#আগন্তুক
#প্রথম_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা
…মানে আপনার কথা শুনে যা দাঁড়ালো, তা হলো, ৬ মাসের মধ্যে আপনার একজনের সাথে পরিচয় হলো, বিয়ে হলো, আবার সন্তানও হয়ে গেল। খুব অবাক লাগছে শুনে। কিছু মনে করবেন না ডক্টর আর্য, আপনি একজন ডক্টর, আপনার মুখে এই অবিশ্বাস্য কথা ঠিক মানায় না।
মেঘার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো আর্য। তারপর হাসি থামিয়ে বললো, ডক্টর মেঘা, এটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। আমার জীবনে এমনি ঘটেছে৷ ভালোই আছি আমরা। আমার একটি কন্যা সন্তানও আছে। একদিন আলাপ করিয়ে দেবো সবার সাথে।
আর্য উঠে দাঁড়াতেই মেঘা বললো, বাড়ি যাওয়ার যদি তাড়া না থাকে, তাহলে পুরো গল্পটা আমি শুনতে চাই, আসলে এই পুরো গল্পটা না জানলে, আমার ঘুম আসবে না রাতে।
আর্য আবার হেসে বললো, এমনিতেও আজ রাতে আপনার ঘুম আসবে না, আপনার আজ নাইটে ডিউটি। আর সাথে আমারও।
মেঘা বললো, তাহলে তো ভালোই, যদি একটু ফ্রি থাকি তাহলে রাতেই তো শোনাতে পারেন আপনার প্রেম কাহিনী?
আর্য বললো, ঠিক আছে তাহলে তাই হবে, এখন একটা বাড়িতে ফোন করে আসি।
আর্য এই হসপিটালে আছে গত ৪ বছর ধরে। মেঘা এই নতুন এসেছে। একটু আধটু পরিচয় হয়েছে কর্ম সূত্রের প্রয়োজনে। কিন্তু যেদিন থেকে মেঘা শুনেছে আর্য ৬ মাসের মধ্যে একজনকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে, এবং ৬ মাসেই এক সন্তানের বাবা হয়েছে, সেদিন থেকেই তার কৌতূহলী মন বারবার জানতে চেয়েছে, আর্যর জীবনের কাহিনী। কিন্তু সেইভাবে সময় হয়ে উঠছিল না। আজ নিজেই আর্যকে একা দেখে ভাব জমিয়েছে কাহিনী শোনার জন্য।
রাত্রি প্রায় ১২ টা…
মেঘা একবার রাউন্ড দিয়ে এসে বসেছে নিজের চেয়ারে। আর মনে মনে আর্যর জন্য অপেক্ষা করছে। কিছুক্ষণ সময় পেরিয়ে যাবার পর, আর্যকে দূর থেকে দেখতে পেল, হাসতে হাসতে আসছে।
আর্য বেশ সুদর্শন পুরুষ। একজন ভালো ডাক্তারও। সারাক্ষণ হাসিখুশি থাকে। রোগীদের ব্যাপারে একদম ধৈর্য হারায় না। ব্যবহারের জন্য সবাই তাকে ভালোবাসে। তবে এক নার্সের কাছে শুনেছে আর্য আগে এমন ছিল না। চুপচাপ, কম কথা বলতো, গম্ভীর ছিল।
বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলো না মেঘা। এমন সুদর্শন বিবাহিত পুরুষ দেখে তার মনটা ভে ঙে গেছে আগেই। তবুও আর কি করার। বিবাহিত শুনেই সে বেশি আর ঘেঁষে নি আর্যর কাছে। কিন্তু আর্যর ব্যাপারে একটু-আধটু জেনে কৌতূহলবশত একটু ভাব জমাতেই হলো মেঘাকে।
… মেঘা, আপনি খেয়েছেন।
… হ্যাঁ ডক্টর আর্য। আপনি খেয়েছেন?
… হ্যাঁ। ডিনারটা রাত্রি ৮ টার মধ্যেই করে ফেলি। তারপর তো সারারাত এখন চলতেই থাকবে, এই পেশেন্টকে দেখুন ওই পেশেন্টকে দেখুন।
কথাটা বলেই আবার হেসে উঠলো আর্য। মেঘা চোখটা নামিয়ে নিল। এমন সুন্দর হাসি দেখলে যে কেউ ক্রাশ খেয়ে যেতে পারে। মেঘা তারপর বললো, এখন আপনার সময় হবে, কাহিনী শোনানোর জন্য?
আর্য হাতের ঘড়িটা দেখে বললো, হ্যাঁ একবার তো রাউন্ড দিয়ে এসেছি, ডাক না পড়লে এখন আর যেতে হবে না। সেই আবার সকালে।
তবে আপনার ধৈর্য হবে তো? আসলে কাহিনী কিন্তু অনেক বড়।
মেঘা সাথে সাথে বললো, হবে হবে। বলুন।
আর্য মুচকি হাসলো। তারপর শুরু করলো তার প্রেম কাহিনী। বলতে বলতে হারিয়ে গেল অতীতের পাতায়…
… দেখুন আমি এখানে একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি। নাম বুম্বা। বাইক অ্যা ক্সি ডে ন্ট হয়েছে। তবে যমে নেয় নি। বেঁ চে আছে এখনও। আমার বন্ধু হয়, তার সাথেই দেখা করবো।
… দেখুন ম্যাম এই নামে এই হসপিটালে কেউ এডমিট হয় নি।
… আরে দেখুন না ভালো করে। এখানেই এডমিট হয়েছে। গায়ের রঙ শ্যামলা। জিরাফের মতো লম্বা। দেখলেই মনে হবে নে শাখো র।
… সরি ম্যাম, এইভাবে বর্ননা দিলেও আমি কোনো হেল্প করতে পারবো না।
পাশ থেকে পুরোটা শুনছে আর্য। এই সদ্য এই হসপিটালে এসেছে। এমনিতেই কাজের প্রেশার নিয়ে বেশ ঝামেলায় আছে। একটু ফ্রি হতেই নীচে নেমে এসেছিল। পাশে এমন উত্তেজিত ভাবে একজনকে দেখে হেল্প করার জন্য এগিয়ে এল। কিন্তু যে ভাবে উনি বর্ননা দিচ্ছেন তাতে হাসিই পেল আর্যর। নিজের হাসি কন্ট্রোল করে সামনে এগিয়ে গিয়ে বললো, দেখুন ম্যাম আপনি যে ভাবে বলছেন, তাতে পেশেন্টকে খোঁজা মুশকিল এত বড় হসপিটালে। আর আমার মনে হয় পেশেন্টের কোনো ভালো নাম আছে, সেটা আপনি বলুন।
অন্তরা মাথা চুলকিয়ে বললো, বুম্বা নামেই তো ডেকে এসেছি, ভালো নামটা মনে নেই।
আর্য এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
… আচ্ছা কবে অ্যা ক্সি ডে ন্ট হয়েছে।
… আজ সকালে।
… আপনি শিওর তো এই হসপিটালেই এডমিট আছেন উনি?
… হ্যাঁ হ্যাঁ দেখুন, আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করে এখানেরই ঠিকানা দিয়েছে। কিন্তু এখন ওর ফোনটা বন্ধ। নয়তো ওকে ফোন করে জেনে নিতাম।
আর্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজের দিকে তাকিয়ে দেখলো, তাতে নাম সেভ করা আছে বুম্বা মাঙ্কি বলে।
আর্য এবার অন্তরার দিকে তাকালো, মেয়েটাকে স্বাভাবিক বলে মনে হলো না তার, মাথায় কিছু সমস্যা থাকলেও থাকতে পারে। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে, রিসেপশনিস্টকে বললো, আজ সকালের কোনো অ্যা ক্সি ডে ন্ট কেস ছিল?
তিনি কম্পিউটারে দেখে বললেন, হ্যাঁ ডক্টর আছে। নাম বিশ্বজিৎ কুমার। ৭ নম্বর বেডে আছেন উনি।
সবটা শুনে অন্তরা কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এল আর্যর কাছে।
ও ডক্টর আপনি একবার চলুন না আমার সাথে। আমি তো কিছুই চিনি না।
আর্য নিরুপায়, এই যা মেয়ে, কিছুতেই মনে হয় ছাড়বে না। একবার পেশেন্টের সাথে দেখা করিয়ে দিলে, আর কোনো ঝামেলা থাকবে না। তাই বাধ্য হয়ে বললো, চলুন।
যেতে যেতে অন্তরা বললো, আপনি গাইনোকোলজিস্ট?
আর্য বললো, না আমি জেনারেল ফিজিশিয়ান।
অন্তরা তখন বললো, ও আচ্ছা।
আর্য তখন বললো, কেন বলুন তো? আমাকে দেখে এমন মনে হওয়ার কারণ কী?
অন্তরা হেসে বললো, না এমন হ্যান্ডসাম মেয়েদের ডক্টর হলে তো কথায় নেই।
আর্য মনে মনে ভাবলো, এই মেয়ের সত্যিই মাথায় সমস্যা আছে।
অন্তরা বললো, আমি অন্তরা। আমি একজন ফটোগ্রাফার। আপনার নাম কী?
আর্য গাম্ভীর্য নিয়ে বললো, আমার নাম আর্য চৌধুরী। নিন চলে এসেছি আপনার পেশেন্টের কাছে। দূর থেকে দেখেই চিনতে পারলো অন্তরা। এই তো গাধাটা। ওখান থেকে চিৎকার করে বললো, ওই বুম্বার বাচ্চা, বেঁ চে আছিস, চল ট্রিট দে।
আর্য বললো, আস্তে আস্তে, এটা হসপিটাল। অন্তরা জিভ কে টে বললো, ও সরি সরি। আসলে বন্ধু ভালো আছে দেখে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। সরি সরি। আর অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। কথাটা বলেই অন্তরা এগিয়ে গেল। পেছন থেকে আর্য ডেকে বললো, আপনার বন্ধুর নাম বিশ্বজিৎ। নামটা আশা করি এবার মনে থাকবে৷ অন্তরা পেছন ফিরে বললো, হ্যাঁ ভুলেই গিয়েছিলাম, গাধাটার নাম বিশ্বজিৎ।
আর্য আবার বললো, গাধা হলে, হোয়াটসঅ্যাপে নামের পাশে মাঙ্কি সেভ করা কেন? আর তখন রিসেপশনিস্টকে বলছিলেন আপনার বন্ধু জিরাফের মতো লম্বা। একটা মানুষের মধ্যে এত গুলো প্রাণী থাকে কিভাবে?
কথাটা বলেই আর্য হেসে চলে গেল। কিছুটা যেয়ে খেয়াল হলো, ওর মতো গম্ভীর ছেলেকেও মেয়েটা হাসিয়ে দিল। মেয়েটার মধ্যে নিশ্চয় কোনো জাদু আছে।
কয়েকদিন পর….
আর্য ডিউটি টাইমে একটু ফ্রি হতেই নীচে নেমে এল। দূর থেকে অন্তরাকে দেখেই চিনতে পারলো। এই মেয়ের মুখ সহজে ভোলার নয়। কথাবার্তায় ছেলেমানুষী ভাব থাকলেও, মুখখানা খুব মায়াবী। যে কোনো মানুষকে হাসানোর ক্ষমতা আছে মেয়েটার। আসলে এখানকার যুগে এমন মানুষ খুবই বিরল। আর্য, অন্তরার কাছে গিয়ে বললো, কী ব্যাপার ম্যাডাম? বন্ধুর তো সেদিনই ছুটি হয়ে গেছে। আজ আবার এখানে কেন?
অন্তরা মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে, ধীরে ধীরে বললো, আজ আমি নিজে এসেছিলাম। গাইনোকোলজিস্টকে দেখানোর জন্য। কয়েকটা টেস্টের রিপোর্ট দেখানোর ছিল।
আর্য বললো, হয়ে গেছে দেখানো?
অন্তরা বললো, হ্যাঁ হয়ে গেছে। আসলে মাথাটা একটু ঘুরে গিয়েছিল, তাই একটু এখানে বসলাম।
আর্য বললো, সে কি আপনি ঠিক আছেন তো? বিপি চেক করিয়েছেন?
অন্তরা বললো, হ্যাঁ করিয়েছি। আসলে এই সময় এমন হয়। আমি প্রেগন্যান্ট।
আর্য বললো, ওহ আচ্ছা। তা আপনার সাথে কেউ আসেনি?
অন্তরা আবার ধীরে ধীরে বললো, না। এবার যাই আমি, কাজ আছে আমার। কয়েকটা ফটো তুলতে হবে।
আর্য সাথে সাথে বললো, কিন্তু এখন এই অবস্থায় একটু রেস্ট নিলেই তো পারতেন।
অন্তরা বললো, এখন রেস্ট নিলে হবে না। কাজ করতে হবে, এই তো চার মাস। ধীরে ধীরে কাজ করলে সমস্যা হবে না। আসি আর্য বাবু।
অন্তরা চলে যেতেই। গাইনোকোলজিস্ট অরুন্ধতী, আর্যকে ডেকে বললো, ডক্টর আর্য একবার শুনবেন?
আর্য কাছে গিয়ে বললো,
…হ্যাঁ বলুন।
… আপনি চেনেন মেয়েটিকে? যার সাথে কথা বলছিলেন?
… না না সেভাবে পরিচিত নই আমরা। কেন কী হয়েছে বলুন তো?
… ওনার শরীরের যা কন্ডিশন, তাতে বেবি নেওয়ার জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। বাড়ির কাউকে নিয়ে আসেন নি উনি। কার সাথে কথা বলবো বুঝতে পারছি না। আমার মনে হয় বাড়ির ব্যাপারে উনি কিছু লুকাচ্ছেন। হাজব্যান্ডের ফোন নাম্বার চাইলাম, কিছুতেই দিল না।
… আপনি এই কথাগুলো আগে বললেন না কেন, যখন উনি ছিলেন?
… আপনারা কথা বলছিলেন, তাই ডিস্টার্ব করি নি।
আর্য ছুটে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে দেখলো, সেখানে অন্তরা নেই। মনটা কেমন যেন করে উঠলো। কতই বা বয়স হবে মেয়েটির, বড় জোর ২৪/২৫। মনে মনে ভাবলো, যে ভাবেই হোক, মেয়েটিকে খুঁজে বের করতেই হবে।
চলবে।