#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#পর্বঃ১০
বিয়ের বেশ কিছু মাস পর সাদিকের দাদাবাড়ি যাওয়ার সৌভাগ্য হলো অহনার। গেলো, ফরিদা, খলিল সাহেব আর অহনা। সাদিকের যাওয়ার কথা দুইদিন পর। সবাই যাওয়ার একটাই কারণ, সাদিকের দাদী অসুস্থ। এই সময় নাতবৌকে দেখতে চেয়েছেন। নাহলে ফরিদা কখনোই অহনাকে নিয়ে যেতো না। অহনা এতোকিছু জানতো না। ওর ধারণা মতে সব এখন ঠিক। বিরাট এই ভুল ধারণা ভাঙলো গ্রামে পৌঁছানোর পর। সবাই বিরক্ত আর ব্যাজার মুখে গ্রহন করলো ওকে। বিশেষ করে সাদিকের কাজিনরা। ওকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে চলে গেলো। বেশ মন খারাপ হলো তার। চুপচাপ থাকার কারনে ওর নিজের কাজিনদের সাথেও তেমন ভালো সম্পর্ক না। সবাই আড্ডা দিলে ওকে সেখানে কখনও নিতেই চাইতো না। বলতো, অহনা গেলেই পরিবেশ ভারী হয়ে যায়। আবার ঘুরতেও নিয়ে যেতো না। নিজে কখনও এমন প্রাণখোলা হাসি হাসে না জন্য আড্ডার মাঝে সবার প্রাণখোলা হাসি দেখতে তার দারুন লাগে। সবাই কত মিল দিয়েই না থাকে!
এ বাড়ির সকলে ঠিক তেমনই প্রাণোচ্ছল, দূরন্ত। অহনা দূর থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখে তাদের। সিদ্দিকার কথায় দুই তিনবার ওদের সাথে গিয়ে বসে ছিলো। আগ্রহ ছিলো মিশে যাওয়ার। কেউ এগিয়ে আসলে হয়তো চেষ্টা করতে পারতো কিন্তু ওরা কেউ ওকে সহ্যই করতে পারে না। অহনা ওদের সাথে বসতেই তাদের আলোচনায় ভাটা পরে। সবাই অস্বস্তি নিয়ে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। সব বুঝতে পারে অহনা। উঠে চলে যায় বড়দের কাছে আর নাহলে রান্নাবান্নায় সাহায্য করে।
ইয়াং জেনারেশনের সকলে ঘুরতে যাবে। বেশ ঘটা করে প্ল্যান করা হলো। ওদের যাওয়ার আসল কারনটা অহনা জেনেছে। মৌলির মন ভালো করতে যাবে সকলে। কারো মন খারাপের জন্য এতো মানুষ উদ্ধিগ্ন হয়ে যায় সেটা জানা ছিলো না তার। তাই যখন সিদ্দিকা ওদের সাথে যেতে বলল তখন বেশ আগ্রহ নিয়েই রাজী হলো। ইচ্ছা ছিলো, দেখার যে কিভাবে মন ভালো করে। তার সাথে যে এমন হবে না সেটা ও জানে। তাই দেখতে চাইলো মন দিয়ে৷ এই আগ্রহ যে চুপচাপ থাকা অহনার জন্য এক বিরাট শিক্ষা যে হয়ে যাবে তা তার কল্পনাতেও আসেনি।
অহনা সাথে যাওয়ায় সবাই মুখ ভাড় করে গেলো। বড়দের জন্য না চাইতেও যেতেই হলো। তবে ডেস্টিনেশন বদলালো। সিদ্ধান্ত হলো, এমনিতেই গাড়িতে ঘুরবে আর টি-স্টলে সবাই মিলে চা খাবে। একসময় অহনার বাবা খুব চা খেতেন। তার সাথে অহনাও খেতো। বাবা চলে যাওয়ায় এই শখটা বাদ দিতে হয়েছে। আজ চা খাওয়ার কথা শুনে মনে মনে খুব খুশি হলো। ইচ্ছে তো হচ্ছিলো দুই কাপ চা খাওয়ার। কিন্তু এদের সামনে বলতে লজ্জা করবে জন্য সিদ্ধান্ত নিলো, এক কাপই খাবে।
বড় গাড়িতে উঠে সবাই হইহই করতে করতে পুরো রাস্তা গেলো। অহনা নামক প্রাণীকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করাই ছিলো ওদের প্রধান উদ্দেশ্য। রাত হয়ে যাওয়ায় গাড়ি থামালো শুনশান এক চায়ের দোকানের সামনে। এক মহিলার দোকান সেটা। পাশেই এক বড় ছাউনি আছে। ওখানে বসেই চায়ের অর্ডার দেওয়া হলো। এদের মধ্যে সবার বড় নিধি। সবার মধ্যে একমাত্র নিধিই ছিলো নিষ্ক্রিয়। অহনার প্রতি না ভালো লাগা আছে আর না বিদ্বেষ আছে। সবার পছন্দের চা যখন জিজ্ঞাসা করা হচ্ছিলো তখন অহনাকে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন মনে করে বলল,
–অহনা, চা খাবে?
নিধি সাদিকের সমবয়সী হওয়ায় অহনাকে নাম ধরেই ডাকলো। অহনা দুধ চা খুব পছন্দ করে৷ অনেকক্ষণ নিজের মনে মনে প্র্যাকটিস করে দুধ চা বলতে চেয়েছিলো, তার আগেই মৌলি মুখ বেঁকিয়ে বলল,
–ছেলেদের মাথা খেতে বলো আপু, খুব সুন্দর করে খেয়ে ফেলবে।
সবাই উচ্চশব্দে হেসে উঠলো। সবার কাছে এটা বিরাট মজা ছিলো। অহনার মুখ তেঁতো হয়ে গেলো। চা খাওয়ার ইচ্ছা চিরজীবনের মতো বাতিল হলো বলেই মনে হলো। খাবে না বলতে চাইলো কিন্তু তার আগেই সায়রা টিটকারি দিয়ে বলল,
–তোরা সবাই সাবধানে থাকিস। বলা যায় না, সাদিক ভাইয়ের থেকে মন উঠে গেলে তোদের পিছে লাগতে পারে।
ছেলেদের উদ্দেশ্য ছিলো কথাগুলো। এবারেও একে অপরের গায়ে পরে হেসে উঠলো সকলে। লজ্জায় অপমানে মাটিতে মিশে যেতে মন চাইলো অহনার। নিধি ধমক দিয়ে বলল,
–তোরা চুপ করবি?
চাপা স্বরে হেসে উঠলো সকলে। অহনা একটু দূরে গিয়ে বসলো। এই ঘটনার পর না চা খেতে চাইলো আর না কেউ একবার জিজ্ঞাসা করলো। সময় গড়িয়ে যেতেই মৌলি হঠাৎ কেশে উঠলো। শ্বাস আটকে আটকে আসতে লাগলো তার। সবাই বিচলিত হলো খুব। অহনা ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর অবাক হয়ে দেখলো, সবাই ওকে ফেলেই গাড়িতে উঠে গেলো। কাছে যাওয়ার সময়টুকুও পেলো না, তার আগেই গাড়ি চালিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেলো। অহনা শূণ্য দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলো শুধু। হাতে না আছে মোবাইল আর না আছে টাকা। চা দোকানের মহিলাটিও অবাক হয়ে গেলো। কৌতুহলী হয়ে অহনাকে বলল,
–তুমি ওগোর সাথে আসো নাই?
অহনা ছলছল চোখে মাথা উপরনিচ করে বলল,
–এখন আমি যাবো কিভাবে?
মহিলাটিকেও বেশ চিন্তিত দেখালো। আকাশের অবস্থা ভালো না। ছোট সমাধান দিয়ে বলল,
–গাড়ি দাঁড় করামু? যাইবা?
অহনা বারংবার ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল,
–আমি ঠিকানা জানি না।
মহিলাটি আফসোসে মাথা নেড়ে বলল,
–আহারে জালিম লোক! তুমি এইখানে থাকো। কারুর না কারুর তো তোমার কথা মনে পড়বোই। তখন খুঁজতে আসবিনে।
অহনা নীরবে ছাউনির নিচে বসলো। আকাশের অবস্থা হঠাৎই বিগড়ে গেলো। শো শো বাতাসে ধূলা উড়তে লাগলো। মহিলাটি দোকান বন্ধ করে এসে বলল,
–আমার বাড়ি দুইপা হাঁটলেই। আমার সাথে বাড়িত চলো।
অহনা মাথা নেড়ে বলল,
–কেউ এসে যদি আমাকে না পায় তাহলে আবার ফেলে চলে যাবে।
অহনার মুখে অসহায়ত্বের ছাপ দেখা যাচ্ছে। মহিলাটি আফসোস করে বলল,
–ঝড় হইবো রে। আমি আর থাকবার পারমু না। ওইযে আমার ঘর দেখা যায়। সমস্যা হইলে চইলা আইসো।
অহনা ভয় পেলেও কারো কষ্টের কারণ হতে চাইলো না।।ঘাড় কাত করে সায় জানিয়ে যেতে দিলো।
মৌলির অসুস্থতার খবর বাড়ির সবার কাছে পৌঁছে গেছে। সাদিক এসে পড়ায় ওর কাছেও এসেছিলো। অহনা ওদের সাথে যাওয়ায় এমনিতেও আসতে চেয়েছিলো তাই এখন মৌলির খবর শোনায় আর দেরি করলো না। চলে গেলো হসপিটালে। মৌলির সামান্য শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো। ডক্টর মেডিসিন দিতেই ঠিক হয়ে গেলো। সাদিক আসলো ঝড় আসার ঠিক আগে আগে৷ এসে পরিস্থিতি দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। হসপিটালে সবাই আছে কিন্তু অহনাকে কোথাও পাওয়া গেলো না। কপাল কুঁচকে গেলো সাদিকের। ভারিক্কি স্বরে বলল,
–অহনা কোথায়?
কথায় রাগ স্পষ্ট। সকলেই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। গাড়িতে ওঠার সময় অহনার কথা ওদের কারো মনে ছিলো না। কিছুদূর যাওয়ার পর মনে পরলেও ফিরতে মন চায়নি কারোরই। হসপিটালে এসেও সকলে আলোচনা করেছে, কিভাবে বাড়িতে ম্যানেজ করবে। এখন সাদিকের সামনে মুখে জড়তা এসে গেলো।। সজীব সাহস করে বলল,
–ভাই, মৌলির শরীর খুব খারাপ। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিলো।
সাদিক চোখ পাকিয়ে ধমকে উঠল,
–আমি বলছি অহনা কোথায়? ও তো তোদের সাথেই এসেছিলো। কোথায় রেখে এসেছিস?
রিকু ভয়ে আমতা-আমতা করে বলল,
–ভাই, ভাবী বোধহয় ওখানেই আছে। মৌলির এতো শরীর খারাপ ছিলো যে অন্য কারো দিকে নজর দেওয়ার সময়ই হয়নি। ভাবীর তো উচিত ছিলো আমাদের সাথে আসা। আমাদের মনে ছিলো না জন্য কি নিজেরও একটু জ্ঞান থাকবে না!
সব দোষ অহনাকে দিয়ে দিলো। সাদিক ক্রোধে জর্জরিত ভয়ংকর স্বরে বলল,
–কোথায় গেছিলি তোরা?
সাদিকের গর্জে ওঠা স্বরে তোতলাতে তোতলাতে মিরাজ জায়গা সম্পর্কে বলল। সাদিক সাথে সাথে যেতে চাইলেই সায়রা বাঁধা দিয়ে বলল,
–বাইরের অবস্থা তো ভালো না ভাইয়া। খুব বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি একটু থামুক তারপর যেও।
সাদিক ভয়ংকর চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, অবস্থা খুব খারাপ। আর এই অবস্থায় তোরা ওকে ফেলে এসেছিস। দোহাই দিচ্ছিস, মনে নেই। আমি দুধের শিশু না যে বুঝবো না কিছু। এরপর থেকে আমার ওয়াইফের থেকে শত মাইল দূরে থাকবি।
স্পষ্ট ভাবে সতর্ক করে চলে গেলো সাদিক। এই নীরব, নির্জন হসপিটালের করিডরে বসে সবটাই দেখলো মৌলি। ভালোবাসা কি সত্যিই এতো তাড়াতাড়ি বদলায়!
সাদিক ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে রিক্সা নিয়ে ছুটলো অহনার কাছে। দূরত্ব বেশি না হলেও ঘটনার ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। অতি দ্রুত যেতে হবে সেখানে। অহনা ওখানে ওভাবেই রয়েছে। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। কি হবে যদি অন্য কোন লোক এসে যায় কিংবা খারাপ কেউ আসে? কি করবে তখন! নিজেকে প্রটেক্ট করবে কিভাবে! হতাশ হলো চরমভাবে। অন্ধকারে নিভৃতে বসে নিজের পরিনতি ভেবে শিউরে উঠলো। ও কি সত্যিই আবার ছাদ হারা হলো!
অহনার আশার প্রদীপ যখন নিভু নিভু তখন সাদিক আসলো পূর্ণ আলো নিয়ে। তাকে দেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো অহনা। সাদিকের ভেজা শরীর আকড়ে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আগলে ধরে রাখলো সাদিক৷
ওখান থেকে আর গ্রামের বাড়ি ফিরলো না তারা। রিক্সা চেপে বাসস্ট্যান্ডে গেলো। এরপর রাত এগারোটার বাসে সোজা নিজের বাসা। বিয়ের প্রথম রাতের মতো আবার তারা পাশাপাশি বসা তবে অহনার পাশে মানুষটা এবার ওর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকেনি। তাকে দেখেছে, বোঝার চেষ্টা করেছে, ভালোবাসার চেষ্টা করেছে। কিন্তু, এভাবে কি চেষ্টা করে ভালোবাসা হয়!
****
সাদিক গভীর মনোযোগে মাহাদীর ছোট থেকে এতো বড় হওয়ার ছবি ভিডিও দেখছে। অহনা যার কাছে থেকেছে সেই দাদী নাকি মাহাদীর জন্মের পর স্মার্টফোন কিনেছিলো শুধুমাত্র বাচ্চার ছবি, ভিডিও করবে বলে৷ এতো বয়সেও সুন্দরভাবে সব শিখে গেছিলো। মাহাদীর প্রতিটা পদক্ষেপের ছবি সেখানে আছে। কোনটাতে চোখ বুজে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে তো কোনটাতে হাত পা ছুড়ে খিলখিল করে হাসছে। একটাতে আবার চোখ মুখ ফুলিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ছবিটা দেখে অহনা বলল, প্রথমবার ইঞ্জে’কশ’ন দেওয়ার পর কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরেছিলো মাহাদী। এটা সেই সময়কার ছবি। ছবি দেখা শেষে ভিডিও দেখলো। খাওয়ার ভিডিও, গোসলের ভিডিও, বসা শেখার ভিডিও, হামাগুড়ি দেওয়ার ভিডিও দেখ প্রতিটা বাচ্চার জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মোমেন্টের ভিডিওটা দেখলো৷ বাচ্চার প্রথম স্টেপ। কতশত স্মৃতি বানানো যায় এই মোমেন্টটা নিয়ে৷ এরপরের ভিডিও ছিলো মাহাদীর প্রথম বাবা বলার ভিডিও। ভিডিওর ওপাশ থেকে অহনার সেই দাদীর মুখ বেঁকিয়ে বলা,
–তোর বাপ হলো বজ্জাদের হাড্ডি। বল, বজ্জাত বাপ।
এতোক্ষণ দাদীকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলেও এইটা বলার জন্য রাগ এসে জুড়ে বসলো। মাহাদী সাদিকের বুকের উপর শুয়ে ল্যাপটপে ছবি দেখছিলো। বাবার এই বেজ্জতি দেখে খিলখিল করে হেসে ফেললো। রাগে এই ছবিগুলো নিজের ল্যাপটপে কপি করে পেনড্রাইভ ফেরত দিলো অহনাকে৷ এরপর ছেলেকে নিজের পরিবারের লোকজনদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলো। প্রথমে তাদের ফ্যামিলি ফটো বের করে খলিল সাহেবকে দেখিয়ে বলল,
–এটা তোমার দাদু। কোন ডাবওয়ালা তোমার দাদু না।
শেষটায় বেশ রাগ ছিলো। মাহাদী গম্ভীরমুখে মাথা নাড়লো৷ সাদিক এরপর ফরিদা আর তাকে দেখিয়ে বলল,
–এটা দাদীমা আর এটা তোমার আব্বু।
মাহাদী মাথা তুলে চিন্তিত গলায় বলল,
–আব্বু? আম্মুর আব্বু তো আমি। তাহলে আমার আব্বু কে?
–তোমার আব্বু আমি।
মাহাদী ঠোঁট উলটে বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
–তুমি তো আমার বাবা।
সাদিক হেসে ফেলে বলল,
–বাবা আর আব্বু একই।
মাহাদী বোঝার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো৷ অহনা বিছানার এক কোনে বসে মাহাদীর জামা কাপড় খুব যত্ন নিয়ে ভাজ করছিলো। ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ মাহাদী একটা ছবি দেখিয়ে বলল,
–এটা কে?
–এটা তোমার চাচ্চু। এটা সজীব চাচ্চু, এটা রিকু চাচ্চু আর এটা মিরাজ চাচ্চু। চাচ্চু মানে কাক্কু।
এতো চাচ্চুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর ছেলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো, ছেলে চাচ্চু মানেই বোঝেনি। তাই মানে বুঝে দিলো। মাহাদী বিষ্মিয় হয়ে বলল,
–এতো কাকু!
–হুম। আর অনেক ফুপুও আছে। সায়রা ফুপু, নিধি ফুপু আর মৌলি ফুপু।
মৌলি নাম শুনেই তাকালো সাদিকের দিকে। সাদিক মনোযোগ দিয়ে ছেলেকে ফুপুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। অহনার কপাল কুঁচকে গেলো। সম্পর্ক শেখালে এমন ভুলভাল সম্পর্ক কেন শেখাচ্ছে? মৌলি ওর কোন জনমের ফুপু হলো?
হঠাৎ মাহাদী উত্তেজিত হয়ে বলল,
–তোমার হাতে এটা আছে। আম্মুর হাতে নেই কেনো?
ওর দৃষ্টি সাদিকের হাতের হীরার আংটির দিকে। সাদিক হালকা হেসে বলল,
–তোমার আম্মুর আমার দেওয়া জিনিস পছন্দ না। তাই ফেলে দিয়েছে।
মাহাদী অভিযোগ নিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। বাবার দেওয়া জিনিস ফেলে দিয়েছে কেন? অহনা তাকালো সাদিকের হাতের দিকে। আর ঠিক তক্ষুনি কিছু মনে পরে গেলো। প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে কাপল রিং উপহার দিয়েছিলো তাকে। এটা কি সেই রিং? ডিজাইন মনে পরছে না কেন! এটা কি তবে বাগদানের আংটি না? পিঠ বেঁকিয়ে ল্যাপটপে ছবিটা দেখতে চাইলো। সাদিক বুঝে ল্যাপটপ ওর দিকে সরিয়ে দিলো। ছবি দেখেই হকচকিয়ে গেলো সে। এটা তো সেই ছবিই। তার আর সাদিকের এই মূহুর্তের ছবি। তার আংটিটা তো ওই বাড়িতেই রয়ে এসেছে। তাহলে সাদিকের এনগেজমেন্ট রিং কোথায় গেলো! বিভ্রান্ত নিয়ে সাদিকের দিকে তাকায়েই ভ্রু নাচালো সে। এর মানে পরিষ্কার, নিজের মতো কথা ভেবে নিলে এমনই হয়! এই নিজের মতো কথা ভেবে নেওয়ার জন্য সাদিকের থেকে কত কথাই না শুনেছে সে। গর্দভ, ডাল, নির্বোধ আরো সুন্দর সুন্দর কথাবার্তা বলেছে তাকে। হকচকিয়ে মাহাদীকে কোলে বসিয়ে আস্তে করে বলল,
–আব্বু, ঔষধ খেতে হবে। খাবার আনবো?
মাহাদীর খেতে মন চাচ্ছে না। তাই ব্যাজার মুখে ঘাড় কাত করে হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তর্জনি অল্প ফাঁকা করে বলল,
–এইটুকু। বেশি না।
অহনা মৃদু হেসে খাবার আনতে গেলো। মাহাদীর জন্য বানিয়েছে কর্ণ স্যুপ। ভুট্টা, মাখন, ময়দা, পানি, লবণ আর সামান্য মরিচ দিয়ে। একটুখানি মুখে দিতেই মাহাদী চিৎকার করে উঠলো,
–ঝাল, ঝাল!
অহনা বিচলিত হয়ে উঠলো,
–ঝাল তো অল্প দিয়েছি।
সাদিক কপাল কুঁচকে মাহাদীর মুখ চেক করে বলল,
–মুখ ছিলে গেছে মনে হচ্ছে।
অহনার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো। তারপর মাহাদীকে কোলে বসিয়ে আস্তে করে বলল,
–দুধ আনি আব্বু? দুধ খেলে ঝাল লাগবে না।
মাহাদী মাথা নেড়ে বলল,
–খাবো না।
–একটু খাও?
–খাবো না।
বলতে বলতে কেঁদে ফেললো মাহাদী৷ অহনা সাদিক দুজনেই বিচলিত হলো। অহনা চিন্তিত স্বরে বলল,
–কি হয়েছে বাবা?
–আম্মু, ব্যাথা।
ব্যাথা অনেকক্ষন হলোই হচ্ছিলো তার। এতোক্ষণ সহ্য করলেও মায়ের আদর পেয়ে আর ঢেকে রাখতে পারলো না। ফোঁপাতে ফোঁপাতে হাত পা দেখাতে লাগলো। অহনা মাহাদীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইলো। সাদিক চিন্তিত স্বরে বলল,
–কি হয়েছে?
অহনা উত্তর না দিয়ে কাঁপা গলায় বলল,
–ওকে একটু রাখবেন? আমি দুধ গরম করে আনছি।
সাদিক মাথা নেড়ে মাহাদীকে কোলে নিয়ে পুরো ঘর পাইচারি করলো। নানান কথা বলে ব্যাথা থেকে মন ঘুরানোর চেষ্টা করলো। অহনা দুধ নিয়ে এসে জোর করে খাওয়ালো ছেলেকে। এরপর মেডিসিন বের করলো খাওয়ানোর জন্য। ওর মেডিসিন দেখে বিষ্মিত হলো সাদিক,
–এতো মেডিসিন সব মাহাদীর?
অহনা উত্তর না দিয়ে নিজের কাজ করতে লাগলো। সাদিক চোয়াল শক্ত করে অহনার হাত চেপে রাগী গলায় বলল,
–কিছু বলছো না কেন? কি লুকাচ্ছো তুমি?
অহনা চোখ নিচু করে আস্তে করে বলল,
–কাল বলবো। আজ না।
অহনার চোখ মুখের অবস্থা দেখে অজানা আতঙ্কে বুক কেঁপে উঠলো সাদিকের। আর প্রশ্ন করার সাহস করে উঠলো না। ঔষধ খাওয়ায় কিছুটা আরাম হলো মাহাদীর। আরাম হতেই বাবার কোলে ঘুমিয়ে পরলো। বিছানায় ওকে মাঝে শুইয়ে পাশে শুয়ে পরলো সাদিক। অহনা সরে যেতে চাইলে চোখ গরম করে শুতে ইশারা করে চোখ বুজলো। অহনা চুপচাপ শুয়ে পরলো। ঘুম তো তার এমনিতেও হবে না।
চলবে…