অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-০৯

0
2

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#পর্বঃ০৯

অহনার জ্বর এসেছে। থার্মোমিটারে মাপলে বোধহয় একশো তিনয়ের ঘর ছাড়িয়ে যেতো। ঔষধ খেয়ে কিছুই হয়নি। দুইদিন জ্বরে অমনি কাতরালো। মেয়েটার জ্বরে তাপা মুখ দেখে মায়া হলো ফরিদার। এই অবস্থায়ও ঘরের সব কাজ নিজ হাতে করছে। কোমড় আর পিঠ ব্যথা সহ্য করে সে নিজেও কিছু করতে চেষ্টা করে। এরমাঝে সাদিক আসলো হুট করে। গম্ভীর, চিন্তিত মুখ। অহনার অবস্থা দেখে মুখ আরো শুকিয়ে গেলো। ফরিদার থেকে জানতে পারলো, জ্বর দুইদিন হলো। তড়িৎ হসপিটালে নিয়ে গেলো অহনাকে। অহনাকে বসিয়ে সিরিয়াল দিতে গেলো। অহনা চুপচাপ বসে রইলো। ওর থেকে একটু দূরে একটা মেয়ে বসে আছে চুপচাপ। দৃষ্টি অহনার দিকে স্থির। অহনার আচমকা দৃষ্টি ওইদিকে যেতেই সে থমকালো। সুন্দর, টানা টানা চোখের মেয়েটাকে ও চেনে। এই চেহারা ভুলবার নয়। মৌলি! এসেছিলো বাড়িতে। মুখে ছিলো অবজ্ঞার হাসি। দুইমিনিট ওকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে চলেও গেছিলো। সুন্দর দেখতে মেয়েটির সাথে সাদিককে খুব সুন্দর মানাতো। কেউ একবার দেখলে আর নজরই ফেরাতে পারতো না। অহনার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। কাচুমাচু হয়ে বসে চোখ সরিয়ে ফেললো। সামনের ওই মেয়েটির দিকে তাকালে নিজেকে এতো অপরাধী যে লাগে! সাদিক হাতে পানির বোতল নিয়ে এসে অহনার সামনে দিয়ে বলল,
–এক ঘন্টার পরের সিরিয়াল।। এতোক্ষণ কি এখানে থাকবে নাকি একটু বাইরে হাঁটবে?

অহনা বোতল হাতে নিলো চুপচাপ। প্রশ্নের উত্তর আর দিলো না। টলটলে চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আবার মৌলির দিকে তাকালো। সাদিকের কপাল কুঁচকে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে অহনার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই দৃষ্টি আটকে গেলো মায়াবী চেহারাটার দিকে। একসময় যার চোখের দিকে তাকালে আর চোখ ফেরাতে পারতো না, আজ সেই চোখের দৃষ্টি থেকে বাঁচতে চোখ সরিয়ে ফেলল দ্রুত। মৌলির নজর অহনার দিক থেকে সরে সাদিকের দিকে গেছে। সাদিককে তার দিকে এক পলক তাকাতে দেখে স্মিত হেসে এগিয়ে আসলো। সাদিকের ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
–সুন্দরী বউ পেয়ে কাজিনকে ভুলে গেলে সাদিক ভাই? দেখেও না দেখার ভাণ করছো যে?

সাদিক চোখ সরিয়ে মৃদু গলায় বলল,
–ভুলিনি। কেমন আছিস?

মৌলি এক গাল হেসে বলল,
–অনেক ভালো। একদম রিল্যাক্সে আছি। ইদানিং নিজেকে খুব হালকা হালকা লাগে। পাখি টাখি হলাম নাকি বুঝতে পারছি না।

অহনা ব্যথিত চোখে দুইজনকে দেখে চোখ সরিয়ে নিলো। পাশাপাশি দাঁড়ানোয় কি সুন্দর লাগছে! নিজেকে এদের মাঝে পরগাছা মনে হচ্ছে৷ শরীরে বল থাকলে এক্ষুনি এদের মাঝ থেকে সরে যেতো। মৌলির পরের কথা ওর কানে শিশার মতো ঢুকলো,
–তোমার অল্প বয়সী মেয়ে পছন্দ তা তো জানতাম না? আর কি কি পছন্দ বদলেছে বলোতো? আচ্ছা ভালো কথা। এখানে কি প্রেগ্ন্যাসি টেস্ট করাতে এসেছো? এতো বড় খবর আমাদের থেকে লুকাচ্ছো তুমি? ভেরি স্যাড! আমাদের প্রথম ভাতিজা ভাতিজি। আর আমাদের থেকেই লুকাচ্ছো! সবাই শুনলে কত কষ্ট পাবে বলোতো?

কিসব কথাবার্তা বলছে! নিজেকে গুটিয়ে ফেলল অহনা। এখান থেকে সরার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে লাগলো। মৌলির কথায় সাদিকের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। কথা ঘুরিয়ে শক্ত গলায় বলল,
–তুই কি একাই এসেছিস?

মৌলি হা হা করে হেসে উঠলো। বলল,
–কি যে বলো! একা আসবো না তো কার সাথে আসবো? আমার তো আর হাবি নেই। থাকলে দেখা যেতো।

সাদিকের ধৈর্যের সীমা পেরিয়ে যাওয়ার আগেই চলে যেতে চাইলো। অহনার তপ্ত হাত শক্ত হাতে চেপে বলল,
–চলো অহনা, পরে আসা যাবে। এতোক্ষণ এখানে থাকতে হবে না। আমার কাজ আছে একটু।

অহনা সাদিকের আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে ওর বাহুর আড়ালে নিজেকে গুটিয়ে নিলো। মৌলি গালে হাত দিয়ে বিষ্মিত হওয়ার ভাণ করে বলল,
–আরে বাপরে! প্রেম দেখি উতলে উতলে পরছে! চিন্তা করো না সাদিক ভাই, তোমার বউকে আমি খেয়ে ফেলবো না। তুমি তোমার কাজ সেরে আসো৷ ততক্ষণ তোমার বউয়ের সাথে একটু আড্ডা দেই। ছেলে পটানোর টিপস নেই একটু।

সাদিক না কিছু বলতে পারছে আর না সইতে পারছে। অহনার হাত টান দিয়ে বলল,
–অহনা, লেটস গো।

অহনা একটু মৌলির সাথে কথা বলতে চায়। মৌলি সাদিকের সাথে খারাপ ব্যবহার করছে। ভুল বুঝছে তাকে। সত্যিটা জানাতে চাচ্ছে তাকে। সাদিকের হাত থেকে নিজের হাত টেনে বলল,
–আমি একটু থাকি।

সাদিক অহনার চোখে চোখ রেখে শক্ত গলায় বলল,
–থাকতে হবে না।

সিদ্দিকা আসলো দেখা। সাদিক আর অহনাকে দেখে অবাক হয়ে বলল,
–সাদিক, তোরা কখন আসলি?

মৌলি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ব্যঙ্গ করে বলল,
–তোমার ভাতিজা বউকে ছাড়া থাকতে পারে না মা। প্রতি সপ্তাহে ছুটতে ছুটতে চলে আসে।

সাদিক নিজের রাগ সামলাতে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। সিদ্দিকা চোখ গরম করে মৌলির দিকে তাকাতেই মৌলি হেসে বলল,
–সরি সরি! আমি এই থাকলাম ভাবীর কাছে৷ তোমরা ফুপু ভাতিজা কথা বলো। আমরা ননদ ভাবী কথা বলি।

বলেই অহনা যে চেয়ারে বসেছিলো, মৌলিও ঠিক সেই চেয়ারে বসে পরলো। সাদিক দুই পা পিছিয়ে গেলো। অহনা সাদিকের বাহু খামছে কান্না আটকালো। কান্না পাচ্ছে তার। এই অপরাধের বোঝে নিতে সে অপারগ। সাদিক ফুপুকে দেখে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে বলল,
–ফুপু, আমার একটা কাজ আছে। আধ ঘন্টার মতো লাগবে। আপনি একটু অহনাকে দেখেবেন প্লিজ।

সিদ্দিকা মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বলল,
–ঠিক আছে যা। চিন্তা করিস না।

সাদিক অহনাকে সিটে বসিয়ে চলে যেতেই গুটিয়ে বসলো অহনা। ভয়ে বুক কাঁপছে তার। সিদ্দিকা পাশে বসে টুকটাক কথাবার্তা বলল। খানিক পর মৌলির রিপোর্ট আসায় তাদের ছেড়ে রিপোর্ট আনতে গেল। আশেপাশে তেমন লোকজন নেই। অহনা চারপাশে নজর বুলিয়ে অনেক সাহস সঞ্চয় করে বিমর্ষ স্বরে বলল,
–মৌলি আপু, উনি আপনাকে খুব ভালোবাসে। আমি তো উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। ওনার সাথে এমন ব্যবহার করবেন না প্লিজ।

মৌলি মোবাইল রেখে ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসলো। তারপর পরিহাস করে বলল,
–বাবা! এতো ভালোবাসা! তো উড়ে এসে জুড়ে যখন বসেছো তখন আবার উড়ে গেলেই তো পারো। থাকতে কে বলেছে?

অহনা চোখ নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবলো,
–ঘর ছাড়া পাখি আমি। কোথায় যাবো? আমার তো যাওয়ার জায়গাটাও নেই।

কিন্তু বলা হলো না৷ এমনিই কি দোষ কম নাকি যে আরো দোষ নেবে! তখন ভাববে, সহানুভূতি চাচ্ছে! আসলে তো তা না। ও তো সাধারণ মেয়ে। সাধারণ একটা জীবনই চায়। মৌলি বিদ্রুপ করে বলল,
–আসলে কি বলোতো, তোমাদের মতো বিলো এভারেজ মেয়েরা টাকা দেখলে আর ঠিক থাকতে পারে না। কামড়ে যখন ধরেছো তখন ধরেই থাকো। এমনিতেও, অন্য কারো জিনিসে আমার কোন আগ্রহ নাই।

অহনা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো। সবাই এতো অপমান করে কেন! তাদের কথার মাঝেই সাদিক আসলো। মৌলিকে অহনার কাছে দেখে রেগে গেলো। দ্রুত এসে বলল,
–ফুপু কোথায়?

মৌলি ব্যাঙ্গ করে বলল,
–তোমার বউকে আমি খেয়ে ফেলিনি। উলটে তোমার বউ তোমাদের সংসার ভেঙে আমাকে ঢুকতে অফার করছে। বলছে, তুমি নাকি ওকে ভালোবাসো না। ও চলে গেলে আবার আমার কাছে ফিরে আসবে। অফার কি গ্রহণ করবো সাদিক ভাই?

অহনা আকাশ থেকে পড়লো। ও কি এসব বলেছে নাকি! ওর কথার মানে কি এটা ধরে নিয়েছে! সাদিককে কি বলবে, ও কি বলেছিলো? না থাক। ওর কথা বিশ্বাস তো করবে না। বিশ্বাস করার মতো কোন মানুষ না ও। তার থেকে চুপচাপ এই দায় স্বীকার করে নেওয়াই শ্রেয়।
সাদিক দাঁতে দাঁত চেপে চাপা গলায় বলল,
–নিজেকে এতোটাও নিচে নামাস না যাতে তোর নাম শুনলেও ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেই।

বলেই অহনার হাত ধরে ডক্টরের চেম্বারের সামনে গিয়ে বসলো। সিদ্দিকা এসে অল্প কথাবার্তা বলে মৌলিকে নিয়ে চলে গেলো। নিয়ে যাওয়ার সময় ছলছল চোখের মেয়েটিকে দেখলো অহনা। বোধহয় অনেকক্ষণ নিজেকে শক্ত করে রাখলেও শেষ পর্যন্ত আর পারেনি। চোখ দিয়ে অজান্তেই পানি পরে গেছিলো। অহনা ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামনে শুকনো মুখের স্বামীকে দেখলো। এসব কি কোন স্ত্রীর পক্ষে আদৌ সহ্য করা সম্ভব!
ডক্টর খুব ডিটেইলসে চেকাপ করল অহনার। রক্ত পরিক্ষা, ইসিজি, আল্ট্রাসাউন্ড, সিটি স্ক্যান, এক্সরে সব করলো। রিপোর্ট দিল বিকালে। বিকালে আর তার আসতে হলো না। সাদিকই রিপোর্ট নিয়ে ডক্টরের সাথে কথা বলে মেডিসিন আনলো। রিপোর্ট স্বাভাবিক পেয়ে শান্ত হলো সাদিক। রাতে আলতো ভাবে অহনাকে বুকের সাথে জড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কখনও কি মেয়েটাকে বলা হবে, ও হুট করে কেনো ছুটে আসলো? কখনও কি বলবে, ওর ভাই আর এই পৃথিবীতে নেই। ওর ভাইকে আনতে গিয়ে জেনেছে, এক সপ্তাহ আগে বাবার মতোই ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে সে। চিকিৎসা করানোর মতো কেউ ছিলোই না! শুনলে কি আফসোস করবে অহনা? যেমন এখন সে করছে। এই ক্যান্সার অহনার শরীরেও বাসা বেঁধেছে নাকি ভেবে কত চিন্তিত ছিলো সে। আর আজ রিপোর্ট নরমাল দেখে যতটা শান্তি পেয়েছে, এইরকম শান্তি যে আগে পায়নি, সেসব কি বলবে? কিছু না বলাই ভালো। এই দুর্বল মনের মেয়েটি না জেনেই ভালো থাকুক। ভালো থাকুক, ভালো থাকুক।

****
সাদিক নিজেই মাহাদীকে তৈরি করে দিলো। গ্রে টিশার্ট, ব্লু জিনস প্যান্ট আর সাদা কেডস পরিয়ে ছেলের সাথে টুইনিং করে শপিং এ বের হলো। অহনা ভীষণ ব্যস্ত এখন। পুরোদমে কাজে মনোনিবেশ করেছে। মাহাদীকে সাদিকের সাথে মিশতে দেখে বেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। অনেকটা চিন্তামুক্ত এখন।

সাদিকের গাড়ি এই বাড়িতে রাখার জায়গা হয়নি। পাশের বাড়িতে ছোট একটা গ্যারেজ আছে। সেখানেই রেখেছে। সাদিক সেখান থেকে গাড়ি বের করে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে ছেলেকে পাশের সিটে বসালো। মাহাদী আগ্রহভরে গাড়ি দেখতে লাগলো। গাড়ি চালু হতেই বিষ্ময়ে এটা ওটা প্রশ্ন করতে লাগলো। সাদিক সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বলল,
–গাড়ি চালাবে?

মাহাদী মাথা নেড়ে মন খারাপ করে বলল,
–আমি পারি না। আমি এখন তো ছোট, বড় হলে চালাবো।

সাদিক মৃদু হেসে মাহাদীকে কোলে বসিয়ে ওর ছোট ছোট হাত স্টেয়ারিং এ রেখে হাতের উপর হাত রেখে গাড়ি চালাতে লাগলো। মাহাদী উচ্ছ্বসিত হলো দারুন। পুরো রাস্তা বাবার কোলে বসে গাড়ি চালিয়ে গেল। এরপর দুইজন খুব ঘোরাফেরা করলো আর খুব শপিং করলো। সব শেষে আবার বাবার কোলে বসে গাড়ি চালিয়ে ফিরলো। ফেরার পথে মাহাদীকে মোটরসাইকেলের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাতে দেখে সাদিক প্রশ্ন করলো,
–মোটরসাইকেলে উঠবে?

মাহাদী সজোরে মাথা নেড়ে বলল,
–না, আরিফ কাক্কুর আছে৷ আমি ওই গাড়িতে অনেক উঠেছি।

সাদিকের কপাল কুঁচকে গেলো। বিরক্তি নিয়ে বলল,
–আরিফ কাক্কু কে?

মাহাদী মাথা ঘুরিয়ে চোখ পিটপিট করে সাদিকের দিকে তাকালো। আরিফ কাক্কুকে চেনে না! আরিফ কাক্কুকে তো সবাই চেনে আর ওর বাবা চেনে না! মাথা নেড়ে কপাল চাপড়ে বলল,
–আরিফ কাক্কুকে চেনো না? নিশু আপুর আব্বু।

সাদিক বিরক্তিকর শব্দ করে বলল,
–সম্পর্ক বানানোর জন্য দাদুবাড়ির সম্পর্ক ছাড়া আর কিছু পাওনি? তোমার আম্মু কি নানু, নানী, মামা, মামী, এইসব সম্পর্ক শেখায়নি?

মাহাদী গাল ফুলিয়ে রইলো। সাদিক বুঝে তার গালে টপাটপ চুমু খেয়ে বসলো। গাল ফুলালে যে বাচ্চাটাকে এতো আদুরে লাগে!
গাড়ি পেছন দরজা দিয়ে বাড়ির পেছনের গ্যারেজে রাখতে হবে। তাই মাহাদীকে নামিয়ে সেদিকে গেলো সাদিক। গাড়ি থেকে নামতেই মাহাদী তার নিশু আপুকে দেখলো। উঠানে রোদে বসে পড়ছে। এক দৌঁড়ে ছুটে গিয়ে হাত দেখিয়ে বলল,
–নিশু আপু, দেখো?

মাহাদীর নিশু আপু তার ছোট হাতে স্পাইডারম্যানের ঘড়ি দেখে চমৎকৃত হয়ে বলল,
–কি সুন্দর ঘড়ি! কে কিনে দিলো মাহাদী? আম্মু?

মাহদী মাথা নেড়ে বলল,
–না, বাবা দিয়েছে।

–বাবা!

অবাক হলো সে। পড়াশোনার জন্য অন্য জায়গায় থাকে। ওর বাবার আসার কথা শুনেছিলো কিন্তু মনে ছিলো না। মনে পড়তেই বলল,
–তোমার বাবা কোথায়?

–আরিফ কাক্কুর ঘরে গাড়ি রাখতে গেছে।

বলেই বাড়ির পেছন সাইড দেখালো। তারপর বাবাকে আসতে দেখে উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল,
–ওই দেখো বাবা?

নিশা অবাক হয়ে দেখলো, মাহাদীর বাবাকে একদম মাহাদীর মতোই দেখা যায়। একই নাক, একই মুখ। হাঁটেও একইভাবে। মূহুর্তেই মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। মাহাদীর দিকে ঝুঁকে গাল টেনে বলল,
–তুমি আম্মুর কাছে যাও। আমি তোমার আব্বুর সাথে একটু কথা বলবো।

মাহাদী ঘাড় নেড়ে চলে যেতেই সাদিকের কাছে গেলো সে। পেছন থেকে আস্তে করে বলল,
–এক্সকিউজ মি!

সাদিক ঘুরলো। হাতে এক গাদা ব্যগ নিয়ে বিরক্ত মুখে ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
–ইয়েস?

–আমি নিশা। এখানে থাকি।

সাদিক মাথা নেড়ে বলল,
–ওকে

নিশা রাগলো। কিসের এতো অ্যাটিটিউড! চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
–আপনি কি ওদের নিয়ে যাবেন?

–জানি না।

নিশা রাগা শুরু করলো। শক্ত গলায় বলল,
–আপনার জানতে ইচ্ছা হয় না, আপনার বউ এতোদিন কি করেছে? কিভাবে সারভাইভ করেছে?

সাদিক কাঁধ নাচিয়ে বলল,
–নট ইন্টারেস্টেড। এটা ওর পারসোনাল ম্যাটার।

ব্যাটা বিয়ে করে বাচ্চা পয়দা করার সময় মনে হয় না এটা বউয়ের পারসোনাল ম্যাটার হতে পারে? যেই বাচ্চার দ্বায়িত্বের কথা বউয়ের দ্বায়িত্বের কথা আসে সেই হয়ে যায় পারসোনাল ম্যাটার! নিশু ফোঁসফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল,
–যে মানুষ প্রেগন্যান্ট ওয়াইফকে অ্যাবর্শন করার জন্য টাকা দেয় তার থেকে আসলে ভালো কিছু ডিজার্ভ করাই ভুল হয়েছে। আপনাদের মতো মানুষদের সমাজে থাকতে দেওয়াই ভুল। সমাজের কীট! যত্তোসব!

উল্টাপাল্টা কথায় রেগে গেলো সাদিক। রাগী গলায় বলল,
–এক্সকিউজ মি?

নিশা কোমড়ে হাত রেখে আঙুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল,
–এক্সকিউজ ইউ! আমার সময় আর রুচি সাংঘাতিকভাবে নষ্ট হচ্ছে। তিনমাস চলে গেলে দয়া করে এলাকা ছেড়ে চলে যাবেন। এলাকা দুষিত হচ্ছে।

বলেই বাড়ির ভেতর গেল। এতো সুন্দর দিনটা নষ্ট করে দেওয়ায় সাংঘাতিক চটে গেলো সাদিক। হম্বিতম্বি করে অহনার কাছে গিয়ে বলল,
–কাদের সাথে থাকো তুমি? যেখানে বাচ্চার কথাই জানতাম না সেখানে আমাকে বলে, আমি নাকি অ্যাবর্শনের জন্য তোমাকে টাকা দিয়েছি! সার্কাস হচ্ছে আমার সাথে?

অহনা বিষ্মিত হয়ে মুখে হাত চেপে ধরলো। এই সাংঘাতিক খবর কে দিলো তাকে! প্রশ্ন করার সাহসটাও করতে পারলো না। মাহাদী এসে বাবাকে তার আর্ট দেখাতে টেনে নিয়ে গেল। অহনা দম ছেড়ে ফ্লোরে বসে পরলো।

সারাক্ষণ অহনা খুব ভয়ে ভয়ে ছিলো। না জানি সাদিক কখন ওকে চেপে ধরে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। মাঝরাতের দিকে সাংঘাতিক জ্বর আসলো মাহাদীর। উঠে মাথায় পানি ঢালতে হলো। শব্দ শুনে সাদিক ঘুমঘুম চোখে উঠে এসে এই অবস্থা দেখে চিন্তিত হলো। ভালোই তো ছিলো ছেলেটা, হঠাৎ করে জ্বর আসলো কেন! অহনা ব্যস্ত হয়ে বলল,
–আপনি একটু ওর পাশে বসুন। আমি মাহাদীর জন্য খাবার নিয়ে আসছি। ঔষধ খাওয়াতে হবে। পাশে কাউকে না পেলে কান্না করবে।

সাদিক বিচলিত হয়ে বলল,
–সবসময়ই কি এমন করে?

অহনা মাথা নেড়ে বলল,
–হ্যাঁ, অসুস্থ হলে একা থাকতে চায় না।

সাদিক ব্যথিত মনে ছেলের কাছে বসলো। ছেলের কত কিছুই সে জানে না। কত কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছে! সন্তানের উত্তপ্ত মুখে হাত বুলিয়ে চোখের পানি আড়াল করলো। মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে ঠোঁট ছোয়ালো। মাহাদী জ্বরের ঘোরে বাবা বাবা বলে ডাকছে। সাদিক ফিসফিস করে বলল,
–বাবা আছে তো আব্বু। এখানেই আছে।

ছেলের অসুস্থতায়ও অহনার ছুটি নেই। বারবার মাহাদীর কাছে ছুটে আসছে আর রান্নাঘরে যাচ্ছে। সাদিক দেখছে আর অবাক হচ্ছে। একটা মেয়ে, একা হাতে সব সামলাচ্ছে! এতোদিন একাই সামলেছে! কিভাবে! সাদিক অহনাকে শান্ত থাকতে বলে নিজেই ছেলের পাশে বসেছিলো। তাও মানেনি অহনা। কেক বানানো শেষে কাচুমাচু করে এসে বলল,
–আমার একটু বাইরে যেতে হবে। এক ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবো।

সাদিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–আমি কোথাও যাচ্ছি না। নিশ্চিন্তে যাও।

অহনা নিশ্চিন্ত হলো না। সন্তান অসুস্থ হলো কোন মা-ই বা নিশ্চিন্ত থাকে। সাদিকের অফিসের কাজ আছে। মাহদীর পাশ থেকে উঠে নিজের ল্যাপটপ আনতে ঘরে গেলো। এক মিনিটের ব্যাপার ছিলো। এরমাঝেই মাহাদী চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ল্যাপটপ ফেলে দৌঁড়ে আসলো সাদিক। মাহাদী এক হাত মাথায় চেপে আরেক হাত সাদিকের দিকে বাড়িয়ে কাঁদছে,
–বাবা ব্যাথা, বাবা ব্যাথা!

সাদিক ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো ছেলেকে। ছেলের ব্যাথা নিজের মধ্যে নেওয়ার উপায় থাকলে সেটাই করতো সে। ব্যাথা ছেলে কাঁদছে আর দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। সাদিক মাহাদীকে কোলে বসিয়ে মাথা টিপে দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর শান্ত হলো মাহাদী। ওর শরীরের উত্তাপে নিজের শরীর পুড়তে লাগলো। ব্যাথা কমতেই ঘুমিয়ে গেলো মাহাদী। সাদিক ঘুমন্ত ছেলের কপালে চুমু দিয়ে কেঁদে ফেলল। ছেলে প্রথমবারের মতো বাবা ডেকেছে বলে খুশিতে কাঁদলো নাকি জ্বরের যন্ত্রণার ছেলের কষ্ট হচ্ছে বলে কাঁদলো বুঝলো না। প্রথমবারের মতো বাবা অনূভুতি তাড়া করলো ওকে। এতো মিষ্টি অনুভূতির থেকে পাঁচ বছর বঞ্চিত ছিলো! ছেলেকে শোয়ানোর সাহসটুকুও হলো না। যদি জেগে আবার কান্না করে! তাই মাহাদীকে কোলে নিয়েই শুয়ে পরলো আর কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেও ঘুমিয়ে পরলো।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে