বড় ছেলে পর্ব-০১

0
2

#বড়_ছেলে (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

আমার টাকার বাড়িতে আমার জায়গা নেই। বারো বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে লাখ লাখ টাকা বাবা, মায়ের কাছে পাঠিয়েছি। সেই টাকায় বাড়ি হলো, জমি হলো। কিন্তু তা আমার হলো না। সবকিছু আমার বাবা, মা ভাইয়ের নামে লিখে দিলো।

আজ দেশে ফিরে যখন বিয়ের কথা ভাবছিলাম। সেই মূহুর্তে বাবা, মা অমত করলো। তাদের কথা এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করার দরকার নাই। আরও কয়েক বছর বিদেশ করে টাকা জমিয়ে, দেশে এসে ব্যবসা ধরে একেবারে বিয়েটা করতে। কিন্তু আমি সেটা চাই না। সে আঠারো বছর বয়সে দেশ ছেড়েছি। এখন বয়স ত্রিশের ঘরে। এই বয়সে এসে বিয়ে না করে আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করা আমার সময় নষ্ট মনে হয়। কিন্তু বাবা, মা এটা বুঝতে চাচ্ছে না। তাই না পেরে আমি বলে দিলাম,“মা আমার একটি মেয়েকে পছন্দ। তার বাসায় বিয়ের কথা চলছে। তাই আমি এখন বিয়ে করতে চাচ্ছি। আমি চাই তোমরা ওর পরিবারের কাছে বিয়ের সম্মোন্ধ নিয়ে যাও।”

বাবা, মা আমার এই কথা শুনে পুরো হতবাক হয়ে যায়। তারা কিছুতেই এটা মানতে পারে না। বাবা সোজা বলে দেয়,“দেখ এখন হাতে কোন টাকা নেই। তোর নিজের কাছেও তো জমা কোন টাকা নেই। বিয়ে করবি কিভাবে? তাই তো বলছি আরও কয়েকটা বছর বিদেশ কর তারপর আমরা টাকা জমাই সেই টাকা দিয়ে কিছু একটা করে বিয়েটা করবি।”

আমি তাদের কথায় রাজি না হয়ে। আমার সিদ্ধান্তে দাঁড়িয়ে থাকি। আমি এখনই বিয়ে করতে চাই। দুই মাসের ছুটি নিয়ে এসেছি। বিয়েটা এরমাঝে করে ফেলতে চাই। এটা বুঝে মা বলে,“ওহ বিয়ে করবি বলেই দেশে আসলি?”

“বাহ্। বাবা, মায়ের কথার কোন দাম নেই।
সংসারে অভাব অনটন তা দেখছিস না। কিন্তু বিয়ে করতে উঠেপড়ে লেগেছিস।”
এক কথা দুই কথায় যখন বাবা বললো,“বিয়ে করবি যা জমানো টাকা আছে? আমাদের তো বলিস হাতে কোন টাকা নাই। মিথ্যে বলে জমিয়েছিস? ভালো। তোর যদি সব ব্যবস্থা থাকে তাহলে বিয়ে কর।”

“না। আমার হাতে তো কোন টাকা নেই।
সব টাকা তো তোমাদের দিয়েছি। সেখান থেকে কিছু টাকা দিয়ে ঘরোয়াভাবে বিয়ের আয়োজন করলেই হবে।”
আমি সেই টাকার কথা তুলতে বাবা, মা হতভম্ব হয়ে যায়। তারা এমন ভাব নেয় যেন কোন টাকাই আমি পাঠায়নি। তাদের কাছে কোন টাকা নয়। এসব নিয়ে আমাদের মাঝে কথা কাটাকাটি হলে বাবা বলে,“এখন টাকা নিয়ে আমাদের সাথে ঝগড়া করছিস? তোকে যে টাকা দিয়ে বিদেশে পাঠিয়েছি তার নাম নাই? আর তুই যা টাকা পাঠিয়েছিস তা সব সংসার খরচেই তো শেষ। কত টাকা আর পাঠিয়েছিস।”

“আচ্ছা। তোমাদের কাছে যেহেতু টাকা নেই সেহেতু যে জমি কিনছো সেখান থেকে কিছুটা বিক্রি করে দিও। তাহলে তো হয়ে যায়।”
আমার মুখে এই কথা শোনার জন্য বাবা, মা প্রস্তুত ছিলো না। আর এখানেই তাদের আসল রূপ বের হয়ে আসে। বাবা, মায়ের কথায় বুঝতে পারি কোনকিছু আমার নেই। সব তারা ভাইয়ের নামে করেছে। উল্টো বাবা আমাকে হুমকি দিয়ে বলে,“জানতাম তুমি এমনই করবে। তবে হ্যাঁ শোনো তোমার যদি বিয়ে করতে মন চায় কিংবা আমাদের সাথে তর্ক সেটা ঘরের বাহিরে গিয়ে করো। আমাদের ঘরে থেকে আমাদের মুখের উপর কথা বলা যাবে না।”

“তুমি আমাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছো?”
আমি অনেকটা বিষ্ময় নিয়ে বাবা, মায়ের দিকে তাকায়। বাবা বলে,“কথা না শুনলে তো এটাই করবো।”

এখানে কথা প্রসঙ্গে আমি বুঝতে পারি ছোট ভাইয়ের পড়ালেখা শেষ। এখন সে একটা ব্যবসা করতে চায়। বাবা, মা চায় আমি বিদেশে গিয়ে গাধার মতো খেটে টাকা পাঠাই সেই টাকায় সে ব্যবসা দিক। অর্থাৎ আমার টাকা বাবা, মা আমার ভাইয়ের ভবিষ্যতে গুছিয়ে দিচ্ছে। সব জমির মাঝে আমার বাবা, মায়ের নামে দশ শতাংশ জমি রয়েছে। যেখান থেকে আমি পাঁচ পাবো। আমি তাদের কথা না শুনলে সেটাও পাবো না। তাদের আসলে ভয় হচ্ছে, আমি বিয়ে করলে তাদের আর টাকা পাঠাবো না। বউয়ের কথায় নাচবো। বউকে সব দিবো। তাই বিয়ে করাতে চাচ্ছে না। নিজের বাবা, মায়ের এই স্বার্থপর রূপ দেখে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। এতদিন যাদের জন্য এতকিছু করলাম। দিনশেষে তারা আমার কথাই ভাবলো না।

প্রত্যেক বাবা, মা নাকি সন্তানকে সমানভাবে ভালোবাসে। না। এটা সত্যি নয়। এই পৃথিবীর সব বাবা, মা প্রতিটি সন্তানকে সমান চোখে দেখলেও আমার বাবা, মা দেখে না। সেটা আজ আমি বুঝতে পারলাম। তারা আমাকে শুধু স্বার্থের জন্য ভালোবাসে। এছাড়া নয়। তাদের আসল ভালোবাসা তো ছোট ছেলের জন্য। তাই তো সবকিছু তার জন্য করলো।

____

আমি মনমরা হয়ে বিছানায় বসে ছিলাম। সেই মূহুর্তে কাজল ফোন দিলো। আমি তার ফোনটা ধরতে কাজল বলে,“তোমার বাবা, মাকে আমাদের কথা বলেছো। তোমরা কবে আসবে আমাদের বাড়ি?”

“তুমি তোমার বাবা, মায়ের পছন্দে বিয়ে করে নাও কাজল।”
বুকে পাথর চাপা দিয়ে কথাটি বললাম কাজলকে। কাজল আমার মুখে এই কথাটি শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। সে অনেকটা অবাক হয়। পরক্ষণে নিজেকে সামলে বলে,“এই সময়ে মজা করো না তো। আমি সিরিয়াস।”

“আমিও সিরিয়াস।
আমার কাছে কিছুই নেই কাজল। আমি এক শূন্য মানুষ। আমার মতো এক মানুষের সঙ্গে তোমার বাবা, মা কখনোই আমাকে বিয়ে দিতে চাইবে না। আর আমার শূন্য পকেট ভরতে কমপক্ষে আরও পাঁচ বছর লাগবে। এত বছর তুমি অপেক্ষা করতে পারবে? তখন আমার বয়স পঁয়ত্রিশ হয়ে যাবে। তোমার সাতাশ বছর। পারবে এতটা সময় পার করতে? যদি পারো তাহলে হয়তো আমাদের এক হওয়া সম্ভব। তাছাড়া নয়।
আমি জানি এতটা বছর তোমার নিজের বাবা, মাকে বোঝানো সম্ভব নয়। তাই তোমার জন্য ভালো হয় তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করে নাও।”
আমার কথা শুনে কাজল চুপ হয়ে যায়। তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না। আমি তার নিরবতা দেখে আবার বলি,“তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করে নাও। চিন্তা করো না। আমি কিছুই মনে করবো না।”

“তুমি সবকিছু শেষ করছো?”
কাজলের কথাটি শুনে বুকের ভেতর কেমন একটা করে উঠে। নিজের কষ্টটা লুকিয়ে বলি,“হ্যাঁ। এছাড়া যে উপায় নেই। আর যদি অপেক্ষা করো তাহলে আমি তোমারই হবো।”

“এতদিন বলেছো, দেশে আসলেই বিয়ে করবে। এখন বলছো আরও অপেক্ষা করতে।”

“জোর নাই। তুমি চাইলে অপেক্ষা নাও করতে পারো।”

“জয়। যদি জানতেই বিয়ে করতে পারবে না তাহলে এত আশা দেখিয়েছো কেন? এখন স্বপ্ন ভেঙে দিচ্ছো? তোমার জন্য বাবা, মায়ের কাছে পাত্রদের খুঁত বের করে বলতাম। আর আজ তুমিই আমার হবে না বলছো। একটা মেয়েকে ঘরে তুলতে না পারলে স্বপ্ন দেখাও কেন?”
কাজল আরও কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু আমি সুযোগ দিলাম না। আমি ফোনটা কেটে দিলাম। কারণ কাজলের কথা সহ্য করার মতো ক্ষমতা আমার আর নেই। আমি ফোনটা রাখতে আমার চোখটা ভিজে উঠলো।

কাজলের সঙ্গে পরিচয় ফোনেই হয়েছে। তাই আশা করি কাজল আমাকে খুব সহজেই ভুলে যাবে। সে নিজের জীবনে এগিয়ে যাবে। আমার মতো মানুষের সঙ্গে বিয়ে হলে সে সুখী হতো না। সে আরও ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে। এটা ভেবে চোখের পানিটা মুছে নিলাম। দরজায় মা নক করতে আমি তার দিকে তাকালাম। মায়ের দিকে চোখ পড়তে আমার মনে পড়ে গেল, কিভাবে আমার বাবা, মা আমাকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করেছে। আমাকে স্বার্থের জন্য ভালোবেসেছে। এটা মনে পড়তে আমি মাকে বললাম,“প্রথম যখন বিদেশ গিয়েছি। তখন না খেয়েও থাকতে হয়েছে। কত কষ্ট করেছি। ঐ দেশে টাকাগুলো এমনি দেয়নি। কষ্টের বিনিময় দিয়েছে। তবুও সেই কষ্টগুলো আমার কষ্ট মনে হয়নি। কারণ আমি তো সব আমার পরিবারের জন্যই করছিলাম। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। আমার তো কোন পরিবার ছিলোই না। তাই না মা?”

“জয়!”
মা কিছুটা অবাক হয়ে কথাটি বলে। পরক্ষণে চোখ নামিয়ে নেয়। শান্ত গলায় বলে,“তুই ভুল ভাবছিস জয়।”


চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে