অবুঝ পাড়ার বাড়ি পর্ব-০১

0
4

#অবুঝ_পাড়ার_বাড়ি
#হুমায়রা
#সুচনা_পর্ব

স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের ঠিক দুদিন আগে শ্বশুরবাড়িতে উপস্থিত হলো অহনা। পাঁচ তলা বিল্ডিং এর বাইরে টাঙানো সাইনবোর্ডে বড় হরফে সুন্দর করে লেখা-

“সাদিক ও মৌলির শুভ বিবাহ।”

আজ এনগেজমেন্ট, কাল গায়ে হলুদ আর পরশু বিয়ে। ধুমধাম করে হচ্ছে সব অনুষ্ঠান। সবাই নিশ্চয় খুব খুশি। খুশি তো হবারই কথা। এতো বছরের অপেক্ষার অবসান হচ্ছে আজ।
ছয় বছর! ছয় বছর কম সময় তো না। ছয় বছরে কত কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। পাঁচ তলার সেই ছোট ফ্ল্যাট আর নেই। ভেঙে বিশাল বড় বিল্ডিং তৈরি হয়েছে। ভেতরে ঢুকতে দারোয়ানের মুখোমুখি হতে হয়। আজকে নির্দ্বিধায় ঢুকতে দিয়েছে তাকে। কাজের মেয়ে ভেবেছিলো বোধহয়। ভাবলেও ভুল কিছু ভাবেনি। এই বাড়িতে যতদিন ছিলো ততদিন সে কাজের মেয়ের মতোই ছিলো৷ ঘরও ছিলো পরিত্যাক্ত আসবাব রাখার ঘর৷ দারোয়ানের থেকে সত্যটা জানা হয়নি। এই পোশাকের ভিখারিও আজকাল দেখা যায়। সেটাও ভাবতে পারে। তবে আজ ভিক্ষা নিতেই আজ এসেছে সে। মলিন, ধূসর শাড়ির আঁচল পেতে ভিক্ষা নেবে।

দূরে আতশবাজির শব্দ হলো। আলোর রেশ আকাশের বুকে নিজেকে মেলে ধরলো। দারুন এক দৃশ্য। ছোট ফুপুর বিয়ের দিন আতসবাজি ফুটানো দেখেছিলো। কেউ ধরতে দেয়নি তাকে। ছোট হওয়ার অযুহাতে দূরে ঘরে বন্ধ হয়ে ছিলো।
আজকের বাজিতে কারো বিধিনিষেধ নেই বোধহয়। আলোর ঝলকানির সাথে সাথে ছোট বড় সকলেই উল্লাসে মেতে উঠল। মেতে উঠলো না শুধু অহনা। এই সাজসজ্জার মাঝে একমাত্র মলিন কাপড় পরে ঝিকিমিকি আলোর ভেতর দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে লাগলো।

স্বামীর বিয়ের কষ্ট তার হচ্ছে না। মানুষটা কোনকালেই তার ছিলো না। তিন কবুল আর একটা সাইনেই যে কেউ কারো আপন হয় না, তার জ্বলন্ত প্রমান সে। রঙিন বাতির রঙিন আলো, বিয়ের গানের শব্দ, হাসি মজা, সবকিছুই তার কাছে ফিকে মলিন।

হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো অহনা। বুকের ভেতরটা শূন্যতায় খাঁ খাঁ করে উঠলো। তবে চোখ ভিজলো না। কান্নার ক্ষমতা হারিয়েছে বহু আগেই৷ মনে পড়লো সেই রাতের কথা, যখন পরিস্থিতির চাপে পরে বিয়ে হয়েছিলো তাদের। বিয়েতে না ছিলো ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি আর না ছিলো সারাজীবন পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি। তাহলে কেন এসেছে আজ! অনর্থক আসা কি! একবার মনে হলো ফিরে যাক। পা ফিরিয়েও নিয়েছিলো আর ঠিক তক্ষুনি নজরে পরলো সাদিককে। ব্যস্ত সাদিক অতিথিদের সাথে কথা বলছে আর হাসছে। মেরুন পাঞ্জাবিতে কি দারুন দেখাচ্ছে! তাদের বিয়ের সময় বড় কাকার দেওয়ার সোনালি পাঞ্জাবি পরেছিলো সে। সেটাতেও কি দারুন লেগেছিলো। তবে আজকে বেশি সুন্দর লাগছে। ভালো তো লাগতেই হবে। ভালোবাসার মানুষকে যে পাচ্ছে।
আর পা আগানোর সাহস পায়নি সে। দূর থেকেই মন ভরে দেখল। আগের মতো টগবগে যুবক আর নেই। মুখে এক ঠান্ডা অভিব্যক্তি এসেছে। চোখে উঠেছে রিমলেস চশমা। হঠাৎই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো৷ দাঁড়িয়ে থাকতে সে আসেনি। কাজ সেরে আবার ফিরতে হবে। শক্ত হাতে কাঁধের কালো রঙের টোট ব্যাগ মুঠো করে ধরলো। ব্যাগের ভেতর ছোট টাকার পার্স, ছাতা, পানির বোতল রেখেছে। আর রেখেছে রিপোর্ট ফাইল। প্রমাণের প্রয়োজন পরলে রিপোর্ট দেখাতে হতে পারে।

পা বাড়ানোর আগে চারপাশে তাকালো সে। আশেপাশের মানুষের হাসাহাসি, সাজসজ্জা সবকিছু অসহ্য লাগতে লাগলো। এই চাকচিক্যময় পৃথিবীতে তার জায়গা কখনও ছিলোই না। তবুও একসময় চেয়েছে। পাগলের মতো চেয়েছে নিজের জায়গা করে নিতে। কিন্তু পারেনি।

অহনার বেশি কষ্ট করতে হলো না। সেদিকে যাওয়ার আগেই কোন এক অনাত্মীয়ের নজরে পড়েছিলো। আত্মীয় তো সাদিকের। তার তো কিছুই না। তবুও যখন এক প্রকার টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেলো তখন চুপচাপ চলে গেলো সে। আজেবাজে চিন্তা করার মানসিক পরিস্থিতি তার নেই।
অনেক অনেকদিন আগে এক রাজপুত্রের বিয়ে হয়েছিলো চাকরানীর সাথে। আজ আবার সেই রাজপুত্রের বিয়ে হচ্ছে এক রাজকুমারীর সাথে। সেখানে কেউ কালো ছায়া কেন মানবে!
মূহূর্তেই পরিবারের লোকজন দিয়ে ঘর ভরে উঠলো। সাহসী অহনার সাহস দুর্বল হয়ে আসতে লাগলো। তবুও মাথা তুললো। গলা উঁচিয়ে বলল,
–প্রথম স্ত্রীর জীবিত থাকা অবস্থায়, তার অনুমতি না নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে দিচ্ছেন কিভাবে? দেশে আইন কানুন আছে।

–মরোনি তো এতো বছর কার সাথে থেকে এসেছো? ফষ্টিনষ্টি করে এখন আবার আমার ছেলের জীবন নষ্ট করার ধান্দায় এসেছো? শয়তান মেয়ে কোথাকার!

কথা শেষে সাদিকের মা তেড়ে গেলেন মারতে। আটকালো সবাই। গমগমে পরিস্থিতিতে ভারি কদমের চাপ ফেলে উপস্থিত হলো সাদিক। তীর্যক চোখে পর্যবেক্ষণ করলো অহনাকে। তারপর শীতল স্বরে বলল,
–কত টাকা চাচ্ছো তুমি?

–টাকা না, সময় চাই। তিনমাস সময় চাই আপনার।
দলা পাকানো স্বরে প্রতিউত্তর করলো অহনা। সাদিক কপাল কুঁচকে তাকালো। ভ্রু জোড়া সুন্দরভাবে বেঁকে গেলো তাতে। হাতের ইশারায় সবাইকে বাইরে যেতে বলে দরজা চাপালো। পা দিয়ে টুল ঠেলে অহনাকে বসতে দিয়ে নিজে বসলো খাটে। তারপর কাঠকাঠ গলায় প্রশ্ন ছুড়লো,
–সময় বেচে কি কিনবে?

অহনা কপালের ঘাম মুছলো। আস্তে আস্তে যে সত্যিটা সামনে আনতে হবে তার সূচনা করল। সামান্য ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
–খুশি।

–কার?

পালটা প্রশ্ন আসতে সময় নিলো না। দম বন্ধ করে প্রশ্নের উত্তর দিলো অহনা,
–আমার ছেলের।

–বাবা কে?

এমন প্রশ্নের আশা সে করেনি। অবাক হয়ে সামনে তাকালো। দু’একবার কামনার টানে যে কাছে এসেছিলো, সেটা কি ভুলে গেছে? নাকি ভেবেছে, ও সব ছেলের বিছানায় শুয়ে পরার মতো মেয়ে! রাগ হলো ওর। শক্ত গলায় বলল,
–ডিএনএ টেস্ট করালে জানতে পারবো।

সাদিক শান্তু গলায় কাঁধ উঁচিয়ে বলল,
–তাহলে আমি স্যাক্রিফাইস করবো কেন?

স্বাভাবিক কথা। অন্য কারো ছেলের জন্য ও কেনো স্যাক্রিফাইস করবে! অহনার শরীর ভেঙে আসলো। সামনের মানুষটা ওকে এতো নীচ ভাবে? ছেলেটা যে তারও হতে পারে, এর বিন্দুমাত্র ধারনাও করতে চাইছে না! সিদ্ধান্ত নিলো সে। ছেলের বাবার পরিচয় জানাবে না। যেমন আছে তেমন থাকুক। শান্ত হলো মূহুর্তেই। চোখে চোখ রেখে শীতল গলায় বলল,
–কারন আপনার ডিভোর্স চাই। তিনমাস পর ডিভোর্স দিয়ে দেবো। বাঁধা থাকবে না।

–তোমার কথার সত্যতা কি?

অহনা উকিলের তৈরি কাগজ বের করে সাদিকের হাতে দিলো। সাদিক পড়লো সবটা। প্রথম কাগজটা শর্তনামা আর দ্বিতীয় কাগজটা ডিভোর্স পেপার। প্রথমটায় সাইন হলেও দ্বিতীয়টায় সাইন হবে তিনমাস পর। কাগজ রাখলো বিছানায় নিজের পাশে। নির্লিপ্ত স্বরে বলল,
–ঠিক আছে৷ তোমার শর্তে আমি রাজি। অনুষ্ঠান শেষ হলে যাবো।

–আমি ডিভোর্স না দেওয়া পর্যন্ত আপনি বিয়ে করতে পারবেন না।

স্পষ্ট ভাষায় নিজের কথা জানিয়ে দিলো অহনা। সাদিক তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
–শুধু এনগেজমেন্ট হবে।

অহনা চুপ রইলো। শান্ত স্বরে কিছুক্ষণ পর বলল,
–অনুষ্ঠান কবে?

–আজ রাতে।

–ঠিক আছে।

অহনা মাথা নেড়ে রাজি হলো। এখানে ইমোশোনের খেলা খেলতে এসেছিলো সে। খেলায় অংশগ্রহণই করতে পারলো না। কত শত প্ল্যান, কত শত চিন্তা করেছে এতোদিন! এতো সহজে যে সব হবে তা কল্পনার বাইরে ছিলো।
বাড়ির লোককে সাদিক কিভাবে ম্যানেজ করেছে তা জানে না সে। জানতে চায়ও না। তার কাজ হলেই হলো। বাড়িতে এসে প্রথমটায় ইমোশনাল হয়ে পরেছিলো। পুরোনো অহনায় ফেরত গিয়েছিলো। এখন ঠিক আছে৷ একদম সুস্থ স্বাভাবিক। টিকিট কাটা আছে। সময় বেশি নষ্ট করবে না। আজ রাতের ট্রেনেই ফিরে যাবে।

অতীত যখন আসে, তখন একজনের সাথে আরেকজনকে নিয়ে আসে। অহনার অতীত শুধু অহনার না, সাদিকেরও। অহনার বাবাকে দাফন করানোর পরই মা কেমন একটা হয়ে গেলো। মৃত্যুভয় তারা করতো সবসময়। ছোট ভাই আর বড় বোনকে নিয়ে নানিবাড়িতে ওঠার পরপরই বোনের বিয়ে হয়ে গেলো। অহনার তখন সতেরো চলছিলো আর বোনের উনিশ। স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে চলে গেলো শ্বশুরবাড়ি। একা রইলো অহনা। দুইদিন পর মামা তারজন্যেও পাত্র আনলো। বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছিলো। নানান ঝামেলায় সেবার বিয়ে না হলেও পরের বছর ঠিকঠিক বিয়ে ফাইনাল হলো। পাত্র সাদিক ছিলো না। সে কীভাবে থাকবে! সাদিককে তো চিনতোই না কেউ। তারপরও কিভাবে কিভাবে যেনো ওই বিয়ে ভেঙে তার সাথে বিয়ে হয়ে গেলো৷ এতো আগ্রহ ছিলো না জন্য জানতে চায়নি। আর এখন চাইলেও সম্ভব না। খোলাখুলি কথা বলার মতো সম্পর্ক কোনদিনই হয়ে ওঠেনি। বিয়ে হলো সংগোপনে। মামার পুরোনো পাঞ্জাবি পরলো সাদিক আর সে পরলো মামির পুরোনো লাল শাড়ি। এলাকার ইমামের সাহায্যে কবুল পড়িয়ে বিবাহকার্য সম্পন্ন করে ফেললো দ্রুত। এরপর কোত্থেকে কাজিও আসলো, রেজিস্ট্রিও হলো। তড়িঘড়ি করে বিদায় দিয়ে বাড়ির দরজা তারজন্য চিরতরে বন্ধ করে ফেললো।
পুরো রাস্তা কান্না করেছিলো অহনা। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিলো। বাসের এই জার্নিতে পাশের সিটের মানুষটা কাঠের পুতুলের মতো বসেছিলো শুধু। ধোঁয়া ধোঁয়া স্মৃতি সব। মা ভাই বোন সবাই খুব আপন থাকলেও মাথার উপর ছাদের খুব প্রয়োজন ছিলো। মা বলে দিয়েছিলো,
–অহনা, যাই হয়ে যাক, আশ্রয় হারাবি না।

অহনা মেনেছিলো সেই কথা। সেই মেনেই যে কত কি হয়ে গেলো। কত কি! সেসব মনে করেই উদাস হয়ে গেলো!

গাড়ির কথা উঠতেই সাফ সাফ মানা করে দিলো সে। কোন টাকা যে নেবে না। গাড়ি নেওয়া মানে সাদিকের খরচে যাওয়া। চোখ মুখ শক্ত করে টোট ব্যাগ থেকে দুটো টিকিট বের করে দেখালো। সাদিক মুখ গম্ভীর করে রিক্সা চেপে চলে গেলো রেলস্টেশনে। ট্রেন আসলো আরো এক ঘন্টা পর। ট্রেনের সিটে পাশাপাশি বসলো তারা। ঠিক বিয়ের দিনের মতো। এবারে সাদিকের বাম হাতের অনামিকায় জ্বলজ্বল করছে হীরার আংটি। সদ্য বাগদানের সাক্ষী হয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। অহনা হাসলো মনে মনে। দুনিয়ায় জীবিত থাকতে হলে কত কিছুই যে দেখতে হয়!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে