#সন্দেহের_কাঁটা।
পর্ব:- তিন।
লেখা:- সিহাব হোসেন
বিয়ের পর শ্রেয়া আর রাহুলের জীবনটা ছিল স্বপ্নের মতো। একে অপরের সঙ্গ, ভালোবাসা আর ছোট ছোট খুনসুটিতে তাদের দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল অনাবিল আনন্দে। একদিন রাতে পাশাপাশি বসে গল্প করার সময় রাহুল হঠাৎ বলে উঠল,
– “কাল আমার বন্ধুরা বাসায় আসবে। বিয়ের সময় তো কাউকে ঠিকমতো দাওয়াত দিতে পারিনি, সবকিছু খুব হুট করে হয়ে গেল। তাই ওরা তোমার সাথে পরিচিত হতে চায়।”
– “তা আসুক, সমস্যা নেই। কিন্তু আমি কারও সামনে যাবো না।”
– “কেন? গেলে সমস্যা কী?”
– “দেখো, এটা কিন্তু ঠিক নয়। ইসলামে নারীদের জন্য পরপুরুষের সামনে যাওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র ১৪ জন মাহরাম ছাড়া কারও সামনে যাওয়া যাবে না, এটা তো তুমি ভালো করেই জানো।”
– “আরে, এখনকার যুগের সাথে একটু তাল মিলিয়ে চলতে হয়। তুমি তো আর ওদেরকে নিজের শরীর দেখাচ্ছ না! শুধু সামনে যাবে আর দুটো কথা বলবে, এটুকুই।”
– “আমি পারব না। তুমি যতই চেষ্টা করো, আমি তোমার কথা মানতে পারব না।”
– “ঠিক আছে, তোমার যা মন চায় করো।”
রাহুলের গলার স্বরে ছিল স্পষ্ট বিরক্তি। সে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। সেই রাতটা শ্রেয়ার আর ভালো করে ঘুম হলো না। স্বামীর এই শীতল আচরণ তার বুকে কাঁ*টার মতো বিঁ*ধছিল।
পরদিন বিকেলে তৌফিকসহ রাহুলের আরও দুজন বন্ধু বাসায় এলো। রাহুল তাদের নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে আড্ডা দিতে লাগল। শ্রেয়া যত্ন করে তাদের জন্য নাস্তা তৈরি করে রাহুলকে ইশারায় ডাকল। রাহুল ভেতরে এলে সে বলল,
– “তুমি ওদেরকে খাবারগুলো দিয়ে আসো।”
– “তুমিও চলো। ওরা তোমার সাথে পরিচিত হবে।”
– “আমি তো আগেই বলেছি, আমি কারও সামনে যাবো না।”
রাহুল আর কথা বাড়াল না। সে নিজেই খাবার পরিবেশন করল। তৌফিকসহ সবাই খাবারের খুব প্রশংসা করছিল। কিন্তু সেই প্রশংসা গুলো শ্রেয়ার কানে বি*ষের মতো লাগছিল। হঠাৎ তৌফিক বলে উঠল,
– “যে এত সুন্দর করে আমাদের জন্য রান্না করল, তাকে তো দেখলামই না। একবার ভাবিকে ডাক দোস্ত।”
– “তোর ভাবি আসবে না। ও পর্দা করে চলে, এসব ওর পছন্দ না।”
– “শোন দোস্ত, পর্দা করে, এটা খুব ভালো কথা। কিন্তু যারা বেশি পর্দা করে, তাদের মধ্যেই কিন্তু দোষ বেশি থাকে। আজকাল এতটাও ভালো না।”
– “বা”জে বকিস না!” রাহুল ধমকে উঠল।
তখন আরেক বন্ধু যোগ করল,
– “শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি। আজকালকার যুগ সম্পর্কে তোর কোনো ধারণাই নেই। এমন অনেক মেয়েকে দেখেছি, শুনতাম খুব পর্দা করে, কিন্তু পরে গিয়ে শুনি সে এমন সব বাজে কাজ করেছে যা কল্পনারও বাইরে।”
রাহুল এবার রে*গে গিয়ে বলল,
– ”এমন হতে পারে, কিন্তু তোর ভাবি সেরকম না। আর এসব কথা বলিস না প্লিজ।”
তৌফিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– “হ্যাঁ, সেরকম না হলেই ভালো।”
ভেতরের ঘরে বসে শ্রেয়া সব শুনছিল। অপমানে, কষ্টে তার বুক ফে”টে যাচ্ছিল। সে নীরবে চোখের জল ফেলছিল। বন্ধুরা চলে যাওয়ার পর রাহুল ঘরে এসে দেখল শ্রেয়া কাঁদছে।
– “কী হলো? এভাবে কান্না করছো কেন?”
– ওরা আমাকে নিয়ে এতগুলো অপমানজনক কথা বলল, অথচ তুমি একটুও প্রতিবাদ করলে না কেন?”
– “ওরা তো তোমাকে কিছু বলেনি, অন্য কারও কথা বলছিল।”
– “ওদের বলা মানেই আমাকে বলা! কারণ, আমিও তো পর্দা করি, নিজেকে যথাসম্ভব ঢেকে রাখার চেষ্টা করি। এতকিছুর পরেও যদি এমন কথা শুনতে হয়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখের আর কী আছে, বলো?”
– “ওদের সামনে গেলেই তো আর এতকিছু হতো না।”
– “তার মানে আমি ওদের সামনে যাইনি, এটাই আমার অপরাধ?”
– “না, তা নয়। তবে যাওয়া উচিত ছিল। একটু কথা বলত, এর বেশি তো কিছু হতো না।”
এরপর দুটো দিন শ্রেয়া রাহুলের সাথে কোনো কথা বলল না। শুধু একা একা বসে কাঁদত। রাহুল তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু সে কোনো কথাই শুনছিল না। সে শুধু বারবার বলছিল,
– “আমি চাই না তুমি ওদের সামনে যাওয়ার জন্য আমাকে আর কখনো বলো। আর ওদেরকে এই বাড়িতে না আনলেই ভালো হয়।”
– “এখন তো আমার মনে হচ্ছে, ওদের কথাই ঠিক।”
রাহুলের মুখ থেকে এই কথাটা শোনার সাথে সাথে শ্রেয়ার বুকের ভেতরটা যেন ভেঙে চুর*মার হয়ে গেল। তার স্বামী, তার সবচেয়ে কাছের মানুষটা তাকে এতটা অবিশ্বাস করতে পারে, এতটা আ*ঘা*ত দিতে পারে, তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। রাহুল বুঝতে পারল, সে খুব বড় একটা ভুল করে ফেলেছে। কথাটা বলা তার একদমই উচিত হয়নি। সে সাথে সাথে শ্রেয়ার কাছে ক্ষমা চাইল, কিন্তু শ্রেয়া তাকে ক্ষমা করেছে কি না, তা বোঝার উপায় ছিল না।
কয়েকদিন পর, রাহুল তার কারখানায় বসে ছিল। এমন সময় তৌফিক এসে মুখটা ভার করে বসল।
– “ভাবির এমন আচরণে বেশ খারা*প লেগেছে, দোস্ত। উনি নিশ্চয়ই আমাদের খারাপ ভেবেছেন, তাই সামনে এলেন না।”
– “ধুর! এসব কিছুই না।”
– “তবে যাই বলিস, বেশি পর্দা করা মেয়েদের একদম বিশ্বাস করিস না। এরা পর্দার আড়ালে অনেক অকাম করে বেড়ায়।”
তৌফিকের কথা শেষ হতে না হতেই পাশে থাকা আসিফ বলে উঠল,
– “ভাই, আপনার মা-কেও তো পর্দা করে থাকতে দেখি। তিনি আবার খা*রাপ কিছু করেন না তো?”
কথাটা শোনামাত্র তৌফিক তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল।
– “এই… তোর আমার মা-কে নিয়ে বা*জে কথা বলার সাহস হলো কিভাবে?”
– “আপনি যে আরেকজনের স্ত্রীকে নিয়ে এভাবে বলছেন, আপনার লজ্জা করছে না? এসব কথা বলে যে উনার মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিচ্ছেন, এতে কিন্তু তাদের সংসারে অশান্তি বাড়বে। এই তৃতীয় মানুষের জন্যই আজকাল বেশিরভাগ সংসারে ভাঙন ধরে।”
তৌফিক রা*গে গজ*রাতে গজ*রাতে রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “ওকে চুপ করতে বল! নয়তো যা হওয়ার তাই হবে একটা!”
রাহুল আসিফকে শান্ত হতে বলল। আসিফ চুপচাপ নিজের কাজে মন দিল। তৌফিক আর এক মুহূর্তও সেখানে না থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেল। কিন্তু যাওয়ার আগে সে যে সন্দেহের বিষ রাহুলের মনে ছড়িয়ে দিয়ে গেল, তা ধীরে ধীরে ডালপালা মেলতে শুরু করল।
নিজের বন্ধুদের কথায় প্রভাবিত হয়ে রাহুলের মনে সন্দেহের যে বিষবৃক্ষ জন্মেছিল, তা দিনে দিনে আরও শাখা-প্রশাখা মেলতে শুরু করল। সে শ্রেয়ার অগোচরে তার অতীত ঘাঁটতে লাগল, যদি কোনো কলঙ্কের দাগ খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু শ্রেয়ার অতীত ছিল স্বচ্ছ কাঁচের মতো, একদম পরিষ্কার। রাহুল পড়ল এক গভীর দ্বিধাদ্বন্দ্বে। একদিকে তৌফিক তার ছোটবেলার বন্ধু, বিপদে-আপদে সবসময় পাশে থাকে। তাকে বাসায় আসতে বারণ করলে সে নিশ্চিত ভাবেই মন খারাপ করবে। অন্যদিকে, শ্রেয়া তাকে সহ্যই করতে পারে না। যদিও শ্রেয়া একটা সমাধান দিয়েছিল,
– “তুমি ওদেরকে বাসায় নিয়ে আসো, এতে আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ওরা যতক্ষণ বাড়িতে থাকবে, আমি ঘর থেকে বের হবো না। আর যদি খুব বেশি জোর করো, তাহলে আমি সেদিন বাবার বাড়ি চলে যাব।”
রাহুল কোনো উত্তর দিতে পারে না। কিন্তু তার মনের ভেতর এক অদ্ভুত চিন্তা ঘুরপাক খায়, আচ্ছা, এমন কি হতে পারে যে শ্রেয়া আর তৌফিক আগে থেকেই একে অপরকে চেনে? এমন কোনো অতীত ঘটনা, যার কারণে শ্রেয়া ভয়ে তৌফিকের সামনে আসতে চায় না? কোনো কূলকিনারা খুঁজে পায় না সে।
এদিকে, তৌফিকের বাসায় আসা-যাওয়া যেন আরও ঘন ঘন হতে লাগল। একদিন রাহুল প্রায় জোর করেই শ্রেয়াকে তৌফিকের সামনে নিয়ে এলো। সেই মুহূর্তে, সেই অ*পমান আর অসহায়ত্বের ক্ষণে, শ্রেয়ার মনে রাহুলের জন্য এক তীব্র ঘৃ*ণার জন্ম নিল।
তৌফিক শ্রেয়াকে আপাদমস্তক জরিপ করে বলে উঠল,
– “বাহ্ দোস্ত! ভাবি তো দেখতে দারুণ সুন্দর! মনে হচ্ছে যেন আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো পরী!”
কথাটা একটা ব*র্শার মতো শ্রেয়ার বুকে এসে বিঁ*ধল। সে পাথরের মতো চুপ করে রইল। সেদিনও সে কোনো প্রতিবাদ করল না। কিন্তু এরপর থেকে শুরু হলো নতুন উপদ্রব। তৌফিক প্রায়ই দুই-একদিন পর পর, বিশেষ করে রাহুল বাসায় না থাকাকালীন সময়ে, এসে হাজির হতো। কিন্তু শ্রেয়া কখনো দরজা খুলত না, ভেতর থেকেই জানিয়ে দিত যে রাহুল বাসায় নেই।
এই কথা রাহুলকে জানালে, সে নির্বিকারভাবে বলল,
– “আসলে ও আমার মতো তোমার সাথেও একটু ফ্রি হতে চায়। এতে সমস্যা কী?”
– “তুমি কি পুরুষ?” শ্রেয়ার কণ্ঠস্বর ছিল বরফশীতল।
– “কী সব আ*জেবা*জে বকছো?”
– “তা নয়তো কী বলব? কেমন পুরুষ তুমি যে নিজের বউকে বন্ধুর সাথে লেলিয়ে দিতে চাও?”
– “দেখো, ও শুধু ফ্রি হতে চাইছে, এর বেশি কিছু না।”
– “তার মানে তুমি চাও আমি সবার সাথে ফ্রি মাইন্ডে চলি, তাই তো?”
– “হ্যাঁ, এখন তো সবাই এটাই চায়।”
– “তাহলে বিয়ের আগে এত পর্দাশীল মেয়ে খুঁজছিলে কেন? কোনো মডার্ন মেয়েকে বিয়ে করলেই তো পারতে! যাইহোক, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তুমি যেমনটা চাইছো, আমি ঠিক তেমনটাই করব। আর হ্যাঁ, তোমার বন্ধুর চাহনি মোটেও ভালো না। দেখেই বোঝা যায়, সে একটা চরিত্রহীন লোক।”
– “ও ফ্রি হতে পারে, কিন্তু ওর চরিত্র খারাপ নয়।”
– “আচ্ছা।”
সেই আচ্ছা শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে ছিল এক ভয়ংকর ঝড়ের পূর্বাভাস। শ্রেয়া এক প্রকার জে*দ করেই নিজেকে বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। সে তার বান্ধবী রুহির সাথে সবটা শেয়ার করেছিল। রুহি তাকে পরামর্শ দিয়েছিল,
– “ওদের জন্য নিজেকে এভাবে বদলে না ফেলে, বিষয়টা তোর বাবা-মা বা রাহুলের বাবা-মাকে জানা। কারণ তুই যেটা করতে চাইছিস, এটা অনেক বড় একটা পাপের পথ।”
– “যেখানে আমার স্বামীই আমাকে পাপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সেখানে আমার আর কী করার আছে, বল? তবে রাহুলকে একটা শিক্ষা আমাকে দিতেই হবে। আর সেই সাথে এমন কিছু করতে হবে, যাতে তৌফিক আর কোনোদিন কোনো বিবাহিত নারীর দিকে তাকাতেও ভয় পায়।”
শ্রেয়ার ভেতরের সেই শান্ত, লাজুক মেয়েটি সেদিন ম*রে গেল। যে তার সম্মান আর আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য যেকোনো পথ অবলম্বন করতে প্রস্তুত। সে এক বি*পজ্জনক খেলায় নামার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিল।
চলবে…..!