#শারদীয়ায়_শুভমিলন ( দ্বিতীয় পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
সেদিন এই এলোমেলো ভাবনার ভিড়েই বিকেল গড়িয়েছিল। নীলা এই সময় ঠাম্মার ঘরেই ছিল। জানলায় দাঁড়িয়ে বই পড়ে শোনাচ্ছিল। এই সময় ঘরে আন্তরিক এসে হাজির। নীলার ব্যাপারে ও এর মধ্যে হরি কাকার কাছে অনেক কিছু শুনেছে। নীলা একটা স্কুলে পড়ায়। এছাড়া পাড়ার বাচ্চাদের নাচ গান শেখায়। আর বাকি সময় ঠাম্মার সাথে বকবক করে, গল্প শুনিয়ে কাটিয়ে দেয়। যাইহোক, এবার শুধু মেয়েটার সাথে নতুন করে আবার আলাপ জমাতে হবে। কথাগুলো ভেবেই ও হেসেছিল নীলাকে দেখে। যদিও নীলা ওকে দেখে বই পড়া থামিয়ে দিয়েছিল নিজের। এই সময় অরুণা দেবী বলে উঠেছিলেন,
———” নীলা, যা তো। আন্তরিক এর জন্য রান্নাঘর থেকে এক বাটি পায়েস নিয়ে আয়। দাদুভাই অনেকদিন আমার হাতের পায়েস খায়নি। ছোটবেলায় কত ভালোবাসতো! ”
এই কথায় নীলা কিছুটা আন্তরিককে উদ্দেশ্য করেই বলেছিল,
——–” ছোটবেলার ব্যাপার আলাদা ছিল। ওনার কি আর পনেরো বছর বাদে পায়েস মুখে রুচবে ঠাম্মা! এতদিন বিদেশে থেকে কেক পেস্ট্রি খেয়ে অভ্যস্ত। ”
এই কথায় আন্তরিক সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠেছিল,
———” আমি তো এই পনেরো বছর ধরে ঠাম্মার হাতের এক বাটি পায়েসের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। পৃথিবীর কোন কেক পেস্ট্রিই এর ধারের কাছে যাবে না। ”
কথাটা শুনে নীলা আর কোন কথা বাড়ালো না। বেশ গম্ভীর হয়ে বললো, ” আনছি পায়েস। ”
তারপর চলে গেল রান্নাঘরে। কিন্তু আন্তরিক ওর মুখটা দেখে বুঝেছিল নীলা যেন এই উত্তরটা আশা করেনি আন্তরিকের কাছ থেকে। মেয়েটা আসা থেকে এরকম ব্যবহার করছে কেন কে জানে! কেমন গম্ভীর রাগি রাগি একটা মুখ। কথাটা ভেবেই আন্তরিক বলে উঠলো ঠাম্মাকে,
——-” আচ্ছা ঠাম্মা, নীলা কি আমার ওপর কোন ব্যাপারে রেগে আছে? এসে থেকে লক্ষ্য করছি। একটু হেসে কথা বলে না। না কি ওর স্বভাবটাই ওরকম, রাগি রাগি। ”
এই কথায় ঠাম্মা জোরে হেসে ফেলেছিল সেই মুহূর্তে। তারপর হালকাচ্ছলেই বলেছিল,
——–” না না। নীলা রাগি হতে যাবে কেন! ভীষণ মিষ্টি আর ভালো মেয়ে। পাড়ার সবার কাছে তাই ওর খুব সুনাম। আসলে তোকে নতুন দেখছে তো এত বছর বাদে! একটু সময় দে। মিশে যাবে আগের মতন। ”
কথাটা শুনে আন্তরিক আর কথা বাড়ালো না। মনে মনে অপেক্ষায় রইলো সময়ের। তবে পরেরদিন সকাল সকাল আন্তরিক বাগানে মর্নিং ওয়াক করতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল হঠাৎ। একটা খুব সুন্দর গানের সুর কানে ভেসে এসেছিল।
” কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
তোমারো চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া। ”
গানটার সুর ধরে এগিয়ে গিয়েছিল আন্তরিক ধীর পায়ে। তারপর আবিষ্কার করেছিল বাগানের শেষ প্রান্তে ফুল তুলতে এসে নীলা গানটা গাইছে এক মনে একা একা। নীলা যদিও আন্তরিককে খেয়াল করেনি। তবে আন্তরিক স্থিরভাবে তাকিয়েছিল ওর দিকে। লাল রঙের শাড়ি, খোলা চুলে কেমন চোখ ফেরাতে পারছিল না মেয়েটার থেকে। এতদিন বিদেশে থেকে এত জিন্স টিশার্ট পড়া মেয়েদের দেখে আসলে এই শাড়ি পড়া, এই বড় খোলা চুল , কাজল ভরা দুটো চোখ ভীষণ অন্য রকম লাগছে আন্তরিকের।
সেদিন এরপর গানটা শেষ হতে আন্তরিক নিজে থেকেই এসেছিল নীলার কাছে, তারপর আলতো স্বরে ওকে ডেকে বলেছিল,
———–” তুমি এত সুন্দর গান গাও! আমি তো চুপ করে শুনছিলাম। কিন্তু এই গানটা আগে কোনদিন শুনিনি! বাট রিয়েলি নাইস সং..মাস্ট সে দিজ.. আসলে আমিও একটু আধটু গান গাইতে পারি তো, তাই বলছিলাম। ”
এই কথায় নীলা কেমন তির্যক হেসে বলেছিল,
———” আপনি যেরকম গান জানেন, যেমন রক মিউজিক, পপ মিউজিক সেরকম সুর তালহীন গান এটা নয়। এটাকে বলে রবীন্দ্রসঙ্গীত। সবার দ্বারা এই গান বোঝা সম্ভব না। ”
কথাগুলো বলে নীলা আর দাঁড়ালো না। ফুলের সাজি নিয়ে চলে গেল আন্তরিকের সামনে থেকে। তবে আন্তরিক কেমন নির্বাক ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো সেই সকালে। নীলার এরকম কঠিন কঠিন কথার কোন উত্তর খুঁজে পেল না ঠিক।
তবে সেদিন সকালে বাড়িতে জোর কদমে রিহার্সাল চলছিল পাড়ার ফাংশনের। একটা ঘরে পাড়ার সব কাকুরা নাটকের রিহার্সাল দিচ্ছে। আর একটা ঘরে নীলা পাড়ার বাচ্চাদের ফাংশনের জন্য নাচের রিহার্সাল করাচ্ছিল। আন্তরিক সেই সময় আনমনে যাচ্ছিল ঘরের পাশ দিয়ে, আর নীলার নাচ দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল এক জায়গায়। ওর কি হয়েছে কে জানে! এই মেয়েটার থেকে চোখ সরাতে পারছে না ঠিক। যদিও নীলা ওর ওপর কেমন রেগে রেগেই থাকে, তাও এই মেয়েটার প্রতি অদ্ভুত একটা আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। তবে আন্তরিক খেয়াল করছিল নীলা এই পাড়ার বাচ্চাদের সাথে কত মিষ্টি ভাবে কথা বলছে, সবাইকে চকলেট দিচ্ছে, হাসছে। কিন্তু একমাত্র ওকে দেখলেই মেয়েটার মুখের ভাব বদলে যায়। এক রাশ গাম্ভীর্য এসে জড়ো হয় মুখে, যার কোন কারণ খুঁজে পায় না আন্তরিক। মাঝে মাঝে মনে হয় সত্যিই কি নীলা ভুলে গেল ওদের ছোটবেলার বন্ধুত্ব! সেই পুরনো হাসি, কথা, গল্প! যার কোন উত্তর খুঁজে পায় না আন্তরিক।
যাইহোক, ষষ্ঠীর দিন এই ভাবনার ভিড়েই সন্ধ্যে নেমেছিল। আজ ঠাকুর দালানে পাড়ার ফাংশন, তাই ব্যস্ততা তুঙ্গে। উদ্বোধনী সঙ্গীত হয়ে গেছে। পাড়ার কাকিমারা এখন বাচ্চাদের সাজাতে ব্যস্ত। নীলা আবার ফাংশনে নাচবে, ঠাম্মা তাই নিজের বেনারসি বার করে পড়িয়ে দিয়েছে ওকে। আজ নীলাকে এই সাবেকি সাজে এত সুন্দর লাগছে যে কেউ চোখ ফেরাতে পারছে না ওর দিক থেকে। এইভাবেই সন্ধ্যা এগিয়ে যাচ্ছিল। একের পর এক অনুষ্ঠান হচ্ছিল সবার স্টেজে। সেই সময়েই হঠাৎ মাইকে এনাউন্সমেন্ট,
” এখন আপনাদের সামনে গান গাইতে আসবেন আন্তরিক। ”
নীলা সেই সময় ব্যাক স্টেজে ছিল। কথাটা শুনে বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল ও। অনুষ্ঠানসূচি তো নীলা নিজে তৈরি করেছিল। কিন্তু সেখানে তো আন্তরিকের নাম ছিল না! কথাটা ভেবে বেশ বিরক্ত হয়েছিল সেদিন। এখন আবার রক মিউজক শুনতে হবে হয়তো এত সুন্দর অনুষ্ঠানে। আন্তরিকের পক্ষে তো আর বাংলা গান গাওয়া সম্ভব না! এই কথাগুলোই ভাবছিল মনে মনে, তখনই বেজে উঠেছিল মাইকে একটা গিটারের সুর, তারপর ভরাট গলায় গেয়ে উঠেছিল আন্তরিক,
———–” কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া
তোমারো চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া”
গানটা শুনে নীলা অবাক হয়ে গিয়েছিল কেমন! আন্তরিক কি করে এই গানটা শিখলো! আর এত সুন্দর গাইছেই বা কি করে! কথাটা ভাবতে ভাবতেই নীলা স্টেজের সামনে গিয়েছিল, আর কয়েক মুহূর্তের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল আন্তরিকের গানের সুরে। নির্বাক শ্রোতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সবার মাঝে।
সেদিন গানটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আন্তরিক নিজে এসেছিল নীলার কাছে। তারপর আলতো হেসে বলেছিল,
———–” আমেরিকায় থাকলেই যে কেউ রবীন্দ্র সঙ্গীত এর র ও জানবে না, এটা ভাবা ঠিক না। ”
কথাটায় নীলা আর কিছু বলতে পারেনি। চুপ করে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল নিজের আন্তরিক এর থেকে।
পরের দিনের সকাল শহরে সপ্তমীর শুরু নিয়ে এসেছিল। ঠাম্মা এইদিন সকাল সকাল নীলার হাতে একটা ধুতি দিয়ে বলেছিল আন্তরিকের ঘরে রেখে আসতে। উনি খুব চায় আন্তরিক আজ পুজোতে ধুতি পাঞ্জাবি পড়ুক। সেই ছোটবেলায় আন্তরিককে এইভাবেই ধুতি পড়িয়ে নিজের মনের মতন করে সাজিয়ে দিত ঠাম্মা। কিন্তু কথাটা শুনে নীলা বেশ জোর দিয়ে বলেছিল,
———” ছোটবেলার কথা আলাদা ছিল ঠাম্মা। এখন তোমার মনে হয় তোমার আমেরিকা ফেরৎ হাফ সাহেব নাতি পুজোতে ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে আসবে! তুমি শুধু শুধুই এইসব পাঠাচ্ছ ঠাম্মা। আন্তরিক কখনোই এইসব ধুতি পাঞ্জাবি পড়বে না। ”
কথাগুলো শুনে অরুণা দেবীর মুখটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল সেই মুহূর্তে। তবে এরপর মণ্ডপে যখন নীলা পুজোর কাজ করছিল, তখন আচমকা আন্তরিক এসে হাজির লাল রঙের পাঞ্জাবি আর সাদা ধুতি পড়ে। দেখে তো নীলার চোখ স্থির হয়ে গিয়েছিল কয়েক সেকেন্ড। আন্তরিকের সাথে আজও ভাবনাটা মিললো না ওর! ছেলেটা সত্যি ধুতি পাঞ্জাবি পড়েছে! কথাটা ভাবতে ভাবতেই ও ঠাম্মার দিকে খেয়াল করেছিল। ওনার মুখে এখন জয়ের হাসি। নাতি মুখ রক্ষা করেছে আজ। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই অরুণা দেবী বলে উঠেছিলেন,
———” কি মিষ্টি দেখতে লাগছে আমার দাদুভাই কে। একা একাই ধুতি পড়তে পারলে? না কি কেউ সাহায্য করেছে। ”
এই কথায় আন্তরিক হেসেই বললো,
———” হরি কাকা হেল্প করেছে। ব্যাস, পড়ে ফেললাম। ”
কথাগুলো খুব সহজভাবে আন্তরিক বললেও নীলা যেন ওকে সহজভাবে নিতে পারছিল না ঠিক। শুধু মনে হচ্ছিল ছেলেটা যা করছে সবটা দেখানো। আসল সত্যিটা অন্য। নিশ্চয়ই কিছু উদ্দেশ্য আছে আন্তরিকের।
যাইহোক, এইসব এলোমেলো ভাবনার ভিড়ে সেদিন পুজো শুরু হয়েছিল। এরপর সকালের পুজো শেষ হয়ে সব মিটতে মিটতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছিল সেদিন। নীলার তাই ঠাম্মাকে ওষুধ দিতে দেরি হয়ে গিয়েছিল বেশ। ওই বেলা তিনটের সময় নীলা তাড়াহুড়ো করে এসেছিল অরুণা দেবীর ঘরে, তারপর এলোমেলো ভাবে বলেছিল,
——–” সরি ঠাম্মা। আজ পুজোর এত কাজ ছিল যে তোমাকে ওষুধ দিতে দেরি হয়ে গেল! যাইহোক, আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি ওষুধ গুলো। ”
কথাটা বলেই নীলা ওষুধের বাক্স আনতে যাচ্ছিল, তখনই ঘরে অন্তরা এসে হাজির। আজ ও ভীষণ বিরক্ত হয়েই নীলাকে বলে উঠলো,
———-” থাক নীলা, সারাদিনে যখন তোমার একবারও টাইম হয়নি এই বয়স্ক মানুষটাকে ওষুধ খাওয়ানোর, তাহলে আর এখন কিছুর দরকার নেই। আমি এসে গেছি, আমি মাকে ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি। এই বাড়িতে দিনের পর দিন ফ্রি তে থাকছো, খাচ্ছো, অথচ একটা কাজ ঠিকভাবে করতে পারো না? ”
কথাগুলো বেশ ঝাঁঝালো গলায় বলেছিল অন্তরা। কিন্তু অরুণা দেবী এই মুহূর্তে বেশ কঠিন স্বরে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
———” তুমি নীলার সাথে এইভাবে কথা বললে কি করে! আজ এতগুলো বছর ধরে নীলাই আমাকে ওষুধ দিচ্ছে, আর আজও নীলাই দেবে। তোমার কোন প্রয়োজন নেই এখানে বৌমা। তুমি আসতে পারো। ”
কথাগুলো শুনে অন্তরা কিরকম হকচকিয়ে গিয়ে বলেছিল,
———-” একটা বাইরের মেয়ের জন্য আপনি আমার সাথে এইভাবে কথা বললেন! আশ্চর্য! ”
এই কথায় অরুণা দেবী বেশ জোর দিয়ে বলেছিল,
———-” নীলা আমার মেয়ে। তুমি ওকে বাইরের মেয়ে ভাবলেই ও বাইরের মেয়ে হয়ে যাবে না। আর নীলার সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও মনের সম্পর্ক আছে। যেটা তুমি বুঝবে না। ”
কথাগুলো কেমন স্থির গলায় বলেছিল অরুণা দেবী। অন্তরার যদিও এইসব শুনে পা থেকে মাথা অব্দি জ্বলে যাচ্ছিল। ইচ্ছে করছিল এই অপমানের পর এক্ষুণি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে, কিন্তু তারপরই প্রোমোটারের কথাটা মনে পড়ে গেল! তাই এই অপমানটা সহ্য করেই ফেললো চোখ বন্ধ করে। তবে অন্তরা জানে, অরুণা দেবীর মন এত সহজে গলাতে পারবে না এই ব্যাপারে। তবে তুরুপের তাস তো হাতেই আছে, একমাত্র নাতি আন্তরিক। সে কিন্তু ঠাম্মার মন ভালোভাবেই জয় করতে পারছে। এখন নাতির ভবিষ্যত এর কথা ভেবে এই বাড়িটা নিশ্চয়ই আন্তরিকের নামে করে দেবে তার ঠাম্মা। তারপর বাকি ব্যবস্থা ও আর অমিতাভ মিলে করে নেবে। আর সেই সময়েই এই নীলা মেয়েটাকে নিজের আসল জায়গা দেখিয়ে দেবে খুব ভালো করে। সবার প্রথমে এই মেয়েটাকে বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করবে অন্তরা। কথাগুলো যেন নিজের মনেই বলে উঠলো সেদিন।
যাইহোক, এইসবের পর অষ্টমী এসে হাজির বাঙালির দরজায়। সকাল সকাল মণ্ডপে অঞ্জলী দেয়ার ভিড়, ঠাকুরমশাই এর মন্ত্রচ্চরণ, ফুল নেয়ার জন্য সকলের লাইন, এইসবের মাঝেই আন্তরিক এসে দাঁড়িয়েছিল নীলার পাশে। তারপর ফুল হাতে নিয়ে আলতো গলায় ওর কানের কাছে এসে বলেছিল,
——–” হ্যাপি অষ্টমী। ”
কিন্তু এই কথায় নীলা বেশ দিদিমণির মতন বলে উঠেছিল শুনিয়ে,
——–” হ্যাপি অষ্টমী না, শুভ অষ্টমী। আমরা তো বাঙালি। তাই। ”
কথাটায় আন্তরিকের বেশ মজা লেগেছিল। মেয়েটার মধ্যে একটা বাংলার কড়া টিচারের মতন ভাব আছে। শুধু যদি একটা চশমা পড়িয়ে দেয়া যায়, তাহলেই হেড মিস্ট্রেস। কথাটা ভাবতে ভাবতেই আন্তরিক বলেছিল,
———” উপস, মাই মিসটেক.. শুভ অষ্টমী। ”
এই কথায় নীলা আর কথা না বাড়িয়ে এবার অঞ্জলীতে মন দিয়েছিল।
কিন্তু বেলার দিকে আন্তরিক একটা প্ল্যান করেছিল। ও ঠাম্মার কাছে নিজে থেকে গিয়েই বলেছিল ও শ্রীরামপুর ঘুরে দেখতে চায়, সব প্যান্ডেল গুলো। কিন্তু শ্রীরামপুরের রাস্তাঘাট তো কিছুই চেনে না। তাই নীলা যদি ওর সাথে যায়, তাহলে খুব ভালো হয়।
কথাটা শুনে নীলার মনে হয়েছিল ও ফেঁসে গেছে। এখন এই হাফ সাহেবকে নিয়ে শ্রীরামপুর ঘোরাতে হবে! আর এই ছেলেটার সাথে ও কথাই বা বলবে কি সারা রাস্তা! কিছুই তো মেলে না দুজনের। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই নীলা বলেছিল,
———” আমেরিকার রাস্তায় এতদিন ঘোরার পর আপনি শ্রীরামপুরের রাস্তায় ভিড় ঠেলে হাঁটতে পারবেন? পুজোর সময় তো টোটো অটোও বন্ধ অনেক জায়গায়। অবশ্য আপনার তো টোটো অটোতে চরারও অভ্যাস নেই। আপনার এখানে ঘুরে পোষাবে না। এখানকার ধুলো মাটি জল হাওয়া কিছুই সহ্য হওয়ার নয়। আপনি বরং বাড়ি থাকুন। সেটাই ভালো। ”
কথাগুলো বলে ভেবেছিল নীলা বেঁচে যাবে। কিন্তু আন্তরিক যে অতো সহজে ছাড়ার পাত্র নয়, সেটা বোঝেনি। তাই ওর ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার আগেই আন্তরিক বলেছিল,
———” এটা আমি মানতে পারলাম না যে আমার নিজের দেশের ধুলো মাটি জল হাওয়া সহ্য হবে না! আর তোমার হয়তো মনে নেই, ছোটবেলায় আমি তোমাকে শ্রীরামপুরে হেঁটে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেতাম পুজোতে। এখন এত বছর বাদে রাস্তাগুলো আমার ঠিকভাবে মনে নেই বলে হেল্প চাইছি। এবার তুমি যদি হেল্প করতে না চাও, সেটা আলাদা ব্যাপার। বলে দাও। নো প্রব্লেম। আমি একা একাই যাবো। ”
কথাগুলো এই মুহূর্তে নীলাকে শুনিয়েই বললো আন্তরিক। তবে ঠাম্মা এত কিছু শুনে এবার নীলার দিকে তাকিয়ে অর্ডারের সুরে বললো,
———” কেন এরকম করছিস ছেলেটার সাথে! যা না ওকে নিয়ে, ঘুরিয়ে দেখা শ্রীরামপুর। আমি কিছু শুনতে চাই না আর। ”
এই সময় নীলা আর কি বলে! ঠাম্মার মুখের ওপর তো আর না বলতে পারবে না। তাই যেতেই হলো সেই। তবে এ গলি সে গলি ঘুরতে ঘুরতেও নীলা বেশ গম্ভীর ছিল। দরকারের বাইরে একটা কথাও বলছিল না আন্তরিকের সাথে। অথচ আন্তরিক খেয়াল করছিল রাস্তায় মাঝে মাঝে যখন নীলার সাথে কোন পরিচিত বন্ধু বান্ধবদের দেখা হয়ে যাচ্ছে, তখন নীলার মুখে হাসি। বেশ জমিয়ে গল্প করছে। কিন্তু শুধুমাত্র আন্তরিকের সাথেই যে কেন এই অবিচার, বুঝতে পারে না ছেলেটা।
তবে সেদিন পাড়াতে ঢুকে কিছু বাচ্চা ছেলেদের সাথে দেখা হয়েছিল নীলা আন্তরিকের। ওরা ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল আপন মনে। এমনিতে ওরা নীলার স্টুডেন্ট সব, টিউশন পড়তে আসে। তবে আজ অষ্টমীতে নীলাকে দেখে কিছুতেই ছাড়বে না ওরা। নীলাও ওদের দেখে এই মুহূর্তে বলে উঠেছিল,
——–” কি রে, কেমন মজা করছিস অষ্টমীতে? পুজোর সময় কিন্তু নো পড়াশোনা। হোম ওয়ার্ক গুলো সব পুজোর পর করিস। ”
এই কথায় বাচ্চাগুলো বলে উঠেছিল,
———” হ্যাঁ হ্যাঁ, হোম ওয়ার্ক এ আমরা কেউ এখনো হাতই দিইনি। সব পুজোর পরে করবো। ভালোই হলো তুমি এলে, আমাদের সাথে ঘুড়ি ওড়াও না প্লিজ। আর দাদাটাকেও বলো আমাদের সাথে ঘুড়ি ওড়াতে? ”
শেষ কথাটা আন্তরিক এর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিল বাচ্চারা।
এই কথায় নীলা অল্প কথায়ই বলেছিল,
——–” কি যে বলিস তোরা! উনি ওড়াবেন ঘুড়ি! এতদিন আমেরিকায় থেকে এইসব পারবে না কি উনি! এইসব ওনার কম্মো না। চল আমি তোদের সাথে ঘুড়ি ওড়াবো। ”
কথাগুলো কেমন যেন ইগোতে লেগেছিল আন্তরিকের। তাই সাথে সাথেই বলে উঠেছিল বেশ জোর দিয়ে নীলাকে,
———-” তুমি বোধ হয় ভুলে গেছ, ছোটবেলায় ঘুড়ি ওড়ানো আমিই তোমায় শিখিয়েছিলাম। হ্যাঁ, আমেরিকায় থাকার জন্য ঘুড়ি ওড়ানোটা প্র্যাকটিসে নেই। তবে ভুলেও যায়নি। ”
কথাটা বলেই বাচ্চাদের কাছ থেকে ঘুড়ির সুতো নিয়েছিল ও। তারপর সেই আগের মতন ঘুড়ি ওড়াতে শুরু করেছিল বাচ্চাদের সাথে মজা করে। এইসব দেখে নীলাও বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল। আন্তরিক সেই আগের মতনই ঘুড়ি ওড়াচ্ছে! কোন জড়তা নেই ওর মধ্যে। কিন্তু কিছুক্ষন বাদে আন্তরিক খেয়াল করেছিল, নীলাও ঘুড়ি ওড়ানো দেখতে দেখতে বাচ্চাদের সাথে এতটা একসাইটেড হয়ে গেছে যে সেই পুরনো দিনের মতন ওর কাঁধে হাত রেখে বলে উঠছে,
———–” ওই ঘুড়িটা কাটো আন্তরিকদা। তাড়াতাড়ি কাটো। ”
কথাগুলো শুনে আন্তরিকের মনে হচ্ছিল সব যেন আগের মতনই আছে। সেই ওদের বন্ধুত্ব, হারিয়ে যাওয়া সময়, মুহূর্তগুলো আর নীলা। তবে কিছুটা সময় বাদে নীলার স্তম্ভিত ফিরেছিল হঠাৎ। ও তাড়াতাড়ি আন্তরিকের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে আবার যেন কিরকম আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই মাপা দূরত্বটা নিয়ে এসেছিল দুজনের মাঝে।
এর মধ্যে ধীরে ধীরে নবমী চলে এসেছিল অষ্টমী পেরিয়ে। শহরে উৎসবের শেষ দিনের আমেজ। আন্তরিক আজ ভীষণ মজা করেছে পুজো মণ্ডপে। ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে পাড়ার ছেলেদের সাথে ধুনুচি নাচ নেচেছে সবার সাথে। সেই দেখে পাড়ার সকলেই আন্তরিকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ছেলেটা এতদিন বিদেশে থেকেও বাঙালির ট্রেডিশন কালচার কিছুই ভুলে যায়নি। আর সব থেকে বড় কথা হলো ব্যাবহার। সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলে। নম্র ভদ্র স্বভাবের আন্তরিককে কেউ না পছন্দ করে থাকতেই পারে না। এইভাবে সেদিনের সন্ধ্যা কেটে যাওয়ার পর রাতে ঠাকুর দালান ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। আন্তরিক সেই সময় খেয়াল করেছিল নীলা দুর্গা দালানে একা বসে। আন্তরিক এটা দেখে নীলার কাছে না এসে থাকতে পারেনি। তবে এই মুহূর্তে আন্তরিক দেখেছিল নীলার চোখে জল। এক মন দিয়ে কি সব ভেবে যাচ্ছে যেন মেয়েটা। এই দৃশ্য দেখে আন্তরিক ওর কাছে এসে বলেছিল,
———” কি হলো? পুজো শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে মন খারাপ? ”
কথাটায় যেন নীলার মনের ঘোরটা কেটে গিয়েছিল। তবে ও আন্তরিকের প্রশ্নে আজ কেমন থমকে থাকা গলায়ই বলেছিল,
———” আমার কেন মন খারাপ সেটা আপনি কোনদিন বুঝবেন না। আপনাকে বলেও লাভ নেই। ”
কথাটা বলে নীলা আর কোন প্রশ্ন উত্তরের অপেক্ষা করেনি। দুর্গা দালান খালি করে চলে গেছিল ঘরে। তবে আন্তরিক সত্যিই এর কোন মানে খুঁজে পায়নি। নীলা যে কেন ওকে পছন্দ করে না, সহজ মনে মেশে না, এর কোন কারণ সত্যি খুঁজে পায় না আন্তরিক।
চলবে।