অদৃশ্য দেয়াল পর্ব-০৫

0
5

#অদৃশ্য_দেয়াল।
পর্ব:- পাঁচ।
লেখা: সিহাব হোসেন।

লিমা মুগ্ধ চোখে বেলি ফুলের মালাটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার খুব শখ ছিল এমন একটা মালা পরার, কিন্তু আশেপাশে কোথাও এই গাছ খুঁজে না পাওয়ায় সেই ইচ্ছাটা অপূর্ণই রয়ে গিয়েছিল। সে অবাক হয়ে সায়নকে জিজ্ঞেস করল,
– “বেলি ফুল যে আমার এত পছন্দ, এটা তুমি জানলে কীভাবে?”
– “তোমার কি স্কুলের সেই দিনগুলোর কথা মনে আছে? স্কুলে যাওয়ার পথে একটা বাড়িতে বেলি ফুলের গাছ ছিল। একদিন তুমি সেখান থেকে ফুল পাড়তে গিয়েছিলে, কিন্তু বাড়িওয়ালা দেখে ফেলায় তোমাকে তাড়া করেছিল। ঠিক তার পরের দিনই তারা গাছটা কেটে ফেলে। আর সেদিন তুমি ক্লাসে বসে খুব কান্না করছিলে।”

সায়নের কথা শুনে লিমার চোখের সামনে যেন অতীতের সেই দৃশ্যটা ভেসে উঠল। সে বলল,
– “আর ঠিক তখন এক ছোট ভাই আমাকে অনেকগুলো বেলি ফুল এনে দিয়েছিল। সে বলেছিল, ফুলগুলো সে আনেনি, অন্য কেউ তাকে দিয়েছে, আর নাম বলতেও নিষেধ করেছে। আমি এখন নিশ্চিত, ওটা তুমিই ছিলে, তাই না?”

সায়ন লাজুকভাবে মাথা নাড়ল। লিমা খিলখিল করে হেসে ফেলল। তার হাসিতে যেন কফিশপের পুরো পরিবেশটা আরও স্নিগ্ধ হয়ে গেল।
– “তো, আজকের কাহিনিটা বলো। এই মালাটা পেলে কোথায়?”
– “আমাদের এলাকা থেকে বেশ দূরে একটা গাছ আছে। খুব ভোরে গিয়েছিলাম ফুল আনতে। কিন্তু গিয়ে দেখি, আমার আগেই একটা মেয়ে প্রায় সব ফুল কুড়িয়ে নিয়েছে।”
লিমা ভ্রু কুঁচকে বলল, “তাহলে তুমি পেলে কীভাবে?”
– “গাছে আরও অল্প কিছু ফুল ছিল। আমি যখন সেগুলো কুড়াচ্ছিলাম, তখন মেয়েটি আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইয়া, এটা কি আপনি আপনার কোনো প্রিয় মানুষকে দেবেন?’ আমি লজ্জায় কিছু বলতে পারছিলাম না। তখন সে মুচকি হেসে তার কুড়ানো সব ফুল আমাকে দিয়ে দিল। বাসায় ফিরে আমি নিজ হাতে এই মালাটা গেঁথেছি।”

লিমা কিছুক্ষণ চুপ করে মালাটার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সায়নের দিকে মালাটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
– “নাও, এবার এটা আমার হাতে পরিয়ে দাও।”

লিমার কথায় সায়ন চমকে উঠল। তার হাত স্পর্শ করতে হবে, এই ভাবনাতেই তার ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল। লিমা সায়নকে চুপ করে থাকতে দেখে দুষ্টুমি করে বলল,

– “কী হলো? আবার বাথরুম পেয়েছে নাকি?”
– “আরে না!”
– “তাহলে পরিয়ে দাও।”

সায়ন কাঁপা কাঁপা হাতে লিমার হাতটা ধরতেই তার সারা শরীরে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে পরম যত্নে মালাটা লিমার কোমল হাতে পরিয়ে দিল। লিমা তার দিকে তাকিয়ে এক মায়াবী হাসি দিল।
এরই মধ্যে কফি এসে গেল। তারা কফি শেষ করে বসে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু বৃষ্টির তেজ কমার কোনো লক্ষণই নেই। হঠাৎ লিমা বলে উঠল,
– “এই বৃষ্টি আজ আর থামবে না। চলো, আজ বৃষ্টিতে ভিজব।”
– “ভিজলে ঠান্ডা লাগবে তো।”
– “তুমি কি বাচ্চা নাকি যে বৃষ্টিতে ভিজলেই ঠান্ডা লাগবে? চলো তো।”

লিমার জেদের কাছে সায়নকে হার মানতেই হলো। তারা কফিশপ থেকে বেরিয়ে এল ঝুম বৃষ্টির মাঝে। ভিজতে ভিজতে তারা কলেজের বিশাল মাঠে চলে এল। লিমা তার দুই হাত মেলে আকাশের দিকে মুখ করে বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটাকে যেন আলিঙ্গন করছিল। আর সায়ন মুগ্ধ হয়ে দেখছিল তার ভেতরের এই উচ্ছল মানুষটিকে।

হঠাৎ তাদের চোখ পড়ল মাঠের অন্য প্রান্তে। আরিশা আর নাহিদও বৃষ্টিতে ভিজছে। আরিশা, সায়ন আর লিমাকে একসাথে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। লিমা ওদের দিকে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে সায়নকে নিয়ে সেখান থেকে সরে গেল।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেক আগেই। সায়ন লিমাকে রিকশায় তুলে দিয়ে বাসায় ফিরল। তার ভেজা শরীর দেখে রাবেয়া বেগম উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,
– “তুই বৃষ্টিতে এভাবে ভিজেছিস কেন?”
– “ভিজতে ইচ্ছা করছিল, তাই ভিজলাম।”
ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে সায়ন আজকের বিকেলটার কথাই ভাবতে লাগল। এমন একটা সুন্দর দিন যে তার জীবনে আসবে, তা সে কখনো কল্পনাও করেনি।

সায়নকে লিমার সাথে দেখার পর থেকেই আরিশার মনটা অস্থির হয়ে আছে। সে কিছুতেই এটা মানতে পারছিল না। তৎক্ষণাৎ লিমাকে ফোন করে সে বলল,
– ” তোর সাথে ওর সম্পর্কটা কী, বল তো?”
– “কেন রে?”
– “তুই ওর সাথে এভাবে মিশছিস কেন?”
– “মিশলে সমস্যাটা কী?”
– “ওই ফকিন্নিটার সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিজের সুন্দর জীবনটা নষ্ট করিস না। ওই অশিক্ষিত, মূর্খটা তোকে কোনোদিন সুখী করতে পারবে না। ওর তো কোনো ভবিষ্যৎই নেই।”
– “দেখ আরিশা, তুই ওকে কেন সহ্য করতে পারিস না, তা আমি জানি না। কিন্তু ওর মধ্যে আমি এমন কিছুই দেখিনি, যাতে ওকে অশিক্ষিত মনে হয়। আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার আমরা কেউ না। ওপরে একজন বসে আছেন, তিনিই সব ভাববেন।”
– “কিন্তু তাই বলে তুই ওর সাথে?”
– “তোরা সবাই তো বলিস যে ও জীবনে কিছুই করতে পারবে না, ওর মতো ছেলেকে বিয়েই বা কে করবে? আমি তোদের সবাইকে দেখিয়ে দেব, ও খুব তাড়াতাড়িই অনেক বড় কিছু করে দেখাবে। আমার কথাটা মনে রাখিস। আর এখনো সময় আছে, নিজের অহংকারটা ঝেড়ে ফেল। নয়তো পতন হতে বেশি সময় লাগবে না।”
– “তার মানে, তুই ওকে পছন্দ করিস?”
– “হুম। যে আমাকে এতটা ভালোবাসে, তাকে ভালোবাসতে আমার কোনো সমস্যা নেই। ওকে আমি অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতাম, শুধু ওর সরলতার কারণে।”

দিন যত যাচ্ছে, লিমা আর সায়নের সম্পর্কটা ততই গাঢ় হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কেউ কাউকে মুখে “ভালোবাসি” কথাটা বলেনি। কিন্তু তাদের একে অপরের প্রতি যে গভীর নির্ভরতা তৈরি হয়েছে, তা না বলা অনেক কথাই বলে দেয়। এখন তাদের জীবনে এমন কোনো ঘটনাই নেই, যা তারা একে অপরের সাথে ভাগ করে নেয় না।

কর্মফল বোধহয় একেই বলে। আফজাল মিয়ার সুদের ব্যবসার ওপর যেন হঠাৎ করেই কালো মেঘের ছায়া নেমে এসেছে। তার বিশ্বস্ত এক লোক চার লাখ টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে, কোনো হদিসই পাওয়া যাচ্ছে না। এর কিছুদিন পরেই খবর এল, বাজারের আরেকজন, যাকে তিনি পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছিলেন, সে-ও অতিরিক্ত সুদের বোঝা বইতে না পেরে এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। এরা দুজনই ছিল আফজাল মিয়ার খুব কাছের লোক, তাই তিনি কোনো কিছু বন্ধক না রেখেই সরল বিশ্বাসে টাকাগুলো দিয়েছিলেন। এখন এই নয় লাখ টাকা উদ্ধার করতে না পারলে তার নিজের পকেট থেকেই দিতে হবে। সামনে আর মাত্র দুই মাস বাকি সমিতির টাকা পরিশোধ করার। এই বিশাল অঙ্কের টাকার চিন্তায় তার র*ক্তচাপ বেড়ে গেছে, রাতের ঘুম হা*রাম হয়ে গেছে।

নাহিদ আর আরিশার সংসারেও অশান্তির আগুন জ্বলছে। নাহিদ অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে দেখল, আরিশা বিছানায় শুয়ে ফোন টিপছে। সে এসেছে, অথচ সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। নাহিদের মেজাজ বিগড়ে গেল।
– “সারাদিন এই ফোন টেপা ছাড়া তোমার আর কোনো কাজ নেই?”
– “সব কাজই তো করি। আর কী বাকি আছে?” আরিশার নির্বিকার উত্তর।
– “আমি অফিস থেকে ফিরলাম, আমার ফাইলপত্রগুলো একটু গুছিয়ে রাখবে, তা না করে নিজের মতো ফোন টিপছ! যত্তসব ফালতু কাজকর্ম।”

নাহিদের রাগে আরিশারও জেদ চেপে গেল, কিন্তু সে মুখে কিছু বলল না। রাতে নাহিদ যখন বিছানায় শুয়ে ছিল, আরিশা তার পাশে এসে বসল। নাহিদ ঠান্ডা গলায় বলল,
– “তোমার বাবা যে গয়না দিতে চেয়েছিলেন, সেটার আর প্রয়োজন নেই। তার চেয়ে বরং সমপরিমাণ টাকা দিতে বোলো।”
– “টাকা দিয়ে কী করবে?”
– “টাকা দিয়ে মানুষ কী করে, তা তো জানোই। আর শোনো, ছয় মাস পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করতে পারব না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টাকাটা যেন দিয়ে দেয়। তোমার বাবা তো কারও কাছ থেকে এক টাকা পেলে একদিনও দেরি সহ্য করেন না, তাহলে আমার বেলায় এত দেরি করার কোনো মানে হয় না।”
নাহিদের কথায় আরিশার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে বলল,
– “আমার ওপর তোমার মোহরানা পরিশোধ করা ফরজ ছিল, কিন্তু তুমি তো আমাকে সেই সুযোগই দাওনি। অথচ নিজের বাবার যৌতুকের টাকার জন্য আমার ওপর এমন জুলুম করছ?”
– “আমার সামর্থ্য ছিল দুই লাখ টাকা মোহরানা দেওয়ার। কিন্তু তোমরা জোর করে সেটা পনেরো লাখ টাকা ধার্য করলে। এত টাকা আমি এখন কীভাবে দেব? অথচ বিয়ের আগে তো তোমরা দুই লাখেই রাজি ছিলে। তোমার সুদখোর বাবা এই বিয়েটাকেও একটা ব্যবসায় পরিণত করেছে।”

নাহিদের কথায় আরিশা মাথা নিচু করে রইল। পরদিন সে তার বাবাকে গিয়ে সবটা খুলে বলল। আফজাল সাহেব তখন টাকার চিন্তায় দিশেহারা। তিনি চিন্তিত মুখে বললেন,
– “ওদেরকে আর দুটো মাস অপেক্ষা করতে বল। আমি সব টাকা একসাথে দিয়ে দেব।”

নয় লাখ টাকার বিশাল লোকসানের চিন্তায় যখন আফজাল সাহেব অস্থির, ঠিক তখনই তিনি একটা খবরের সন্ধান পেলেন। শহরে নাকি নতুন এক এনজিও এসেছে, যেখানে যত টাকা রাখা হবে, ঠিক এক মাস পর তার দ্বিগুণ ফেরত পাওয়া যাবে। আফজাল সাহেব খোঁজ নিয়ে দেখলেন, বিষয়টা সত্যি। অনেকেই নাকি দ্বিগুণ টাকা ফেরত পেয়েছে। তার মাথায় সাথে সাথে এক নতুন বুদ্ধি খেলে গেল। তিনি মনে মনে ঠিক করলেন, তার সমিতির যে পঁচিশ লাখ টাকা আছে, সেটা যদি এক মাসের জন্য এই এনজিওতে রাখা যায়, তাহলে তো মাস শেষে তা পঞ্চাশ লাখ হয়ে যাবে!

যেই ভাবা, সেই কাজ। তিনি সমিতির সব টাকা তুলে নিয়ে সেই এনজিওতে রাখলেন। প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্রও সযত্নে নিজের কাছে রাখলেন। মনে তার তখন কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন।

কিন্তু বিপদ যখন আসে, তখন চারদিক থেকেই আসে। এই টাকার ঝামেলার মধ্যেই তিনি এক ভয়ংকর খবর পেলেন। তার মেয়ের জামাই নাহিদ আসলে কোনো সরকারি চাকরি পায়নি। সে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে, সেটাও নাকি যাওয়া-যাওয়া অবস্থায়। এই খবরটা যেন তার মাথায় ব*জ্রপা*তের মতো আ*ঘা*ত করল। যে সরকারি চাকরির লোভে তিনি সায়নকে অপমান করে নাহিদের সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন, সেই চাকরিটাই আসলে একটা মস্ত বড় ধোঁকা ছিল।

চলবে….!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে