিখেছে এসব! মাই গড… হাউ রোমান্টিক! এ তো দেখছি পুরাই উপন্যাসের নায়কের মত রোমান্টিক আর কাজকারবার সব তামিল মুভির ভিলেনের মত। তার মাথায় গুনগুন করে গান বেজে উঠল- “হিরো তু মেরা হিরো হ্যায় ভিলেন য্যায়সা কাম না কার, সাপ্নো কি ইস রানীকো এ্যাসে তো বাদনাম না কার…” আচ্ছা সে কী তূর্যর ম্যাসেজের রিপ্লাই দিবে? কী লিখবে? ধুর তার চেয়ে ম্যাসেজ আনড়িড করে রাখুক। ব্যাটা বহুত জ্বালিয়েছে একটু তো তারও জ্বলা উচিত।
আলো আর তূর্যর বিয়ের ডেট ফাইনাল হয়ে গেছে। প্রায় মাসখানেক পর তাদের বিয়ে। আলোর পরিবার চেয়েছিল আরও একমাস পর বিয়েটা দিতে যাতে তারা ততদিনে তাদের বাড়ির কাজটা দ্রুত শেষ করে ফেলতে পারে। নতুন বাড়িতে উঠেই বিয়ে হবে কিন্তু তূর্যর পরিবার চাইল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা হয়ে যাক তাই সেই অনুযায়ী ডেট ফিক্সড হয়েছে। খুব জোরেশোরে আয়োজন চলছে দুই পরিবারে। বিয়ের শপিং এর জন্য তূর্যর মা তারান্নুম হোসেন আলোকে বলে রেখেছেন সাথে যেতে। তিনি যাবার আগে তূর্যকে একবার জিজ্ঞেস করলেন যাবে কিনা? আলোর সাথে কিছুক্ষণ থাকাও হবে আবার পছন্দ অপছন্দ গুলোও জেনে কেনাকাটা করা যাবে।
তূর্য অবাক হয়ে বলল- আমি গিয়ে কী করব? মেয়েদের শপিং এর কী বুঝব আমি?
-এখানে বোঝাবুঝির কী আছে? গেলে কিছুক্ষণ একসাথে থাকা হবে আবার পছন্দ অপছন্দ গুলোও জানা যাবে এইজন্য যাবি।
-মা অযথা আমাকে টেনো না তো। তোমাদের কেনাকাটা তোমরাই করো।
-সে তো আমরা করবই কিন্তু তোর অভ্যাস করতে হবে না?
-ওসব অভ্যেস সময়েরটা সময়ে দেখা যাবে। এখন পারব না,তোমরা যাও। বলে তূর্য নিজের ঘরে চলে যায়। গিয়েই আলোকে ফোন দিয়ে বলে- শ্বাশুড়িকে লুটপাট করতে নাকি তার সাথে শপিং এ যাচ্ছ?
-হ্যাঁ যাচ্ছি, দেখি তিনি কতটা লুটপাট হন? আপনার কিছু লাগবে? লাগলেও আনতে পারব না।
-পারবে না সেটা জানি। বলে বোঝানোর দরকার নেই। তবে আমি সেজন্য ফোন দেইনি।
-কী জন্য ফোন দিয়েছেন? ঝগড়া করতে?
-ভালো প্রেমিকা হলে জিজ্ঞেস করতে “গল্প করতে?”
-ভালো প্রেমিকা পেতে হলে ভালো প্রেমিক হতে হয়।
-ভালো প্রেমিক কিনা প্রমাণ দিব?
-হ্যাঁ, দিন।
-ঠিক আছে। তবে তার আগে তোমাকে একটা শর্ত পূরণ করতে হবে।
আলো সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করল- কী শর্ত?
-শপিং এ যাবার আগে মাকে ফোন দিয়ে বলবে, আমাকে ছাড়া শপিং এ যাবে না তুমি।
আলো আধশোয়া থেকে উঠে সোজা হয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল- কী! আমি কেন এটা বলতে যাব?
-আমার শর্ত, তাই বলবে।
-অসম্ভব। আন্টিকে এসব কী করে বলব আমি? তিনি আমাকে বেহায়া ভাববে না?
-আন্টি তোমাকে কী ভাববে বা তুমি কী করে আন্টিকে বলবে that’s none of my business. মনে রেখো তোমার হাতে সময় খুব অল্প আর আমাকে ছাড়া তোমার বিয়ের শপিং করা চলবে না।
আলো কিছু বলতে যাবে তার আগেই তূর্য “best of luck” বলে ফোন কেটে দেয়।
আলো মহা বিপদে পড়ে গেল। তূর্য এমন একটা শর্ত দিয়ে বসবে কে জানত? ব্যাটা হাড়ে হাড়ে বজ্জাত একটা। তার শপিং এ যাবার ইচ্ছে তো আন্টিকে বললেই পারে? আমাকে এভাবে চেপে ধরার মানে কী? সে তূর্যকে আবার ফোন দিল। তূর্য ফোন ধরেই বলল-
-এত তাড়াতাড়ি পারমিশন নিয়ে ফেলেছ? ভেরি স্মার্ট!
-আমি কাউকে কিছু বলিনি। আপনাকে বলতে ফোন দিয়েছি।
-কী বলবে? আমার সাথে কথা বলার সারাক্ষণ এত বাহানা খোঁজ কেন?
-বাহানা করেছি বেশ করেছি। আরও করব কোনো সমস্যা?
-মিষ্টি করে কথা বললে সমস্যা হবার কথা না। কিন্তু এভাবে বললে তো অবশ্যই সমস্যা।
-শুনুন, আমি আপনার শর্ত মানতে বাধ্য নই।
-অবশ্যই বাধ্য। শর্ত জানতে চেয়েছ মানেই ওটা তুমি agree করে নিয়েছ। তাই যে মুহুর্তে জানতে চেয়েছ সে মুহুর্ত থেকে মানতে বাধ্য হয়ে গেছ। তাছাড়া ভেবে দেখো একবার, পার্মানেন্ট ক্ষ্যাপাটে স্বামী চাই নাকি পার্মানেন্ট রোমান্টিক প্রেমিক চাই? ডিসিশন তোমার হাতে। বাই। বলেই তূর্য ফোন কেটে দিল।
আলো পুরোপুরি হতাশ হয়ে গেল… তার একবার মনেহল আদিবা আপুকে দিয়ে আন্টিকে বলাবে কিনা? পরমুহূর্তেই সেটা বাতিল করে দিল। কারণ শর্ত তো তাকেই পূরণ করতে হবে! কীভাবে বলবে… এমন সময় তূর্যর মায়ের ফোন এলো। ফোনের স্ক্রিনে আন্টি নাম দেখেই ওর মাথায় একটা আইডিয়া এলো। সে ফোন পিক করলে তারান্নুম হোসেন বললেন-
-তুমি রেডি হয়েছ? তাহলে এখনি বের হতাম।
-জ্বি আন্টি আমি রেডি একটা কথা…
-হ্যাঁ বলো?
-তূর্য ভাইয়া কী যাবে আমাদের সাথে?
তারান্নুম হোসেন হেসে বললেন- ধুর মেয়ে, তূর্য এখনো তোমার ভাইয়া আছে নাকি? শুধু তূর্য বলবে। ওকে বলেছিলাম কিন্তু কিছুতেই রাজি হল না। যাবে না বলল।
আলো ভীষণ অবাক হলো তারপর মনে মনে একশ একটা বকা দিল তূর্যকে এক মুহুর্তে। ব্যাটা আন্টিকে বলেছে যাবে না আর তাকে শর্তটা দিল কী? তাকে হয়রানি করে খুব আনন্দ পায় বোঝাই যাচ্ছে। এর প্রতিশোধ যদি না নিয়েছে… আলো খুব ধীরে বলল- আন্টি, আপনার ছেলেকে সাথে নিলে ভালো হত। মা বলছিল সুযোগ পেলে ওনার কেনাকাটাও আজ করে ফেলতে।
-তূর্য তো যেতেই চাইছে না আর একদিনে তো এত কেনাকাটা করা যাবে না।
-আমরা যেহেতু যাচ্ছিই যতটা পারা যায় আর কি… মা বলছিল…
-আচ্ছা আমি বলে দেখি ওকে কিন্তু রাজি হবে বলে মনেহয় না। তারান্নুম হোসেন তূর্যর ঘরে গিয়ে দেখলেন তূর্য ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। সে ওর বিছানায় বসে বলল- যা তৈরি হয়ে নে।
তূর্য মুচকি হেসে টুপ করে হাসিটা গিলে ফেলে অবাক গলায় বলল- তৈরি হব কেন?
-আলো বলল তোকেও সাথে নিতে।
-কেন? ও কী চাইছে আমি ওর ব্যাগ টানব?
-এ আবার কী ধরনের কথা? আমরা যাচ্ছিই যখন তুইও চল সুযোগ হলে তোর কেনাকাটাও করা হবে।
-কী? সুযোগ হলে!!! তারমানে আমার সাথে সুযোগের সদ্ব্যবহার করা হবে?
-উফ ও তাই বলেছে নাকি? সরাসরি তো বলতে পারছে না তুই গেলে ওর ভালো লাগবে তাই একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলেছে। এটুকু না বোঝার কী আছে?
-আলোর কী ভালো লাগবে সেটা ভাবছ আর আমার ভালো লাগার কথা ভাবছ না, বাহ্!
-আশ্চর্য, তুই এমন করছিস কেন? কী কথা টেনে টেনে কোথায় নিচ্ছিস!
-আচ্ছা sorry চলো যাই… তোমাদের কামলা খাটতে।
তারান্নুম হোসেন ওর বাহুতে ছোট্ট করে একটা চড় দিয়ে বলল- পাজি ছেলে।
আলো চেয়েছিল শপিং এ ওর মা সাবীরা খাতুনও যাক কিন্তু ওর বাবা যেতে দেননি। বাবা মায়ের প্রতি বরাবরই এরকম ভয়ানক রকম কড়া। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাবা অতিরিক্ত করেন। অথচ বাবা অন্য কারো সাথে কখনোই এমন নয়। শুধু মায়ের সাথে কী যে আছে তার যার কারণে বাবা মায়ের সাথে এমন জালিমের মত আচরণ করে কে জানে! আলো বহুবার জানতে চেয়েছে কিন্তু বাবা বলেননি। শুধু বলেছে- বড় হলে নিজেই সব বুঝবে। আলোর ধারণা মা অতিরিক্ত অহংকারী আর অপ্রয়োজনে মিথ্যা বলে দেখেই বাবা এমন করে। এখন এছাড়া আর কিছু আছে কিনা কে জানে! আলোর নিজেরও মায়ের এইদিক গুলো জঘন্য লাগে কিন্তু এত বছরেও বাবা তাকে শোধরাতে পারেনি। আলোর বিয়ে হয়ে দুদিন পর শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছে… মা যেমনই হোক তার সাথে বাবার এই কঠিন আচরণ যদি ওর শ্বশুরবাড়ির কেউ দেখে ফেলে কেমন হবে? আলো আর দেরি না করে বের হয়ে গেল।
ওরা নিচে গিয়ে গাড়িতে বসতে বসতে আলো চলে এলো। তূর্যর দিকে একবার তাকিয়ে ভেংচি কেটে গাড়িতে বসে আন্টির সাথে গল্প করতে লাগল। তূর্য সামনে বসেছে আর ওরা দুজন পেছনে। ব্যাক মিররে তূর্য আলোর দিকে তাকিয়ে ছিল, ওর সাথে চোখাচোখি হতেই তূর্য eye blink করল। আলো সাথে সাথে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আর সেটা দেখে তূর্য হাসতে লাগল। এক ফাঁকে আলো তূর্যকে ম্যাসেজ পাঠালো- “Now it’s your turn.”
সেটা দেখে তূর্য মুচকি হেসে পেছনে তাকিয়ে মাকে বলল- মা আমি পেছনে আসব?
-পেছনে আসবে কেন?
-আলো ওখানে বসে ম্যাসেজ পাঠাচ্ছে ভাবলাম গল্প করতে চাইছে…
আলো এতটা মোটেও আশা করেনি। ছেলেটা এত ক্রিঞ্জ কেন? সে মুখে মাস্ক টেনে দিয়ে উইন্ডোর দিকে তাকিয়ে কাশতে লাগল। তূর্য তখন মুচকি হেসে পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল- পানি লাগবে?
আলো কঠিন একটা লুক দিয়ে নিজের হ্যান্ড ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে পানি খেয়ে উইন্ডোতে চোখ রাখল। এরচেয়েও ভয়ংকর কথা ওদের কান্ড দেখে তারান্নুম হোসেন মুখ টিপে হাসতে লাগল। তারপর আলোকে বলল-
-আলো, আমি কী সামনে চলে যাব?
আলো সাথে সাথে কিচ্ছু না বলে ওড়না দিয়ে নববধূর মতো পুরো মুখ ঢেকে ফেলল। তারান্নুম হোসেন তখন শব্দ করে হেসে ফেললেন।