আগন্তুক পর্ব-০২

0
4

#আগন্তুক
#দ্বিতীয়_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা

দুপুরের পর থেকে জ্বরটা আর নেই আর্যর। তবে মনটা কেমন যেন বি ষ ণ্ণ। সারাদিনের বৃষ্টির পর বিকেলে মেঘের গুমোট ভাব এখনও রয়ে গেছে। হয়তো আরও বৃষ্টি হবে। এইভাবে বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল না আর। তাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো আর্য। কিছুক্ষণ পর ঝমঝম করে আবার বৃষ্টি নামলো। গাড়ির ভিতর থেকে ঝাপসা অথচ অন্তরাকে দেখেই চিনতে পারলো আর্য। এই মেয়েটাকেই তো গত একমাস ধরে খুঁজছিল সে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে গাইনোকোলজিস্ট অরুন্ধতীর কাছে গিয়ে খবর নিয়েছিল আর্য, অন্তরা আর চেক আপে এসেছিল কিনা। কিন্তু অরুন্ধতীর কাছে অন্তরা আর আসেনি।
আর একটুও দেরি করলো না আর্য। অন্তরার কাছে গিয়ে আর্য বললো, এই ভাবে ভিজছেন কেন? গাড়িতে উঠে আসুন। অন্তরা হঠাৎ করে আর্যকে দেখে কিছুক্ষণ অবাক হয়েছিল, হয়তো প্রথমে চিনতে অসুবিধা হয়েছিল, তারপর চিনতে পেরেই বললো, ও ডক্টর যে, আপনি এখানে কী করছেন?
আর্য বললো, সব কথা গাড়িতে বলাও যাবে, আপনি উঠে আসুন। অন্তরা সাথে সাথে বললো, আর আপনি ব্যস্ত হবেন না, এখনই আমি কোনো গাড়ি পেয়ে যাব। আর্য এবার কিছুটা রা গ দেখিয়ে বললো, আপনি আসবেন, নাকি আমি গাড়ি থেকে নামবো?
অন্তরা আর কথা বাড়ালো না। গাড়িতে এসে চাপলো।
তারপর আর্য গাড়ি স্টার্ট করে এগিয়ে গেল।
অন্তরা বললো, উফ দেখলেন তো, আপনার গাড়ির সিট কেমন ভিজে গেল আমার জন্য। আমি বললাম তো তখন, আমি কোনো না কোনো গাড়ি পেয়ে যেতাম।
আর্য অন্তরার কোনো কথা পাত্তা না দিয়ে বললো, শরীর কেমন আছে এখন?
অন্তরা বললো, ঠিক আছে, তবে মাঝেমধ্যে মাথাটা খুব ঘোরায়। আর পুষ্টিকর খাবার দেখলে বমি আসে। তবে ফাস্টফুড দেখলে সেটা হয় না। এখন তো ছয় মাস চলছে। একটু একটু করে ওর নড়াচড়া অনুভব করতে পারি। কথাটা বলেই অন্তরা পেটে হাত দিয়ে মনে মনে হাসলো। সেটা খেয়াল করলো আর্য। এখনই অন্তরার সাথে কথা বলা ঠিক হবে না। আগে ওর হাজব্যান্ডের সাথে কথা বলতে হবে। কিছুক্ষণ থেমে আর্য বললো, বাড়ির ঠিকানাটা দিন, আপনাকে পৌঁছে দেবো। অন্তরা সাথে সাথে বললো, না না এখনই বাড়ি যাবো না, আমার এখনও ফটোশুটের কাজ আছে। বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে। সামনেই শপিংমল আছে, তার অপজিট সাইডে দাঁড়িয়ে যাবেন। আর্য অন্তরার কথা না শুনে, সোজা গিয়ে শপিংমলের কাছে এসে দাঁড়ালো। অন্তরা অবাক হয়ে বললো, এখানে দাঁড়ালেন কেন?
আর্য কোনো কথা না বলে, গাড়ি থেকে নেমে, অন্তরার কাছে এসে, গাড়ির দরজা খুলে নামতে বললো। অন্তরা অবাক হলো ঠিকই, কিন্তু আর্যর কথা মতো নেমে গেল। তারপর আর্য বললো, যেমন বলবো, তেমন করবেন, কোনো প্রশ্ন করবেন না। শপিংমলে ঢুকে আর্য একটা ঢিলেঢালা পোশাক খুঁজছিল, যা অন্তরার পরতে সাচ্ছন্দ্য হবে। সে রকমই একটা পেয়ে অন্তরাকে বললো, যাও চেঞ্জ করে এসো। অন্তরা আর কোনো কথা না বলে আর্যর কথা মতো ড্রেস চেঞ্জ করে এল। তখন আর্যর বিল পেমেন্ট করা হয়ে গেছে। দুটো কফি নিয়ে বসেছে দুজনে। আর্য বললো, আপনার হাজব্যান্ডের নাম্বারটা একবার দিন। এমনি একটু পরিচয় করবো। অন্তরা সাথে সাথে বললো, আসলে ও একটু ব্যস্ত আছে। এক কাজ করুন, কাল এইসময় এখানে আসুন, আমিও আমার হাজব্যান্ডকে নিয়ে আসবো। পরিচয়টা হয়ে যাবে। আর্য মুখে বললো, ঠিক আছে। কিন্তু অন্তরার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ যেন আর্যর কাছে কেমন যেন লাগলো। কিছু একটা লুকাচ্ছে মেয়েটা। কিন্তু অরুন্ধতীর কথা মতো, এই বাচ্চাটা নিতে গেলে অন্তরার জীবনের ঝুঁকি আছে। ছয়মাস হয়ে গেছে, এখন কিছুই করা যাবে না। তবে হাজব্যান্ডের সাথে কথা বলে দেখতে হবে, নিশ্চয় কিছু একটা পথ বেরোবে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, অন্তরা রিপোর্টের ব্যাপারে সব জানে, তাও বিন্দুমাত্র ওর মধ্যে কোনো টেনশন বা ভ য় নেই। সুন্দর কাজ করে যাচ্ছে। আরও কয়েকবার অন্তরার হাজব্যান্ডের ব্যাপারে জানার চেষ্টা করলো আর্য, কিন্তু প্রতিবার অন্তরা খুব স্মার্টলি কথা ঘুরিয়ে দিল।

অন্তরার কথা মতো সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়ে আর্য অনেক আগেই ফিরে গেছে বাড়িতে। বারবার মনে হচ্ছে, অন্তরা কিছু লুকাচ্ছে। যা জানতেই হবে আর্যকে। এমনিতেও কাল তো দেখা হচ্ছেই ওর হাজব্যান্ডের সাথে।

হসপিটালে গিয়ে আগে অরুন্ধতীর সাথে দেখা করলো আর্য। অরুন্ধতীকে জানালো অন্তরার ব্যাপারে। অরুন্ধতী সাথে সাথে বললেন, গ্রেট জব ডক্টর আর্য। অন্তরার হাজব্যান্ডের সাথে দেখা করাটা খুবই জরুরি। অন্তরার প্রেগন্যান্সির জটিলতার মাঝে আরও একটা সমস্যা হলো ওর Rh নেগেটিভ, যার জন্য ওর হাজব্যান্ডের ব্লাড টেস্ট খুব জরুরি। যদি ওরা অন্য কোথাও টেস্ট করিয়ে নিয়েছে বা অন্তরাকে অন্য কোথাও দেখিয়েছে, সেক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কিছু নেই। তবে যদি না করিয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই করতে হবে। আর্য বললো, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, অন্তরা কিছু লুকাচ্ছে আমাদের কাছে। আমি ওর হাজব্যান্ডের কথা জানতে চাইলাম, আর ও বারবার সেটা এড়িয়ে গেল। অরুন্ধতী বললেন, সেদিন আমিও চেষ্টা করেছিলাম, আমার সাথেও তাই করেছে। আপনি প্লিজ ব্যাপারটা একটু দেখুন।
আর্য মাথা নাড়লো।

নির্দিষ্ট সময় মতো আর্য চলে এসেছে। কিন্তু অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও অন্তরা এল না। প্রায় ২ ঘন্টা থাকার পরও এল না। পরের দিনও আর্য এল, সেদিনও অন্তরা এল না। আর্যর এবার ধৈর্যর বাঁধ যেন ভা ঙ লো। খুব রা গ হলো অন্তরার উপর। যেখানে অন্তরাকে নামিয়েছিল, সেখানে গিয়ে খোঁজ নিয়েও কিছু জানতে পারলো না। রা গ, হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরে এল আর্য। কে টে গেল আরও কয়েকটা দিন। এর মাঝে একদিন ডক্টর অরুন্ধতী আর্যর কাছে এসে সবটা শুনে বললো, আমাদের তাহলে করার কিছু নেই। হতে পারে ওরা অন্য কোথাও দেখিয়েছে। এই অবস্থায় তো ফেলে রাখা যাবে না। হয়তো আমরা এই কেসটা নিয়ে একটু বেশি ভাবছি। আসলে এমন জটিলতা আমি আর কোনো পেশেন্টের মধ্যে পাই নি। তাই মনটা যেন কেমন লাগছে।
আর্য কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললো, কয়েক মাস আগে, ওর এক বন্ধু এখানে এডমিট হয়েছিল। রিসেপশনিস্টকে বলে যদি তার ঠিকানাটা বের করতে পারি, তাহলে কিন্তু অন্তরার খোঁজ পাওয়া যাবে।
অরুন্ধতী বললেন, চলুন তাহলে, একবার দেখা যাক।
অনেক খোঁজার পর বিশ্বজিৎ কুমারের ঠিকানাটা পেল আর্য।
অরুন্ধতী বললেন, আর দেরি না করে যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমিও যাব দরকার হলে আপনার সাথে।

বিকেলে একটু ফ্রি হতেই দুজনে বেরিয়ে গেল বিশ্বজিৎ কুমারের ঠিকানায়।
দরজার কলিং বেলের আওয়াজ শুনে বিশ্বজিৎ এসে দরজা খুললো। আর্য বললো, আপনি আমাকে চিনবেন না, আমরা আপনার কাছে অন্তরার খোঁজে এসেছি। বিশ্বজিৎ শান্ত গলায় বললো, ভিতরে আসুন।
আর্য আর অরুন্ধতী দুজনে ভিতরে গিয়ে বসলো। বিশ্বজিৎ বললো, বলুন কী জানার আছে অন্তরার ব্যাপারে?
আর্য বললো, আপনি যে হসপিটালে এডমিট হয়েছিলেন অ্যা ক্সি ডে ন্টের পর, আমরা সেই হসপিটালের ডক্টর। তখনই পরিচয় হয়েছিল অন্তরার সাথে। মনে আছে আপনার? অন্তরা আপনাকে দেখতে গিয়েছিল?
বিশ্বজিৎ বললো, হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে তো। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা আমাকে বলুন তো।
এবার অরুন্ধতী বললেন, অন্তরা প্রেগন্যান্ট। সেজন্য পরে আবার হসপিটালে গিয়েছিল। আমি কয়েকটা টেস্ট করাতে দিয়েছিলাম, রিপোর্টে অনেক সমস্যা আছে, যার জন্য ওর বাড়ির কারোর সাথে কথা বলাটা খুব জরুরী। ওকে বলেছিলাম, কিন্তু ও পুরোপুরি এড়িয়ে গেছে।
বিশ্বজিৎ উদাস সুরে বললো, বাড়ির কেউ থাকলে তো, ও যোগাযোগ করাবে। খুব ছোটবেলাতেই মা-বাবাকে হারিয়েছে। চার্চের ফাদারের কাছে বড়ো হয়েছে। ওখানে থেকেই পড়াশোনা। কলেজে আমাদের পরিচয় হয়, তখন থেকে আমরা বন্ধু। সারাক্ষণ হাসিখুশি থাকা চঞ্চল মেয়ে একটা। কিন্তু ওর জীবনেই এমন ঘটে যাবে, কেউ বুঝতে পারি নি।
আর্য বললো, তাহলে ওর হাজব্যান্ডের সাথে আমরা দেখা করবো, ওনার সাথে কথা বলবো।
বিশ্বজিৎ কিছুক্ষণ থেমে আবার বললো, ওর বিয়ে হয়নি। কয়েকবছর আগে নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিয়েছিল অন্তরা। ফটোগ্রাফি নেশা ছেড়ে প্রফেশন হয়ে দাঁড়ালো। বেশ নামও হয়েছিল ওর। সেই সময় ওর জীবনে আসে সুমন। বেশ ভালোই চলছিল ওদের জীবন। কিন্তু কয়েকমাস আগে, সুমন যখন জানতে পারলো অন্তরা প্রেগন্যান্ট, তখন ওর কেমন যেন পরিবর্তন হয়ে গেল। বারবার এই বাচ্চা ন ষ্ট করার কথা বলতো। অন্তরা রাজি ছিল না। শেষ পর্যন্ত ব্রেক আপ হয়ে যায় ওদের। আমরা বন্ধুরা মিলে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। সুমন বুঝলো না। নিজের সন্তানকেই মে রে ফেলার কথা বলতে লাগলো। শেষে অন্তরা যেন কঠোর হয়ে বললো, এই সন্তানের উপর অধিকার শুধু অন্তরার। কোনোদিন সুমনের কাছে কোনো অধিকার দাবি করবে না। এই বাচ্চাকে অন্তরা একা মানুষ করবে। আমরা সবাই ওর সাথে ছিলাম। যে মেয়েটা বন্ধুর বি’পদে সবার আগে ঝাঁ’পিয়ে পড়তো, তার এই কঠিন সময়ে কী করে একা ছাড়ি বলুন? তবে ওর প্রেগন্যান্সির জটিলতার ব্যাপারে আমরা সবাই পরে জেনেছি। আগে জানলে কিছু একটা ব্যবস্থা করা যেত। ওর কিছু হয়ে গেলে, ফাদার ওর সন্তানের দায়িত্ব নেবেন। আর আমরা বন্ধুরা তো আছিই। এখন একটাই প্রার্থনা, মেয়েটার জীবনে সবকিছু ভালো হোক। খা’রাপ কিছু যেন না হয়, তবে সবদিকটা আমাদের ভাবতে হচ্ছে। এমন জেদি মেয়ে যে একটা কথা শোনে না। এই অবস্থাতেও কাজ করে যাচ্ছে।
অরুন্ধতী আর আর্য অসহায় দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
আর্য এবার বিশ্বজিৎ এর কাছে অন্তরার ঠিকানা আর ফোন নাম্বার নিল।

বাইরে বেরিয়ে আসার পর অরুন্ধতী জিজ্ঞাসা করলেন, এবার কী করবেন ডক্টর আর্য?
আর্য আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, জানি না। তবে মেয়েটাকে একা ছাড়া যাবে না। যেভাবেই হোক আমি ওর সাথে যোগাযোগ করবো।

চলবে…

ভুলত্রুটি মার্জনীয় 🙏

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে