আনন্দ অশ্রু

0
2511

 আনন্দ অশ্রু

লেখা- অনামিকা ইসলাম।

০৫.০৭.২০০৬
আরেকটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে শুনলাম। প্রথমটা যৌতুক এত বেশি চেয়েছিল যে, হলো না। ছেলেটা দেখতে ছিল সালমান শাহ্’র মতো। আমি আরেকটু সুশ্রী হলে হয়তো ওরা এ দিকটাতে একটু ছাড় দিত।
জন্মান্তরে বিশ্বাসী না আমি, তথাপি কেন যেন মনে হচ্ছে গত জন্মে বোধ হয় বড়লোক বাবার অহংকারী, সুন্দরী মেয়ে ছিলাম। মানুষকে মানুষ বলে গণ্যই করতাম না। যার শাস্তি সরূপ এ জন্মে হয়েছি গরীবের কালো মেয়ে। একে তো কালো, তারউপর ভিষণ রকম কুশ্রী। আবার নাম রেখেছে মায়া।
ধূর! আর লিখব না। ভালো লাগছে না। কাল আবার শিমু আপুর বিয়ে। সকাল সকাল উঠতে হবে।

০৭.০৭.২০০৬
শিমু আপু চলে গেল। কাল রাতে ও বাড়িতেই ছিলাম। অনেক মজা হলো বিয়েতে। ছেলে বাড়ির লোকেরা তো রাজিই ছিল না এ বিয়েতে। ছেলে আবার শিমু আপুকে না পেলে আত্মহত্যা করবে, তাই বাধ্য হয়েই ওদেরকে রাজি হতে হলো।
কত বড়লোক ওরা!
কোনো যৌতুক দিতে হয়নি। অবশ্য প্রেমের বিয়েতে ওসব লাগেও না।
সবার কপাল কি আর ওরকম হয়? বাবা নেই, মা শয্যাশায়ী। মামার সংসারে কড়াকড়ির মধ্যে মানুষ। যেখানে পান থেকে চুন খসলে রটে যায়, সেখানে ওসব ভাবাও যায় না।
কিন্তু বয়সের দোষ বলে একটা কথা আছে। খালাতো ভাই চোখের ভাষায়, ঠাট্টার ছলে অনেক বার আমায় বুঝানোর চেষ্টা করত, সে আমায় ভালোবাসে। আমি সায় না দিলেও হৃদয়টা তাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখত।
টনক নড়ে সেদিন, যেদিন সে খালার পছন্দের ফর্সা মেয়েকে নিয়ে ঘরে এলো। আর আনবেই বা কেন? আমি তো আর সেই কপাল নিয়ে জন্মাইনি যে আমার জন্য কেউ শিমু আপুর বর যা করল তাই করবে!
যাক নিয়তিকে মেনে নিতেই হবে। কাল নাকি পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।

০৮.০৭.২০০৬
আমার বিয়ে মোটামুটি ঠিক। সকালে দেখতে এসেছিল। কথাবার্তা সবই মিলেছে। মামা ছেলের প্রশংসায় যতই পঞ্চমুখ হোক না কেন, আমার জন্য যে কোনো রাজপুত্র আসবে না, সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম। তবে সকাল থেকে কেমন যেন মনের মধ্যে অন্য রকম এক অনুভূতি কাজ করছিল।
ইস! মশা খুব বিরক্ত করছে। আজ আর লিখতে পারছি না।

১৩.০৭.২০০৬
অনেকদিন পর ডায়েরীটা হাতে নিলাম। আমার বিয়ের কাজ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছিল। বাড়িতে অনেক লোক। নিকটাত্মীয়রা মোটামুটি সবাই চলে এসেছে। নিরিবিলি জায়গার অভাবে ডায়েরী লেখা হচ্ছিল না। আমিই যে পাত্রী!
খালাতো বোন লিমা এসেছিল বরকে নিয়ে। গয়নায় গা-ভর্তি ছিল ওর। দুলাভাই ওর সব আবদার পূরণ করত।
করবেই বা না কেন? প্রেমের বিয়েতে এমনই হয়। আর আমারটা তো একটা চুক্তি মাত্র। ঐ ছেলে কি আমার সুখ দুঃখের কথা ভাববে? লিমাকে দেখার পর নতুন করে নিজেকে অসুখী মনে হচ্ছিল।
১৬তারিখে আমার বিয়ে। পাত্র বাঁধন মাহমুদ। সেনাবাহিনীতে চাকরী করত। ছেলের মা- বাবা ছিল না। চাচার কাছে মানুষ। সেই চাচা অসুস্থ থাকায় বিয়েতে এত তাড়াহুড়া। তিনি ভাতিজার বউ দেখে মরতে চান।
ভাবি ডাকছে। কাল- পরশুর মধ্যেই সব আত্মীয় স্বজন এসে যাবে। আর বোধ হয় লেখা হবে না।

১৮.০৭.২০০৬
না, আমি শ্বশুর বাড়িতে না, এ বাড়িতেই। এমন অবস্থায় লিখতে পারার কথা নয়। কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল, কাউকে কিচ্ছু বলতে পাচ্ছিলাম না।
তবুও লিখছি। লিখে যদি কষ্টটা একটু হালকা হয়।
একটু দেরীতে পাত্রপক্ষ আসল, তাও মাত্র হাতে গুনা ১৫জন। চিরাচরিত নিয়মে আয়নার দৃষ্টি বিনিময়ের সময় তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে আছে। যেন কেউ তাকে জোর করে বন্দুক ধরে বিয়ে করাতে নিয়ে এসেছে। বিয়ের কার্যক্রম শেষ হতেই মামাকে বলল, তার অতি দরকারি কাজ আছে, যেতে হবে। না গেলে চাকরী থাকবে না।
সবার সব কথা না শুনেই চলে গেল। যাওয়ার বেলায় আমার দিকে তাকিয়ে শুধু বলল, আসি।
মামাকে বলল, আমাকে খুব তাড়াতাড়ি একদিন এসে নিয়ে যাবে।
জীবন খুব প্রেমময় হবে না, সেটা জানতাম। তাই বলে এতটা অবহেলা? আর লিখতে পারছি না। মাথাটা ঘুরছে।

১৯.০৭.২০০৬
চোখের পানি সামলাতে পারছিলাম না আমি। এও কি সম্ভব? সকালে দুটি চিঠি এলো। একটা আমার, আরেকটা মামার নামে। প্রেরক বাঁধন। চিঠিটা নিয়ে আমার ঘরে রেখে দিলাম। পড়তে ইচ্ছে করছিল না।
একটু পর দেখলাম, মামা তৈরি হচ্ছে আমার শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার জন্য। মামি আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল, বড় ভালো কপাল নিয়ে জন্মেছিস।
আমি কিছু বুঝলাম না। ঘরে এসে চিঠিটা খুললাম।

মায়া,
জানি তোমার মন ভালো নেই। সে দায় আমার। কিন্তু কি করব বলো? বরযাত্রী নিয়ে রওনা হব, এমন সময় বাড়িওয়ালার বাসায় টেলিফোনে খবর এলো চাচা মারা গেছেন। তুমি তো জানো, আমি এতিম। চাচার কাছেই মানুষ। ওনার বড় সাধ ছিল আমার বউ দেখার। সে কথা ভাবতেই তোমার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। তখন যদি আমি না যেতাম তবে তুমি হতে অপয়া। আর আমাদের মা- চাচীরা এখনো সব দায় মেয়েদের কাধেই দেন। আমার জন্য তোমার এই কখনোই মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই আত্মীয়দের মৃত্যু সংবাদ না দিয়ে বেশি সংকটাপন্ন অবস্থার কথা বলে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। পরে আমি কয়েকজন পড়শি আর বন্ধুদের নিয়ে তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম।
সেখানে হয়তো মামাকে সত্যটা বলতে পারতাম। কিন্তু কথাটা একবার আত্মীয় মহলে ফাস হলে তোমায় অলক্ষ্মী অপবাদ দিতে কেউ থামত না। এর চেয়েও বড় কথা, চাচা নেই- এ কথা একবার মুখ দিয়ে বের করলে আমি আর স্থির থাকতে পারতাম না।
আমি বোধ হয় এলোমেলো কি সব লিখছি। আসলে সব দায়িত্ব আমার কাধে, তাই তাড়াহুড়া করে শেষ করতে হচ্ছে। আর হ্যা, আমি আমার লক্ষ্মী বউটাকে খুব তাড়াতাড়ি নিতে আসব। ভালো থেকো।
তোমার বাঁধন।

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে