#সন্দেহের_কাঁটা।
পর্ব:- দুই।
লেখা:- সিহাব হোসেন
শ্রেয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে ঢুকল। রাহুল চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছে। শ্রেয়া তার পাশে বসে নরম স্বরে বলল,
– “কোনো বিষয় নিয়ে টেনশন করে প্রেশার বাড়িয়ে ফেলেছ, তাই না?”
– “আমার টেনশনে তোমার কী আসে যায়?”
– “আসে যায়, কারণ আমি তোমার স্ত্রী।”
রাহুলের খুব ইচ্ছে করল চিৎকার করে বলতে, “এই পাপী মুখে ‘স্ত্রী’ শব্দটা উচ্চারণ করতে তোর লজ্জা করে না?” কিন্তু সে কোনোমতে নিজের রাগটা গিলে ফেলল। শ্রেয়া বলল,
– “তুমি ভালো করে শুয়ে পড়ো। আমি তোমার মাথায় পানি ঢেলে দিচ্ছি, আরাম পাবে।”
– “লাগবে না আমার।”
এবার শ্রেয়ার কণ্ঠস্বর বদলে গেল। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
– “এক কথা কিন্তু আমার বার বার বলতে ভালো লাগে না।”
রাহুলের অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে শুয়ে পড়ল। শ্রেয়া বাথরুম থেকে একটা বড় বালতি টেনে আনতে লাগল। ভারী বালতিটা টানতে গিয়ে তার ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। সে খুব যত্ন করে, ধীরে ধীরে রাহুলের মাথায় পানি ঢালতে শুরু করল।
রাহুল চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, কিন্তু তার ভেতরের পৃথিবী তোলপাড় করছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। যে নারী কিছুক্ষণ আগেই তার বন্ধুর সাথে পার্কে বসে হাসাহাসি করে এল, তার চোখেমুখে কোনো অপরাধবোধ নেই, অনুশোচনা নেই। বরং এখন সে পরম মমতায় তার সেবা করছে! এই যত্নের মানে কী? এটা কি তার অপরাধ ঢাকার নিখুঁত অভিনয়, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো গল্প আছে? তৌফিকের সাথে দেখা করার ব্যাপারটা তো মিথ্যা নয়, তার ফোনে তার প্রমাণও আছে। তাহলে শ্রেয়ার এই দ্বৈত রূপের রহস্যটা কী? রাহুলের ঝাপসা চোখের সামনে সবকিছু আরও বেশি ঘোলাটে হয়ে গেল।
শ্রেয়া পরম যত্নে রাহুলের মাথা মুছে দিল। তারপর নরম কণ্ঠে বলল,
– “তুমি শুয়ে থাকো। আমি রান্না করে আনছি।”
শ্রেয়া চলে যাওয়ার পর রাহুল বিছানায় এলিয়ে পড়ল। তার চিন্তার জগৎ তখন ভীষণ বিক্ষুব্ধ। একটা বিষয় সে কিছুতেই মেলাতে পারছিল না,শ্রেয়া যদি সত্যিই অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়ায়, তবে তার এতটুকু যত্ন করার কথা নয়। বরং সে বিরক্ত হতো, এড়িয়ে চলতো। অথচ কিছুক্ষণ আগে যখন শ্রেয়া তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল, রাহুলের কোনো অস্বস্তি হয়নি; বরং অদ্ভুত এক প্রশান্তি ঘিরে ধরেছিল তাকে। এই স্বস্তি আর সন্দেহের দ্বন্দ্বে ক্লান্ত হয়ে সে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল, টেরও পেল না।
ঘুম ভাঙল কপালে এক নরম, উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শে। চোখ মেলে রাহুল দেখল, শ্রেয়া তার মাথার কাছে বসে আছে। মুখে লেগে আছে স্নিগ্ধ এক হাসি, মাথাটা ওড়নায় ঢাকা। ঠিক যেন তার সেই পুরনো লাজুক শ্রেয়া। তার এই রূপ দেখে রাহুলের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। শ্রেয়া আলতো করে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
– “চলো, এবার খেয়ে নাও।”
রাহুল কোনো কথা না বলে যন্ত্রচালিতের মতো উঠে বসল। শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, সে নামাজ সেরে উঠেছে। রাহুল ভাবতে লাগল, মেয়েরা এত নিখুঁত অভিনয় করে কীভাবে? কিন্তু সে কি সত্যিই অভিনয় করছে? তার মনটা বারবার জানতে চাইছে, কেন শ্রেয়া এমন করছে? কেন তাকে ঠ*কিয়ে তার বন্ধুর সাথে সময় কাটাচ্ছে? কিন্তু সরাসরি প্রশ্ন করতেও তার মন সায় দিচ্ছে না। কারণ, শ্রেয়া জানে রাহুল তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। এই প্রশ্নটা করলে সেই বিশ্বাসের দেওয়ালে প্রথম ফা*টল ধরবে। কিন্তু শ্রেয়া যা করছে, তা তো সরাসরি বিশ্বাসঘা*তকতা! এই চিন্তার স্রোতে ভাসতে ভাসতে সে খেতে গেল।
রাতে দুজন পাশাপাশি শুয়ে আছে। আজ শ্রেয়ার হাতে ফোন নেই। রাহুল অবাক হয়ে খেয়াল করল, আজ সারাদিন সে শ্রেয়াকে একবারও ফোন হাতে নিতে দেখেনি। বরং সে যথাসম্ভব রাহুলকে সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করছে। রাহুল কিছু একটা বলতে যাবে, ঠিক তার আগেই শ্রেয়া তার বুকের ওপর উঠে এল। তার চোখে গভীর আবেদন। সে রাহুলের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে দীর্ঘ সময় নিয়ে এক গভীর চুম্বনে ডুবিয়ে দিল। তারপর ঠোঁট সরিয়ে, রাহুলের চোখের দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে ফিসফিস করে বলল,
– “আমার এই চুমুতে কি কোনো অভিনয় দেখতে পাচ্ছো?”
রাহুল চমকে উঠল। সে তো এতক্ষণ এটাই ভাবছিল! শ্রেয়া এত সহজে তার মনের কথা পড়ে ফেলল! শ্রেয়া আলতো করে তার নাকে নাক ঘষে বলল,
– “এই শ্রেয়া চৌধুরী রাহুল ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসে না, আর বাসবেও না। কথাটা মনে রেখো।”
এই বলে শ্রেয়া পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। তার এই অদ্ভুত আচরণ, এই রহস্যময় কথা, রাহুলের কাছে সবকিছু গোলক ধাঁধার মতো মনে হতে লাগল। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে এটুকু নিশ্চিত হলো, শ্রেয়া যা-ই করছে, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো গভীর কারণ আছে। তাকে এভাবে একতরফা দোষ দেওয়াটা হয়তো ঠিক হবে না। রাহুল সিদ্ধান্ত নিল, এবার তাকেও মাঠে নামতে হবে। সত্যটা তাকেই খুঁজে বের করতে হবে।
পরদিন রাহুল কারখানায় বসে ব্যবসার হিসাব-নিকাশ করছিল। এমন সময় আসিফ এসে তার সামনে বসল। তার মুখে চাপা উ*ত্তেজ*না।
– “ভাই, তৌফিক ভাইয়ের একটা গোপন কাহিনি জানতে পেরেছি।”
রাহুল অবাক হয়ে বলল,
– “কী কাহিনি?”
– “আশেকপুরে এক বিধবা মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিল। মেয়েটাকে বিয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে তার সাথে অনেকবার ঘনিষ্ঠ হয়। ফলস্বরূপ, মেয়েটা গর্ভবতী হয়ে পড়ে। তখন তৌফিক বাচ্চাটা নষ্ট করতে বলে। কিন্তু মেয়েটা তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিলে এলাকায় বিশাল ঝামেলা শুরু হয়। শেষে তৌফিক সব দোষ মেয়েটার ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে গ্রামছাড়া করে।”
– “মেয়েটা কি বাচ্চাটা ন*ষ্ট করেছিল?”
– “তা জানি না, ভাই। ওই ঘটনার পর থেকে মেয়েটার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। এজন্যই তো বলি, আপনি ওই লোককে বাসায় তুলবেন না। সে আপনার বন্ধু হয়ে আপনার পিঠেই ছু*রি মা*রবে।”
রাহুল মনে মনে বলল, “ছু*রি তো সে অলরেডি মেরে দিয়েছে।” শ্রেয়ার ওপর থেকে তার সন্দেহ পুরোপুরি যায়নি, কিন্তু সে কেন তৌফিকের সাথে মিশছে, সেই রহস্যটা আরও ঘনীভূত হলো।
ঠিক তখনই কারখানার দরজায় ছায়ার মতো এসে দাঁড়াল তৌফিক। যে বন্ধুকে সে ভাইয়ের মতো বিশ্বাস করত, সে তার সাথে এত বড় বেইমানি করেছে ভেবে রাহুলের নিজের ওপরই তীব্র রাগ হলো। তৌফিক এসে তার সামনে বসে একগাল হেসে বলল,
– “কী বন্ধু, দিনকাল তো বেশ ভালোই যাচ্ছে! ভাবির মতো একটা সুন্দরী বউ পেয়েছিস। এমন বউ থাকলে দিন সুন্দর না হয়ে কি উপায় আছে?”
– “আজকাল দেখছি আমার বউয়ের একটু বেশিই প্রশংসা করছিস। ব্যাপার কী?”
তৌফিকের মুখের হাসিটা কেমন যেন মিলিয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল,
– “আরে, সুন্দর জিনিসের প্রশংসা করা তো স্বাভাবিক।”
– “আমার বউয়ের দিকে নজর দিস না। এর চেয়ে বরং নিজে একটা বিয়ে করে নে, তারপর সারাদিন বউয়ের প্রশংসা করিস। অনেক সওয়াব হবে।”
– “তোর বউয়ের মতো কাউকে পেলে তবেই করব। আর যদি চাস, তো তোর বউকে আমার হাতে তুলে দে!”
কথাটা শোনামাত্র রাহুলের র*ক্ত মাথায় চড়ে গেল। তার হাতের মুঠি শক্ত হয়ে এল। তৌফিক পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে হো হো করে হেসে উঠে বলল,
– “আরে বেটা, মজা করছি! সিরিয়াসলি নিস না। আচ্ছা, আসি তাহলে।”
তৌফিক চলে গেল, কিন্তু তার বলা কথাটা রাহুলের কানে বাজতে থাকল। রাহুল বুঝতে পারল, এটা কোনো মজা ছিল না। এটা ছিল তার ভেতরের নোংরা ইচ্ছারই এক নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ।
বাসায় ফিরে রাহুলের মনটা ছটফট করছিল। তৌফিকের বলা নোংরা কথাগুলো তার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে আর স্থির থাকতে পারল না। সোজা শ্রেয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল এবং তৌফিকের বলা কথাটা তাকে জানাল। সে ভেবেছিল, শ্রেয়া হয়তো রেগে যাবে, কষ্ট পাবে। কিন্তু যা হলো, তা তার কল্পনারও বাইরে ছিল।
রাহুলের কথা শুনে শ্রেয়া হাসতে লাগল। সেই হাসিতে ছিল এক অদ্ভুত রহস্য, যা রাহুল পড়তে পারল না। হাসি থামিয়ে শ্রেয়া বলল,
– “সে তো ঠিক কথাই বলেছে। সুন্দর জিনিসের প্রশংসা করাটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?”
– “তার মানে ওর মুখে প্রশংসা শুনতে তোমার ভালো লাগে?”
– “কেন লাগবে না? শুধু আমার নয়, যেকোনো মেয়ের সৌন্দর্যের প্রশংসা যদি কোনো পুরুষ করে, তখন সে খুশি হবেই।”
– “তার মানে, তুমি ওর প্রশংসা পাওয়ার জন্যই সে বাসায় এলে এভাবে সেজেগুজে থাকো?”
– “অবশ্যই!”
– “তুমি তো আগে এমন ছিলে না! তাহলে এখন এসব কেন করছো, শ্রেয়া?”
রাহুলের এই অসহায় প্রশ্নটা শুনে শ্রেয়ার মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। তার চোখ দুটো কঠিন হয়ে উঠল। সে দাঁতে দাঁত চেপে শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলতে লাগল,
– “বিয়ের পর থেকে আমাকে কখনো কোনো বাইরের পুরুষের সাথে মিশতে দেখেছো?”
– “না।”
– “তোমার বন্ধুরা বাসায় এলে আমি তাদের সামনে যেতে না চাইলে, কে আমাকে জোর করত?”
এই প্রশ্নটা শোনার সাথে সাথে রাহুলের সমস্ত তেজ নিভে গেল। সে যেন অতল গভীরে তলিয়ে গেল। ধপ করে বিছানার ওপর বসে পড়ল সে। শ্রেয়া তার পাশে এসে বসল। তার ঠোঁটের কোণে এবার ফুটে উঠল এক বাঁকা হাসি। সেই হাসিতে ছিল করুণা, ছিল দীর্ঘদিনের জমানো ক্ষো*ভ। শ্রেয়া বলতে শুরু করল,
– ” প্রথম যেদিন তৌফিক আমাদের বাসায় এলো, মনে আছে তোমার? আমি দূর থেকে তোমার হাতেই ওদের জন্য খাবার পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি এক প্রকার জোর করে আমাকে টেনেহিঁচড়ে ওদের সামনে নিয়ে এলে। সে এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিল, যেন আমাকে গিলে খাবে। আমি সেদিন দৌড়ে ঘরে পালিয়ে এসেছিলাম। রাতে যখন তোমাকে বললাম, তৌফিকসহ তোমার বন্ধুদের আর বাসায় এনো না, ওদের কারও চাহনি আমার ভালো লাগেনি, তখন তুমি রেগে গিয়ে কী বলেছিলে, মনে আছে?”
রাহুলের চোখের সামনে সেই রাতের দৃশ্যটা স্পষ্ট ভেসে উঠল। তার নিজের বলা কথাগুলোই যেন তার কানে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। সে সেদিন রা*গে ফেটে পড়ে শ্রেয়াকে বলেছিল,
– “তুমি সাধারণ একটা বিষয়কে এত সিরিয়াসলি নাও কেন? ওরা তোমার প্রশংসা করছিল, এটাকে খারাপভাবে নেওয়ার কী দরকার? তোমার মনে যদি কোনো খারাপ চিন্তা না থাকে, তাহলে ওদেরকে ভালোভাবে নিতে সমস্যা কোথায়?”
নিজের বলা সেই কথাগুলো আজ রাহুলের কাছে বি*ষাক্ত তী*রের মতো মনে হলো। সে বুঝতে পারল, যে পরিবর্তনের বীজ সে আজ দেখতে পাচ্ছে, তা সে নিজের অজান্তেই, নিজের হাতেই রোপণ করেছিল। শ্রেয়ার এই বদলে যাওয়ার পেছনে যে তারই ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, এই কঠিন সত্যটা আজ তার সামনে উন্মোচিত হলো। সে বোবার মতো শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে রইল, তার বলার মতো কোনো শব্দই আর অবশিষ্ট ছিল না।
চলবে…..!