মাস্টারমশাই পর্ব-০১

0
2

#মাস্টারমশাই (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

ছাত্রীর প্রেম প্রস্তাবে রাজি না হওয়া আজ চোর অপবাদ পেতে হলো। তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার দু’দিন পরই তার বাবা আমাকে বাসায় ডেকে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,“তুমি ভুল করে পদ্মর সোনার চেইনটি নিয়েছো?”

এই কথাটি শুনে আমি লজ্জায় মাথানত করে ফেললাম৷ আমি যখন বললাম,“না। আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে চাচা।”
সেই মূহুর্তে পদ্ম খুব জোর গলায় বললো,“আমি নিজ চোখে আপনাকে সোনার চেইনটি পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকাতে দেখেছি।”
পদ্মর মুখে এই কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেল। পদ্মর বাবা তার মেয়ের কথা বিশ্বাস করে খুব সুন্দরভাবে বলে,“তুমি চেইনটি ফেরত দিয়ে যেও। তুমি গত দু’দিন ধরে আসছিলি না। হয়তো চেইনটি নেওয়ার অপরাধবোধেই। অথবা ভয়ে। যাই হোক আর তোমাকে পদ্মকে পড়াতে আসতে হবে না।”
এটা বলে সেদিনের মতো তিনি আমাকে বিদায় করলেন। আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, তিনি যেমনটা ভাবছে তেমন নয়। অতঃপর সেই চেইনের সম-পরিমান মূল্যে আমাকে টাকা ফেরত দিতে হয়েছে। যদিও সব সমস্যা সেখানেই শেষ হয়েছে। তবে আমার স্মৃতি থেকে বিষয়টি যাচ্ছে না। এত বছরে প্রথম এত অপমানিত হলাম। আমি এই অপমান সহ্য করতে পারছি না।

কথাগুলো বলে মাস্টারমশাই শিউলির দিকে তাকায়৷ শিউলি এতক্ষণ তার কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। মাস্টারমশাই এবার বলেন,“আমার পক্ষে এই গ্রামে থাকা সম্ভব নয়। তাই আমাকে যেতেই হবে শিউলি ফুল।”

“মাস্টারমশাই।”
শিউলি কাঁপা গলায় কথাটি বলে। মাস্টারমশাই ম্লান হেসে নরম গলায় বলে,“এমনি চলে যেতাম আমি। আমার মা অসুস্থ। তাই এখান থেকে বদলী নিয়ে নিজ গ্রামের স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে বরাবরই ছিলো। সেই কথা ভেবেই আবেদন করেছিলাম৷ তবে হ্যাঁ তোমার কথা ভেবে হয়তো কয়েকটা দিন এখানে বেশি থাকতাম। কিন্তু এখন আর পারবো না। আমার পক্ষে এখানে আর থাকা সম্ভব নয়। স্যরি শিউলি ফুল।”

“আপনি কখন যাবেন মাস্টারমশাই?”
শিউলি কাঁদো কাঁদো গলায় কথাটি বলে। মাস্টারমশাই কিশোরী শিউলির আবেগের কথা বুঝতে পারে। তবে তার কিছু করার নেই। তিনি বলেন,“বিকালে রওয়ানা দিবো।”
এটা বলে মাস্টারমশাই তার পকেট থেকে একটি কাগজের টুকরো বের করেন। সেটা শিউলির হাতে দিয়ে বলে,“এখানে আমার নাম্বারটা দিয়ে দিলাম। তোমার আমার কথা মনে পড়লে বাবার ফোন দিয়ে যোগাযোগ করো।”

শিউলি কাগজটি নেয়। তার মন মানছে না। তবুও মাস্টারমশাইকে তার বিদায় জানাতে হবে। সেজন্য নিজেকে সামলে বলে,“মাস্টারমশাই আমাদের আবার দেখা হবে তো?”

“হবে।”
মাস্টারমশাই আশ্বাস দেয়। শিউলি ভরসা পায়। সে আরও অনেক কথা বলতে চায়। কিন্তু পারে না। তবুও বহুকষ্টে বলে,“আপনি না এলে আমার কখনো জানা হতো না আমি কত সুন্দর মাস্টারমশাই। আপনার সঙ্গে এই দূরত্ব আমাকে খুব পোড়াবে। আপনাকেও কি আমার মতো পোড়াবে মাস্টারমশাই?”

“শিউলি ফুল।”
মাস্টারমাশাই শান্ত এবং কোমল গলায় কথাটি বলে। শিউলির মুখে হাসি ফুটে উঠে। মাস্টারমশাইয়ের এই ডাকটি তার খুব প্রিয়।হৃদয়ে অন্যরকম এক অনুভূতির জন্ম দেয়। মাস্টারমশাই শিউলির হাতে হাত রেখে বলে,“তুমি সত্যি খুব সুন্দর। তোমাকে যারা অসুন্দর বলে তাদের মনটা অপরিষ্কার। তাই বলে। তুমি এই বিষয়টি নিয়ে কখনো মন খারাপ করবে না। যখন মন খারাপ হবে তখন অবশ্যই মনে করবে কেউ একজন আছে যার চোখে তুমি খুবই সুন্দর। তুমি অপরূপা শিউলি ফুল।”

শিউলি খুশি হয়। মাস্টারমশাইয়ের এই সুন্দর দৃষ্টির প্রেমেই তো সে পড়েছে। এই মানুষটি না এলে জানা হতো না শিউলির মতো কুৎসিত মানুষটিও সুন্দর হতে পারে। এই মানুষটিকে চোর অপবাদ দিলো পদ্ম। শুধুমাত্র তাকে মাস্টারমশাইয়ের পছন্দ নয় বলে। পদ্মর অবশ্য রাগ করার কারণ রয়েছে। তার মতো সুন্দরী আশেপাশে দশ গ্রামে খুব কম রয়েছে। দুধে আলতা গায়ের রঙ। সেই মেয়েটিকে মাস্টারমশাইয়ের পছন্দ নয়। তার পছন্দ শিউলির মতো কুৎসিত মেয়ে। শিউলি যার গায়ের রঙটা বড্ড চাপা, মুখভর্তি গোটা গোটা দাগ। মুখে না রয়েছে মায়া, না রয়েছে শ্রী। এজন্য অবশ্য তাকে কম কথা শুনতে হয়নি। সেই মানুষটিকে মাস্টারমশাইয়ের পছন্দ। পদ্মর মতো সুন্দরী মেয়েকে তাই সে ফিরিয়ে দিয়েছে। এটা মেনে নেওয়া পদ্মর জন্য কষ্টকর। তবে শিউলির জন্য আনন্দের। সারাজীবন যে রূপ নিয়ে মানুষের কটু কথা সহ্য করতে হয়েছে। সেই রূপ কারো প্রিয়। এটা আনন্দেরই।

তবে পদ্মর কাজটি শিউলির পছন্দ হয় না। তার পদ্মর উপর খুব রাগ হয়। এত ভালো মানুষটিকে চোর বানালো। যেটা নিতে না পেরে সে চলে যাচ্ছে। শিউলির থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। এই দূরত্ব শিউলি সইবে কিভাবে? ইচ্ছে করছে পদ্মকে কিছু একটা করে দিতে। শিউলির এসব ভাবনার মাঝে মাস্টারমশাই বলে,“বাসায় যাও শিউলি ফুল।”

শিউলি মাথা নাড়ায়। সে এক বুক আশা নিয়ে মাস্টারমশাইয়ের চোখের দিকে তাকায়। মাস্টারমশাই মিষ্টি হেসে বলে,“আমি আবার আসবো। অবশ্যই সেটা বর বেশে।”

এই কথাটি শুনে শিউলি লাজুক হাসি দেয়। তার হৃদয়ে অন্যরকম অনুভূতি জাগে। সে হাসিমুখে মাস্টারমশাইকে বিদায় দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য পা ফেলে। মাস্টারমশাইও তাকে খুশিমনে বিদায় দেয়।

____

কেটে যায় কয়েকদিন। মাস্টারমশাই চলে গিয়েছে। সে যেদিন চলে যায় সেদিন সারারাত শিউলি বিছানায় মুখ লুকিয়ে কান্না করে। নিরবে কেঁদে যায়। পরবর্তী দিন সকালে বাবার ফোন চুরি করে মাস্টারমশাইকে ফোন দেয়। কিন্তু ফোন যায় না। ফোন বন্ধ বলে। সেদিন থেকে আজ অব্দি সহস্র বার শিউলি ফোন দিয়েছে। প্রতিবারই নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছে। শিউলি ভয় পায়। ভীষণ ভয়। মাস্টারমশাইয়ের কিছু হয়ে গেল না তো। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে শিউলি ভেঙে পড়ে। সেই সাথে পদ্মর উপরও তার রাগটা বেড়ে যায়। সে এমন নোংরা অপবাদ না দিলে মাস্টারমশাই এত দ্রুত যেতো না। সে তো তার মাকে এখানে নিয়ে এসে শিউলিকে বিয়ে করে একসঙ্গে যেতে চেয়েছিলো। সেই সময়টা পদ্মর জন্য পায়নি। তাই শিউলির রাগ হয়। সেই সঙ্গে চিন্তাও। মাস্টারমশাইয়ের কিছু হয়ে গেল না তো।

শিউলিকে এভাবে সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকতে দেখে, লুকিয়ে কান্না করতে দেখে তার দাদী অবাক হয়। সে না পেরে এসে শিউলিকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলে,“মুখপুরী কী হইছে তোর?
এমনে মুখ ঘোমড়া কইরা বইসা থাকো ক্যান? আমার পোলার হাড় মাংশ তো জ্বালাইয়া খাইছোই এহন আবার কী খাইতে চাস?”

“তুমি আমার মন খারাপের কারণ জানতে এসেছো নাকি তোমার ছেলের ঘাড়ে আমি কতবড় বোঝা সেটা জানাতে?”
শিউলি কিছুটা রাগ দেখিয়ে কথাটি বলে। এটা শুনে তার দাদী বলে,“চোপার জোর তো ভালোই বাড়ছে। মুখপুরী তোর মুখ দিয়া আগে গন্ধ ছড়াইতো এহন দেখি মুখের বুলি দিয়াও ছড়াচ্ছে। এত উড়ছিস কী বুইঝা?”

দাদীর কথার জবাব দেয় না শিউলি। সে নিরবে চোখের পানি ছেড়ে দেয়। তার চোখের পানি দেখে দাদী কিছুটা অবাকই হয়। শিউলিকে এমন কথা দাদী রোজই বলতো। একটা সময় পর সব কথা সে হেসেই উড়িয়ে দিতো। তাই কান্নাটা ঠিক হজম হচ্ছে না। দাদী এবার কিছুটা নরম গলায় বলে,“কাঁদছিস ক্যান? কী হইছে?”

“তুমি বুঝবে না বুড়ি।
তোমার বিশ্বাসও হবে না।”
এটা বলে শিউলি বিছানায় উল্টো দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ে। মাথার উপর কাঁথা টেনে দেয়। অতঃপর কান্নায় ভেঙে পড়ে। সে কান্নারত অবস্থায় মনেমনে পড়ে,“তুমি ভাবতেও পারবে না বুড়ি আমার মতো রূপহীন, কালী মেয়ের প্রেমেও কেউ একজন পড়েছে। সেই মানুষটির হয়তো কোন বিপদ হয়েছে। তাই তো তার ফোন বন্ধ। তাই তো চিন্তা হচ্ছে আমার। কষ্ট হচ্ছে খুব। আমি জানি এই কথা তুমি বিশ্বাস করবে না। কিছুতেই করবে না।”
এসব ভাবতে ভাবতে শিউলি অতীতের স্মৃতিতে পাড়ি জমায়। কত দুঃখী ছিলো সে! সেই দুঃখের জীবনে মাস্টারমশাই এক চিমটি সুখ হয়ে ধরা দিয়েছিলো।

অতীত,
“মুখপুরী এহনি পাশের ঘরের ময়নার মায়ের থেইকা ছুনু পাউডার মুখের উপরে বেশি কইরা মাইখা আয়। এই পাত্র হাতছাড়া করা যাইবো না। যা ভালো কইরা ছুনু দিয়া আয়। যাতে তোর কালী রূপটা না দেখায়।”
দাদীর কর্কশ কন্ঠে শিউলি কিছুটা কেঁপে উঠে। তবে তার কথায় তেমন গুরুত্ব দেয় না। দাদী রাগী গলায় বলে,“কী কথা কানে যায় না?
এই নিয়া আমার পোলায় তোর পিছনে পাত্রপক্ষ আপ্যায়ন কইরাও মেলা টাকা খুওয়াইছে। আইজ যদি তোরে পাত্র পছন্দ না করে তাইলে খবর আছে। যা। আমি ময়নার মারে বইলা দিছি। তোরে ছুনু পাউডার দিয়া সাজাইয়া দিবো।”

“তাইলে বুঝি আমার গায়ের রঙটা বদলে যাবে? পাত্রপক্ষের সামনে রঙটা প্রকাশ পাইবে না?”
শিউলির মুখ দিয়ে এই কথা বলতে দেরি তার গালে দাদীর থাপ্পড় পড়তে দেরি নয়। অতঃপর শিউলিকে তার কথা শুনে ময়নার মায়ের কাছে যেতে হয়। সেখানে গিয়েও ময়নার মায়ের কাছে তার গায়ের রঙ, তার অসুন্দর মুখটা নিয়ে কম কথা শুনতে হয় না। একটুখানি মুখটা সাজাতে গিয়ে তাকে হাজারটা কথা শুনতে হয়। এজন্য শিউলি এখানে আসতে চায় না। যদিও তার মুখ সাজাতে তার বাবার থেকে টাকা নিয়ে এসে দাদী ময়নার মাকে দেয়। তবুও শিউলিকে কথা শুনতে হয়। ঐ যে কপালপোড়া। জন্মের পর মা ম রলো। সেই সঙ্গে জন্ম নিলো রূপহীন হয়ে। এজন্য বাবা এবং দাদীর চিন্তার শেষ নেই। বয়স পনেরোর ঘরে পড়তে না পড়তে দশ বিশটা পাত্র দেখা শেষ। কিন্তু কেউ শিউলিকে পছন্দ করছে না। শিউলি নিশ্চিত এবারও তাকে পছন্দ হবে না পাত্রপক্ষের। যতই তাকে ফুলপরী সাজানো হোক না কেন? শেষমেশ হলোও সেটা। শিউলির মুখটা সাদা করতে গিয়ে খুব জঘন্যভাবে তাকে সাজানো হলো প্রসাধনী দিয়ে। সেভাবে তাকে পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে আসা হলো। তারা দেখে প্রথম কথায় বলে উঠলো,“এমনে সঙ সাজাইলে বুঝি কালী রূপ ঢাকা যায়। এই মাইয়া পাতে দেওয়ার মতো ঘটক সাব। এইটা দেখতে নিয়া আইসা আমাদের সময় নষ্ট করলেন ক্যান?”

অতঃপর তারা শিউলির গায়ের রঙ নিয়ে কটুক্তি করে চলে যায়। তারা চলে যেতে দাদীও ক্ষেপে গেল শিউলির উপর। খুব রাগ নিয়ে বলে,“মুখপুরী ম রতে পারোস না। পোনা পুকুরে ডুইবা ম রতে পারোস না। তোর লাইগা আমার পোলার নাক কাটা যায়। তুই ডুইবা ম র। ম র তুই। তাইলে যদি আমরা শান্তি পাই।”


চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে