অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-০২

0
4

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#পর্বঃ০২

দরজা খুলে দিলো সাদিকের মা ফরিদা। বউ বেশে ছেলের পাশে একজনকে দেখে প্রথমে হতভম্ব হলেন, পরে রেগে চিৎকার করে উঠলেন। সাদিক শুধু দরজা খোলার অপেক্ষায় ছিলো। দরজা খুলতেই পায়ের জুতা খুলে মাকে পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। এক ফোটা শব্দও যেন সে শোনেনি। অন্যদিকে ফরিদার চিৎকারে ঘরের ভেতর থেকে খলিল সাহেব চলে আসলেন। স্ত্রীর চিৎকারে আর সামনের মেয়েটির বেশভূষায় কিছুক্ষণ বেক্কলের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। হতভম্ব স্বরে বললেন,
–কি হয়েছে ফরিদা? এই মেয়ে কে?

–তোমার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করো? সেই তো নিয়ে এসেছে।

ফরিদা তিরিক্ষি স্বরে বলল। খলিল সাহেব অহনাকে ভেতরে ঢুকতে বলে আগে দরজা লাগালেন। প্রতিবেশীরা অলরেডি উঁকিঝুঁকি দেওয়া শুরু করেছে। এরপর সাদিকের ঘরের দরজায় টোকা দিয়ে দরজা খুললে বললেন। খানিক ডাকাডাকির পর দরজা খুললো সে। মাথা সম্পূর্ণ ভেজা। বোধহয় গোসল করেছে। এইটুকু সময়ের মধ্যে গোসল! সু কেবিনেটের পাশের দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে চোরা চোখে সাদিকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে চিন্তা করলো অহনা। ফরিদা সোফায় বসে রাগে গজগজ করছিলো। ছেলে বের হতেই হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। রক্তিম চোখে রাগ নিয়ে বলল,
–এসব কি নাটক হচ্ছে?

সাদিক একপলক বাবা মায়ের দিকে তাকালো। তারপর চোখ নিচু করে বলল,
–কয়েক ঘন্টা আগে আমার বিয়ে হয়েছে।

–বিয়ে হয়ে গেছে? কে করালো এই বিয়ে? তুই নিজে করেছিস? নাকি এই মেয়ে এসে গলায় ঝুলে পড়েছে?

ফারিদার বিষঢালা কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল। রেগে গেলেন খলিল সাহেব। স্ত্রীর উপর গর্জে উঠে বললেন,
–থামো তুমি। আগে কথা শুনতে দাও।

ফরিদা ফোঁপাতে ফোপাঁতে আবার সোফায় বসে পরলো। খলিল সাহেব ছেলের দিকে ফিরে শান্ত গলায় বললেন,
–হঠাৎ এই বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারন? আমরা কি কিছুতে বাঁধা দিয়েছিলাম?

–আমার ইচ্ছেতে কিছু হয়নি।

সাদিক উঁচু গলায় বলল। খলিল সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন,
–মানে? জোর করে বিয়ে দিয়েছে?

–অনেকটা সেরকমই।

–কেন? কি করেছিলে তুমি?

–সেটা ওর পরিবারের লোকের থেকেই জানো।

কাঠকাঠ গলায় বললো সাদিক। সাথে ঘর থেকে অহনার মামার নাম্বার এনে বাবার হাতে তুলে দিলো। বাইরে থেকে কথা বলে এলেন তিনি। কি কথা বললেন তা কাউকে বলল না। ঘরে এসে শুনলেন, ফরিদা মেয়েটির উপর চোটপাট করছে। মেয়েটি ভয়ে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ফরিদা স্বামীকে দেখে তেজি গলায় বলল,
–আমি এই মেয়েকে রাখব না।

—ফরিদা, থামো। বিয়ে হয়ে গেছে মানে ও এখন এই বাড়ির বউ। বাড়ির বউয়ের অসম্মান করা ভালো না।

খলিল সাহেব শান্ত গলায় বললেন। ফরিদা ক্রোধে গর্জে উঠলেন,
–কিসের বউ? চেনো তুমি ওকে? ওর চরিত্র সম্পর্কে কিছু জানো? কোথাও বিয়ে দিতে পারেনি জন্য আমার ছেলের ঘারে চাপিয়ে দিয়েছে। আমার ছেলের জীবন নষ্ট করেছে।

খলিল সাহেব ধমক দিয়ে স্ত্রীকে থামিয়ে বললেন,
–ঘরে যাও তুমি।

ফরিদা কাঁদতে কাঁদতে ঘরে গেলো। যাওয়ার আগে বলে গেলো,
–ওই মেয়ে যেন আমার সংসারে না ঢোকে।

সাদিক তো বাবাকে কাগজ দিয়ে আবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন ঘরে তিনি আর অহনা একা। মেয়েটিকে কি বলবেন ভেবে পেলেন না খলিল সাহেব। ওর মামার থেকে যথেষ্ট অপমানিত হয়েছেন তিনি। সম্পূর্ণ দোষ সাদিকের আর অহনার দিয়েছে ওরা। ওরা দুজন মিলে নাকি ওদের মুখ কালো করেছে। এক ঘরে পাওয়া গেছে ওদের। এর প্রেক্ষিতে আর কিছু বলার ক্ষমতা হয়নি তার। আর না এখন মেয়েটির সাথে কথা বলার ইচ্ছা হলো। সত্যি জানার আগ্রহ হলো না মোটেও। তিনিও চুপচাপ চলে গেলো। অহনা কি করবে বুঝতে না পেরে ওখানেই বসে পরলো। রাত বাড়লে মাথার ওড়না বিছিয়ে তার উপর শুয়ে পরলো।

*****
ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত শান্তি লাগছিলো অহনার। লড়াইয়ের প্রথম ধাপ শেষ। পরাজয়ের হিসাব অনেক বড় হলেও বর্তমানের জয়টাই সব। অবশেষে বাচ্চাকে তার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবে। এই শান্তির তুলনা হয় না। মুখে এক গভীর প্রসন্নতার ছাপ রেখে চোখ বুজলো। পাশের সিটের মানুষটাকে না জানিয়েই কখন যে ঘুমিয়ে পরলো বুঝতেই পারলো না। গত কয়েকদিনের ক্লান্তি আর ঠিকমতো না খাওয়া তার শরীরকে একদম ভেঙে দিয়েছে। তবে ঘুম বেশিক্ষণ হলো না। কিছুক্ষণ ঘুমানোর পর দুঃস্বপ্ন দেখে ধরফরিয়ে জেগে উঠলো। ঘুম ভেঙে কিছুকাল কিছু ঠাহর করতে পারলো না৷ তারপরই সব মনে পরায় তড়িৎ পাশে তাকালো। পাশের সিটে কেউ নেই। বুক ধক করে উঠলো অহনার। উতলা হয়ে উঠতে নিতেই দেখে সামনের সিটে সাদিক পায়ের উপর পা তুলে ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হকচকিয়ে গেলো সে। ওঠা বাদ দিয়ে নিজেকে ঠিকঠাক করে সোজা হয়ে বসে আশেপাশে তাকিয়ে ব্যাগ খুঁজলো। না পেয়েই আবার আত্মা কেঁপে উঠলো। ব্যাগ না পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। বাড়ি ফিরবে কিভাবে? সাদিক বুঝতে পেরে বিরক্ত হলো। হাতের ইশারায় ট্রেনের টেবিলের উপর নির্দেশ করে বলল,
–আছেই তো দুশো সত্তোর টাকা। এই সামান্য টাকার জন্য এতো উতলা!

অহনা ব্যাগ বুকে চেপে বিষ্মিত স্বরে বলল,
–আপনি আমার ব্যাগ চেক করেছেন?

–হ্যাঁ, করেছি।

একদম চোখে চোখ রেখে সত্যি বললো সাদিক। অহনা দ্বিতীয় দফায় হকচকিয়ে চোখ সরিয়ে ফেলল। দুঃস্বপ্নের তোরে বুক এখনও কাপছে। যদি সত্যি সত্যি সাদিক সাথে না আসতো তাহলে বাচ্চাটার ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারতো না। পরমুহূর্তেই কিছু মনে হতেই ব্যাগটা আরো শক্ত হাতে বুকের সাথে চেপে ধরলো। তার মানে ছেলের বার্থ সার্টিফিকেট ও দেখেছে! সন্দেহ সত্যি করলো সাদিক৷ অবজ্ঞা ভরা স্বরে বলল,
–তোমার ছেলের নাম তাহলে মাহাদী?

নীরবে মাথা নেড়ে সায় জানালো অহনা। একবার ভাবলো ছেলের বাবার নামটা বলে দিক। যদিও বার্থ সার্টিফিকেটে বাবার নাম আছে। তবুও বিশ্বাস করার জন্য মায়ের মুখ থেকে শোনা বেশি ভালো৷ কিন্তু মুহূর্তেই মাথা ঝাঁকালো। না বলাটাই বেশি নিরাপদ। কিছু সত্য যত লুকানো থাকে, ততই মানুষকে বাঁচায়।

–তুমি কতদিন আমার সাথে থেকেছো?

সাদিক ফের প্রশ্ন করে। অহনা মাথা তোলে একবার। তাদের সিট চারজনের। সামনাসামনি চারজন করে মোট আটজনের সিট। বর্তমানে সেখানে তারা ছাড়া আর কেউ নেই। তাই কথা শোনার অস্বস্তি থেকে বেঁচে গেলো। থুতনি চিবুকের সাথে আটকে আস্তে করে বলল,
–দুই বছর।

হ্যাঁ, থেকেছিলো অনেকদিন। যেদিন কাছাকাছি টেনেছিলো ঠিক সেদিন থেকেই একই ঘরের একই বিছানায় স্থান হয়েছিলো তার। এই দুই বছরের প্রতিটা ঘটনা তার মনে আছে। বোধহয় শেষদিন পর্যন্ত মনে থাকবে।

–বাচ্চা হলে তো এই দুই বছরে হয়ে যাওয়ার কথা। তাই না?

সাদিক আরেকটা প্রশ্ন করল। কন্ঠ অস্বাভাবিক নিরব। এবারে অহনা নিরব থাকলো। এখন বাচ্চা কবে হবে সেটা ও কিভাবে বলবে!

সাদিক হুট করেই ঝুঁকে অহনার হাত চেপে ধরলো শক্ত হাতে। চোখে চোখ রেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–কার বাচ্চা আমার ঘাড়ে চাপাতে চাচ্ছো?

দম আটকে আসলো অহনার। রাগও হলো, অপমানিতও হলো। কান্না আটকে শক্ত গলায় বলল,
–আমি তো সন্তানের বাবার দাবী নিয়ে আসিনি। শুধু একটু সময় কাটাতে বলছি।

সাদিক যেমন হুট ধরে হাত চেপে ধরেছিলো তেমনই হুট করেই হাত ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। আগের মতোই পায়ের উপর পা তুলে হাত টেবিলের উপর হাত রেখে বাঁকা হেসে বলল,
–সুন্দর কথা। কিন্তু আমার মূল্যবান সময় কোন জায়গায় ওয়েস্ট করবো সেটা বোধহয় আমার জানা প্রয়োজন।

–আপনার ডিভোর্স প্রয়োজন।

অহনার প্রতি উত্তর শুনে সাদিক হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাসি। পারলে তো হাত তালি দিয়ে হাসতো। তা না পেরে কেশে গলা পরিষ্কার করে ব্যাঙ্গ করে বলল,
–তোমাকে এতোটা বোকা তো মনে হয় না। ডিভোর্স দরকার হলে বিয়ের আয়োজন করতাম কেন? আমি তো জানি তুমি বেঁচে আছো অ্যান্ড বহাল তবিয়তেই আছো।

–তাহলে বিয়ে ছেড়ে আসলেন কেন?

–তোমাকে আমি কৈফিয়ত দেবো না অ-হ-না। তোমার নাম তো অহনা, রাইট?

অহনা লজ্জায় সিটের সাথে একদম মিশে যেতে লাগলো! সময় তো এখনও তিন মাস আছে। এই তিন মাসে আর কতবার যে অপমানিত হতে হবে, কে জানে! অহনা এই অপমানে বদলা নিতে চাইলো। অন্তত একজনের তো মনে হোক, সে আর আগের অহনা নেই। মাথা তুললো। একদম চোখে চোখ রেখে চোয়াল শক্ত করে বলল,
–আপনার নাম তো সাদিক, তাই না?

–ভেরি ক্লেভার!

সাদিক সুন্দর করে হাসলো। এই হাসিটা ওর মুখে বরাবরই খুব সুন্দর লাগে। তারপরই হাসির বাঁক বদলে গেলো। সুন্দর হাসিমুখ কঠিন করে বলল,
–বাচ্চার বাবা হিসেবে কয়জনকে হাতে রেখেছিলে?

অহনা বিষ্ময়ে তাকাতেই সাদিক আবার বলল,
–আমি কয় নাম্বার ছিলাম?

আবার! ঘুরে ফিরে সেই একই কথা। অহনার একবার বলতে মন চাইল,
–আপনারা তাড়িয়ে দেওয়ার পর আমার তো চলতে হতো। সে হিসেবে প্রতি রাতে একজন হলেই সুন্দর ভাবে দিন চলে যেত।

বলতে চাইলো কিন্তু বললো না। অপমানে মাথা নুইয়ে রাখলো। ভুল ভেবেছে সে। প্রতিবাদের ভাষা তার তখনও ছিলো না আর এখনও নেই।

–বাচ্চার কথা আমাকে বলোনি কেন? যেদিন সিওর হলে তুমি কন্সিভ করেছো সেদিক তো আমাকে জানানো উচিৎ ছিলো।

আবার প্রশ্ন। অহনা বেদনায় জর্জরিত হয়ে কাতর গলায় বলল,
–আপনি নিজের কথায় ঠিক থাকুন প্লিজ। আমার আর আমার বাচ্চার জীবনে আপনার অবস্থান মাত্র তিন মাসের। তিম মাস পর আপনার সাথে আমার সম্পর্কেই ইতি ঘটে যাবে।

ট্রেন থামায় সাদিক আর কিছুই বলল না। সোজা গাড়ি থেকে নেমে গেল। অহনার বুক কেঁপে উঠলো৷ তার কোন কথায় কিছু মনে করে সিদ্ধান্ত বদলে ফেললো না তো! ঢোক গিলে কিছু বলার আগেই দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলো সাদিক। জানালা দিয়ে খুঁজতেও পাওয়া গেলো কিছু দূরে এক খাবারের দোকানে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এলো কেক আর পাউরুটির প্যাকেট হাতে। আরেক হাতে পানির বোতল। এবারেও বসলো একদম অহনার সামনা-সামনি। কেকের প্যাকেট অহনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–নাও

চুপচাপ প্যাকেট কোলের উপর রেখে বাইরের ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম দেখতে লাগলো। সাদিক নিতে বলেছে, খেতে তো আর না। সুতরাং, কথা শোনা হলো। ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে রইলো সাদিক। অহনার সেদিকে তাকানোর সাহস নেই। মাথা নিচু করে হাত কচলাতে লাগলো। কাল থেকে পানি ছাড়া আর কিছুই খায়নি। মাথা তো ঘুরছিলো কিন্তু ছেলেকে না দেখে কিছুই খেতে পারবে না। প্যাকেট শক্ত হাতে চেপে সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বুজলো।
ভোররাতে ঘটে গেলো দুর্ঘটনা। ক্লান্তি আর না খাওয়ায় প্রেসার ফল করে জ্ঞান হারালো অহনা।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে